এখন সময়:দুপুর ১:৩৯- আজ: মঙ্গলবার-২৫শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-১১ই চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-বসন্তকাল

এখন সময়:দুপুর ১:৩৯- আজ: মঙ্গলবার
২৫শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-১১ই চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-বসন্তকাল

আমার ছেলেবেলার কানুদি 

প্রবীর বিকাশ সরকার

১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধ হয়েছিল। আগস্ট মাসে শুরু সেপ্টেম্বর মাসে বিরতি হয় বৃটেনের হস্তক্ষেপে। আমি তখন মাধ্যমিক স্কুলের ছাত্র। মনে আছে, শহরে সান্ধ্য আইন জারি করা হয়েছিল। সন্ধ্যার পর কেউ বাইরে বের হতে পারত না। রাতের বেলা অন্ধকার থাকত পুরো শহর। তখন এমনিতেই বিদ্যুৎ ছিল না ঘরে ঘরে। ভুতুড়ে ছিল শহরের পরিবেশ। মাঝে মাঝে সাইরেন বাজত ভোঁওওও শব্দ করে দীর্ঘক্ষণ। ভয় পেতাম আমরা। সন্ধ্যার পর মানুষজন খুব একটা বাইরে যেতও না। লোকসংখ্যাও ছিল খুবই কম। তাছাড়া যুদ্ধ চলছিল পশ্চিম পাকিস্তানের দিকে প্রধানত পাঞ্জাবের কাশ্মির অঞ্চলে। পূর্ব পাকিস্তানে প্রভাব তেমন ছিল না।

কিন্তু যুদ্ধের পর সীমান্তের প্রহরা খুব কড়াকড়ি করা হল। সহজে আর দুই দেশের মানুষ যাতায়াত করতে পারত না। লুকিয়ে লুকিয়ে বনজঙ্গল দিয়ে গোমতী নদী পার হয়ে যাওয়া-আসা করতে হত। কারণ ১৯৪৭ সালে ভারতভাগের সময় এপারের বহু হিন্দু ওপারে এবং ওপারের মুসলমানও বেশকিছু এপারে বসতি গড়েছেন। কলকাতা, পাঞ্জাব, লাহোর, করাচি প্রভৃতি বড় বড় শহরে নির্মম দাঙ্গা হয়েছিল, প্রচুর নিরপরাধ মানুষ খুন হয়েছে, ধনসম্পদ  খোয়া গেছে। ইতিহাসে কুখ্যাত হয়ে আছে এই হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা ও হত্যাযজ্ঞ। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের অনেক হিন্দু পরিবার নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে শুরু করে।

অনেক ধনী পরিবার অবশ্য প্রভাবশালী মুসলমানদের প্ররোচনা ও ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে বাড়িঘর বিক্রি করে ভারতে চলে যেতে থাকে। তাদেরকে রক্ষা করা বা দেখভাল করার অবস্থাও তখন নেই কেননা, পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে তখন স্বাধীনতার আন্দোলন ক্রমশ দানা বাঁধছে, রাজনৈতিক অস্থিরতা বেড়েই চলেছে পাকিস্তানি সামরিক শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে। কে কার কথা ভাবে?

এমন অবস্থায় আমাদের পাড়ায় কয়েক ঘর ব্যবসায়ী হিন্দু পরিবার খুব ভয়ভীতি নিয়ে একরকম নিরাপত্তাহীনভাবে বসবাস করছিল। যুদ্ধের পর থেকেই এইসব হিন্দুরা দেশছাড়া শুরু করেন। বাবা ছিল তখন পুলিশ অফিসার। বিকেলবেলা অফিস থেকে ফিরে মাকে বলত,“আজও পলায়নরত কয়েকটি হিন্দু পরিবারকে আটক করা হয়েছে সীমান্তের জঙ্গলে। হিন্দুরা কেন চলে যাচ্ছে বুঝতে পারছি না! কী ভয় তাদের? মুসলিমরা যতই ভয়ভীতি দেখাক, অত্যাচার করুক, আমাদেরকে সাহস নিয়ে লড়াই করতে হবে! বলতে হবে, এই দেশ আমারও দেশ। এই দেশে আমার জন্ম। এই দেশে বসবাস করা আমার জাতিগত অধিকার!”

