গৌতম বিশ্বাস
হরষিত যখন বাগমারা গাঁয়ে ধান কাটতে যাওয়ার কথা বলেছিল তখনই ছিদামের চোখে ভেসে উঠেছিল বৌ পারুলের মুখখানা। কতদিন যে দেখা হয় না ওই মুখ। হিসেব করে দেখলো পুরোই দু’ দুটো বছর। দু’টো বছর কি আর কম দিন? কম সময়? অথচ একটা সময় প্রতিদিনই ওই মুখটা দেখা হত তার। ওই মুখ দেখেই ঘুমোতে যেত। আবার ঘুম ভাঙতো ওই মুখ দেখেই। অথচ আজ –
হরষিত বলেছিল,” সেই কবে কি হইচে তা ধইরে বস্যে থাকলি হয়? সে আছে বল্যে কী ওই গাঁয়ে যাওয়া যাবে না ছিদেম দা?”
একটা দীর্ঘশ্বাস আপনা থেকেই বেরিয়ে এসেছিল ছিদামের ভেতর থেকে। আকাশের দিকে তাকিয়েছিল ছিদাম। বলেছিল,” আমি সে কথা ভাবছি নে রে হরষিত।”
” তাহলি?”
” ভাবছি সে যদি আমার সামনে পড়্যে যায় তহন কি করবো আমি।”
” কি যে কথা কও না ছিদেম দা। সে কি আর এট্টুখানি গাঁ। তাছাড়া কাজের ফাঁক ই বা কুথা যে সে তুমার সামনে পড়বে।”
” তবুও।”
” তাহলি তুমি এক কাজ করো ছিদেম দা,আজ রাত্তির ডা ভাবো। অহনও তো দু’দিন আছে।”
সে রাতে অনেক ভেবেছিল ছিদাম। সারারাত যতবারই দুই চোখের পাতা এক করতে গেছে ততবারই চোখে ভেসে উঠেছে পারুলের মুখ। ঝকঝকে দাঁত। দু’ঠোঁটের কোণায় ঝুলে থাকা হাসি। সাবান ঘষা চুল। তার সেই চেনা গায়ের গন্ধটাও বুঝি ফিরে এসেছে বার বার।
অগত্যা সিদ্ধান্তটা নিয়েই নিয়েছিল ছিদাম।
পরদিন হরষিতের বাড়ি বয়ে গিয়ে বলে এসেছিল,” তোর কথা মতন অনেক ভাবলাম রে হরষিত।”
” তা কী ভাবলে তাই কও ছিদেম দা।”
” ভাবলাম কথা ডা তুই মন্দ কস নেই। অতবড়ো গাঁ। সে আমার সামনে পড়বে ক্যামনে। তাছাড়া কাজ ছেড়্যে আমিই কী আর পথে পথে ঘুইরে বেড়াবো?”
” তার মানে তুমি যাবা আমাগোর সাথে?”
” হঃ রে। কাজ না করলি খাবো কী? আমরা হলাম গে রুখুশুখু দ্যাশের মানুষ। চাদ্দিকি খটখটে মাঠ। জল জমিনের বড়োই অভাব এখেনে। খ্যাত আছে,ফসল নাই। খিদে আছে,ভাত নাই। ফি বচ্ছর এই সুমায়ডায়ই তো কাজে যাই আমরা। ফিরে আসি এক থোক ট্যাকা নিয়া। ওই ট্যাকায় কয়ডা দিন ভালোমন্দ খাতি পারি। গায়ে পছন্দ মতন দু’ডো পোশাক জড়াতি পারি। আড়কাঠিগের জেবনে এডাই তো সুখ। দু’ডো বচ্ছর এই সুখ থ্যিকে দূরি ছিলাম। আর থাকতি চাই নে। আমি যাবো রে হরষিত। তোগের সাথে যাবো।”
কথাগুলো বলে বুক ভরে শ্বাস নিয়েছিল ছিদাম।তখন বিকেল। বৈশাখের আরও একটা দিন শেষ হয়ে আসছে। আকাশের বুকে ভেসে থাকা খণ্ড মেঘের ডানায় ঝলকে উঠছে দিন শেষের ইশারা। ক্রমশ একটা খোলসের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে রোদ।
হরষিত বলেছিল,” আমরা কিন্তুক কালই যাচ্ছি ছিদেম দা রাতের মধ্যি সপকিছু গোছায়ে নিও।”
