এখন সময়:রাত ২:৪৭- আজ: সোমবার-২২শে ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-৭ই পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-শীতকাল

এখন সময়:রাত ২:৪৭- আজ: সোমবার
২২শে ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-৭ই পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-শীতকাল

“এবং স্বপন সেন” : অনুচ্চারিত আলোর ইতিহাস

শোয়েব নাঈম

কিছু কিছু মানুষ আছেন, কেবল ইচ্ছাশক্তির জোরে তাঁরা স্বনির্ভর হতে পারেন। এই স্বনির্ভরতা বাহ্যিক নয়, এটি আত্মচেতনার অন্তর্নিহিত স্বাধীনতা, মন ও মানসের পরিপূর্ণ অধিকার। তাঁরা যুগের প্রবাহে ভেসে যান না; বরং নিজের অন্তর্লোকের দৃঢ়তায় দাঁড়িয়ে নির্মাণ করেন এক স্বনির্ভর সত্তা। তাঁদের এই ইচ্ছাশক্তি কেবল ব্যক্তিগত নয়, তা হচ্ছে এক ধরনের নৈতিক শক্তি। তখন তাঁদের মনটাই যেন দেহ হয়ে ওঠে, আর এই মনোধারী দেহটার চলন হয় মানসিক। এই মানুষদের মানসিকতা হয়ে ওঠে এক স্বচ্ছ আয়না, যেখানে জগৎ প্রতিফলিত, বিম্বিত ও প্রতিসরিত হয় এক বহুস্তরীয় মানবিক প্রতিচ্ছবিতে। তাঁদের ইচ্ছাশক্তি নিঃশব্দে চারপাশের মানুষকে প্রভাবিত করে, অনুপ্রাণিত করে, কখনও বা পুনর্গঠিত করে। তাঁদের উপস্থিতিতে সমাজের অন্যরা অচেতনেই অনুভব করেন সেই দীপ্তি, এবং হয়ে ওঠেন তাঁদের আত্মনির্ভরতার নীরব সহযাত্রী। এই স্বনির্ভর মানুষেরা বুঝতে পারেন, মানুষ আসলে সমবায়ী চেতনায় একে অন্যের প্রয়োজনে এগিয়ে আসে, মানবজীবন মূলত এক গভীর সমবায়ী চেতনার ওপর দাঁড়িয়ে। এই চেতনা মানুষকে অনুভব করায় যে, সত্যিকারের স্বনির্ভরতা কেনো একাকিত্ব নয়, বরং পারস্পরিক প্রয়োজন ও

সহমর্মিতার সৃজনশীল সংহতি। নিজের শক্তিতে দাঁড়িয়ে থাকা মানে অন্যের প্রতি দায়বদ্ধতা অস্বীকার করা নয়; বরং তা হলো মানবিক সহায়তার বিনিময়কে মর্যাদা দেওয়া যেখানে একের ইচ্ছাশক্তি অন্যের সাহচর্যে আরও জীবন্ত থাকে। কমরেড স্বপন সেন ছিলেন এমনই এক বিরল আত্মা, যিনি ব্যক্তিগত ইচ্ছাশক্তির অদম্য জোরে স্বনির্ভরতার এক জীবন্ত দৃষ্টান্ত নির্মাণ করে গেছেন। তাঁর জীবনই ছিল এমন প্রমাণ, যে একক মানুষের দৃঢ়তা কখনও কখনও এক সমগ্র সমাজের চেতনায় প্রতিসরণ ঘটাতে পারে। আর সেই প্রতিসরণের আলোয়, মানুষ আবার উপলব্ধি করে, সমবায়ী মানবতা ছাড়া কোনো স্বনির্ভরতা পূর্ণ নয়।

স্বপন সেন ছিলেন অভিধানহীন রাজনীতির এক নীরব বিপ্লবীর নোটবুক, যেখানে প্রতিটি পৃষ্ঠায় লেখা ছিল মানবিক দৃঢ়তা ও নৈতিক সহমর্মিতার আলোকে।

