এখন সময়:দুপুর ১২:১৩- আজ: শনিবার-২২শে নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-হেমন্তকাল

এখন সময়:দুপুর ১২:১৩- আজ: শনিবার
২২শে নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-হেমন্তকাল

সৈয়দ মনজুর কবির-এর অনুগল্প

শুধুই কলিজার টুকরা পারে

 

সম্প্রতিক সৃষ্টি হওয়া চরম বিপরীতমুখী দুই পরিবারের মাঝে একটি টানা বেড়ার আড়াল। শুধু ওপাশের আম গাছটির ছড়ানো লম্বা ডালটি চলে এসেছে এধারে, ছুঁয়েছে এপারের বাড়ির টিনের চাল। গড়েছে যেন এক সেতু বন্ধন। এপারে বসবাসরত রবির একাকিত্বের জীবনে চলছে কষ্টের গড়গড় সুর। এই তো দিন ছয়েক হলো – রবির হৃদয় ছিঁড়ে নিয়ে গেল তারা তুলিকে ওপাশের দালান বাড়িতে – তুলির প্রভাবশালী দুই মামার জিম্মায়। সরল সোজা রবি পারে না চলতে দুষ্টু, অসুস্থ এ সমাজে। হোঁচট খেতে খেতে সংসারে হয় এক ব্যর্থ, অনুপযোগী কর্মী। তবে হতে পেরেছিল এক আবেগময় বাবা ঐ ছোট্ট আট বছরের তুলির। পরিশেষে চূড়ান্ত বোঝাপড়া হয়ে গেল। মা নিয়ে গেল সাথে করে তুলিকে। হৃদয়ে হাপরের ধ্বনি তুলে গুটি গুটি পায়ে চলে যায় তুলি ঐ ওপারে ঐ বাড়িতে। মাঝে প্রতিবন্ধক ঐ বাঁশের বেড়াই শুধু। নির্ঘুম রাত কাটে – রবির বুকে তো কলিজার টুকরা নাই-আট বছরের নিদারুণ মায়ার অভ্যাসের হলো যেন করুণ ব্যবচ্ছেদ! আদুরে তুলি নিজেই ঘুম পাড়ানি সুর তুলে বাবার বুকেই যেতো ঘুমিয়ে। কিন্তু আজ সেই ঘুম পাড়ানি সুর ফুঁপিয়ে কান্নায় হয় পরিণত! মাথার গভীরে, অতি গভীরে তীক্ষ¥ ঘন্টা ধ্বনি যেন বাজে, গভীর রাতে। অনেক সময় হলো কি! ঐ তীক্ষ¥ ঘন্টা বাজছেই। হঠাৎ লাফিয়ে উঠে রবি – আতংকে বুকে বাজে হাপর। ফোপানো কান্না যেন ভেসে যাচ্ছে টিনের চাল ঘেঁষে ঘেঁষে। বুক ফাটা সন্দেহ যায় বেড়ে- দুরন্ত গতি পায় পা। হাতে টর্চ, খালি পা- ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসে রবি, ভয়ার্ত- আতংকিত মনে। টর্চের আলো গিয়ে পরে চালের উপর ওপার থেকে আসা আম গাছটির ডালটিতে। যুবুথুবু এক ছোট্ট দলা যেন কোনোমতে আঁকড়ে আছে ঐ ডালটি! চোখ দুটি বোজা, আর কণ্ঠে হৃদয় ফাটা ফুঁপিয়ে ক্রন্দন। হায় খোদা! ঐ তো বসে আছে রবির কলিজার টুকরা! হৃদয় নিংড়ানো ছোট্ট ধন তুলি! ঐ বাড়ির আক্রোশ মন যখন ঘুমন্ত, অচেতন, পাথর, তখনই চুপিচুপি উঠে এসেছে সে গাছটির ঐ ডালে। উঠে এসেছে ছোট্ট শরীরে কি অসাধ্য সাধনে- সমস্ত ভয় জয় করে। এসেছে ঘৃণার ওপাশ থেকে তার ভালোবাসার ঐশ্বর্য্যরে এপাশে। সমাজের সরল সোজা রবির হৃদয়ে উথলে উঠে ঝড়। দুহাত উপরে তুলে আকাশ ভাঙা চিৎকার করে কাঁদে, আর বলে – আয় মা, আমার কলিজার টুকরা, আয় আমার বুকে।

 

 

শিরদাঁড়াহীন

 