তা গুছিয়ে নিয়েছিল ছিদাম। গরীব গুর্বো মানুষ সে। দিন কতকের জন্য বাড়ির বাইরে যাওয়া। তা কতটুকুই বা আর গোছানো লাগে তার। বাড়তি একটা লুঙি,একটা জামা,খান দুই গামছা,বিড়ি,দেশলাই,আর টুকটাক একটা দু’টো জিনিস। সেটুকু গোছাতে খুব বেশি সময় লাগেনি তার। একটু হাত চালিয়েই গুছিয়ে নিয়েছিল সে। এক সময় গোছানো হয়ে গেলে ঝ্ুঁঝকো আঁধারে ঘিরে নেওয়া বাড়ি জুড়ে যখন আরও একটু বেশি করে নির্জনতা নেমে এসেছিল তখন দুই চোখে সেই আঁধার মেখে দাওয়ায় এসে বসেছিল ছিদাম। গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে বয়ে আসা পূবের হাওয়া এসে অমনি ছুঁয়ে দিয়ে গিয়েছিল তাকে। আর সেই ছোঁয়ায় অনেকটা পেছনের দিকে হাঁটা শুরু করেছিল সে।
নিবারণ ঘটকের কথাটা আরও একবার মনে পড়ে গিয়েছিল ছিদামের। এমনি করেই একদিন এই ঘরের দাওয়ায় বাঁশের খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে বাপকে ডেকে ঘটক বলেছিল,” মেয়ে কিন্তু মন্দ নয়। গাঁয়ের রং টাই যা একটু চাপা। তা বলে তাকে কালো বলা যায় না মোটেই। বরং সেই চাপা রঙেই তাকে মানায় ভালো। একবার দেখলে ঠিকই পছন্দ হয়ে যাবে।”
বাপ বিড়ি ধরিয়ে তাতে আয়েস করে টান দিতে দিতে জিজ্ঞেস করেছিল,” তা কোন গাঁয়ের কথা কও য্যান?”
” কোন আবার,পাথরডাঙা। আমাদের পাশের গাঁ। সে মেয়েকে তো আমি ছোট থেকেই চিনি রে।”
” তা আমাগের সোংসারের অবস্থার কথা মেইয়ের বাপেরে কইছো তো?”
” তা আবার বলিনি। সব শুনেই তো সে রাজি হয়েছে।”
” তাহলি – ”
” তাহলে কী?”
” খানিক থেমেছিল বাপ।আড়চোখে একবার তাকিয়েছিল মায়ের দিকে।তারপর বলেছিল,” তাহলি ওগের দিন দিতি কও। আমরা দেহে আসি গে।”
যে দেখায় শুরু সেই দেখাতেই শেষ। ওখানেই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল ছিদামের। শরীর,মনে ভরা যৌবন তখন তার। বৌ পেয়ে বেজায় খুশি সে। সারাদিন খেটেখুটে এসে এক দন্ড বৌকে ছাড়া থাকতে পারে না। কাজে গেলেও বার বার তার মুখটা মনে পড়ে। মন টা আনচান করে। ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে ওঠে ছিদাম।
তা বৌকে বড়ো ভালোবাসতো সে। পারুলের সান্নিধ্য তাকে সুখের সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে যেত বার বার। তেমনই ভেসে যেতে যেতে একদিন ছিদাম পারুলের বুকে মুখ রেখে বলেছিল,” আমারে তুমি ছাড়্যে যাবা না তো কুনোদিন? তুমারে ছাড়া আমি কিন্তুক বাঁচপো না।”
এক ঝটকায় ছিদাম কে হাত খানেক সরিয়ে দিয়ে পারুল বলেছিল,” খালি অলুক্ষুনি কথা। সরো,সরো।”
কপট রাগের ভান করে পাশ ফিরে শুয়েছিল পারুল। হাত বাড়িয়ে টেনে তাকে নিজের দিকে ঘোরাতে ঘোরাতে ছিদাম বলেছিল,” কি করবো কও।তুমারে যে বড়ো ভালোবাসি আমি। তাই তো – ”
” অত ভেব্যো না তো। ওই সপ ভাবার আগে য্যান মরণ হয় আমার।”
সে ছিল ফাল্গুনের এক মন কেমন করা রাত। গাঁ-গেরামের রাত। সন্ধে উতরোতে না উতরোতে তা গাঢ় হয়ে আসে। খেটে খাওয়া মানুষ গুলো বিছানার সান্নিধ্য পেতে ছটফট করে। আর একবার তা পেতেই নির্জনতায় ঘিরে আসে চারপাশ। তেমনি এসেছিল সেদিনও। তবে পূর্ণিমার রাত বলে আকাশ জোড়া একটা চাঁদ ছিল সেদিন।আর ছিল সব ধুয়ে দেওয়া জ্যোৎস্না। সেই জ্যোৎস্নায় গা ধুয়ে আঁধারটাও ফিঁকে হয়ে এসেছিল অনেকখানি। গাছপালার ফাঁক দিয়ে বয়ে আসা দক্ষিণের হাওয়ায় ছিল আমের বোলের গন্ধ। ঘরের পেছনের নন্দ গুড়ের তেঁতুল গাছের ডালে ডেকে ওঠা পেঁচার আওয়াজ ছাড়া চারপাশের সবই ছিল নৈঃশব্দের চাদরে মোড়া।