পড়ার ঘরে থেকে এসব কথা আমার কানে আসত। আমিও যে ভাবতাম না তা নয়। কিছুক্ষণ পর বাবা হতাশ কণ্ঠে আবার বলত, “কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতির যে অবস্থা কে বলবে এসব কথা? আর কেই বা শুনবে?” বাবার দীর্ঘশ্বাস আমার চেতনায় ধাক্কা দিত। আমিও ক্রমে ক্রমে হতাশ হতে লাগলাম, যখন আমাদের পাড়ার হিন্দুদের কয়েকজন বলাবলি করছে, ‘এই দেশের ভবিষ্যৎ নেই। ওপারে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।’

বড় ধাক্কাটি খেলাম যখন মা একদিন বিষণ্ন কণ্ঠে আমাকে বলল, “শুনেছিস? কানুর বাবা বাড়িটি বিক্রি করে দিয়েছে ইসকান্দর আলীর কাছে। ঐ যে নূরপুরে লোহালক্কড়ের কারখানা আছে যার। ওরা চলে যাবে আগামী বছরের জানুয়ারিতে। আর মাত্র ক’টা মাস। আহা! কত পুরনো সম্পর্ক আমাদের!” মা একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কানু মানে কাননবালা সরকার। বাবা-মা কানু বলে ডাকে, আর আমি ডাকি কানুদি।

আমি এতটাই আঘাত পেলাম যে, বোবা হয়ে গেলাম! কী বলছে মা! কানুদিরা ভারতে চলে যাবে! কেন? কী কারণে? তাদেরকে কেউ কি ভয় দেখিয়েছে? কেউ কি কিছু বলেছে? কই এমন তো শুনিনি এখন পর্যন্ত! তবে অনেকেই দেশত্যাগের কথা চিন্তা করছে এটা জানি। অরুণ, তপন, বিধান, নরেন, সত্য, সুখেন সমবয়সী হিন্দু বন্ধুদের মুখে অবশ্য শুনেছি যারা ধনী হিন্দু তারা ওপারে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন। হারুদার মিষ্টির দোকানে বসে রাজুদা, নির্মলদা, রুদ্রদা আর কালীপদ মাস্টারমশাই ইদানীং ফিসফাস করে দেশবদলের কথাবার্তা বলছেন। ইতিমধ্যে পাড়ায় এক নতুন পরিবার এসেছে একটি পরিত্যক্ত দুতলা দালানবাড়িতে। এটা বেশ কয়েক বছর খালিই ছিল, এক বৃদ্ধ দম্পতি নিচতলায় থেকে দেখভাল করত। কখন তারা চলে গেছেন টেরই পাইনি! এখন সেখানে মাসখানেক হল একটি মুসলিম পরিবার এসেছে পশ্চিম বঙ্গের বর্ধমান থেকে। বেশ বড় পরিবার, কমপক্ষে ১২-১৩ জন সদস্য। সবাই আধুনিক এবং কলকাতার ভাষায় সুন্দর বাচনভঙ্গিতে কথা বলে। প্রতিবেশীদের সঙ্গে জমিয়েও ফেলেছে তরুণ দুইভাই। বাড়ির মালিকের সঙ্গে সম্পত্তি অদলবদল করেই এসেছে শোনা যাচ্ছে। সত্যিমিথ্যে বলতে পারব না। শহরের কেন্দ্রস্থলে একটি বড় স্টেশনারি দোকানও দিয়েছে “দিলদার এন্টারপ্রাইজ” নামে, দুইভাই বসছে দোকানে।