ওই যে দেখতাছো রাইজ্যের অন্ধকারে ডুবা বড় ঘরডা, ওইডায় আমাগো কইলজার টুকরার কইলজা টেস করবো! সত্য কতা বাইর অইবো হক্কালের আলোর নাহান। ফেচুডা আগেই ট্যাহা দিয়া দিছে ওই ছুড়ি ধরা ডাক্তারের। হ্যাড় জ্ঞানের ভাণ্ডার বিছাইয়া দিবো এক নিমেষেই! কাগুজে কি সব লেহা লেহি আগেই লেহা হয়া আছে, হেরপরও ক্যান আমগো কইলজার টুকরারে টুকরা করবো? অ্যামনেই তো সারা রাত কত্ত কষ্ট পাইছে  বাঁচবার চাইছিল আসমানের হমান, মনের জোর লাগাই আইছিলো ওই ঘাট পর্যন্ত। ওই বেয়াইন্নার আলোয় ঘাটের কিনারে ওরে একবার দেখছিলাম খালি-দৌড়াইয়া গিয়া বুকত জড়াইয়া ধরলাম – য্যান একডা রক্তমাখা দলা। শেষ একডা কতাই কইলো- ফেচুরে ছাইড়ো না বাবজান। ফেচুর তো ম্যালা ট্যাহা, ওই তো ওইহানে খাড়ায়া হাসতাছে, অন্যায়ের পরতিবাদ করনের মরণ শিক্ষা হাতে নাতে দিছে। ওই ছুড়িওয়ালা ডাক্তার আমগো ছাওয়ালডার কইলজা কাটবো,দেখবো পুষ্কুনির জলে ডুইব্বা মরার আলামত একদম একশোতে এখশো। বউ কষ্ট লইয়োনা বুকোত- পরতিবাদ যাও ভুইলা।দ্যাহতো তাকায়া, আমাগোর কইলজার টুকরা হাসতাছে য্যান!হাসোন তোর মানায় রে বাপ- এমুন শিরদাঁড়া ভাঙা বাপের লাগি!

 

 

এ কেমন স্নেহ!

 

সত্যি কথা বলতি কি বাপ, ওই অভিশাপ দেওয়ার কাজডা আমি করি নেই। দিনের পর দিন অনাহারে দুডো শরীর তাকাইয়া ছিলো, তোর মতন শক্ত উপার্জন করা ছাওয়ালের দুডো টাকার লাগি। খিদের বেদনা তোর তো কুনো দিন পাইতে দেইনিরে বাপ। এই দুইডা হাত কোদাল চালাইছে যতদিন গতরে শক্তি ছিলো। যতদিন তুই নিজের পায়ে শক্ত হয়ি দাঁড়াতি না পারছিলি, ততোদিন। ততোদিন তোর এই বাপ-মা হইয়েছিলো আধপেটা। বড় হয়ি সেই যে সুখের লাগি দুই বুড়ো বুড়িকে ভাঙা ঘরে রেইখে চইলে গেলি, ভুল কইরে নাড়ির টান আবার ভুইলেও গেলি কত সহজে। ভুইলে গেলি অসহায় দুই বুড়ো বুড়ির কথা – কতো কষ্টের কথা। কত বিপদি পড়লি ওই হাটের বটগাছের নিচে গিয়ে বসি, দুহাত পাতি সাহায্যের ভিক্ষা চাই চক্ষুর লজ্জা খেয়ি। সেই কবি এত দূঃখ সহ্য করতি না পারি চইলে গেলো বুড়িটা। ভয় পাসনি বাবা, কুনো ভয় নাই- ভয়হীন থাকিস। মরবার কালি সেও যেমনডা দেয়নি কুনো অভিশাপ তোর নামি! ঠিক, ঠিক আইজও তেমনি আমারও নেইকো কুনো অভিযোগ। রাখিনি এইটুকুও কষ্ট তোর ভবিষ্যতের সুখ চিন্তা করি। এখন পইড়ে ঘোড় ট্যাকার বিপদি ভাবছিস অভিশপ্ত হয়েছিস।নারে বাপ না, তুই যেন এমন বিপদি না পড়িস – তার লাগি জমিয়েছি তিল তিল করি ভিক্ষার টাকা- ওই যে, ওই বস্তায়।যা নিয়ে যা সঙ্গে করি – বিপদ থেকে উদ্ধার কর নিজেরি। কি ভাবছিস? ভিক্ষার ট্যাকা নিতি তোর সম্মান হানি হবি? আরে বাপ, তুই তো নিবি বাপের ট্যাকা- বাপের কাছ থাকি। সম্মান হানির ময়লা সব তো লাগিছে তোর বাপের গাওত। যাও মুছি যাবি আজ, হয়তো আরেকডূ সময় আমার মরার পরি!