সেদিনের সেই নৈঃশব্দ্যকে বড়ো ভালো লেগেছিল ছিদামের। মনে হয়েছিল তার বৌ টা আর পাঁচটা বৌয়ের মত নয়। অন্যদের থেকে সে অনেকটাই আলাদা হ্যাঁ,আলাদাই বটে।না হলে এমনি করে নিজের স্বামী, সংসার, বাড়িঘর, গাছপালা ছেড়ে পরপুরুষের সংসারে গিয়ে ওঠে?
বছর দুই হয়ে গেল পারুল নেই। ছিদামের হাত ছেড়ে অন্য হাত ধরে চলে গেছে সে।তার যেমন নতুন স্বামী হয়েছে,তেমন নতুন ঘর হয়েছে। নতুন সংসার হয়েছে। আর ছিদাম-সে পড়ে রয়েছে সেই ভাঙা ঘরে। সেই ঘর,উঠোন,গাছপালা আর স্মৃতিকে আঁকড়ে বেঁচে আছে একাই। অতীতকে সে ভুলতে পারেনি এতটুকু। আর তাই আড়কাঠির জীবনটা সে ছেড়েই দিয়েছিল। গেল বার হাজার চেষ্টা করেও কেউ নিয়ে যেতে পারেনি তাকে।সবাইকেই সে বলেছে,” ওই কাজে আমি আর যাবো না রে।”
” ক্যান? যাবা না ক্যান?”
” যে কাজ কত্তি গে আমি সপকিছু হারায়ে ফ্যাললাম,সেই কাজ আমি ফের করি ক্যামনে?”
” আচ্ছা ছিদেম দা – ”
” ক। ”
” আরেট্টা বে করলি হয় না?”
একটা ফ্যাকাসে হাসি দু’ঠোঁটের কোনায় ঝুলিয়ে ছিদাম বলেছে,” কি যে কথা কস না তোরা।ওরে বে করলিই কি আর আমার হারায়ে যাওয়া জিনিস আমি ফেরত পাবো?না রে।আমি হলাম ঘর পোড়া গোরু।সিন্দুরে ম্যাঘ দেখলিও ভয় হয় আমার।”
গেল বার সারা গাঁয়ের মানুষ যখন ঘর সংসার ফেলে বৌ-স্বামী-ছেলেমেয়ে মিলে একটু সুখের আশায় অনেকখানি পথ পাড়ি দিয়ে পূবদিকের গাঁ-গেরামে গিয়ে উঠেছে তখন ছিদাম রয়ে গেছে তার বাড়ি। সেই ভাঙা ঘর। রুখুশুখু গাঁ। নীরস মাটি।কিন্তু মন তাকে কেবলই টেনে নিয়ে গেছে সেই গাঁয়ে।গা-গতরে একটু বেড়ে ওঠার পর থেকে যে গাঁয়ে গিয়ে উঠেছে বছরের পর বছর। এমনই জায়গার মানুষ ছিদাম যেখানে না ফলে তেমন ফসল,আর না আছে ভালো কোনও কর্মসংস্থানের উপায়। বাঁজা মাটি এখানে বড়োই নীরস। অগত্যা পূবের দিকে ধানকাটা মরশুম শুরু হলেই গাঁয়ের পর গাঁ উজাড় করে মানুষ ছোটে সেদিকে। সেখানে গিয়ে আশ্রয় নেয় অবস্থাপন্ন সব গৃহস্থের বাড়িতে। সেই বাড়িতে থেকে তাদের জমি থেকে ধান কাটে।ধান ঝাড়ে।সোনালি ফসলকে কৃষকের গোলায় তুলে দিয়ে তবেই ছুটি। ততদিন কেবল কাজ আর কাজ।
বিয়ের পর প্রথম বছরটা বাদ দিয়ে পর পর দু’বছর বৌকে নিয়েই আড়কাঠির কাজে গিয়েছে ছিদাম।গিয়ে উঠেছে রাধেশ্যাম বিশ্বাসের বাড়ি। প্রতিবারই অন্তত মাস খানেক করে থেকেছে সেখানে। তারপর ফিরে এসেছে একসঙ্গে অনেকগুলো টাকা নিয়ে।
দু’দুটো বছর পারুল ফিরে এলেও তৃতীয় বছরে আর ফেরেনি।বাড়ি ফেরার আগের রাতেই –
