রূপক বরন বড়ুয়া
আমি মাসিক ‘আন্দরকিল্লা’ কাগজের নিয়মিত পাঠক। প্রতিবারের মতো হাতে নিলাম এবারের দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদে ঢাকা জুলাই ২০২৫ সংখ্যা, হাতে নিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখতেই চোখ আটকে গেলো সম্পাদকের দেয়া সংখ্যার শিরোনামে ‘আমরা কী প্রস্তর যুগে প্রত্যাবর্তন করছি’। এই শিরোনামটা পড়েই মনটা কেমন যেন বিষিয়ে উঠলো, দারুণ এক ঘা দিলো সচেতন, সুচারু মনোজগতে। মানুষের অন্তর্জগৎ কতটা অন্তর্দহনে আলোড়িত হলে বা মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হলে মানুষ তার গতিশীলতা হারিয়ে মূক হয়ে যায়, নিমজ্জিত হয় হতাশার নির্জন অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। যেখানে ভাবনার বিষয়গুলোর চারুতা এলোমেলো ও সৃজনীশক্তি হারিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে। সুন্দরের অভিমুখে মানুষের যাত্রা মগজ ও মননপ্রসূত হয়েছে বিভিন্ন ধারাবাহিক ক্রমবিবর্তনিক পথ পেরোনোর মধ্য দিয়ে। মানব সভ্যতার ক্রম বিকাশের সূচনা দেখতে পাই নিওলিথিক প্রস্তর যুগ থেকে। এই যুগকে মানব ইতিহাসের দীর্ঘতম সময় হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যা প্রায় ৩.৩ মিলিয়ন বছর আগে শুরু হয়ে অঞ্চলভেদে ৩৩০০-২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত তার পথ পরিক্রমা করেছে। আমার আজকের আলোচ্য বিষয় হলো শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সমাজভাবনামূলক কাগজ ‘আন্দরকিল্লা’ জুলাই ২০২৫ সংখ্যার শিরোনাম নিয়ে।
সম্পাদক তাঁর গভীর পর্যবেক্ষণ ও অনুসন্ধিৎসার আলোকে সমাজ, রাষ্ট্র ও দেশের প্রেক্ষাপটকে সামনে এনে বিশ্বের সামগ্রিক অস্থিরতাকে তুলে ধরতে চেয়েছেন তাঁর প্রাজ্ঞিক ধ্যান ও ধারণায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে হয় যে ‘আন্দরকিল্লা ‘মাসিক কাগজের সম্পাদক কবি মুহম্মদ নুরুল আবসার নির্লোভ, নিরহংকারী, অসম্ভব সুন্দর মননের একজন সহজ, সরল, নির্বিবাদী মানুষ। একজন সৎ, নিষ্ঠাবান সম্পাদক। প্রায় দীর্ঘ আাটাশ বছর ধরে নানা চড়াই-উতরাই তথা আর্থিক অসঙ্গতি, আলোচনা সমালোচনা, ভয়ভীতি, হুমকি, রাজনৈতিক রক্তচক্ষুকে একরকম উপেক্ষা বা জয় করে এই কাগজের ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন রেখেছেন। এ কাগজ কতটুকু নিরপেক্ষ তা চুলচেরা বিশ্লেষণ করে তার মাত্রা নির্ধারণ করা না গেলেও একথা হলপ করে বলা যায় সম্পাদক ‘আন্দরকিল্লা’ কাগজকে রেখেছেন অশুভ প্রভাবমুক্ত। নিজস্ব নিয়ম নীতিতে অটল থেকে নিজের মৌলিকত্বকে অয়োময় করে রেখেছেন নৈতিকতা বিসর্জন না দিয়ে। আজো প্রাণপাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন নিজের সন্তানের মতো শিল্প,সাহিত্য,সংস্কৃতি ও সমাজ ভাবনামূলক কাগজ ‘আন্দরকিল্লা’ কে নিয়মিত রাখার জন্য। বৈরী সকল পরিবেশে এই কাগজের ফুলময় অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে। প্রায় আটাশ বছর তিনি সংগ্রাম করে চলেছেন ব্যবসায়িক চিন্তাধারায় নয় লাভ-লোকসানের কথা ভেবেও নয় বরং বলা যায় শাশ্বত সুন্দরের, সৃষ্টির বিকাশে মাতোয়ারা হয়ে শুধুমাত্র নিজের ও পাঠকের আনন্দের মাঝে তৃপ্তি খুঁজতে।
এ প্রসঙ্গে সম্পাদকের ভাবনামূলক এই কাগজের দৃশ্যমান হওয়ার সময়ে যে চিন্তন কাজ করেছে তাতে কবি সুকান্তের ছাড়পত্রের একটা অংশের প্রতিফলন দেখতে পাই;
“এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান:
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তুপ-পিঠে
চলে যেতে হবে আমাদের।
চলে যাবো তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাবো জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ-শিশুর বাসযোগ্য করে যাবো আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।”
আজ সে চিন্তা, চেতনায় এমন কী অনুষঙ্গ যুক্ত হলো যা সম্পাদকের গতিশীল মননে ভাবান্তর এনেছে সমাজ, দেশ, রাষ্ট্র ও বিশ্বের চরম ক্রান্তিলগ্নে। এ বিষয়ে আমার ভাবনা তাই যুগপৎ তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে এর কারণ খুঁজতে। সম্পাদকের অনুভবে, চিন্তনে ও অনুসন্ধিৎসু মনে কী এমন ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে, কোন বিষয়বস্তু এমনতরো অশনিসংকেত দিচ্ছে তা নিয়ে ভাববার সময় এসেছে বৈ কি!
১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে এই মাসিক সাহিত্য কাগজের জন্ম হয়েছিলো জমকালো বর্ণাঢ্য বিষয়বস্তু নিয়ে। ‘সীমা মেনে সীমা ভেঙ্গে’ স্লোগান বা শিরোনাম নিয়ে। প্রচ্ছদ ছিলো ‘আধুুনিক বাংলা কবিতার নিঃসঙ্গ শেরপা- শামসুর রাহমান’ কে নিয়ে। উল্লেখ করতে হয় তৎসময়ে সুপরিচিত কবি ‘আলফ্রেড খোকন’কে দিয়ে তিনি ত্রিশ দশকের সাড়া জাগানো কালের কবি শামসুর রাহমান এর ছবি তুলিয়ে ছিলেন এবং সাক্ষাৎকার রেকর্ডিং করিয়েছেন আহমেদ মাওলা’কে দিয়ে। কতটুকু আগ্রহ, ঐকান্তিক ইচ্ছা আর সৃজনশীল মনোবৃত্তি থাকলে ঢাকায় গিয়ে এসব সংগ্রহ করেছেন একটা নবজাতক কাগজের ভেতর ও বাহিরের অঙ্গসজ্জা দীপ্যমান করে তুলতে।’ আন্দরকিল্লা ‘ কাগজ এবং এর সম্পাদক নিয়ে আরো অনেক কথা প্রাসঙ্গিকভাবে আলোকপাত হবে পর্যায়ক্রমিকভাবে বিভিন্ন ঘটনা বর্ণনার মধ্য দিয়ে।