 

মায়ায় ভরা আত্মা এসেছিলো একবার

 

ওইতো সোজা পথ, কোনো রকম হেরফের নেই রে দাদু।কবিরপুর ইস্টিশনে নেমে হাঁটা পথ, টমটমেও হবে না যে চড়তে। হাতের বাঁয়ে খাল পাড় দিয়ে এই তো শ’পাঁচেক হাঁটতে হবে শুধু, তারপর প্রাচীন মান্দার গাছটারে ডানে রেখে বায়ে মোড়। ধান কাটা হয়ে গেছে, এখন শুকনো মাটির উপর দিয়েই – আড়াআড়ি লোকে চলে আসে সবুজ ঘেরা পুরনো বাড়িটাতে। দূর থেকে দেখতে দেখায় বড় তাল গাছ দুটোকে যেন দুইটা থোকা পাহাড়। লোকে ভালোবেসে বলতো- দুই পাহাড়ের খানদানী বাড়ি! কি? অমন করে চোখ দুইটারে বড় বড় বানিয়ে রাখলি কেন দাদু? কি নাকি শুনেছিস? সেই ছোট্ট কালের কথা এখন আর মনে রাখিস না।আমিতো এখনও বেঁচে আছি- তোরে দেখা ছাড়া মরণ নাই গো।আহা! এমন বিলাতী সাহসী নাতি আমার- ভয় পাশ কেন? ভয় পেয়েছিলাম তো আমি সেই তোর গ্যাদা কালে যখন শেষ নিঃশ্বাস ছাড়ি! দেখি যখন ঘরটা শূন্য ফাঁকা, যখন দেখি আমার পাশে কেউ নাই! শোন দাদু, আমি একা একা দুই দুইটা যুগ পার করছি ওই দুই পাহাড়ের বাড়িতে।

তোর বাপজান মস্ত বড় ডাক্তার- সবাই তার কাছে কত শত সেবা নেয়, আমি মা হয়েও আমার ছেলের রক্তের ধপধপানি ছোঁয়াটাও পেলাম নারে! বিশ্বাস কর দাদু, আমি কিন্তু মরি নাই- এই দ্যাখ, দ্যাখ না – তোরে দেখতে কত সাধ ছিল রে, ছিল কত কত ইচ্ছা মনে। সোনারুরে ডেকে এনে কত কি বানিয়েছি তোর জন্যে। ইচ্ছা তোরে এই কোলে তুলে প্রত্যকটা দিন একটা একটা করে পড়িয়ে দিবো। তোরে না দেখে যে ওই দুই পাহাড়ের বাড়িও ছাড়তে চাইছিলো না মন। দাদুভাই, পারলে একবার আসিস ওই বাড়িতে ওই পথ দিয়ে। যেয়ে যেয়ে আমারে না পেলেও আমার শোওয়ার ঘরেতে যাস। বিছানার উত্তরের পায়ার নিচে মেঝের বড় চাড়িটা তুলিস দাদু। দেখবি, সিঁদুর রঙা কাঠের বাক্সে সুন্দর করে গুছিয়ে রেখেছিরে আমার শেষ ইচ্ছাগুলি!

 

এ জলে তো পদ্ম ফোটে না

 

এ বিলে জন্মেছি শুধুই আমরা মাসে কলমীরা জংলা দু’ঝাঁক ও পাশের টোপাপানারা কোথা থেকে এসেছে তা আমি জানি না বাপু, তবে আমরা ‘কলমীরা’ এসেছি হাসু দাদার হাতে ধরে। বহু সংগ্রামের পথ ধরে আমরা হেসেছি এই বিলের চারিপাশ। কলমীর গাঢ় বেগুনি রঙের ফুলেতেই এ বিলের নাম হয়েছে যে! কতদূর দূরান্তের পথিক বলে – এই যে “বিল কলমী”টা ঠিক যেনো কোথায়?