স্কুলে যেতে-আসতে কানুদির সঙ্গে মুখোমুখি হই প্রতিদিনই। তিনিও স্কুলে যান পড়াতে, গিরিধারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাতৃভাষা আর মেয়েদের গৃহসজ্জার কাজ শেখান কয়েক বছর ধরে। কানুদির বয়স চল্লিশের কম নয়। বিয়ে করেননি। একমাত্র ভাই বড়দা সুকৃতি সরকার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে পড়ালেখা ও ডক্টরেট করে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষকতা করছেন। দু-তিনবার এসেছিলেন তখন দেখা হয়েছিল। এই পরিবারটি খুবই শিক্ষিত পরিবার, কানুদির বাবা এই শহরের বিখ্যাত আইনবিদ মধুসূদন সরকার। মা গিরিধারী স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষিকা। আমাদের পাড়ার খুব সম্মানিত পরিবার। যতখানি জানা যায় তাদের পূর্বপুরুষ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কোনো এক গ্রাম থেকে এসেছিলেন ব্রিটিশ আমলে।

দেখা হলেই সুন্দরী, দীর্ঘ সুঠামদেহী কানুদি হেসে বলতেন,“ভালো করে পড়ালেখা করছিস তো? ভালো রেজাল্ট করতে হবে কিন্তু! কিছু না বুঝলে বাড়িতে আসিস, বুঝিয়ে দেব।” এই আশ্বাস পেয়ে কম গিয়েছি কানুদির কাছে! গণিতে আমি বরাবরই কাঁচা ছিলাম, কানুদি কী সহজ করে নানা পদ্ধতিতে বুঝিয়ে দিতেন। তাই অংকে ভালোই নম্বর পেয়েছি। গেলেই চিড়া-মুড়ি-খইয়ের মোয়া, নারকেলের পেড়া আর ফলফসারি এনে আগে টেবিলে রাখতেন, বলতেন, “খেতে খেতে দ্যাখ্ কীভাবে অংকগুলো করছি। চিন্তার কারণ নেই। অংক হচ্ছে একটি গেইম, নানা পদ্ধতিতে খেলা যায়।”

যেভাবে আপন ছোটভাইয়ের মতন আদর-যত্ন করতেন আমাকে, পাড়ার আরও উঠতি ছেলেমেয়েদেরকে যে, কানুদিকে আমাদের নিজেদের বড় বোন বলে মনে হত। তার হাসিমুখ আর আঁচল কোমরে পেঁচিয়ে বাটার চামড়ার পাতলা স্লিপার পায়ে দিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে চলার ভঙ্গিমা ছিল অনুকরণীয়। ভালো ভালো ঘর থেকে বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল, কানুদি হাসিমুখে বিনম্রভাবে সব ফিরিয়ে দিয়েছেন। এমনকি, বেশ কিছুদিন বাড়ির ফটকে একটি সাইনবোর্ড লাগাতে বাধ্য হয়েছিলেন, তাতে লেখা ছিল “ঘটকের প্রবেশ নিষেধ”, আর তাই নিয়ে কী তোলপাড়! কী হাসাহাসি পাড়ায়! তখন ঘটকদের খুব উৎপাত ছিল সমাজে।