স্বপন সেন ছিলেন বর্ণচিত্রিত এক সত্তা। ছিলেন চিন্তা, অনুভব ও রাজনৈতিক কর্মসূচির সমবায়। সমাজ পরিবর্তনের যে চেতনা তিনি জীবনভর লালন করেছিলেন, তা ছিল তাঁর চেতনার আলো থেকে উৎসারিত বিশাল বারান্দা। এই চেতনার বারান্দায় দাঁড়িয়ে তিনি অনুভব করেছিলেন সমাজতান্ত্রিক সূর্যের লাল আকাশ। তাঁর এই সমাজতান্ত্রিক বোধ ছিল প্রকৃতির বিন্যাসের মতোই জৈব, স্বতঃস্ফূর্ত ও মানবিক। বাম রাজনীতির আদর্শ তাঁর অন্তরে ছিল এক শুদ্ধ বিশ্বাসের ফোয়ারা। কমিউনিজম ছিল তাঁর অহংকার নয়, বরং তাঁর আত্মসম্মান। তাই সমাজতন্ত্রের স্বপ্নকে তিনি নিজ জীবনের ভবিষ্যৎ হিসেবেই গ্রহণ করেছিলেন; যেন তাঁর জীবনই সমাজতন্ত্রের পরীক্ষাগার। কিন্তু সেই বিশ্বাস তাঁকে এমন এক ক্লাসিক্যাল কমিউনিজমে নিবিষ্ট করেছিল, যেখানে নতুন সমাজ, নতুন শব্দ, নতুন ব্যাখ্যা, কিংবা প্রযুক্তির উদ্ভাবন সবই রয়ে গেছে তাঁর অভ্যস্ত অনুধাবনের বাইরে। আধুনিকতার এই প্রবাহের প্রতি তাঁর অনীহা তাঁকে আরও নিবিড়ভাবে ফিরিয়ে দিয়েছে পুরোনো কমিউনিজমের কঠিন, কিন্তু নির্মল আদর্শে। তাঁর জীবন কোনো পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনার ফল ছিল না, বরং জীবনের ঘটনাবহুল বিস্তারেই সাম্য, প্রগতি ও মানবিকতার ক্ষুধা তাঁর অন্তরে উদোম দুপুরের উত্তাপে উতলে উঠেছিল। সেই ঘটনাগুলোই তাঁর জীবনের আলোকরেখা, তাঁর অস্তিত্বের উৎসব। তাই এক রাজনৈতিক দলে স্থির না থেকে তিনি অতিক্রম করেছেন সিপিবি, ন্যাপ, গণতন্ত্রী পার্টির মতো নানা পরিসর, প্রতিটি পরিসর তাঁর সমাজতান্ত্রিক চিন্তার আদর্শ হয়ে উঠেছিল। তাঁর জীবন আসলে এক চলমান সেলাইমেশিন, যেখানে তাঁর পোশাকে সবসময় বাম রাজনীতির ঘ্রাণ বাস করতো, স্বপ্নের ধোঁয়ার সাথে প্রগতির গন্ধ মিশে থাকতো। সেই  গন্ধভরা জামার পকেটে তাঁর ইচ্ছার রাজহাঁস কত ডিম পাড়তো, আর সেসব ডিম থেকে বের হতো তাঁর ‘বিশদ জোছনা, কুসুম কোমল’ কত গান। তাঁর একমাথা পাকা চুলে শৌখিন প্রজাপতি উড়তো। আর তাঁর অন্তরে বিপ্লবের লাল লেপ যেন ধ্যানস্থ হয়ে রোদের কোমল উষ্ণতায় ঘুমাত। কখনো আদর্শে ছিন্নমূল হয়ে প্রোপাগান্ডায় আস্থা রাখেননি। আর সবিনয়ে সংযুক্ত ছিলেন অনেক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে। আর অথৈ আবেগের অগ্নিগিরি-তে তাঁর সমাজতন্ত্রের স্বপ্নকে রেখে চিরতরে চলে গেছেন পৃথিবী থেকে। স্বপন দা’র কাছে ‘কমরেড’-অর্থ ছিল  সেই মানুষ, যিনি নিজের ব্যক্তিগত সীমানা পেরিয়ে দাঁড়ান মানুষের পক্ষে।

কমরেড স্বপন সেনের স্মৃতি, তাঁর রাজনৈতিক সত্তা এবং তাঁর জীবনের ভবিষ্যৎ যেখানে থামিয়ে চলে গেছেন অনন্তের পথে; এই তিনের মধ্যে প্রথিত করে গেছেন তাঁর অমরতার চাবিটুকু। সেই অমর চাবি স্বপন সেনকে নিয়ে কোনো এক গম্ভীর আলোচনা-অনুষ্ঠানের তালার মুখে ধরলে খুলে যাবে এক অনুচ্চারিত দরোজা। যেখানে কমরেড স্বপন সেনের শান্ত, সরল, অথচ অন্তঃসারপূর্ণ অনুভবের স্রোত বয়ে চলে নীরবে। চিতার দহন থেকে যে জীবন উঠে আসে মানুষের ভালোবাসায়, যে ভালোবাসার সমাপ্তি নাই তার নাম ‘এবং স্বপন সেন’- এর স্মরণসভা। চট্টগ্রামের অলিগলিতে কমরেড স্বপন সেনের হেঁটে যাওয়া এই পদচারণার শব্দে ছিল না কোনো প্রলাপের মতো। স্বপন দা’ ছিলেন এক নিবিড় নীরব মিশ্রণ রাজনীতি ও মমতা, আদর্শ ও মানবিকতার। রাজনৈতিক মঞ্চে তাঁর উপস্থিতি ছিল দৃঢ়, অথচ অনাড়ম্বর। চট্টগ্রাম শহরের অনেক পথ তাঁর দায়িত্ববোধের সাক্ষী। রাতের ডায়ালে নিয়ন আলোয় যখন ঝলমল করতো বড় বড় বিজ্ঞাপনের বোর্ড, তখন সেই আলোর পাশদিয়ে চলে যাচ্ছেন এক ক্লান্ত অথচ অবিচল ছায়া। হাতে প্রেসরিলিজ ধরা এই মানুষটি যিনি ক্ষুধায় নয়, কোনো পারিশ্রমিকের আকাঙ্ক্ষায় নয়, বরং এক অবিনশ্বর কর্তব্যবোধের খেয়ালে জ্বলতে জ্বলতে এগিয়ে যেতেন। পত্রিকার পাতায় তাঁর নাম ছাপা হতো না শিরোনামে, না বক্তৃতার কেন্দ্রে। বহু বক্তার দীর্ঘ তালিকার শেষে, এক নিঃশব্দ উপসংহারে, প্রায় অনুচ্চারিতভাবে জেগে থাকত মাত্র দুটি শব্দ “এবং স্বপন সেন।” সেই দুই শব্দে ছিল এক জীবনের সারসংক্ষেপ। এ কোনো ব্যথা নয়, কিন্তু ব্যথার ইঙ্গিত।  অগণিত সকাল-সন্ধ্যার পরিশ্রম, নিঃশব্দ দায়িত্ব, আর অনুচ্চারিত ত্যাগের ইতিহাস। যত সভা, যত সংবাদ, যত আন্দোলনের ঘোষণা সবশেষে, বিনম্রভাবে, যেন ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে থাকত তাঁর নাম। কেউ হয়তো পড়ত না মনোযোগ দিয়ে, কিন্তু শহরের বাতাস জানত, এই দুই শব্দেই ঢুকে আছে এক মানুষের সমগ্র প্রস্থানহীন উপস্থিতি। স্বপন দা’ যত বছর বেঁচে ছিলেন, কোনো ব্যাখ্যা দেননি নিজের অবস্থানের পক্ষে বা বিপক্ষে। বরং তাঁর নীরবতা দিয়েই রক্ষা করেছিলেন রাজনীতির পরিবেশকে, অবক্ষয়ের হাত থেকে, অশ্রদ্ধার চর্চা থেকে। তিনি জানতেন, শব্দ যত বাড়ে, সত্য তত ছিন্নভিন্ন হয়। তাই তিনি চুপ থেকে উত্তর দিয়েছেন, নীরবতার ভেতর রেখে গেছেন এক অদৃশ্য আলো। যা এখনো শেখায়, যা এখনও নীরবতাকে অর্থের উৎসে পরিণত করে।

 

ছবিঋণ: কমল দাশ, যার একেকটি ফ্রেমে জেগে আছে স্বপন সেনের ভিন্ন ভিন্ন জীবনের প্রতিরূপ।

 

শোয়েব নাঈম, সাহিত্য সমালোচক ও প্রাবন্ধিক

আন্দরকিল্লা প্রকাশনার ২৮ বছর আগামীর পথ ধরে অনাদিকাল

রূপক বরন বড়ুয়া আমি মাসিক ‘আন্দরকিল্লা’ কাগজের নিয়মিত পাঠক। প্রতিবারের মতো হাতে নিলাম এবারের দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদে ঢাকা জুলাই ২০২৫ সংখ্যা, হাতে নিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখতেই

জলে জঙ্গলে (পর্ব-২)

মাসুদ আনোয়ার   ৬ ডিসেম্বর রাজশাহী বোর্ডের রেজাল্ট আউট হলো। আমি কুমিল্লা বোর্ডের পরীক্ষার্থী। ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে উঠলাম। যে কোনোদিন কুমিল্লা বোর্ডও ফল প্রকাশ

স্বপ্নে গড়া অবয়ব

সৈয়দ মনজুর কবির   মনটা যখনই কেমন অজনা বিষণ্নতায় ছেয়ে যায় তখনই কেয়া জানালার ধারে এই চেয়ারটাতে এসে বসে। আজ অবশ্য অন্য একটা কারণ আছে

অন্তহীন সুড়ঙ্গ

সুজন বড়ুয়া   কবর থেকে বেরিয়ে মহিম অশরীরী রূপ নিল। সঙ্গে সঙ্গে গত কয়দিনের সব ঘটনা একে একে মনে পড়ে গেল তার। ফার্স্ট সেমিস্টারের পর

রাত যখন খান খান হয়ে যায়…

মনি হায়দার   চোখ মেলে তাকায় সোাহেল হাসান। প্রথম দৃষ্টিতে সবকিছু অচেনা লাগে। কোথায় এলাম আমি? উঠে বসতেই মনে পড়ে গতরাতে অনেক ঝক্কি আর ঝামেলার