আমরা কলমীরাও কতজনার মুখে কতবার অপরূপা পদ্মের রূপের কথা শুনেছি গো, কতবার তার রূপের কাছে মেনেছি হার, হিংসেও হয়েছিল বৈকি! সত্যি কথা, এ বিলেতো পদ্মেরা জন্মে না। তবুও আজই এই প্রথম তোমাকে দেখলাম আর কল্পনার সাথে মেলালাম – তখনই বুঝলাম তুমিই সেই পদ্ম – নিরাহংকার, শান্ত, কোমল পদ্ম !লোকে যদি এবার এ বিল কে “বিল পদ্ম” বলে, মনে কষ্ট নেবো না জেনো।

কি সব বলছো তুমি কলমী, সৌন্দর্য্যে অতুলনীয়া বেগুনী লজ্জাবতী? আমিতো প্রকৃতির নিরব, শান্ত বদ্ধ জলাশয়ে বাঁধি বাসা। তবে সৌন্দর্য্যরে পূজারী মানুষ কিভাবে যেন ঠিকই খুঁজে নেয় আমাকে। তেমনি করে আজ সুন্দর ভোরে আনন্দ ঝর্ণা বইলো আমার মনের। বিলের হলের উপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আমার কোমল বৃন্ত গেঁথে গেলো এক কৃষ্ণকলির কালো কেশের খোপার মেঘপুঞ্জে। খোপায় চড়ে তোমার এই বিল কলমীর আসা পথে ছিলাম ভীষণ ঘোরে। বিশ্বাস করো, সে ঘোর কেটে যায় আমার এক ভয়ার্ত দৃশ্যে। কাঁখে করে আনা মাটির কলসি হঠাৎই কৃষ্ণকলি গলায় আষ্টেপৃষ্টে দেয় ঝুলিয়ে। তারপর কতগুলো বদ্ধ সময় পার হয় – হয় জলের তলে হুটোপুটি। মানুষের প্রাণ ভোমরা মুক্ত হবার নিদারুণ দৃশ্যের স্বাক্ষী হলাম যে। কৃষ্ণকলির খোপার বাঁধন গেলো খুলে – ছড়ালো ঘনায়ীত কালো কেশ। বিশ্বাস করো আমি চাই নি সে মেঘপুঞ্জ থেকে মুক্ত হতে,আমি যে বড্ড ভালোবেসে ফেলেছিলাম আমাকে তুলে নেয়া কৃষ্ণকলিকে। দেখলে তো কলমী, আমি জলে ভেসে উঠেছি, কিন্তুু – কিন্তুু সে তো ঠিকই রইল ডুবে।

তুমি ঠিকই বলেছো অতুলনীয়া কলমী, এ জলে পদ্মেরা ফুটে না – কখনো ফুটতেও চাইবে না।

 

 

সৈয়দ মনজুর কবির, গল্পকার

একজন রোমাঞ্চপ্রিয় মানুষ ও তাঁর তোলা কিছু দুর্লভ আলোকচিত্রের কথা

আলম খোরশেদ অনেকেই জানেন যে, প্রখ্যাত ফরাসি কল্পবিজ্ঞানলেখক জ্যুল ভের্ন এর কিংবদন্তিতুল্য গ্রন্থ ‘অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেইজ’ অবলম্বনে ১৯৫৬ সালে হলিউডে একই নামে

প্রগতির পথে, জীবনের গান, সকল অশুভ শক্তির হবে অবসান” এই আহবানে উদীচী চট্টগ্রাম জেলা সংসদের ৫৭ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন

\ ভাস্কর ধর \ সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে প্রতিহত করার আহ্বানের মধ্য দিয়ে এবং প্রগতির লড়াইকে দৃঢ় করার দৃপ্ত শপথের মধ্য দিয়ে উদীচীর ৫৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপিত হয়েছে। 

আমার বাবা কর্নেল তাহের

জয়া তাহের   আমাকে যখনই কেউ জিজ্ঞাসা করেন, কর্নেল তাহেরের মেয়ে হিসেবে আপনার অনুভূতি কি? আমার চোখের সামনে এক নিমেষেই ভেসে ওঠে ৪০ বছরের অসংখ্য

ছাগল-মাহাত্ম্য

ড. ইউসুফ ইকবাল ভূপৃষ্ঠের বঙ্গ-ভূভাগে দ্রুতবর্ধমান প্রাণিকুলের মধ্যে সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য প্রাণিটির নাম ছাগল। আমাদের একচুয়াল ও ভার্চুয়াল প্রতিবেশ-বাস্তব ও মেটাফোরিক পরিমণ্ডলে এর প্রভাব অপরিসীম। ছাগলের

সৈয়দ মনজুর কবির-এর অনুগল্প

শুধুই কলিজার টুকরা পারে   সম্প্রতিক সৃষ্টি হওয়া চরম বিপরীতমুখী দুই পরিবারের মাঝে একটি টানা বেড়ার আড়াল। শুধু ওপাশের আম গাছটির ছড়ানো লম্বা ডালটি চলে