কানুদি শুধু যে স্কুলে পড়াতেন তা নয়, ছুটির দিনে বাড়িতে এই পাড়াসহ অন্যান্য পাড়ার উঠতি মেয়েরা এসে নতুন ডিজাইনের জামা, ব্লাউজ তৈরি করা, কুশিকাঁটা দিয়ে ঢাকনি, ছোট চাঁদর বোনা, উলের কাজ ইত্যাদি শিখত। বিনাখরচে শেখাতেন। বাসায় সিঙ্গারের সেলাই মেশিন ছিল চারটি। শেখানোতেই তার ছিল যত উৎসাহ আর আনন্দ। এরকম শিক্ষিকা শহরে আরও দু-তিন জনকে আমি দেখেছি, হিন্দু-মুসলিম মিলিয়ে। তারা সকল প্রকার অশিক্ষা, কুশিক্ষা আর কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ছিলেন। তাদের মধ্যে সম্ভাব ছিল, আন্তরিকতা ছিল। মাঝে মাঝে বিকেলবেলা তারা হাঁটাহাঁটি করতেন নানুয়া দিঘির পাড়ে, ঘাসে বসে গল্প করতেন। আমরা ভয়ে বা সমীহভরে সেদিকে যেতাম না। যথেষ্ট স্বাধীনতা ছিল তখন কুমিল্লার মেয়েদের। মহিলাদের দিকে চোখ তুলে তাকাত না কোনো ছেলে বা পুরুষ। তারা যথার্থ সম্মান ও সমীহর পাত্রী ছিলেন। স্কুল ও কলেজের ছাত্রীরাও বাইরে স্বাধীনভাবে বের হত, কেনাকাটা করত, শিশু সংগঠন, সাংস্কৃতিক করত, ছাত্ররাজনীতির সঙ্গেও জড়িত ছিল। পিতামাতারাও যথেষ্ট উদার ছিলেন। ফলে সাহিত্য, সঙ্গীত, নাটক, নৃত্য, অঙ্কন, ব্রতচারি তথা সংস্কৃতির যে রমরমা পরিবেশ ছিল তাকে সহজেই উৎসবের সঙ্গে তুলনা করা চলে। রাজনীতিও করতেন উদারপন্থী শিক্ষিত মানুষেরা। এরকম একটি পরিবেশ ছিল আমাদের বাল্যকালে। তারপরও হিন্দুরা শঙ্কিত ছিল দাঙ্গা-হাঙ্গামার ভয়ে, জানমাল হারানোর শঙ্কায়।

কানুদিরাও যে মনে মনে শঙ্কা পোষণ করতেন এটা জানাই ছিল না আমার! মার মাধ্যমে জেনেছিলাম। সে বছর পাড়ার বার্ষিক শিশু সাংস্কৃতিক উৎসব “গন্ধবনের ফুলকলি” অনুষ্ঠিত হল তিন দিনব্যাপী সেবারই আমি প্রথম লক্ষ করলাম, কানুদি কেমন যেন বিমর্ষ, বিষণ্ণ! তার মুখে ও হাতের সঞ্চালনে প্রাণ নেই, যেটা ছিল প্রতিবছর প্রাণবন্ত, সতেজ ও ব্যস্ততর। প্রতিবছর শীতের শুরুতে এই উৎসব বা সম্মিলনী হয়ে আসছে আমাদের শিশুকাল থেকেই দেখে আসছি। “গন্ধবনের ফুলকলি” সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতাদের প্রধানই ছিলেন কানুদি। উৎসবের মাস দুয়েক আগে থেকেই চাঁদা সংগ্রহ, মাঠ পরিষ্কার করা, দেয়ালিকা প্রকাশ, ডেকোরেশন, খাওয়াদাওয়ার আয়োজন নানা কাজে তার বিচক্ষণ নেতৃত্ব কী ভোলা যাবে কোনোদিন?

অনুষ্ঠানের শেষদিন সমাপনী ভাষণে তিনি হঠাৎ করেই কান্নায় ভেঙে পড়েন ভীষণ আবেগ প্রবণ হয়ে। যদিও দ্রুত সামলে নিয়েছিলেন নিজেকে, কিন্তু সমস্ত আনন্দ-আবহের মধ্যে কিছুক্ষণের জন্য শীতল একটা বিষণ্ণ বাতাস উপস্থিত সকলকে ছুঁয়ে চলে গেল। অনেকেই অবাক হয়ে গেলেন! আমার মন ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। কী এমন হল, জানার জন্য পরের দিনই স্কুল থেকে ফিরে কানুদির কাছে গেলাম। কানুদি ছাদে ছিলেন। নির্জন, বড় ছাদ। আম ও জাম গাছের শাখা-প্রশাখা শুয়ে আছে এদিক সেদিক। সন্ধ্যা হয় হয় এমন একটা নিথর পরিবেশ, পাখিরা কিচির মিচির করছে চারদিকে। সূর্য ডুবিডুবি, তার কমলা রঙের আভা এসে কানুদির মুখে, খোলা চুলে ঝিলিমিলি কাটছে। বেশ লাগছিল কানুদিকে। তিনি ছাদের রেলিং ধরে পশ্চিম দিকে দাঁড়িয়েছিলেন।

আমি ডাকলাম দু-তিনবার, কিন্তু শুনতে পেলেন না। নিবিষ্ট মনে নিচের পুকুরের দিকে তাকিয়ে আছেন। কী যেন ভাবছিলেন মনে হল। আবার যখন একটু জোরেই ডাকলাম, তখন চমকে পেছন ফিরে তাকালেন। দেখতে পেলাম তার দুচোখে জল টলমল করছে! কানুদি কি কাঁদছিলেন? কিন্তু কেন?

সেদিন যা বললেন তাতে আমার কিছুই বলার ছিল না, শুধু শুনেই যেতে হল, এবং নীরবে চোখের জল ফেলে একবুক শূন্যতা নিয়ে বাসায় ফিরতে হয়েছিল। শান্ত কণ্ঠে বলেছিলেন, “আমরা আর কয়েকদিন পরেই ভারতে চলে যাব প্রবীর। এইদেশে আর থাকা যাবে না। রাজনৈতিক অবস্থা ভালো নয়। আমাদের এই বাড়ি এবং গ্রামের সম্পত্তির ওপর নজর পড়েছে প্রভাবশালী কতিপয় রাজনীতিকের, তারা ভীষণ উগ্র, ভারতবিদ্বেষী। রবীন্দ্রবিদ্বেষী। নজরুলবিদ্বেষী। বাঙালিবিরোধী। গোপনে হুমকি-ধামকি চলছে, এখন চরমে উঠেছে। দাদা চাপ দিচ্ছে দেশত্যাগ করে কলকাতায় চলে যেতে। বাড়ি, সম্পত্তি বিক্রি করে যা পাওয়া যায় তা নিয়েই যেন চলে যাই। গ্রামের আত্মীয়স্বজন অনেকেই চলে গেছে ত্রিপুরায়। দাদা, বৌদি বলছে, বাবা-মার মৃত্যুর পর আমাকে কে দেখবে? এইসব তো বাস্তবতা প্রবীর, তুই ছোট হলেও বুঝতে কি পারছিস না? সারাদিন হাসিখুশি থাকি ঠিকই, কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমি একদম ভালো নেই রে! ভালো নেই ভাই! ভালো থাকতে আর পারছি না! মুক্তি চাই এবার! বুকের ভেতরে জলভর্তি বড় একটা মেঘের পাহাড় ঝুলে আছে, বৃষ্টি হলেই শান্তি পাব।”

সেদিন একেবারেই ভেঙে পড়লেন কানুদি। আমার দুচোখ থেকে অবিরল ধারায় জল নেমে এলো। কী বলছেন এসব কানুদি! বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না! তিনি এই পাড়া, এই শহর, এই দেশ ছেড়ে অন্যদেশে চলে যাবেন আমাদেরকে ফেলে চিন্তাই করতে পারছিলাম না! না না এটা কী করে সম্ভব! বাসায় ফিরে এসে মাকে জিজ্ঞেস করলে মা বলল,“আমরা তো জানি আগে থেকেই। সেদিন তোকে বললাম না! ভুলে গেছিস?”

এরপর প্রতিদিনের মতো কানুদির সঙ্গে পথে দেখা হয়েছে। কথাও হয়েছে। কিন্তু একদিন যে ঘটনা ঘটল তাতে যে আঘাত পেয়েছি, তা সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। যা আজও আমি ভুলতে পারিনি। ছুটির দিন, রোববার ছিল, বিকেলবেলা আমাকে ও বিধানকে ডেকে নিয়ে বেশকিছু দামি বই নিজের নাম লিখে আমাদেরকে দিয়ে দিলেন। তখন সেখানে ছিল শামীম তথা শামি। প্রতিবেশী হেলালউদ্দিন মির্জা সাহেবের ছোট ছেলে যার বয়স মাত্র ৪ বছর। শামির জন্মের পরপরই তার মা মারা যান। হেলালকাকা জীবন বীমা কর্পোরেশনে চাকরি করেন, খুব ব্যস্ত মানুষ সারাদেশ তাকে চষে বেড়াতে হয়। তার এক ছেলে শামি ও মেয়ে রেণু। রেণুআপা মহিলা কলেজে পড়ে। অনেক বছর পর ছেলে শামির জন্ম হয়েছে। হেলালকাকার স্ত্রী ছিলেন কানুদির খুব ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। তাই বান্ধবী যখন মারা গেলেন শামিকে লালনপালন করতে হচ্ছিল অনভিজ্ঞ রেণুআপাকে। তাই শামির জন্মের পর থেকেই রেণুআপার তত্ত্বাবধান করে আসছিলেন কানুদি। হেলালকাকা বাড়িতে ফেরেন না ব্যস্ততার কারণে সপ্তাহ, কখনো মাসও হয়ে যায়। কানুদি তার সন্তান দুটিকে দেখভাল করেন। কানুদির কল্যাণেই রেণু আপা লেখাপড়া করতে পারছেন। প্রতিদিনই রেণু আপা শামিকে কানুদি বা কানুদির মায়ের কাছে রেখে কলেজে যান। এত আদর করেন শামিকে কানুদি যেন নিজের সন্তান! শামিও কানুমাসির শাড়ির আঁচল ছাড়ে না। সময় পেলেই তাকে নিয়ে বেড়াতে বেরোতেন, স্কুলেও নিয়ে যেতেন কানুদি। আর শামিও দারুণ ফুটফুটে সুন্দর একটি ছেলে। গোলগাল মুখ, ছোট্ট নাক, বড় বড় মায়াবী চোখ, কুকড়ানো ঝাঁকড়া চুল মাথায়, স্বভাবে একেবারে শান্ত। ওর মুচকি মিষ্টি হাসি ভুবন ভোলানো বলে পাড়ার সবাই বলত। দেখলেই যে কেউ কোলে নিতে চাইত।

শামিকে জড়িয়ে ধরে অঝর ধারায় কাঁদছিলেন সেদিন কানুদি আমাদের সামনেই। শামি বলছিল,“তুমি কাঁদছ কেন? তোমারও বিয়ে?” কানুদি চোখের জল মুছতে মুছতে এপাশ ওপাশ মাথা নেড়ে বললেন,“না রে শামি। বিয়ে নয়! বিয়ে নয়! বিদায়! বিদায়!” বলে আরও জোরে চেপে ধরলেন বুকের মধ্যে তাকে। সে এক অভূতপূর্ব বেদনাদায়ক দৃশ্য! আমাদের চোখেও জল নেমে এলো। শামি কানুমাসিকে কাঁদতে দেখে মনে করেছে কিছুদিন আগে তার ছোট খালার মতো কানুমাসিরও বুঝি বিয়ে হবে তাই কাঁদছে, তার ছোট খালাও বিয়ের সময় কেঁদেছিল। কেঁদে কেঁদে সবাইকে ছেড়ে চলে গেছে।  সেই স্মৃতি তার মনে ভীষণ দাগ কেটেছে সন্দেহ নেই।

পরদিন সোমবার কানুদিকে দেখতে পেলাম না স্কুলে যাওয়ার পথে। বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত্ করে উঠল! দ্রুত কানুদিদের বাড়ির গলিপথের প্রবেশ মুখ থেকেই দেখতে পেলাম অদূরে বহুপুরনো হালকা হলদে রঙের বাড়িটির সবুজ রঙের দরজা ও জানালা সব বন্ধ। দ্রুত হেঁটে গিয়ে নীরব একতলা বাড়িটির অনুচ্চ সিঁড়ি টপকে সদর দরজার কড়ায় বড় একটি তালা ঝুলে আছে দেখতে পেলাম। সহসা বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠল আমার! গতকাল বিকেলে শামিকে বলা কথা কানুদির অশ্রুসিক্ত দুটি শব্দ “বিদায়”, “বিদায়” আমার মাথার ভেতরে তারস্বরে চিৎকার করতে শুরু করল! আমি দুকান চেপে শূন্য মনে বাসায় ফিরে এলাম। টের পেলাম কানুদির শূন্যতাটা কেবল গভীর এবং বিস্তৃত হয়ে চলেছে।

আমরা কতিপয় ছাড়া পাড়ার বা শহরের আর কেউ জানল না কানুদিরা দেশত্যাগ করেছেন গতকাল গভীর রাতে। কানুমাসিকে হারিয়ে শামি আরও শান্ত, প্রায় স্তব্ধ হয়ে গেছে যেন! একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম,“শামি, তোর কানুমাসি কোথায় রে?” সহসা উত্তর না দিয়ে, আস্তে আস্তে বলল,“আপু বলেছে, কানুমাসি বেড়াতে গেছে। আগামীকাল ফিরে আসবে।” কিন্তু, শামি তখনো জানত না যে তার কানুমাসি আর কোনোদিন ফিরে আসবে না।

 

প্রবীর বিকাশ সরকার, প্রাবন্ধিক ও জাপান প্রবাসী লেখক

লাহোর প্রস্তাব বিকৃতির কারণে একাত্তর অনিবার্য হয়ে ওঠে

হোসাইন আনোয়ার ২৩ মার্চ ১৯৪০। পাকিস্তানিরা ভুলে গেছে ২৩ মার্চের ইতিহাস। একটি ভুল ইতিহাসের উপর ভিত্তি করেই ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবস পালিত হয় সমগ্র পাকিস্তানে।

ইফতার পার্টি নয়, সেদিন যেন তারার হাট বসেছিল পিটস্টপে

রুহু রুহেল সমাজ ও সংস্কৃতির বড় পরিচয় সম্প্রীতির অটুট বন্ধনে সামনের পথে অবিরাম এগিয়ে চলা। সাম্য সুন্দর স্বদেশ গঠনের জন্য প্রয়োজন বিবিধ মত ও পথকে

নভোচারী সুনিতা মহাকাশে ফুল ফোটায় পৃথিবীতে নারীর পায়ে শেকল পরায় কে?

প্রদীপ খাস্তগীর চমৎকার একটি সফল মহাকাশ সফর শেষ হয়েছে গত ১৮ মার্চ মঙ্গলবার দিবাগত রাত ৩টা ৫৭ মিনিটে। গত বছরের ৬ জুন মাত্র ৮ দিনের

দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ: দর্শনের বিজ্ঞান

রাজেশ কান্তি দাশ দর্শনের ক্ষেত্রে বস্তু ও ভাবের দ্বন্দ্ব অতি প্রাচীন। খ্রিষ্টপূর্ব সময়ের। বস্তুবাদী দার্শনিকেরা মনে করেন বস্তু থেকে জাগতিক সব কিছুর উৎপত্তি। গ্রীক দার্শনিক

মানুষ ও মঙ্গল মানব

সরকার হুমায়ুন দুজন মহাকাশচারী- একজন পুরুষ এবং একজন মহিলা মঙ্গল গ্রহ অভিযানে গেলেন। তারা নিরাপদে মঙ্গল গ্রহে অবতরণ করেন। সেখানে তাদেরকে অতিথি হিসেবে মঙ্গলবাসীরা সাদরে