আজ ‘আন্দরকিল্লা’ জুলাই ২০২৫ সংখ্যার শিরোনাম বা স্লোগান নিয়ে ভাবতে বসে একটা কথা বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে তা হলো একবার কিংবদন্তি বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে মতামত দিয়েছিলেন;তিনি মনে করতেন যে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ যদি পারমাণবিক অস্ত্রের মাধ্যমে সংঘটিত হয়, তাহলে চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধের লড়াই হবে লাঠি এবং পাথর দিয়ে। তিনি সম্ভবত বোঝাতে চেয়েছিলেন যে পারমাণবিক যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ এতটাই ভয়াবহ হবে যে, সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর মানুষ আবারও আদিম যুগে ফিরে যেতে বাধ্য হবে…। তিনি এও বলেছিলেন পারমাণবিক যুদ্ধের ফলে যে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ হতে পারে, তাতে আধুনিক সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে এবং মানুষ আবারও প্রস্তর যুগে ফিরে যেতে পারে।
যুদ্ধংদেহি বিশ্বের পারমাণবিক শক্তিধর দেশ বা পরাশক্তির দেশসমূহের উন্মত্ততা, নৃশংসতা শান্তিকামী আইনস্টাইনের মনোজগতকে বেশ আলোড়িত করেছে। তাঁর সুগভীর চিন্তনে
সম্ভবত তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে ভাবনা তাঁর অন্তরাত্মায় গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি করেছিল।তার একমাত্র কারণ হলো পারমাণবিক যুদ্ধের ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা সম্পর্কে তিনি ছিলেন স্বভাবতই সচেতন, এজন্য এর সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন। তাঁর এই ধারণা বা উক্তি কেবল একটি প্রবাদ বা রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়নি, বরং এটি ছিল পারমাণবিক যুদ্ধের ধ্বংসলীলার একটা মর্মান্তিক রূপকল্প বা চিত্রকল্প।
আন্দরকিল্লা ‘ কাগজের সম্পাদক সাম্প্রতিক সময়ে মানবতার বিপর্যয়ে, গুম, হত্যা, ভাংচুর বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ক্রমাগত যুদ্ধের বিভীষিকা,পারমাণবিক অস্ত্রের হুংকার এবং মারণাস্ত্রের বিষম ব্যবহারে অজস্র মানুষের মৃত্যু, বাস্তুচ্যুত মানুষের আহাজারি সর্বোপরি স্বদেশের অস্থির তাণ্ডব চিত্র,পাথর মেরে, লাঠি দিয়ে পিটিয়ে মানুষ হত্যা, পাথরের ভাস্কর্য ভাঙচুর, নষ্ট, কুপিয়ে মানুষ হত্যা, প্রকাশ্যে নারী লাঞ্ছনা, ধর্ষণ করে উলঙ্গ চিত্র অন্তর্জালে প্রদর্শন, নারী অপহরণের মতো ন্যক্কারজনক ঘটনার ঘনঘটা, নিষ্পেষণ, নিপীড়নের অস্থির অরাজক পরিস্থিতিতে সম্ভবত হয়েছেন ক্ষুব্ধ, শংকিত। হয়তো এ সমস্ত হিংসাত্মক মানবতাবিরোধী কার্যকলাপের বশবর্তী হয়ে তিনি বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের কালজয়ী ভবিষ্যতবাণীকে যেন আত্মস্থ করার চেষ্টা করলেন! অক্ষর সমুদ্রে ভাসিয়ে দিলেন, অন্তর্জালে আলোকমান করলেন হৃদয়ের ক্ষরণ ‘ আমরা কী প্রস্তর যুগে প্রত্যাবর্তন করছি?’
যার কথা নিয়ে এতো ভাবনা, প্রসঙ্গ টানা তার অতীত কর্মজীবনের বন্ধুর পথ, সংগ্রামী জীবন সম্পর্কে ধারণা এবং এর একটা বাস্তব রূপচিত্র পাঠকের সামনে তুলে আনা না গেলে অস্বচ্ছ আরশীতে মুখ দেখার মতোন হবে অর্থাৎ সম্পাদক নুরুল আবসার’ কে চেনা যাবে না ভালো করে। বোয়ালখালী থেকে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা পাসের পর মধ্যবিত্ত পরিবারের এই মেধাবী তরুণ চট্টগ্রাম শহরের মহসিন কলেজে ভর্তি হন। তখন বয়স বোধ করি ১৭/১৮ হবে। পরবর্তী পর্যায়ে আর্থিক অসঙ্গতির জন্য পুনরায় গ্রামে ফিরে যান শহরের পাঠ চুকিয়ে। বোয়ালখালী থেকে ডিগ্রি পাস করার পর পুনরায় তিনি ফিরে আসেন শহরে। তখন তিনি সহজ, সরল, সৎ, নির্ভীক,অকুতোভয়, সদালাপী, হাস্যোজ্জ্বল কর্মচঞ্চল, উদ্যোমী, টগবগে এক যুবক। চাকরি নিলেন অস্থায়ী হিসেবে ‘এবি ব্যাংকে, সাথে জুড়ে নিলেন আজাদীতে সাংবাদিকতার চাকরি। এখান থেকে একসময় পরিচিতি ঘটে মুদ্রণ শিল্পের। ছেড়ে দিলেন ব্যাংকের চাকরি, যুক্ত হলেন প্রকাশনার কাজে। দাম্পত্য জীবনে এক পুত্র ও এক কন্যা সন্তানের পিতা। একসময়ে পুত্র আবির এর নামে খুললেন ‘আবির প্রকাশন’। স্বতন্ত্রভাবে শুরু করলেন প্রকাশনা কার্যক্রম। অফিস নিলেন সাত্তার ম্যানশন, দ্বিতীয় তলা, মোমিন রোড, চট্টগ্রামে। আজাদী পত্রিকায় চাকরি করার সময় পরিচয় হয় আজাদী’র সম্পাদক, তুখোড় পড়ুয়া সাহিত্যপ্রেমী, কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক সাংবাদিক সিদ্দিক আহমেদ’র সাথে। সিদ্দিক আহমেদ’র প্রখর পাণ্ডিত্য তাকে কাছে টেনে নিতে খুব একটা দেরি হয়নি।
দু’জনের গুরু শিষ্যের রূপ নিতেও খুব বেশি সময় লাগেনি। সিদ্দিক আহমেদ সাহেবের ঢেরা ছিলো আবির প্রকাশনা অফিসের পাশে। নানা শলা-পরামর্শ দিয়ে সিদ্দিক সাহেব আবসার সাহেবকে অনুপ্রাণিত করেছেন, শিখিয়ে দিয়েছেন সাহিত্য জগৎ তথা প্রকাশনা জগতে টিকে থাকার মূলমন্ত্র। আজকের আলোচিত এই কাগজের প্রকাশে ও নামকরণের পেছনে যাঁর অবদান শতভাগ তিনি আর কেউ নন দারুণ পান্ডিত্যের অধিকারী ‘সিদ্দিক আহমেদ সাহের। শিল্প,সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সমাজ ভাবনামালক এই কাগজের নামকরণও করেছিলেন তিনি। সিদ্দিক আহমেদ সাহেব তাঁকে বলেছিলেন এই কাগজের নাম ‘আন্দরকিল্লা’ রাখতে। এই নামকরণ নিয়েও কম কথা হয়নি। তবে এরকম নানা উল্লেখযোগ্য স্থান নিয়ে অনেক পত্রিকার নামকরণ করা হয়েছে; যেভাবে ঢাকার আছে গ্রিণরোড পত্রিকা এবং কলকাতার আছে কলেজ স্ট্রিট পত্রিকা এবং আনন্দবাজার পত্রিকা (এই পত্রিকা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৩ মার্চ ১৯২২ সালে দেশ ভাগের আগে। নারায়ণগঞ্জের, সোনারগাঁও উপজেলায় অবস্থিত আনন্দবাজার হাট স্থানের নামানুসারে এর নামকরণ করা হয়ে থাকবে বলে ধারণা করা যায়। অন্যদিকে অনেকের ধারণা রংপুরের গাইবান্ধা জেলার বন্ধ হয়ে যাওয়া আনন্দবাজার রেলওয়ে স্টেশনের নামে হয়েছে। আবার এসব ধারণা ও ভিত্তিহীন হতে পারে।) এ ছাড়াও NewYork Times, Washington post, I The Toronto Sun প্রভৃতিও স্থানের নামানুসারে হয়েছে। সে যা হোক একথা ঠিক যে এক গভীর সুচিন্তনের স্ফুরণ থেকে এই কাগজের নাম আন্দরকিল্লা রাখা হয়েছে। এই নামের রয়েছে অনেক গুরুত্ব ও তাৎপর্য। আন্দরকিল্লা চট্টগ্রামের একটি ঐতিহাসিক স্থান এবং এর নামের সাথেই জড়িয়ে আছে মুঘল আমলের ইতিহাস। ১৬৬৬ এর আগ পর্যন্ত পাহাড় বেষ্টিত দুর্ভেদ্য এই অঞ্চলে মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের ঘাঁটি ছিলো। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দে শায়েস্তা খাঁর চট্টগ্রাম বিজয়ের পর এখানে এটাকে কেল্লা বা দূর্গে পরিণত করা হয়, যা পরে “আন্দরকিল্লা” নামে পরিচিত হয়। একটা ঐতিহাসিক স্থান বা ঐতিহাসিক কীর্তিকে ঘিরে এ সাময়িকীর নামকরণ করা হলেও এটা হলো একটা ‘কাগজের
কিল্লা’। যেখানে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সমাজ চিন্তন ও ভাবনা অক্ষরের যুথবন্ধনে প্রতি মাসিকে বসায় মেলা, আশা রাখে একদিন তার রকমারি কারুকাজ ও বিভিন্ন আঙ্গিক শাশ্বত সুন্দর ও সত্যের রূপকাঠির ছোঁয়ায় অতিক্রম করবে অসংখ্য, অজস্র বছর নিরাপদে, নির্ভেজালে। তারই এক নিশ্চয়তা রেখে যেতে হবে যুগের পর যুগ পেরিয়ে কালের প্রাচীর ভেঙ্গে সততা, নিষ্ঠা ও নিরপেক্ষ সম্পাদনায়। এটা ছিলো ‘সিদ্দিক আহমেদ সাহেবের নীতিকথা, মুলমন্ত্র। গুরুর কথা আজো অক্ষুণ্ন রেখে চলেছেন আজকের ষাটোর্ধ কবি, প্রকাশক ও সম্পাদক মুহম্মদ নুরুল আবসার।গুরুর আদেশ, উপদেশ শিরোধার্য। সেই নামে আজো চলমান এই মাসিক কাগজ। এর মাঝে কতো সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে তারপর থেমে গেছে, হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে একেবারে। কিন্তু ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে ১৯৯৮ জানুয়ারি সংখ্যা বের করার পর নানা সংকট আর আর্থিক অসংগতির কারণে এ মাসিক সাময়িকী ক্ষুদে সংবাদপত্রে বা টেবলয়েডে রূপ পরিগ্রহ করে। এরপর নিয়মিত ও অনিয়মিতভাবে টেবলয়েড আকারে পার করেছে দুই যুগ, আয়ুষ্কাল যখন ২৪ বৎসর তখন আবার ২০২১ সালে ডিসেম্বরে ফিরে এসেছে স্বরূপে, স্বমূর্তিতে। মোদ্দাকথা ২০২১ সালের ডিসেম্বর সংখ্যার পর থেকে এর ধারাবাহিকতায় কোনো পরিবর্তন হয়নি বরং বলা যায় রূপ লাবণ্যে মজ্জা,অস্থিতে এসেছে উর্বর মানসিকতার ও চলমান যুগের আধুনিকতার ছোঁয়া। নান্দনিকতার এক অনুপম হাওয়া লেগেছে একের পর এক প্রতিটা সংখ্যায়।
বলা বাহুল্য ১৯৯৭ এর ডিসেম্বর সংখ্যার চেয়ে বর্তমান সংখ্যাগুলো অধিকতর আকর্ষণীয়, চেনা, অচেনা লেখক, কবি প্রাবন্ধিকের লেখার নির্যাসে ভরপুর। কাগজের পাতায়ও এনেছে যুগান্তকারী বিপ্লব। ১৯৯৭ ইং ডিসেম্বর ও ১৯৯৮ জানুয়ারি সংখ্যা তখন ছিলো অফসেট পেপারে এবং টেবলয়েড এর পাতাগুলো ছিলো উন্নতমানের আমদানিকৃত নিউজপ্রিন্ট কাগজের। আজ এসব অতীত। ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসের পর থেকে অদ্যাবধি অর্থাৎ চলতি প্রতিটা মাসিক সংখ্যার পাতাগুলো হলো বিদেশি ম্যাট পেপারে। নান্দনিক প্রচ্ছদে আবরিত প্রতিটা মাসিক সংখ্যা এককথায় মনকাড়া। প্রগাঢ় উৎসাহে,অসম্ভব পরিশ্রমী, সৃজনশীল এই মানুষ অদম্য সাহসে প্রায় সুদীর্ঘ আটাশ বৎসর প্রকাশনার অন্যান্য কাজের সাথে সাথে একটা মাসিক সাময়িকী বের করে এনেছেন নানা চড়াই-উতরাই পার করে, প্রতিকূলতা ও প্রতিবন্ধকতা জয় করে। সাহিত্যপ্রেমী এ মানুষ সাহিত্য সৃজনশীল কাজের শ্রীবৃদ্ধি ঘটাতে সাময়িকী বের করার পাশাপাশি চালু রেখেছেন প্রায় প্রতিমাসে নিয়মিত সাহিত্য আড্ডা।
এতোকিছুর পরও তিনি কেন আজ শঙ্কিত, অন্ধকার বিবরে ফিরে যাবার দুঃস্বপ্নে আচ্ছন্ন, প্রস্তর যুগে প্রত্যাবর্তনের কথা বলছেন। কোন অশনিসংকেত চক্ষুষ্মান হচ্ছে তার চলার গতিপথে, সৃজনী ধারায়!
প্রসঙ্গক্রমে আবারো ফিরে আসতে হয় ডিসেম্বর ১৯৯৭ সংখ্যায় আবুল মোমেন’র প্রবন্ধের শিরোনামকে আত্মস্থ করে তিনি যে স্লোগান বা শিরোনামে ‘সীমা মেনে সীমা ভেঙে’ নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলো আজ সেখানে ২০২৫ সালের জুলাই সংখ্যার সম্পাদকের স্লোগান হয়েছে ‘আমরা কী প্রস্তর যুগে প্রত্যাবর্তন করছি?’ আবুল মোমেন সাহেব তাঁর প্রবন্ধে ত্রিশ শতকের কালজয়ী কবি শামসুর রাহমান’র বাংলা সাহিত্যে তাঁর কীর্তি সম্পর্কে বলতে গিয়ে এ কথা বলেছিলেন। ‘আন্দরকিল্লা’ সম্পাদক সেই রেশ ধরে সীমায় থেকে সীমা অতিক্রম করার একটা অভিপ্রায় বা অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিলেন। এ আটাশ বৎসরে তিনি তার ধ্যান ধারণা থেকে চ্যূত হননি। একটা সাহিত্য কাগজ প্রকাশনা করতে গিয়ে তিনি অনেককিছু দেখেছেন,আপ্ত করেছেন পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র তথা বিশ্ব পরিমণ্ডলের অস্থির, অসহিষ্ণু চিত্র, দেখেছেন বিশ্বজুড়ে অসহায় নিপীড়িত মানুষের আর্তি, ক্ষুধা পিপাসায় জর্জরিত মানুষের আর্তনাদ, মানবিকতার বিপর্যয়, পেশিশক্তির তাণ্ডব ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডের নির্লজ্জ চিত্র।পরাশক্তিধর দেশের পৃথিবী জুড়ে যুদ্ধের আগ্রাসী ভূমিকা, পারমাণবিক শক্তির আস্ফালন এসব সম্ভবত ভাবিত করেছে সম্পাদককে। সুপরিচিত কবি হেলাল হাফিজ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ কাব্যগ্রন্থে ‘অশ্লীল সভ্যতা’ কবিতায় লিখেছেন “নিউট্রন বোমা বোঝ মানুষ বোঝ না”।
সভ্যতার ক্রমবিকাশের চূড়ান্ত স্তরে যে অধঃপাত নেমে এসেছে তাতে মানবতা বা মানবিকতার অংশবিশেষ আছে বলে মনে হয় না। সভ্যতা বিকাশের যুগে এমন অবক্ষয়ের ধারা কবির দৃষ্টিতে অশ্লীলতা ছাড়া আর কিছুই নয়। আমরা কি তাহলে আইয়ামে জাহেলিয়াত যুগে বসবাস করছি। সভ্যতার বিকাশমান স্তরে এসে মানবতার বিপর্যয় মৃত্যুর বিভীষিকা, যুদ্ধের ভয়াবহ রূপ, বিকৃতি ও বিভ্রান্তি যারপর নেই সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বকে অস্থির ও অসহিষ্ণু করে তুলেছে। ডুকরে কাঁদছে বিশ্বজুড়ে বিপন্ন মানবতা। যে সভ্যতা মানুষের কল্যাণে বিকশিত হয়েছে, মানবের মগজ ও মননের অবিমিশ্র রসায়নে যার ফলশ্রুতিতে মানব সমাজ এক তমসাচ্ছন্ন গাঢ় অন্ধকার ছেড়ে বহু পথ পেরিয়ে, কালের সোপান মাড়িয়ে আলোক যুগে প্রবেশ করেছে
ধাপে ধাপে তা কেন যে পিছিয়ে যেতে চায় তা আজ জটিল প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছে। মানব সভ্যতার উৎকর্ষের এমনতর ধারায় এ কোন্ শক্তি অন্তরক বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে, কোন রহস্য এর পেছনে কাজ করছে গোপনে তার কারণ অজানা। এ সভ্যতা তো মানুষের কাম্য ছিলো না। এতে অনুমিত হয় আমরা এক অশ্লীল, অসভ্য জগতে বাস করছি।
পরিশেষে বলতে হয় একটা পত্রিকা নিরপেক্ষ, বস্তুনিষ্ঠ, সত্যভাষণে তথ্য উপাত্তের নিরিখে সচল ও সক্রিয় রাখতে গেলে অগণতান্ত্রিক, ফ্যাসিবাদী শাসকযন্ত্র ধর্মান্ধদল ও বিরোধী অপশক্তির রোষানলের শিকার হতে হয় প্রায়ই পত্রিকার সম্পাদকদের। হয় এদের কথানুসারে চলতে হবে নচেৎ নানারকম হয়রানি, মিথ্যা মামলায় জড়ানোর হুমকি -ধামকি,অনর্থক,অহেতুক চাঁদাবাজির শিকার ও জীবন নাশের হুমকি এসব নিয়েই সন্ত্রস্ত থাকতে হবে। তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহে এটা নতুন কিছু নয়। এর কারণ হলো তৃতীয় বিশ্বের প্রতিটা দেশ এখন যুদ্ধপীড়িত, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামরিক শাসনে জড়িয়ে পড়ার কারণে এখানে সুবিধাবাদী, সরকারি ক্ষমতার অপছায়ায় এক শ্রেণির মানুষ অনৈতিক কার্যক্রমে ব্যাপৃত হয় এবং অপরাধমনস্ক হয়ে রাষ্ট্র যন্ত্রকে যেমন কলুষিত করে ঠিক তেমনি সমাজকাঠামোকে ভেঙ্গে অস্থির ও অচল করে তুলতে তৎপর হয়ে ওঠে। এরাই সমাজের সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে নিজস্ব স্বার্থের জন্য বাধা প্রদান করে। মব ভায়োল্যান্স নামক অপশক্তি তৈরি করে। বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের অন্তর্ভুক্ত দেশ উপরন্তু রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল হওয়ায় একটা অশুভ ছায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে ক্রমশ এর শিক্ষা, সাহিত্য,সংস্কৃতির সুন্দরতম প্রকাশ ও বিকাশ। এরকম অস্থিতিশীল পরিবেশে ‘আন্দরকিল্লা’ কাগজের সম্পাদক ভয়ভীতিকে উপেক্ষা করে জীবনকে বাজী রেখে কতদিন সৎভাবে, নৈতিকতা নিয়ে সমাজ, সাহিত্য সংস্কৃতির শ্রীবৃদ্ধি সাধনে নিজেকে জড়িয়ে রাখতে পারবেন? কতদিন নিঃস্বার্থভাবে তিনি নির্লজ্জ ভয়ভীতি প্রদর্শনে, প্রাণনাশের হুমকি- ধামকি সহ্য করে সত্য, সুন্দরের জন্য লড়বেন? ‘আন্দরকিল্লা’ কাগজ থেকে সম্পাদক লোকসান ছাড়া কোনো লাভই তো পান বলে মনে হয় না। কারণ জানামতে এই পত্রিকা বের করার জন্য নিজের পুঁজি ভেঙেছেন। নিজের একমাত্র ডিপিএস হিসাব অবসায়ন করে ওই টাকা দিয়ে তিনি একটা ‘আন্দরকিল্লা’ মাসিক কাগজের সংখ্যা বের করে নিয়মিত রাখার চেষ্টা করেছিলেন। একটা মাসিক সংখ্যা বের করার সময় হলে তিনি যে কি পরিমাণ অস্থির হয়ে যান তা আমার খুব কাছে থেকেই প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়েছে। পত্রিকার জন্য একটা বিজ্ঞাপন খোঁজা ও বিজ্ঞাপন পাবার লক্ষ্যে সর্বোপরি অর্থ সহায়তার জন্য মানুষের দ্বারে, দ্বারে ছুটে গিয়েছেন। অলাভজনক হওয়া সত্ত্বেও তিনি আন্দরকিল্লা’ কাগজের প্রকাশের ধারাকে অক্ষুণ্ন রাখতে যারপর নাই চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তারপরও মৃত্যুর ভয় সবাইকে তাড়িয়ে বেড়ায়। তিনিও তো রক্তে মাংসে গড়া মানুষ, তিনি একে এড়াবেন কিভাবে! দেশের সার্বিক অস্থির পরিস্থিতি, চারপাশের রক্তচক্ষু, অশুভ আস্ফালন এসব দেখে সম্পাদক মুহম্মদ নুরুল আবসার একদিকে যেমন হয়েছেন বিচলিত তেমনি হয়েছেন ব্যথিত। যে অশুভ সংস্কৃতির ধারা যেভাবে বিধ্বংসী রূপ নিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রের সরল সত্যকে ঢেকে দিতে চাইছে, নাগরিক জীবনকে অন্ধকার নরকের পথে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে সেখানে তিনি ভাবিত হবেন স্বাভাবিকভাবে প্রস্তরযুগে প্রত্যাবর্তনের আশঙ্কা তিনি করতেই পারেন।
আমরা শাশ্বত সুন্দরের পূজারী, সত্যের অনুগামী। প্রতিটা সৃজনশীল কাজে আমরা আলোড়িত হই। মাসিক ‘আন্দরকিল্লা’ এর মতো কাগজের প্রকাশ সমাজ, রাষ্ট্র কাঠামোকে তথা শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আঙ্গিককে সমৃদ্ধ করেছে এটা গ্রহণযোগ্য সত্য। তাই ‘আন্দরকিল্লা’র মতো মাসিক কাগজ তার নিজস্বতা ও মাহাত্ম্য নিয়ে ধারাবাহিকতায় আরো বেগবান হোক এ কামনা হোক সবার। কোনো অপশক্তির কাছে মাথা যেন নোয়াতে না হয় তার জন্য সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে, সোচ্চার হতে হবে। সাহিত্য জগতে সর্বোপরি প্রগতির পথে ‘আন্দরকিল্লা’ মাসিক কাগজ একটা মাইলফলক হয়ে থাকুক এবং আমাদের চিন্তা চেতনাকে সত্য, সুন্দরের সন্ধান দিক যুগের পর যুগ ছুঁয়ে। পরিধি ও পরিসরে মাসিক ‘আন্দরকিল্লা’ ভিন্ন ভিন্ন মাত্রার অনুষঙ্গ টেনে নিজেকে করেছে সমৃদ্ধ, অন্তর্জালেও ছড়িয়েছে দ্যুতি, ব্যাপ্তিও আজ বিশ্বজনীন। মাসিক ‘আন্দরকিল্লা’ কাগজের আলো সকলের মন প্রাণ ছুঁয়ে যাক,কালের পর কাল বেঁচে থাকুক পাঠকের হৃদয় জুড়ে আগামীর পথ ধরে অনাদিকাল।
রূপক বরন বড়ুয়া, কবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক




