রূপক বরন বড়ুয়া
ষাটের দশকে যে ক’জন কবি রয়েছেন তাদের মধ্যে ময়ুখ চৌধুরী এক ব্যতিক্রমী নাম। তবে তিনি দশক মানেন না। তিনি বলেন “আমি দশকওয়ারি সা¤প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করি না। এর বিরুদ্ধে কবিতাও লিখেছি। এটা পশ্চিমা রোগ– দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝখানে এ ধারণার উন্মেষ ঘটেছে।” তাই সহজেই অনুমেয় কবি ময়ুখ চৌধুরী দশক-দশক প্রীতিতে বিশ্বাসী নন। তাঁর চিন্তা-চেতনা-ধ্যান-ধারণায় কেবল আধুনিকতার আলোক যা যে কোনো দশকেই কাব্যকালের বর্ণময় পেখম খুলতে পারে। বাংলা সাহিত্যে কবির সংযোগ বা পদচারণা খুব অল্প বয়সেই। তাঁর লেখালেখি শুরুর পর থেকেই তা জায়গা করে নেয় বিভিন্ন জাতীয় খবরের কাগজের সাহিত্য পাতায়। বয়সের তুলনায় প্রাজ্ঞতার কারণে মেধাবি এই কবিকে ওই সময়ে অন্য এক উচ্চতার মানদÐে পরিমাপ করতে হয়েছিলো। ষাটের দশকে যে সমস্ত কবি তাদের কাব্যগ্রন্থ নিয়ে কাব্যের উঠোনে আলো ফেলেছিলেন তাদের মতো করে কবি ময়ুখ চৌধুরী কাব্য সম্ভার নিয়ে প্রকাশ্যমান হননি। তবে এটাও ঠিক কবির লেখার সমগ্রতা শুধু কাব্যগ্রন্থ নির্ভর হয়ে তাঁর কাল চিহ্নিত করবে সেটাও গ্রহণীয় হতে পারে না। যেমন কবি শামসুর রাহমান ও কবি আল মাহমুদ পঞ্চাশ দশকের কবি হয়েও ষাটের দশক দাপিয়ে বেড়িয়েছেন তাঁদের কাব্যগ্রন্থ নিয়ে। ষাটের দশকের কবিদের কাব্যগ্রন্থের প্রকাশকাল নিয়ে দুটো শিবির লক্ষ্য করা যায়। স্বাধীনতার আগে ও স্বাধীনতার পরে। অনেকের মতো কবি ময়ুখ চৌধুরী তাঁর কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেছেন স্বাধীনতার পরে। এজন্য কবিকে বলতে দেখা গেছে ‘আমার আসতে দেরি হতে পারে’। এটা একবাক্যে স্বীকার করতে হয় যে স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলা কাব্যে যে অল্পবিস্তর ভিন্নমাত্রা ও ভিন্ন স্বরের, আবেগি অথচ বাস্তবধর্মী রোমান্টিক কবিতার সংশ্লেষণ হয়েছে, সংযোগ ঘটেছে, উৎসারিত হয়েছে যে সমস্ত শক্তিশালী কবিতা এর বেশির ভাগই এসেছে ময়ুখ চৌধুরীর কাব্যধ্যানে, শৈল্পিক চারুতায়। নতুন বিষয় এবং শব্দের নিপুণ চালনায় অগ্রগামী ভাষায় চিত্রকল্প নির্মাণে দক্ষ ময়ুখ চৌধুরীর কবিতা তৈরি করেছে নিজস্ব ঘরানা। বক্তব্য উপস্থাপনে প্রতীকী, উপমা, অলংকার বলার ঢং সম্প‚র্ণ তাঁর নিজস্ব। সেই অয়োময় কাব্যঘরের চৌহদ্দি সুরক্ষিত, আলোকিত আপন কাব্যের মাধুকরীতে। এজন্য তিনি আক্ষেপ করে বলেছেন, সাহিত্য ক্ষেত্রে এতিমের মতো বড় হয়েছি। শুরু থেকেই তাঁর লেখায় স্বাতন্ত্র্য দৃষ্টিভঙ্গি এবং নিজস্ব ব্যতিক্রমী কাব্যস্বরের মাধ্যমে তিনি বোদ্ধা মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন, চেনাতে পেরেছেন নিজের স্বকীয়তা ও সামর্থ্যকে। সৃষ্টিশীল চেতনা ও মননে আপন মেধা ও প্রজ্ঞার সন্নিবেশনে তিনি একাকী তাঁর কাব্যের আঙ্গিনা সাজিয়েছেন রূপে অরূপে মূর্তের ভেতরে বিমূর্ততার প্রকাশ ঘটিয়ে। আজ কবির সাড়া জাগানো কাব্যগ্রন্থ ‘অনিদ্রার কারুকাজ’ আলোচনা করার জন্য সচেষ্ট হলাম।
(২)
কবি ময়ুখ চৌধুরী কবির ‘অনিদ্রার কারুকাজ’ কাব্যগ্রন্থটা সেজেছে ৪৮টা অসাধারণ কবিতার সমন্বয়ে। প্রতিটা কবিতা ঔজ্জ্বল্যে দীপ্যমান হয়েছে বহুমাত্রিকার বর্ণাঢ্যে। তাই কাব্যগ্রন্থের প্রতিটা কবিতা পাঠককে ভাবায়, অনুভবগুলো ডাল-পালা মেলে ঢুকে পড়ে অবলীলায় শাশ্বত সুন্দরে, কালের কাহনে, পুরাণে, অধিবাদ, অতিন্দ্রীয়বাদ, পরাবাস্তবতাবাদ, বাস্তবতার নাগরিক নন্দনে, বস্তুনিষ্ঠ সত্যকথনে। কবিতায় শব্দের মাধুকরী ও গভীর আবেগ বা রোমান্টিক উপস্থাপনে আশ্চর্য এক কাব্যের মায়াঘর তৈরি করেন তা কবিকে তার সমকালীন কবিদের চেয়ে আলাদা স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল করেছে। কাব্যসৃষ্টিতে শৈল্পিক বুননের জন্য কবিকে বাংলা কাব্যের বাবুই বলতে হয়। কাব্যগ্রন্থের প্রতিটা কবিতার পংক্তি জুড়ে কারুময় জিজ্ঞাসা যা কাব্যগর্ভকে অনন্য পরিণতবোধ আর জীবনমুখী দর্শনের দাবিদারে পরিণত করেছে। রোমান্টিক এ কবির কাব্যগ্রন্থ পাঠ যেমন কৌতূহলোদ্দীপক তেমনি বক্তব্যের তেজস্ক্রিয়তা অন্তম‚ল ভেদ করে ধাঁধায় ফেলে তাকে রহস্যময় করে তোলে। কালের বিচিত্র গতিকে পর্যবেক্ষণ করেছেন কবি প্রজ্ঞার গভীর আলোকে, বস্তুনিষ্ঠ চিন্তা চেতনায় বিজ্ঞান আর বাস্তবের ধ্যান-ধারণায়। তাই জীবনের পরতে পরতে যে রহস্যময় চিত্র অবলোকন করেছেন তাতে ক্ষুধিত হৃদয়ে জেগেছে অনন্ত এক জিজ্ঞাসা। সে জিজ্ঞাসা কবিগুরু রবি ঠাকুরের কবিতা ‘প্রথম দিনের স‚র্য’-তে উচ্চারিত হতে দেখা যায়। অনিদ্রার কারুকাজ কাব্যগ্রন্থের শুরুটাই করলেন কবি ‘জিজ্ঞাসা’ কবিতা দিয়ে; “ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলে কালো ঘোড়া দিগন্তরেখা দিগন্তে হয় মলিন চকিতে চক্ষু মেলে দেখে হায় ঘোড়াটি নেই মহাজিজ্ঞাসা ডানা মেলে দিয়ে শ‚ন্যে হয়েছে লীন “ছোট্ট একটা কবিতা অথচ অসাধারণ তার ব্যাপ্তি। এ জিজ্ঞাসা চলছে অনন্তকাল ধরে আর তা নিয়ে যাচ্ছে কাল ছুঁয়ে মহাকালে। সে জিজ্ঞাসা জীবনের পথে পথে যে চড়াই-উৎরাই, জীবনে টিকে থাকার জন্য, বেঁচে থাকার জন্য অহর্নিশ যে সংগ্রাম, কষ্টকর যে দীর্ঘপথ তার প্রতি চোখ রেখে দেখালেন মানবের কৌশলী চোখ, আত্মপ্রত্যয় আর উদ্ভাবনের মগুজে অনুরণনের কাছে প্রকৃতিকে জয় করার উদগ্র বাসনা ও প্রচেষ্টা। তাই ‘মানুষেরা পারে’ কবিতায় কবিকে বলতে দেখি; “নদীর মতো নয়, মানুষেরা হাঁটে খুব কম। এই সক্ষমতা দাস-সভ্যতার আগে মানুষেরা জমা করে রাখতে শিখেছে।” কী সুন্দরভাবে ব্যক্ত করলেন আদিম মানব সমাজ ব্যবস্থায় শ্রেণি বৈষম্য হীনতার কথা যেখানে শ্রম শোষণ বলতে কিছুই ছিলো না, নিজস্ব অধিকার ছিলো অর্থাৎ যা কিছু ছিলো নিজের। তাই মানুষের স্বাধীনতা ছিলো নির্মল। কিন্তু দাস সভ্যতায় তা শৃঙ্খলিত হয়ে পড়ে। তারপরও মানুষেরা নিজের প্রচেষ্টায় দ‚রতিক্রম, অলঙ্ঘ্য, অসাধ্যকে করায়ত্ত করে নিতে পেরেছে সৃজনশীল চিন্তা চেতনায়। এখানে কবি বললেন; “সাঁতার কাটতে জানে না বলেই নদীরা সমুদ্রে ডুবে যায়, মানুষেরা পার হতে পারে। তারপর ‘হোমারের চোখ’ কবিতায় লিখলেন জীবন নদীতে যদি স্রোত না থাকে তাহলে সে কখনো জঙ্গমে যেতে পারে না। এখানে তিনি বললেন; “জটিল ঘুমের ঘোরে নদীর দু’তীর যদি চোখের পাতার মতো কোনদিন এক হয়ে যায় মোহনায় যাবার আগে মৃত্যু হবে তার।” অন্ধ হোমারের চোখের পাতা ও মণিতে অন্ধকার থাকলেও তাতে স্বপ্ন ছিলো,ছিলো সৃষ্টি, সৃজনের অনুপম কাব্য। হোমারের ভেতর উপলব্ধির গভীর না থাকলে,মানব চরিত্র বিশ্লেষণের এক কালজয়ী পুরাণ সৃষ্টি হতো না। অন্ধত্বকে মেনে নিয়ে যদি তিনি ভেতরের হোমারকে জাগিয়ে না তুললে কখনো এ মহাকাব্য হতো না রচিত কোনদিন। ট্রয় নগরীর আগুন আর হেলেন আমাদের মর্ম স্পর্শ করতে পারতো না। কবি এখানে মানব চরিত্রের সর্বোপরি জাতির অন্ধত্বকে যেন সরাতে চাইলেন। বললেন; “এসব দৃশ্যের কথা ভেবে অগ্নিকাÐ বুকে নিয়ে সারারাত জেগে থাকে ধ্রুপদী হেলেন। / চক্ষুষ্মান অন্ধদের এই দৃশ্য দেখাবেন বলে পৃথিবীতে হোমার এলেন।” এরপরে নিরাপদ চলার ক্ষেত্র জনবহুল রাস্তায় বেপোয়ারা যানের হাত থেকে রেহাই পেতে জেব্রাক্রসিং দিয়ে পথ চলার কথা বলতে গিয়ে বললেন প্রথা ভাঙার সাহসী কথা; “কালের অববাহিকা ধরে হাঁটতে থাকা আমি লালবাতির মতো একজন মানুষ… আমাদের প‚র্বপুরুষের রক্তের ভেতরে যে লাল একই সঙ্গে তা আগুন এবং আলো।” এক উজ্জীবনের আলো ছড়ালেন হতাশাগ্রস্ত মানব জীবনের অণুতে পরমাণুতে। দেখাতে চাইলেন জীবনের কল্যাণে আলো এবং বৈপরীত্যে দ্রোহের ফুলকি মানে বিপ্লবের রং দুই-ই যেন সহবাসী।
(৩)
‘জনৈক বেকারের উক্তি’ কবিতায় ১৯৭০ সালের ঘ‚র্ণিঝড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণহানির কথা যেমন বললেন খবরের কাগজের সুত্র ধরে তেমনি আশ্চর্য হয়েছেন তৎসময়ে এতো মৃত্যুর পরে ও বেকারের জন্য কোন কর্মখালির বিজ্ঞাপন না দেখে। সহজ কথা এতো লোক মরলো অথচ কর্ম খালি হলো না। এখানে কবির স‚² একটা দ্রোহও প্রকাশিত হয়েছে তৎকালীন পাক-সরকারের চাকরি প্রদানের ক্ষেত্রে বৈষম্য লক্ষ্য করে, তিনি আক্ষেপে আর দ্রোহে বললেন; ” পিঁপড়ের মতন নাকি মারা গেছে বহুলোক। এতো লোক মরে গেল,পত্রিকার কোন পৃষ্ঠাতে তবু কী আশ্চর্য পেলাম না কোথাও যে খুঁজে একখানি বিজ্ঞাপন কর্মখালির। ” তারপর কবিকে জীবনবোধ আর জীবন দর্শনের কুয়াশাময় নিয়মের বেড়াজাল আর প্রযোজ্য অপ্রযোজ্য সংস্কারকে উন্মোচন করতে দেখি সভ্যতার গলি বেয়ে আসা পলিতে। কবির ‘নৌকাখÐ’ কবিতা কবির অসাধারণ এক সৃষ্টি। কাব্যচারুতায় আর বলার অপ‚র্ব এক ঢং কবিতায় সৃষ্টি করেছে অন্য এক মাধুকরী। অল্প কথায় এ কবিতার মর্মার্থ এবং তার নির্যাস বের করে আস্বাদন করা খুবই দুরূহ ব্যাপার। এখানে কবি মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশে মানব চরিত্রের বিভিন্ন দিক প্রত্যক্ষ করে চরম সত্যকে উপস্থাপন করেছেন অনন্য এক প্রাজ্ঞতার কারুতায়। মানুষ প্রয়োজনে কতকিছুকে আপন করে নেয় আর প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে তা ছুঁড়ে ফেলে, ঝেরে ফেলে অথবা প্রয়োজন ফুরিয়ে যায় বলে আগুনে পুড়িয়ে ফেলে। কবিতার একটা স্তবকে তাই কবিকে বলতে শুনি; “মানুষেরা পারাপার করে যে নৌকায় খেয়াঘাটে নামবার আগে লাথি মারে তার গায়।” একই কবিতায় অন্য আরেক জায়গায় বলতে শুনি; “যাকে প্রিয়জন বানিয়েছ সুবিধামতন তারই জন্য চুনকালি করেছ জোগাড়!” মানবের এই বিচিত্র স্বভাব কবিসত্তাকে আলোড়িত করেছে তাই এই নিগ‚ঢ় সত্যকে তিনি শব্দালোকে আলোড়িত করলেন। বস্তুত ভালো কাজের পেছনে তিরস্কার মুখিয়ে থাকে। তবু সভ্যতা এগোয় নিজস্ব গতিতে এসব সাথে নিয়ে। এরকম একটা বিবশকালে কবি তাকালেন বিবর্ণ জাতির এলোমেলো পথের বাঁকে। ‘দেশলাই’ কবিতায় কবি ইঙ্গিত রাখলেন জাতির পিতার প্রতি। বললেন “যে তর্জনি ইশারায় বাতিঘর পেয়েছ সহজে সেই ইতিবৃত্ত তুমি মুছে ফেললে পাপোসের গায়ে! একদিন অন্ধকারে হাতড়াবে মোমবাতি খুঁজে দেশলাই কোথায় রেখেছো মনে পড়ে?” অসাধারণ এক দেশপ্রেম আর জাতির পিতাকে নিয়ে স্মরণের আলেখ্য। যার তর্জনিতে উঠে এসেছিলো একটা জাতির ভাগ্য, স্বাধীনতা, পেয়েছিলো সুবর্ণ লাল-সবুজের পতাকা অর্থাৎ কবির মনোজ্ঞ উপমায় বাতিঘর সে আর কেহ না জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আজ অতীত ইতিহাস বিস্মরিত হয়েছে! সেখানে নেমে আসছে অন্ধকার। তমসায় ঘেরা জাতির জীবনে এরকম আলোকময় মানুষ বিহনে জাতি আঁধারেই খাবি খাবে আলোকের সন্ধান না পেয়ে এটা স্বাভাবিক সত্য। বাংলা ভাষার প্রতি কবির গভীর আবেগ উদ্বেলিত হতে দেখা যায় ‘বাড়ি যাচ্ছি, বাড়ি’ কবিতায়। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনকে স্মরণ করতে গিয়ে কবি স্বর আবরিত হয়েছে মাত্রাবৃত্তের রীতিতে। কবিকন্ঠে উচ্চারিত হয়েছে; “বাড়ি যাচ্ছি বাড়ি সঙ্গে যাবে একুশে ফেব্রæয়ারি। বাঁশ বাগানের বিষণœতায় শেষবাড়িটার ছাদে চন্দ্রবিন্দু জেগে আছেন ভাষার আর্তনাদে।” ভাষার জন্য এতো সংগ্রাম এতো আন্দোলন তবুও কোথায় যেন বাংলা ভাষার প্রতি অবহেলা অন্য ভাষার প্রতি প্রীতি কবি হৃদয়কে ব্যথিত করেছে। ‘তুলার হরিণ’ কবিতায় কবিকে শৈশবের স্মৃতিকাতরতায় নস্টালজিক হয়ে পড়তে দেখা যায়। কবি জানেন শৈশবের দিনগুলো কখনো আর ফিরে পাবেন না তবু সেই চিত্রকল্পকে শব্দতুলিতে নিয়ে আসলেন আর না ফেরার মতো জগতের চরম সত্য অনন্তে লীন হবার সাদৃশ্যতা প্রকাশ করলেন অনন্য শৈল্পিক ভঙ্গিতে ; “থামাতে পারি না তাকে শৈশব সুতলি বাঁধা বিশ্বাসের ঘুড়ি কেটে যায় ক্যালেÐারে ঝরাপাতা, আমি আর থামাতে পারি না।… পৃথিবীর বিরাট মেলায় কেউ আসে কেউ যায়,ফিরে আর আসে না কখনো।” চঞ্চল চিত্তের অর্থাৎ মনের গতিকে অবলোকন করতে গিয়ে দেখলেন অশান্ত এ মনকে দেখলেন অনিদ্রায় জেগে আছে মনও। এখানে এক বিরাট দর্শনের ইঙ্গিত দিয়ে গেলেন। বৌদ্ধ দর্শনে ‘নাম’ আর ‘রূপ’ নিয়েই তো জীবন যেখানে চিত্তের বা মনের গতি খুবই জটিল ঘোরে আবর্তিত তাকে বশীভ‚ত করা চাট্টিখানি কথা নয়, অথচ এ মনের কারুকাজ দেহকে কেন্দ্র করে। তাই ‘আমার মন ‘ কবিতায় কবিকে বলতে দেখা যায় ; ” ঘরের প্রতিটা বাল্ব এখন গভীর ঘুমে, শুধু জ্বলে নিকোটিন বিষ।/ ‘ আমাকেও একটান দিও।’ হঠাৎ চমকে উঠি – কে? কে? দেখি অন্ধকারে বদমাশটা বসে আছে কোণের সোফায় হাঁটু মুড়ে।” রসিকতায় মোড়ানো শব্দকাব্যে নিজেকে বিশ্লেষণ করলেন কবি ক্যারিশমেটিক প্রজ্ঞায়। অনিদ্রার চারণ ভ‚মিতে কবি নিজেকে যেন নিরন্তর খুঁজে চললেন স্মৃতিকাতরতায় আবরিত জীবনকথার দৃশ্যভ‚ম, গল্প বলার ছলে। কবির কবিতা সম্প‚র্ণ ভিন্ন আদলের মূর্তের ভেতরে বিম‚র্ত আলোড়ন। ‘শ্যাম কবিরাজ বিল্ডিং ‘কবিতা কবির এক সময়ের প্রতিদিনকার যাপিত জীবনে জুড়ে থাকা হারিয়ে যাওয়া একটা আখ্যান। জীবনের সেই দিনগুলো কবি খুঁজে পেতে চাইছেন অনন্য ভাবাবেগে। কবির প্রেম, ভালোবাসার প্রাচীন ছবি প্রেয়সীর বিস্মৃত মুখ, চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গি বাজার এলাকার একসময়ের ঝুরঝুরে কবিরাজ বিল্ডিংকে ঘিরেই কবির কাব্যের কল্পচিত্র গড়ে উঠেছে। বিচিত্র সব উপাদান দিয়ে কবিতাটাকে জীবন্ত করে তুলেছেন অনন্য প্রমায়। শেষ লাইনটা টেনে আনলো ম‚র্ত চিত্রের মাঝে বিম‚র্ত ভাবনার এক অনন্য রসায়ন; “শ্যাম কবিরাজ, পায়ে পড়ি,বয়স কেড়ে নাও আমার সকল দুখের প্রদীপ সে চাবিটা দাও; চাবিটা দাও আমার খুলে দেখি। শ্যাম কবিরাজ, দোহাই লাগে নামটা আবার বলো আমার ডাকে উঠছে কেঁপে কর্ণফুলির জলও।”
৪)
প্রেম, বিরহ, দুঃখ, কষ্ট আনন্দ বেদনা জীবন প্রবাহের একটা চলমান চিত্র। যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ’। কাল হলো সময় ও রঙের সংমিশ্রণ। কবি তারই একটা রূপকল্প আঁকলেন গভীর অনুভবে আর বোধে ‘শ্যামলীর ছায়া’ কবিতায়। দারুণ এক অধ্যাত্মবাদ কবিতার শেষ স্তবকে জানান দিয়ে গেলো। নাড়া দিয়ে গেলো জীবন তরঙ্গে ছায়ায় মায়ায় নৃত্যরত নানা অনুষঙ্গ। সবকিছুর অনিত্যতা দেখালেন জীবন সায়হ্নে, বললেন; “তুমি আরও বেঁচে থাকো,জীবনের তরী বেয়ে যাও;/ ঘাটের কিনারে গিয়ে একবার পেছনে তাকাও ঢেউ ছাড়া আর কিছু নাই।/ প্রেম বলো,কষ্ট বলো – এগুলো তো জীবনেরই টাকা আনা পাই।/ এরপর কবির দৃষ্টিতে দৃশ্যমান হলো রাজনীতি সংকটে ম‚হ্যমান দেশ ও জাতি। অস্থির অবস্থা প্রত্যক্ষ করে কবি দেখলেন কারো হাতে নেই এখন সুন্দরের প্রতি, উজ্জ্বল আলোকের মাঝে মুক্তির প্রেম। ধর্মেও বর্ণিত হয়েছে মানবপ্রেম আর মুক্তির জন্য কোন নবী আর আসবে না হযরত মুহাম্মদ (স.) হলেন শেষ নবী। এ সঙ্কটময় মুহুূর্তে কবি ভাবলেন একমাত্র কবিরাই পারে সুন্দরের সন্ধান দিতে, মুক্তির দিশা দেখাতে। কী সুন্দর অবলীলায় বলে ফেললেন; ” কারা খোঁজে উজ্জ্বল উদ্ধার। কার হাতে বাঁচার সম্বল আর কোন নবী আসিবে না, কবিরাই আসিবে কেবল। “পরাবাস্তবতার একটা ধারণা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে ‘ চন্দনকাঠের শান্তি ‘ কবিতায়। নান্দনিক এবং কুশলী শব্দের যূথবন্ধনে কবি শৈল্পিকতায় প্রকাশ করলেন মৃত্যু পরবর্তী দ‚রপ্রসারী চিন্তন। এ কবিতায় বৃক্ষের প্রতি গভীর প্রেম এবং বৃক্ষ নিধনের প্রতি বিরাগ এবং বিয়োগি সুর তুললেন কবিতায়;”নতুন আসবাবপত্রে ভরে যাচ্ছে ঘর, যদিও অপেক্ষা করে সাড়ে তিন হাত ক্ষুধার্ত কবর।… বনের সেগুনকাঠে ভরে আছে ঘর, কাঠ মানে বৃক্ষ নয়, বাস্তুচ্যুত পাখির কবর।… উৎসবের মোমবাতি একদিন নিভে গেলে পরে চন্দনকাঠের শান্তি আনতে ছুটে যাবে ঘুমের ভেতরে।” ‘তুমি শিল্প, তুমি অনিদ্রার কারুকাজ’একটা অসাধারণ কবিতা। কবি ‘ময়ুখ চৌধুরী’র কবিতা এতোই উপমা, প্রতীকী আর অলংকারে ঠাঁসা থাকে যে কবিতার বিষয়বস্তু সহজে বোঝা যায় না, ভেতর পড়া যায় না। দারুণ এক রহস্যময় নির্বাক শব্দপ্রতিমা দৃশ্যমান হয় তা ভাবায়, অনুভ‚তিকে দোলায়, বিস্মিত করে বৈকি। এই কবিতাও কবির আবেগতাড়িত প্রণয় কথার অংশ। যেখানে কবি তার স্মৃতিবিজড়িত প্রণয়কথা বলতে গিয়ে খোয়াবের বর্ণাঢ্য বিচিত্র মুদ্রায় সাজিয়েছেন প্রণয়ীকে। তাই আজ জীবন সায়হ্নে এসে তিনি সেই প্রতিমার সমগ্রতা ভেঙে বিস্মরণের দ্বার করলেন উন্মোচন, অনিদ্রার চারুতে নিয়ে এলেন সৃষ্টির কারুকাজ, আভাঙ্গা, অব্যক্ত বিষয়কে স্পষ্ট করে তুুললেন। আসলেই কবিতাই তো কবির মানসপ্রতিমা। জীবনের শেষান্তে এসে তিনি সময়ের কথাকলিগুলো একসাথে করে রূপকল্প তৈরি করলেন মেধার বিভ‚তি দিয়ে, আলো ছড়ালেন ফেলে আসা স্মৃতিময় মুহুূর্তের অলিতে গলিতে। জন্ম ও মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে বললেন; ” কতক্ষণ নিজের থাকো, ভ‚মিকাবিহীন থাকো সহজ সংসারে? / জীবনের তিনভাগ জল ঢেলেছ শিল্পের নামে দোফাল্লা টিকিটে।/ তারপর সচল ঘড়ির কাঁটার মতো বুকের স্পন্দন নিয়ে অন্ধকারে নির্ঘুম চিন্তনে নিয়ে আসে অসমাপ্ত কারুতার রোমন্থিত ফিরিস্তি। এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে নিদ্রা অনিদ্রার স্নায়ুতন্ত্রগুলো বেদখল হয়ে যায়। আত্মোপলব্ধি ডালপালা মেলে বিস্তারিত হয় ধ‚সর বিকেলে। নিজেকে চেনার সকল প্রচেষ্টা জেগে ওঠে ক্রমে ;” অনেক ধারণাগুচ্ছ বিক্ষিপ্ত তোমাকে দেবে জোড়া;/ মানুষ নামক এক প্রাণী ছিলে এই সংসারে এই সত্য তোমাকে জাগাবে এ শরীর থেকে যাবে নীল রাতে চ্যালেঞ্জের বশে। “কবি ‘ময়ুখ চৌধুরী’কে খুব কাছে থেকে দেখার এবং চেনার সৌভাগ্য আমার হয়েছে স্বাধীনতার পরে ৭৩/৭৪ এর দিকে লেখালেখির মাধ্যমে। অসাধারণ পাÐিত্যের অধিকারী এ কবির সান্নিধ্য পেয়ে নিজেকে গর্বিত মনে করি। আজ কবির কাব্যগ্রন্থ আলোচনা করতে গিয়ে নিজেকে ধন্য মনে করছি। কাব্যগ্রন্থের প্রতিটা কবিতা অনন্য দর্শনে সমৃদ্ধ, কালের পর কাল অতিক্রম করে যেন কালজয়ী। কবি ‘ময়ুখ চৌধুরী’ সত্যিকার অর্থে বাংলা কাব্যের বাবুই, চারুর ভিন্নতায় অসামান্য এক ধীমান কারু। কবিতার সংজ্ঞা অনুসারে যদি ‘শ্রেষ্ঠতম শব্দের শ্রেষ্ঠতম বিন্যাসই কবিতা হয় তাহলে’ অনিদ্রার কারুকাজ’ কাব্যগ্রন্থের সবগুলো কবিতা এমনভাবে সজ্জিত হয়েছে যেখানে স্পষ্ট হয়েছে ছন্দ, ভাব বা রস, উপমা, অলংকার নিয়ে শ্রেষ্ঠতম শব্দের শ্রেষ্ঠতম বিন্যাসে। নিদ্রাহীনতায় কবি বিবশ হননি বরং হয়েছেন সৃষ্টিশীল, তাতে দৃশ্যমান হয়েছে দেশপ্রেম, প্রকৃতিপ্রেম, কবির চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা স্মৃতিবিজড়িত জীবনের চরম বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। প্রত্যেকটা কবিতা জানান দেয় আলাদা বৈশিষ্ট্যমÐিত স্বাতন্ত্র্যের কথা। পরিশেষে আবারো বলতে হয় ‘ময়ুখ চৌধুরী’ বস্তুত আদ্যোপান্ত একজন কবি। কোন এক সাক্ষাৎকারে তাই হয়তো অবলীলায় বলতে পেরেছেন; “মানুষ কবিতার জন্য সময় দেয়, আমি কবিতার জন্য জীবনকে উৎসর্গ করেছি।” বইটির দৃষ্টিনন্দন ও দারুণ অর্থবহ প্রচ্ছদ করেছেন’ মোস্তাফিজ কারিগর’। অদ্ভুত সুন্দর মলাটে বইটি প্রকাশিত হয়েছে ফেব্রæয়ারি ২০২২ ‘চন্দ্রবিন্দু’ প্রকাশন থেকে। স্বাতন্ত্র্য স্বরের ও ভিন্ন স্বাদের কবি ‘ময়ুখ চৌধুরী’র ‘অনিদ্রার কারুকাজ’ কাব্যগ্রন্থ সংগ্রহে রাখার মতো আমি এর পাঠকপ্রিয়তা কামনা করছি।
লেখক ও প্রাবন্ধিক