অনেকদিন পরে ফের একবার সেদিনের কথা মনে পড়তেই ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এসেছিল ছিদামের। শরীরটাকে বাঁশের খুঁটিতে পুরোপুরি এলিয়ে দিয়ে আকাশের জ্বলজ্বলে তারাগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিল ছিদাম।আরও বেশি করে মনে করতে চাইছিলো পারুলের মুখখানা।আরও একবার সেই ঠোঁট জোড়া হাসি দেখতে বড়ো সাধ জাগছিলো তার।
পরদিন সকাল সকাল বেরিয়ে পড়েছিল ছিদাম রা।কম দূরের পথ তো আর নয়। প্রথমে বাস। তারপরে ট্রেন। ট্রেন থেকে নেমে আবারও বাস। শেষে আবার পায়ে হাঁটা। সন্ধের মুখে ছিদাম রা পৌঁছে গিয়েছিল বাগমারা। গাঁয়ের একেবারে মাঝখানে বাড়ি রাধেশ্যাম বিশ্বাসের। ইটের দেয়াল,দেয়ালের ওপরে ঢেউ টিনের ছাউনি দেওয়া বেশ বড়োসড়ো একখানা ঘর। পাশাপাশি অনেকগুলো খোপ তাতে।ঘর ছাড়িয়ে ডানদিকে নামলেই জমির শুরু। পাকা ধানে উপচে পড়ছে খেত। বিশ্বাস মশাই ছিদাম কে দেখে বলেছিল,” যাক,ফের তাহলে এলি।”
মুখ তুলে তাকানোর মত অবস্থা তখন নয় ছিদামের। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল সে।
বিশ্বাস মশাই ফের বলেছিল,” তোরা চলে যাওয়ার দিন দশেক পর ফিরে এসেছিল তোর বৌ। খবর পেয়ে গেছিলাম। অনেক করে বুঝিয়েছিলাম তাকে। কে শোনে কার কথা। মাথা নেড়ে সে বলেছিল অমন রুখুশুখু গাঁয়ে সে আর ফিরবে না।সেখানে নাকি কেবল খিদে। বেঁচে থাকাই দায়।”
বলতে বলতে থেমে গিয়েছিল রাধেশ্যাম বিশ্বাস। তারপরে বেশ দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলে বলেছিল,” এখন সে বুঝছে। যার হাত ধরে সে গিয়েছিল সে তো আর মানুষ নয়। পাঁড় মাতাল। যা আয় করে তা নেশাভাঙ করেই উড়িয়ে দেয়।সময় অসময়ে ধরে ধরে মারে।না রে ছিদাম, একেবারেই ভালো নেই সে। এই তো দক্ষিণ পাড়ায় খালপাড়ে তার বাড়ি। নিজে গতর খাটিয়ে দু’বেলার খাবার জোগাড় করতে হয় তার। শুনছি নাকি মাঝে মাঝেই বিলাপ করে কাঁদে। কিন্তু কেঁদে আর কি হবে এখন।সে তো এখন – “”
শুনতে শুনতে কোথায় যেন একটা কষ্ট ঠেলে উঠেছিল ছিদামের।আরও একবার তার দু’চোখে ভেসে উঠেছিল সেই চেনা মুখখানা। তবে সেই মুখে আগের মত হাসি ছিল না। ছিল কীসের যেন এক আকুল আহ্বান।
অপেক্ষায় ছিল ছিদাম। দিনান্তের কাজ শেষ করে সবাই যখন ক্লান্ত শরীরটাকে জুড়োনোর জন্য রাধেশ্যাম বিশ্বাসের শান বাঁধানো ঘাটের সিঁড়িতে গিয়ে বসতো ছিদাম তখন বেরিয়ে পড়তো রাস্তায়। ঝুঁঝকো আঁধারে ঢেকে থাকা রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে যেত খালপাড়ের কাছাকাছি। কিন্তু পুরোপুরি যাওয়া হত না কোনওদিন। একটা ভয় এসে ততক্ষণে তার পা দু’টে টেনে ধরতো যেন। ফিরে আসতো ছিদাম। বুকের ভেতরে ঠেলে ওঠা কষ্ট টা ততক্ষণে দ্বিগুন হয়ে রক্তাক্ত করে দিতে শুরু করতো ছিদাম কে।
ব্যাপারটাকে লক্ষ্য করেছিল হরষিত। ছিদাম কে একপাশে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল,” পত্যেক দিন কুথায় যাও গো ছিদেম দা?”
খানিক বুঝি চমকেই উঠেছিল ছিদাম। সামলে নিয়ে বলেছিল,” কুথা আবার।যা গরম পড়িছে। তাই এট্টু রাস্তা দে হেঁট্যে আসি। গায় গতরে হাওয়া লাগাই।”
হরষিতের গলায় ছিল সন্দেহ,” নাকি তুমি বৌদির খোঁজে – ”
হরষিতকে শেষ করতে না দিয়ে ছিদাম বলেছিল,” কি যে কথা কস না হারু। তার সাথে আমার কী?”
” রাত বিরেতে অমন যাইও না ছিদেম দা। সেই মানুষ ডা নেকি ভালো না। কহন কোন বেপদে – ”
কাল সারা রাত দু’চোখের পাতা এক করতে পারেনি ছিদাম।যতবার চোখ বন্ধ করেছে ততবারই ভেসে উঠেছে পারুলের মুখ। কান্না ভেজা দু’টো চোখ। সেই চোখে কীসের এক আকুল আহ্বান। সেই আহ্বানে বার বারই সাড়া দিতে ইচ্ছে হয়েছে ছিদামের। ছুটে যেতে ইচ্ছে হয়েছে তার কাছে। আর যতবারই তা হয়েছে ততবারই বুকের ভেতরে একটা হাহাকার শুনতে পেয়েছে ছিদাম।
অগত্যা –
ছিদাম এখন দাঁড়িয়ে আছে খালপাড়ের বড়ো কলাঝাড়টার আড়ালে। সামনেই ফালি উঠোন। উঠোন পেরিয়ে মুলিবাঁশের বেড়ার ওপরে টিনের ছাউনি দেওয়া ছোট্ট একখানি ঘর। ঘরের চাল ছুঁয়ে হিমসাগর আমের ডালের আড়ালে আঁধারের মাখামাখি। সন্ধে উতরে রাত্রি নেমেছে। আকাশে চাঁদ নেই বলে আঁধারটা বেশ গাঢ়। খুব বেশিদূর দৃষ্টি চলে না। তারই মধ্যে ছিদাম অবশ্য বেশ দেখতে পাচ্ছে ঘর খানা। ঘরের দাওয়ায় ছড়িয়ে থাকা আঁধারে একটা মেয়ে মানুষের ছায়ামূর্তিও বেশ দেখতে পাচ্ছে। কি করছে মানুষটা?আচ্ছা,ওটাই কি পারুল?”
প্রশ্নটা উঁকি দিয়ে যেতেই সারা শরীরে কীসের একটা স্রোত বয়ে গেল ছিদামের। নিঃশ্বাস ঘন হয়ে এলো তার। বুকের ভেতরে হাঁপরের টান অনুভব করলো ভালো মতই। নিজেকে আর ধরে রাখতে পরলো না ছিদাম। চারপাশ আরও একবার ভালো করে দেখে নিয়ে পায়ে পায়ে আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো সে।
এদিকে সেই ছায়ামূর্তিও ততক্ষণে দাওয়া ছেড়ে উঠোনে নেমে এসেছে। আর পায়ে পায়ে গোয়ালের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মাত্রই আর হাত কয়েকের ব্যাবধান। এবার বেশ চিনতে পারলো ছিদাম। পারুল। হ্যাঁ,পারুলই। এক অসহ্য রকমের খুশিতে উদ্বেল হয়ে উঠলো ছিদাম। তার অজান্তেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো শব্দটা,” শোনছো?”
চমকে উঠে থমকে দাঁড়ালো পারুল। কতদিন পরে চেনা কন্ঠ টা কানে গেছে তার।
ততক্ষণে ছিদাম তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।অথচ যেন বিশ্বাসই করতে চাইছে না পারুল। সে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠলো,” ত – তুমি?”
” হঃ,আমি। বিশ্বেস হচ্ছে না?”
” না,মানে – ”
শেষ করতে পারলো না পারুল। তার আগেই ঘর থেকে তার বুড়ি শ্বাশুড়ি গলা তুললো,” ও বৌমা,কার সাথে কথা কও?কেডা আইছে বাড়িত?”
ঈষৎ গলা চড়িয়ে উত্তর দিল পারুল,” কই,কেডা?কেউ না তো।”
” মদনা আলো নি?”
” কি যে কথা কও। অহন কি তার আসার সুমায়?
দাঁড়ালো না পারুল। ছিদামের হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল গোয়ালের পেছনে। এখানেও পাশাপাশি বড়ো বড়ো দু’দুটো কলাঝাড়। ঝুঁঝকো আঁধার আঠার মত লেগে আছে তাদের গায়ে। গোটা কতক জোনাকি আর মাথার ওপর আকাশের তারা ছাড়া কোনই আলোর অস্তিত্ব আর এখানে নেই। তবুও যেন পারুলের মুখখানা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ছিদাম। সে তাকিয়ে রইলো পারুলের দিকে।
পারুল জিজ্ঞেস করলো,” কি দ্যাহো?”
ছিদাম উত্তর দিল না। উল্টে জানতে চাইলো,” ক্যামুন আছো?”
চুপ করে রইলো পারুল। ঘাড় কাত করে একবার শুধু আকাশের দিকে তাকালো বুঝি বা।
ছিদাম ফের জিজ্ঞেস করলো,” কথা কও না ক্যান? ক্যামুন আছো?”
এবার আর চুপ করে থাকতে পারলো না পারুল। বেশ জোরেই ছিদামের দু’টো হাতই চেপে ধরলো সে। তারপর ভিজে আসা গলায় বলল,” ভালো নাই আমি। এট্টুও ভালো নাই। বড়ো ভুল করিছি গো। আমারে তুমি মাপ কইরে দেও।”
বলতে বলতে কেঁদেই ফেললো পারুল।কতদিন পরে যে একটা ভালোলাগা টের পাচ্ছে ছিদাম। পারুলকে জড়িয়ে ধরে বুকে টেনে নেওয়ার বড়ো সাধ হল তার। কিন্তু নিল না। বরং দাঁড়িয়ে রইলো পাথরের মত।
কাঁদতে কাঁদতে পারুল বললো,” তুমি আমার উপর রাগ কইরে আছো,না?তা তো করবা ই। আমি যে – ”
পারুলের কান্নায় ছিদামের চোখ দুটো ভিজে এলো। কিন্তু কাঁদলো না সে। আলতো করে পারুলকে কাছে টানলো ছিদাম। বললো,” উঁহুঃ,আর কুনো রাগ নাই আমার।”
” তাহলি তুমি নিয়া চলো আমারে।”
খুশির একটা ঢেউ আছাড় খেল ছিদামের বুকে। সে বলল,” তুমি যাবা আমার সঙে?”
” হঃ,আমি আবার ফিইরে যাতি চাই আমার সেই পুরোন সোংসারে। আমার সেই বাড়িঘর,সেই গাছপালা, সেই উঠোন,সেই মাঠ,সেই আকাশের কাছে।”
শুনতে শুনতে ছিদামের চোখে ভেসে উঠছে তার ঘর,উঠোন,মাটির দাওয়া, সন্ধে নামা,সাঁঝ প্রদীপ, ধুনোর গন্ধ।
কখন যে ঘোরের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে মাঠে নেমে পড়েছে তারা তা দু’জনের কেউ টেরও পেল না।।
গৌতম বিশ্বাস, কথাসাহিত্যিক, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত