সৈয়দ মনজুর কবির
মাস খানেক হলো হামিম সাহেব সিরাজগঞ্জের এডিসি হয়ে এসেছেন। শহরের ভেতর সরকারি বাড়ি। দুসপ্তাহ আগে পরিবার নিয়ে এসেছেন। পরিবার বলতে স্ত্রী শারমিন জাহান আর সাড়ে তিন বছরের মেয়ে মিষ্টি। শারমিন ঢাকার পেয়ারাবাগের নানার বাড়িতে থাকেন। ওই বাড়িও কম বড় না। নানা নানির কাছেই বড় হয়েছে। ওনারা এখন বৃদ্ধ। আর ওনাদের বিশেষ অনুরোধেই হামিম সাহেব বিয়ের পর থেকে ওই বাড়িতে থাকছেন। ছোট্ট মিষ্টিকে আগামী বছরেই স্কুলে ভর্তি করলে ঢাকা ছাড়তেও অসুবিধা হবে। তাই এই সময়টুকু সিরাজগঞ্জে আসা যাওয়ার মাঝে থাকবে—এমনি ভাবনা দুজনেরই। সিরাজগঞ্জে এসে সাতদিন যেতেই ঢাকায় ফিরে গিয়েছিলেন শারমিন মেয়েকে নিয়ে। আজ সাতদিন পর আবার ঢাকা থেকে সিরাজগঞ্জ ফিরছেন।
যমুনা ব্রিজ পার হয়েই বাঁধলো বিপদের ঘনঘটা। এটাও হতো না যদি গাড়ি টাঙ্গাইলের দেড় ঘন্টা জ্যামে না পরতো। বিপদটা হলো মিষ্টিকে নিয়ে। এতটুকুন ছোট্ট মেয়ের কি হলো কে জানে, সে বাথরুম ছাড়া কিছুতেই হিসু করবে না। পথে দেরী হতে পারে ভেবে শারমিন মেয়েকে ডায়পার পরিয়ে এনেছেন। কিন্তু সেটাও এখন বিফল। মিষ্টি ভীষণ অস্থির হয়ে উঠে—বাথরুম তার লাগবেই লাগবে। তাও আবার পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। মেয়ের অস্থিরতার আঁচ শারমিনের মাঝেও ছড়িয়ে পড়ছে ক্রমান্বয়ে। হামিম সাহেব জানেন তার স্ত্রীর অস্থিরতা তাকে অসুস্থ করে তোলে। নানার কাছে শোনা কথা এটা সে পেয়েছে ওর মায়ের কাছ থেকে। ওর মায়েরটা অবশ্য বেশ বারাবাড়ি রকমেরই ছিলো নাকি! এটা মনে করতেই হামিম সাহেব ড্রাইভারকে একটু দ্রুত গাড়ি চালাতে বললেন। যতখানি সম্ভব গাড়ির গতি বাড়িয়েই চলছে, তবুও সিরাজগঞ্জ বাড়ি পৌঁছাতে আরো কমপক্ষে ঘণ্টাখানেক লাগবে। এদিকে মেয়ে তো অস্থিরের শেষ সীমায়। কান্নাটা বাদ ছিল, এখন সেটাও শুরু হয়েছে। হামিম সাহেব পড়লেন ভীষণ বিপদে। হঠাৎ তার মনে হলো কড্ডার কাছাকাছি যেতেই পথের পশ্চিমে একটা লোকালয় দেখেছেন। দেখেছেন মানে দেখতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ একটাই—ওই ছোট্ট সবুজ মাঠের মাঝে গাছ—গাছালিতে ভর্তি বাড়িটা। মনেই হচ্ছিলো সৃজনশীল কারোর পরিকল্পিত গড়া বাড়ি। মাঠের চারিদিকে ঘন নারিকেল গাছের বেষ্টনী। নার্সারি থেকে বেশ বড় গাছই এনে লাগানো হয়েছে বোধ হয়। মাঠে সবুজ ঘাস। একেবারে দক্ষিণ কর্নারে সুন্দর উঁচু বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা টিনের বড় চৌচালা বাড়িটি। বেড়ার ভেতরে চারদিকে অনেক ফলদ গাছ দশ ফুট উঁচু বেড়ার উপর দিয়ে মাথা তুলে দিয়েছে। সামনে মাঝ বরাবর দশ ফুট দৈর্ঘ্যের সুন্দর আকাশী রঙের লোহার টানা গেট। একটু হাস্যকরই বটে—কেননা বাঁশের বেড়াতে লোহার গেট! এতেই সবার চোখ আটকে যায় হাইওয়ে দিয়ে যাবার সময়। আরেকটা আকর্ষণ, সেটা হচ্ছে মাঠের সামনে উত্তরদিকের লিচু গাছের তলায় অপরূপ সুন্দর একটা টঙ দোকান। হাইওয়ে থেকে গ্রামের ভিতরে যাওয়ার আধা পাকা রাস্তার পাশে। মাঝে মধ্যেই উৎসুক যাত্রীরা গাড়ি নামিয়ে দেন সেখানে চা টা খেতে। হামিম সাহেব ভাবলেন, যদি ওখানে থামা যায়, তবে অনুরোধ করে ওই বাড়িতে মেয়েটাকে নিতে পারবেন। যার এতো সুন্দর রুচি, তার বাড়ির বাথরুমটাও নিশ্চয় তেমনই সুন্দর হবে। যেই ভাবা সেই কাজ। তিনি দেখলেন সামনেই বামে সেই বাড়ি দেখা যাচ্ছে। ড্রাইভারকে বললেন গাড়ি থামাতে ওই গ্রামের পথে আর থামাতে ওই টঙ দোকানের সামনে।
গাড়ি থামতেই হামিম সাহেব তড়িঘড়ি নেমে হাঁটা দিলেন টঙ দোকানে বসা লোকটার দিকে। কাছে যেতেই দেখা গেলো দোকানটি খুবই পরিপাটি করে সাজানো। চায়ের স্টলের পাশে মাচার ওপর নানা দেশীয় ফলে ভর্তি। কোনায় একটা উঁচু ফ্রিজ ভর্তি হালকা পানীয়। একদম ঝাঁ চকচকে পরিবেশ। টঙের সামনে ইউ প্যাটার্নে সাজানো বাঁশের তৈরি লম্বা বেঞ্চ। পশ্চিমের কোণার দিকে একজন পৌঢ় টাইপের মানুষ বসে আছে। দেখতে বেশ সম্ভ্রান্ত পরিবারের মতো। হামিম সাহেব তাড়াহুড়ায় খেয়াল করতে পারলেন না যে সেই লোকটি পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওনার পিছনেই নেমে আসা শারমিন আর মেয়ে মিষ্টির দিকে। অদ্ভুত সে দৃষ্টি — অসীম মমতায় ঘেরা।
হামিম সাহেব দোকানে বসা লোকটার কাছে গিয়ে বললেন, আস্সালামু আলাইকুম, চাচা। একটা কথা বলার ছিলো। আমার ছোট্ট মেয়েটার একটু বাথরুমে যাওয়ার প্রয়োজন। আপনার দোকানের পিছনের ওই বাড়িতে যাওয়ার কি কোনো ব্যবস্থা করতে পারবেন?
ওয়ালাইকুম আস্সালাম। মধ্যবয়স্ক লোকটা তাড়াতাড়ি উত্তর দেয়। আরে, কি বলেন। ছোট্ট মামনীর প্রয়োজন বলে কথা। দাঁড়ান, আমি দেখতেছি। বলে বেঞ্চে বসা সেই লোকটিকে বলল, কাকা ছোট্ট মেয়েটা বাথরুমে যাইতে চায়। তারে কি নিয়া যাবো ভিতরে?
হামিম সাহেব এবার মাথা ঘুরিয়ে ভালো ভাবে দেখলেন বসা লোকটিকে। বয়স আন্দাজ করা গেলো না। মুখের বড় বড় দাড়ি সব সাদা। সুন্দর পরিপাটি করে ছাটা। পড়নে সাদা লুঙ্গি আর গ্রামীণ চেকের মাল্টি কালারের ফতুয়া। ফতুয়ার পকেট দুটোই ফুলে আছে। তার মাঝে ছোট্ট নোটবুক আর বলপেনের মাথাও বেরিয়ে আছে।
লোকটা এক দৃষ্টিতে ওনার স্ত্রী আর মেয়েকে দেখছেন। দোকানদারের প্রশ্ন বোধ হয় উনি শুনতে পেলেন না। দ্বিতীয়বার বলার পর উনি হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। ও হা। ও হা। কেনো যাবে না, অবশ্যই যাবে। ওনার বাসায় উনি যাবেন নাতো কে যাবেন? যাও, তাড়াতাড়ি যাও, ওনার রুমে মানে দরজায় মিষ্টির ছবিওয়ালা রুম খুলে দাও। যাও, জলদি যাও। আর তোমার দেকানের ফল না বাড়ির গাছের পাকা কি কি ফল আছে সেগুলো কেটে রেডি করো তাড়াতাড়ি, কুইক। কথাগুলো বলেই মিষ্টির দিকে আদর মাখা হাসি মুখে বললেন, যান নানুমনি। তারপর শারমিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, সমস্ত ব্যবস্থা করা আছে বাথরুমে। কোনো অসুবিধা হবে না। নানুমনিকে নিয়ে যাও মা।
এটা ঘুণাক্ষরেও আশা করেনি শারমিন। হতবাক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো লোকটির দিকে। দেখে মনে হলো জীবনের পরম আনন্দের মাঝে আছেন তিনি। এদিকে মিষ্টির হাত টানাটানিতে কিছু বুঝে ওঠার আগেই মন্ত্রমুগ্ধের মতো মেয়েকে নিয়ে দোকানদারের পিছু পিছু বাড়িটির দিকে এগুতে থাকে। হামিম সাহেব মনে মনে ওদের একা ছাড়তে রাজি হলেন না। উনিও ওদের সাথে যোগ দিলেন।
বড় গেটটা দিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকেই ওরা বিষম হছকচিয়ে যায়। বাহিরে বাঁশের বেড়া থাকলেও ভেতরে ইটের দেয়াল। এর জন্যই বড় লোহার গেটটা তৈরী। বালির প্লাস্টারের জায়গায় নানা রঙের ছোট ছোট পাথরের আচ্ছাদন। যতদূর দেখা যাচ্ছে দেয়ালের ভেতর ঘেষে বিভিন্ন ফলের গাছ। ছোট বড় পাথরেরই তৈরি লম্বা একটা পথ বাড়িটির সুন্দর টানা বারান্দার সিঁড়িতে গিয়ে শেষ হয়েছে। পথটার দু’ধারেই দু’ফুট প্রস্থের টাইম ফুলের বেড। কত রঙের টাইম ফুল হতে পারে তা এই বেড না দেখলে বোঝাই যেতো না। আর উন্মুক্ত মাটি ঘন কার্পেট ঘাসে ছাওয়া। কি যে সুন্দর লাগছিলো শারমিন আর হামিম এর কাছে! মনে হচ্ছিল যেন আনন্দে চেচিয়ে উঠে। ছোট্ট মিষ্টি তার আনন্দ আর আটকে রাখতে পারলো না। সে চিৎকার দিয়ে হাতে তালি দিতে দিতে লাফাতে থাকে। তার মাঝে অস্থিরতা আর নেই। মায়ের হাত ছেড়ে লাফাতে লাফাতে সবুজ ঘাসে গিয়ে উঠে।
দোকানী লোকটি মানা করতে গিয়েও থেমে যায়। কারো জুতা পায়ে ঘাসে হাঁটা নিষেধ। কিন্তু আজকের ব্যাপারটা কেমন জানি মনে হচ্ছে তার। সাধারণত পরিচিত কেউ আসলে কাকা বারান্দার পূর্ব দিকে গেস্টরুমেই যেতে বলেন। এটাই বলতে গেলে মূল বাড়ির একমাত্র বাইরের ঘর। যার সাথে ভেতরের কোনো সম্পর্ক নেই। ছোট্ট মেয়েটির জন্য ভেতরের ঘরে যেতে বলেছেন, মানে বিশেষ কিছু। এটা ভেবেই লোকটা কিছুই বলল না। বরং হাসি মুখে বাচ্চাটির আনন্দ দেখতে থাকে। এভাবে কিছু সময় পরে ওরা সবাই টানা বারান্দায় উঠে আসে। এখানেও বিস্ময়। এতো কংক্রিটের ঢালাই করা বাড়ি। শুধু বাইরের অংশ টিনে আচ্ছাদিত। বারান্দার মেঝেতে ধবধবে সাদা টাইলস। এটারই মাঝ বরাবর আরেকটা বড় কারুকার্যময় কাঠের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকেই মাথা খারাপ হওয়ার অবস্থা। এ মাথা থেকে ও মাথা লম্বা আর প্রশস্ত করিডোর আলোয় আলোকিত। মাঝখানের ঘরটির সামনে স্বচ্ছ কাচের দেয়াল। ভিতরে ভারী পর্দা ঝুলছে, একপাশে গুটানো। ভেতরের আসবাব দেখেই মনে হচ্ছে ড্রয়িং রুম হবে। পশ্চিমে দুটি রুমের দরজা আর পূবে দুটি রুমের দরজা। লোকটা পুব দিকেই দেখিয়ে দিলো, ওই যে, ওই মিষ্টির ছবি ওয়ালা রুমে চলে যান। দরজা খোলাই আছে।
শারমিন মেয়ের হাত ধরে ওই রুমের দিকে যেতেই পথে দ্বিতীয় রুমের দরজার ছবি দেখে একটু থমকে দাঁড়ায়। ছবিতে তিনটা ধূসর মেঘের নিচে অজস্র ঝরে পড়া বৃষ্টির ফেঁাটা। ভারী অদ্ভুত! ছবিতে নাম লেখার প্রয়োজন নেই। দেখেই বোঝা যাচ্ছে “শ্রাবণ” বোঝাচ্ছে। কি অদ্ভুত! ভাবতে ভাবতে হঠাৎ শারমিন অন্যরকম হয়ে যায়। মনে পড়ে আট বছরের জন্মদিনের দিন ঢাকার বাড়ির গার্ড চাচা লুকিয়ে একটা উপহার এনে দিয়েছিল। সেটার ওপর এই ছবিটাই ছিল। নিচে লেখা ছিলো — মা তোর জন্য। অনেক চেষ্টা করে আজও গার্ড চাচার কাছ থেকে কে দিয়েছে তার তথ্য বের করতে পারে নি।
এদিকে মিষ্টির ছবিওয়ালা দরজায় এসে দাঁড়িয় সবাই। কি সুন্দর সুন্দর লোভনীয় মিষ্টির ছবি। দেখেই মিষ্টি বলে, উঠে বাবা মিষ্টি খাবো। মিষ্টি খাবো।
এমন আবদারে হামিম সাহেব একটু বিব্রত অবস্থায় পড়েন। এখন এই এমন জায়গায় মিষ্টি পাবেন কোথায়।
এখন এটা নিয়ে মিষ্টি আরেক অস্থিরতা না সৃষ্টি করে!
তবে পরক্ষণেই এটা থেকে মুক্তি পেয়েও যায় সহজেই। কারণ দরজা ঠেলে প্রথমেই মিষ্টি ঢুকে ঘরের ভেতরটা দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়। মিষ্টির বায়না যায় উড়ে। ঘরটির এক কোণায় সুন্দর নিচু বেড আর একপাশের পুরো দেয়ালেই ওয়াল টু ওয়াল আলমারি। আলমারি আর দেয়ালে অজস্র রঙিন ফুলের ছবি। এতো ফুল তবু্ও এতো স্নিগ্ধতা — অপরূপ। ফ্লোরে তুলতুলে গাঢ় সবুজ রঙের কার্পেট। একপাশে কত রকমের যে স্টাফ ডলে ভর্তি! মিষ্টি দৌড়ে গিয়ে পুতুলগুলোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সে রীতিমতো বাথরুমে যাবার কথা ভুলে গেছে। তারপরও শারমিন মোটামুটি টেনে নিয়ে গেলো অ্যাটাচ্ড বাথরুমে। কিছু সময় পরই মিষ্টির দারুণ অনিচ্ছা সত্ত্বেও শারমিনরা শুধু ওই রুম থেকে নয় বাড়ির বাইরেই সরাসরি বের হয়ে আসে। মাথায় অনেক রকম প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। পিছন থেকে দোকানী লোকটা ডাইনিং রুমে একটু বসে ফল আর মিষ্টি খাওয়ার অনুরোধ করেই চলেছে, আম্মারা একটু বসে যান। কিছুই না খেলেতো কাকা ভীষণ কষ্ট পাবেন।
এবার শারমিন একটু রেগে যান, কেনো চাচা? উনি কষ্ট পাবেন কেনো?
এমন প্রশ্নে দোকানী লোকটা একটু থতমত খেয়ে যান। তাড়াতাড়ি বললেন, আসলে কাকা মেহমানদের অনেক সম্মান করেন কি না। উনি বলেছিলেন আপনাদের গাছের ফল কেটে দিতে। সেই জন্যই বলা। তাই ভাবলাম আপনারা কিছু না খেলে হয়তো তিনি মনে কষ্ট পাবেন।
শারমিনের মনের ভেতরে এমনিতেই কেমন জানি অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে। আসলে এই বাড়িটি বেশ রহস্যময় লাগছে। এক দরজায় তার পরিচিত শ্রাবণ মেঘের ছবি, আবার আরেক দরজায় নানা রকম মিষ্টির ছবি। শুধু তাই নয়, রুমের ভেতর পুতুল দিয়ে ভর্তি। আর.. আর…ওই ছবি! এগুলোর মানে কি? মনের ভিতরের অস্থিরতা এখন বাইরেও প্রকাশ পেতে শুরু করলো দোকানী লোকটার কথায়। কি যেনো বলতে যাচ্ছিলো ঠিক তখনই হামিম সাহেব ওকে থামিয়ে দিয়ে দোকানীকে বললো, আচ্ছা আচ্ছা, চাচা, বাথরুম ব্যবহার করতে দিয়েছেন এতেই বিশাল উপকার হয়েছে আমাদের। আর আজকে এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেলো জ্যামে পড়ে। আমাদের তাড়াতাড়ি সিরাজগঞ্জের বাসায় যেতে হবে। তাই আজ আর খাবার খাওয়ার সময় যে নেই। কিছু মনে করবেন না চাচা। আমরা আপনার কাকার কাছেও আমাদের এই অপারগতার কথা বলছি। হাঁটতে হাঁটতেই পিছনে তাকিয়ে কথাগুলো বলছিলেন বলে কখন যে কাকার বসে থাকা বেঞ্চের কাছে চলে এসেছেন, তা বুঝতেই পারেন নি। হামিম সাহেব নিজেও কেমন জানি হাঁপাচ্ছেন।
মুখোমুখি হতেই কাকা লোকটি একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ হামিম সাহেবের দিকে তাকিয়ে থাকেন। শুধু মুখের দিকে না, ওনার শরীরও ভালোভাবে লক্ষ্য করে দেখেন। তারপরই হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠেন, এই যে মা, আর এক সেকেন্ডও সময় নষ্ট করে না। এক্ষুনি তোমার স্বামীকে নিয়ে এনায়েতপুর হাসপাতালে চলে যাও। ওখানে কার্ডিয়াক ডিজিজের হেড ডা. আহমেদকে গিয়ে বলো মেহমুদ সাহেব পাঠিয়েছেন। তোমার স্বামীকে যেন দ্রুত ব্যবস্থায় নেয়। যাও, তাড়াতাড়ি যাও।
ছোট্ট মিষ্টি বাদে বাকী তিনজনের চেহারা তখন দেখার মতো হলো। হঠাৎ বিস্ময়ের ধাক্কায় শারমিনের অস্থিরতা প্রায় নাই হয়ে গেলো। কোনো মতে বললো, আঙ্কেল, আপনি এগুলো কি বলছেন? আপনি….
তার কথা বাধা পায় কাকা লোকটির কথায়, কুইক। কুইক। আর কোনো কথা হবে না। যাও, এক্ষুনি।
কাকা লোকটি একপ্রকার জোর করেই ওদেরকে গাড়িতে উঠিয়ে দেন।
গাড়ি চলা শুরু করলে অকল্পনীয় দ্বন্দ্বের ভাব থেকে শারমিন স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরার চেষ্টা করে। ব্যাপারটা কি হলো তার মাথায়ই আসছে না। সে হামিমের দিকে তাকায়। ওর চোখ আরো বড় হয়ে যায় যখন দেখে হামিম এতো জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে আর ডান হাতটা দিয়ে বুকের বামদিকে খামচে ধরে আছে। শারমিনের বুকের ভেতর এক অজানা ভয় মোচড় দিয়ে উঠে। চিৎকার দিয়ে উঠে, এই কি হয়েছে তোমার? এই কি হয়েছে?
হামিমকে প্রায় জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে আবার বলে? এই, কথা বলছো না কেনো? কি হয়েছে?
হামিম সাহেবের চোখের কোণ বেয়ে পানি বেরিয়ে আসে। উনি কোনো কথা বলতে পারছেন না। আস্তে করে মাথাটা শারমিনের ডান কাঁধের ওপর এলিয়ে দেন।
শারমিন ড্রাইভারকে বলে, কচি ভাই, জোরে, আরো জোরে চালান। ওর সামনে সবই কেমন যেন ধোঁয়াশা হয়ে আসছে।
বেশি সময় লাগলো না হাসপাতালে পৌঁছাতে। নেমেই শারমিন ডা. আহমেদ এর কথা জিজ্ঞেস করতেই কেউ একজন বলল, ওই যে উনি বের হচ্ছেন।
শারমিন প্রায় দৌড়ে গিয়ে আহমেদ সাহেবকে সদর দরজায়ই ধরতে পারেন বাহিরে বের হওয়ার আগেই। বিশেষ অনুরোধে নিয়ে যান গাড়ির কাছে তার সদ্য অসুস্থ স্বামীর কাছে।
ডা. আহমেদ হামিম সাহেবকে দেখেই বুঝতে পারলেন ব্যাপারটা সিরিয়াস। তারপর ঘুরে শারমিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, এই অবস্থা কখন হলো?
এই তো কিছুক্ষণ আগে। আমরা তো কিছুই বুঝিনি। ওই যে, কি নাম যেনো, ওই যে মেহমুদ সাহেব না কি যেনো নাম, উনি ওকে তো সুস্থ থাকা অবস্থায়ই এক নজর দেখেই বললেন আপনার কাছে নিয়ে আসতে। আর এখানে আসতে আসতেই গাড়ির ভেতরে ওর এমন অবস্থা হয়ে যায়। তা প্রায় মিনিট বিশেক হলো।
ডা. আহমেদ প্রায় চেঁচিয়ে উঠেন, কিক্ কি! কি নাম বললেন? আর উনি এক নজর পেসেন্টকে দেখেই আমার কাছে দ্রুত পাঠালেন?
হাঁ, তাইতো পাঠালেন। আর ওনার নাম বললেন তো মেহমুদ।
মেহমুদ নামটা শুনেই ডা. আহমেদ হঠাৎ একটু অন্যমনস্ক হয়ে যান। কি যেনো ভাবলেন তারপর দ্রুত হেঁটে হাসপাতালের ভেতরে আবার ফিরে যান। তার কিছুক্ষণ পরই হামিম সাহেবকে নিয়ে তাড়াহুড়ো শুরু হয়ে যায়।
শারমিনের কাছে পরবর্তী পঁয়তাল্লিশ মিনিট কাটলো এক অনন্তকালের ঘোরের মতো। কি থেকে কি হচ্ছিলো তার কিছুই মাথায় ঢুকছিল না। অবশেষে ডা. আহমেদ এলেন ওয়েটিং রুমে হাসি হাসি মুখে। বললেন, মহান আল্লাহ অনেক কৃপা এ যাত্রায় হামিম সাহেব প্রায় সুস্থ। আর এর জন্য মেহমুদ সাহেবকে ধন্যবাদ জানাতে হবে। ভাবছি আমি আজই ওনার সাথে দেখা করবো। বলতে কি আমার মনের মাঝে এক বিশাল কৌতূহল চেপে বসেছে। ওনার সাথে না দেখা পর্যন্ত আমার স্বস্তি নেই।
হাঁা, ঠিকই বলেছেন, ডাক্তার সাহেব। একটা ভারী কন্ঠ শুনে সবাই দরজার দিকে তাকায়। দেখে একজন মধ্য বয়স্ক লোক দাঁড়িয়ে। কোলে আর কেউ নয় শারমিনেরই মেয়ে মিষ্টি। সিরাজগঞ্জ যাবার পর একমাত্র এই লোকটির সাথেই মিষ্টির সখ্যতা গড়ে। উনি হেঁটে ভেতরে আসতে আসতে বলছেন, আমিও শুনেছি ড্রাইভার কচির কাছে। আমি মো: আসাদ উদ দৌলা। সিরাজগঞ্জের ডিসি হিসাবে কাজ করছি। হামিম এর সাথে শুধু স্যারের সম্পর্কই নয়, বরং আমাদের সম্পর্ক বড় ভাই—ছোট ভাইয়ের। আমি তো টেলিফোনে ওর এই অবস্থা জেনেই তাড়াতাড়ি রওনা হয়ে যাই। আমারও আপনার মতো মেহমুদ নামটা শুনে কৌতুহল বেড়ে গেছে। প্রায় এক যুগ হলো ওনাকে আমি অন্তর থেকে খুঁজছি। ওনার যে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা পেয়েছি তাতে সন্দেহটা একটু গাঢ় হয়েছে। তা ডা. সাহেব আপনি কি কারণে ওনার কাছে যেতে চাচ্ছেন?
আসলে এক মেহমুদ হাসানকে আমি খুঁজছি, যিনি আমার, শুধু আমার না, এই বর্তমান পৃথিবীর সকল ডাক্তাররাই ওনার কাছে ভীষণ কৃতজ্ঞ। যেখানে বর্তমান বিশ্ব চিকিৎসা ক্ষেত্রে নানা প্রকার টেস্টের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পরেছে সেখানে দুবছর আগে প্রকাশিত হলো ওনার দশ বছরের গবেষণার ফসল “ভিজিউয়াল ডায়াগনোসিস অফ হিউমান ডিজিজেস”। উনি ছিলেন সরকারি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জয়েন্ট সেক্রেটারি। ওনার ভিজিউয়াল ডায়াগনোসিস এর ওপর বেশ আগ্রহ। দেশ বিদেশে ঘুরে ঘুরে উনি নানা সাধক, মনীষী, কবিরাজদের সান্নিধ্যে আসেন। আর সব কিছু শেখার চেষ্টা করেন। আমার চাকরী জীবনের প্রথম দিকে ওনার সাথে একবার দেখা হয়েছিল। তখন উনি আমাকে দেখেই আমার অন্ত্রের একটা রোগের বিষয়ে চিকিৎসা নিতে বলেন। আমি জানি না, উনি কীভাবে সেটা ধরেছেন। তবে আমি সে রোগের চিকিৎসা করিয়ে আমি সুস্থ। না হলে খারাপ কিছু হয়ে যেতে পারতো। পরে আমি ওনার সাথে দেখা করতে যেয়ে আর ওনাকে পাইনি। শুনেছি উনি হঠাৎ চাকরি থেকে অবসর নিয়ে কোথায় যেনো চলে গেছেন। কেউ কিছু বলতে পারে না। তারপর দশ বছর পর হঠাৎ তুরস্ক থেকে প্রকাশিত নতুন ওই বইটি হাতে আসে। গবেষক, লেখক একজন বাংলাদেশি, নাম মেহমুদ হাসান। বইটা যতই পড়ছি, ততই বিস্ময়ে ফেটে পড়ছি। ওনাকে পেলে আমি ঠিক করেছি ওনার সাথে বছরের পর বছর লেগে থাকবো।
হঁ্যা, ডাক্তার সাহেব। আপনার এই মহা মানুষটিকেই বোধ হয় আমিও খুঁজছি। ওনার সাথে যে আমার অন্য রকম কিছুর দরকার! আচ্ছা, চলুন না আজই ওনাকে দেখে আসি — উনিই আমাদের সেই মানুষটি কি না!
শারমিনের সামনে এমন কথাবার্তাগুলো ওকে আরো মানসিক জটিলতায় ফেলে দেয়। তারও তো মনে ঝড় বইছে। হামিম এর সুস্থতার আশ্বাস পেয়ে সে দমে থাকা ঝড় আবার মাথা চাড়া দেয়। ওই রহস্যময় বাড়িতে মিষ্টি যখন বাথরুমে তখন শারমিন ওই রুমটার ওয়াল টু ওয়াল আলমারির একটা দরজা খুলেই প্রায় বরফ হয়ে গিয়েছিলো। তাকের হ্যাঙ্গারে ছোট্ট মেয়েদের ড্রেসে ভর্তি। মাঝের তাকের ড্রেসগুলোর পিছনের দেয়ালে কোনো ছবি টবি লাগানো আছে মনে হলো। দুহাতে মাঝ বরাবর ড্রেসগুলো দু দিকে সরাতেই দেখে — একি! এতো মিষ্টির তিন বছরের জন্মদিনের কেক কাটার ছবি! হৃদ কম্পন বোধ হয় বন্ধই হয়ে গিয়েছিল শারমিনের। কিন্তু পিছন থেকে মিষ্টির ডাকে আবার স্বাভাবিক হয়। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে। কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলো না। দেখলো হামিম এক মনে পুতুলগুলো পরীক্ষা করছিলো। সে ওর দিকে তাকায় নি তখনও। হঠাৎ অসম্ভব অস্থিরতা আর অজানা ভয় গ্রাস করে ওকে। আর কিছু চিন্তা মাথায় এলো না। প্রায় জোড় করেই মিষ্টির হাত ধরে টেনে ওই ঘর থেকে বাহিরে বেড় হয়ে আসে। সাথে সাথে হামিম সাহেবও ওকে অনুসরণ করতে থাকে। আর তারপরই তো ঘটে গেলো এমন অঘটন।
সম্পূর্ণ এক অচেনা মানুষের বাড়িতে মিষ্টির ছবি সম্বলিত আলাদা রুম। রুমের ভেতর অসংখ্য পুতুল সাজানো। আলমারিতে মেয়ের ছবি কেনো? আর আরেকটা দরজায় বিশেষ শ্রাবণ মেঘের ছবির রহস্যটাই বা কি? এসব চিন্তা করতে করতেই মোবাইলে নানার নাম্বারে কল দিয়ে দেয়। তিন বার রিং হতেই নানা ফোন রিসিভ করে, হ্যালো নানুভাই। কিরে এতো দেরি করলি খবর জানাতে।
নানাজান, আস্সালামু আলাইকুম। কিসের খবর নানাজান?
কিসের খবর আবার। তোরা ঠিকমতো বাসায় পৌঁছেছিস কি না? মিষ্টি ভাইয়ার কোনো রকম অসুবিধা টিধা হলো কি না?
আসলেই তো। দূরে কোথাও গেলে সেখানে পৌঁছানো মাত্রই তার খবরাখবর শারমিন নানাকে জানাতো। কিন্তু আজ ব্যাপারটা কেমন জানি হয়ে গেলো। এতোকিছু হয়ে গেলো নানাজানকে তার কিছুই বলা হয়নি। যা ঘটেছে তাই বলতে গিয়ে আবেগে গলা ধরে আসে। নানাজান, আসলে হয়েছে কি, হয়েছে কি….
কি হয়েছে নানুভাই? তুই কাঁদছিস নাকি? কি, কোনো বিপদ টিপদ হলো নাতো?
হাঁ, হয়েছিলো। ভীষণ রকমের বিপদ। হামিম এখন হাসপাতালে।
হামিম হাসপাতালে? কি বলছিস নানুভাই। কি হয়েছে? কখন হয়েছে? ওর অবস্থা এখন কেমন?
হাঁ, নানাজান। প্রায় দুই ঘন্টা আগে বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ সিভিয়র হার্ট অ্যাটাক হয়। কিন্তু মহান আল্লাহর রহমতে হার্ট অ্যাটাক শুরু হওয়ার আগেই ধরা পড়ায় দ্রুত এনায়েতপুর হাসপাতালে নিয়ে আসি। আর তাতেই রক্ষা। ও এখন বিপদের আশংকামুক্ত।
আলহামদুলিল্লাহ! ওই হাসপাতালে আমার পরিচিত মানুষ আছে। আমি এক্ষুনি বলে দিচ্ছি ভালো দেখাশোনার জন্য।
না, নানাভাই। তার আার দরকার নেই। ওর একদম উপযুক্ত চিকিৎসাই হচ্ছে।
তা ভালো, ভালো কথা। আচ্ছা, একটা জিনিস— তুই যে বললি অ্যাটাক শুরু হওয়ার আগেই বুঝে ফেললি কিভাবে যে সিভিয়ার অ্যাটাক হতে যাচ্ছে?
আসলে নানাজান, সে জন্যই তো তোমাকে ফোন করা। মনটা ভীষণ অস্থির।
কেনো, কি হয়েছে? নানার কন্ঠে উৎকন্ঠা।
আসলে ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল মিষ্টির বাথরুম করা নিয়ে। আমরা কড্ডার আগে একটা বাড়িতে যাই সাহায্যের জন্য। আর ওখানেই শুরু সব অদ্ভুত কাণ্ড। বাড়ির মালিক আমাদের অনুরোধ শোনা মাত্রই ওই বাড়ির বাথরুম ব্যবহারের ব্যবস্থা করে দেয়। আর বলেন, ওনার বাসায় উনি যাবেন নাতো কে যাবেন! কেমন অদ্ভুত কথা বলতো? আর বাড়ির ভেতরে গিয়ে যে রুমে যেতে বলেছিলেন সেটার দরজার উপর কয়েক প্রকারের মিষ্টির ছবি। রুমের ভেতরে অসংখ্য পুতুল। আর আর… বলে শারমিন থেমে যায়। গলায় যেনো কথা আটকে গেছে।
কান্নার ফোঁপানি শুনে নানাও ভীষণ অস্থির হয়ে উঠেন। বলেন, তারপর আর কি? আর কি? বল।
নানাজান, ওই রুমের আলমারির ভেতরের দেয়ালে মিষ্টির তিন বছরের জন্মদিনের কেক কাটার ছবি!
কিক্ কি বলছিস রে তুই, নানুভাই? তারপর, তারপর কি হলো? নানার যেনো রাজ্যের আগ্রহ বেড়ে গেলো। পরের ঘটনা আছে কি না জানার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেন।
শারমিন কাঁদতে কাঁদতে বললো, আমি তো ভয়ে মিষ্টি আর হামিমকে নিয়ে দৌঁড়ে বের হয়ে আসি। আর তখনই ওই বাড়ির মালিক হামিমকে দেখে তক্ষুনি আমাদেরকে হাসপাতালে চলে যেতে বলে। প্রায় জোর করেই গাড়িতে উঠিয়ে দেয়। আর ওনার পরিচিত ডাক্তার আহমেদ এর কাছে। তারপর তো হাসপাতালে যাবার পথেই ওর অ্যাটাক হয়ে যায়। আমরাও ঠিক সময়ে হাসপাতালে পৌঁছে ডাক্তার সাহেবকেও পেয়ে যাই। আর এ যাত্রায় রক্ষা।
নানা আরো অস্থির হয়ে পড়েন। বলে উঠেন, ওই বাড়ির মালিকটির নামটা কি? বল, নানুভাই। ওনার নামটা শুনেছিস কি?
শারমিন এর কান্না থেমে যায় নানাজানের উদ্বিগ্ন প্রশ্নে। এখন সেখানে অন্য একটা আশংকা ভীড় করে। কথা জড়িয়ে আসে। বলে, মেহমুদ, মেহমুদ সাহেব।
কিক্ কি! কি বললি? মেহমুদ! মেহমুদ বেঁচে আছে? বলেই একপ্রকার স্তব্ধ হয়ে যান।
শারমিন যার পর নাই বিস্মিত! নানাভাই, তুমি এসব কি বলছো? তুমিও কি ওনাকে চেনো?
কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতার পর নানার কাঁপা কাঁপা কন্ঠস্বর, আমিও জানি মানে? নানাভাই, আর কেউ কি বলেছে ওকে চিনে?
আসলে উনি বেশ উদ্বিগ্ন। ওনার ধারণা উনি হয়তো ওনাকে চেনেন। এর জন্যই আজই উনি মেহমুদ সাহেবের সাথে দেখা করতে ওনার বাসায় রওনা হচ্ছেন।
ওনার নামটা বলতে পারবি, নানুভাই।
কেনো পারবো না। ওনার নাম আসাদ উদ দৌলা। উনি এখন সিরাজগঞ্জের ডিসি।
নামটা শুনেই নানা আবারো চুপ হয়ে যান। ওপাশ থেকে কথা না শুনতে পেয়ে শারমিন অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, কি ব্যাপার, নানাভাই? তুমি এমন চুপ করে আছো কেনো? তুমি কি আসাদ সাহেবকেও চেনো?
আবারো কাঁপা কন্ঠে বলেন, সত্যি কথা বলতে কি আমি ওনাকেও চিনি। উনিই তো আমার মনের সম্পূর্ণ মিথ্যা ধারণাটাকে পাল্টে দিয়েছেন। আমি যে তোর কাছে বিশাল অপরাধ করেছি নানুভাই, তা তিনিই ধরিয়ে দিয়েছেন। আমি যে ভীষণ পাপ করেছি, পাপ — বলেই বেশ জোরেই কাঁদতে থাকেন।
কান্নার শব্দে শারমিন আরো বিচলিত হয়ে পড়ে। নানাভাই, হচ্ছেটা কি? কিসের পাপ? কি ধরিয়ে দিয়েছেন আসাদ সাহেব?
নানুভাই তুই যখন দেড় বছরের, তখন তোর বাবা মা ফ্রান্সের রাস্তায় এক কার অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়। তুই আমাদের কাছে ছিলি বিধায় তুই বেঁচে আছিস। এমনি তোকে জানানো হয়েছিলো। আসলে এটা সত্যি না। তুইও বোধহয় জেনেছিস তোর মায়ের বাড়াবাড়ি রকমের অস্থিরতার অসুখ ছিল। যা পরে এমন অবস্থায় গেলো যে প্রায়ই অস্থিরতার শেষ সীমায় আত্মহত্যা করতে চায়। তোর বাবা তখন মন্ত্রণালয়ের এক অফিশিয়াল কাজে ফ্রান্সে যাবার কথা। তখন ডাক্তাররা তোর মাকেও সাথে নিয়ে যেতে বলে। তোকে আমাদের কাছে রেখে ওরা চলে যায়। তোর বাবা একা ফিরে আসে। আর বলে তোর মা নাকি হোটেলের আট তলা রুম থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছে। সবাই বিশ্বাস করলেও আমি ও তোর নানি বিশ্বাস করতে পারিনি। বললাম তোর বাবাই ঝামেলা সহ্য করতে না পেরে তোর মাকে মেরে ফেলেছে। প্রচণ্ড রাগ আর ক্ষোভে তোর বাবাকে তোর কাছ থেকে দূরে সারিয়ে দিলাম। ভয় দেখালাম তোর সাথে দেখা করার চেষ্টা করলে ওকে জেলে পাঠানো হবে। আমি সবই লক্ষ করেছিÑতোর বাবা তোর সামনে না এলেও দূর থেকে তোকে সব সময়ই চোখে চোখে রাখতো। বাড়ির গার্ডের সাথে ওর যোগাযোগ ছিল। কিন্তু বলা বারণ বলে আমাকে ছাড়া কাওকে কিছুই বলেনি। তুই যেদিন এস, এস, সি, পরীক্ষা শেষ করলি তারপরের থেকে ওকে আর দেখি নি। ওরই মাঝে হঠাৎ এই আসাদ সাহেব এলো ওর খোঁজে। আমি তো ওর ঘটানো কাজে ভীষণ রাগে বলেছিলাম, ওই খুনির সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই।
তখন আসাদ সাহেব তো তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। বললেন, আপনি জানেন কার সম্বন্ধে কি বলছেন? মেহমুদ স্যারের মতো লোক এ জগতে পাবেন না। উনি ম্যাডামকে কি পরিমাণ ভালোবাসতো তা ঈর্ষণীয়। স্যারের সাথে জুনিয়র অফিসার হিসেবে আমিও সেবার ফ্রান্সেই ছিলাম। আমরা যে হোটেলে উঠেছিলাম সেখান থেকে আমাদের কনফারেন্স হলটি প্রায় সতেরো কিলোমিটার দূরে ছিল। সকাল সাতটায় আমরা যখন একসাথে বের হই তখন ম্যাডাম নিজে গাড়ির পার্কিং পর্যন্ত এসেছিলেন বিদায় দিতে। কনফারেন্স চলাকালিন সময় প্রায় সাড়ে দশটার দিকে হোটেল থেকে খবর আসে ম্যাডাম ওনার আট তলার রুমের খোলা জানালা দিয়ে লাফ দিয়েছেন। স্যার তখন আমাদের প্রতিনিধি হিসেবে ওনার স্পিচ দিচ্ছিলেন। আমরা তৎক্ষণাৎ সরাসরি হাসপাতালে গিয়ে পৌঁছি কারণ ম্যাডামকে সঙ্গে সঙ্গেই হোটেল থেকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছিলো। আমরা গিয়ে ওনাকে মৃত পাই। কীভাবে কী হলো তা স্যার আমাদের কখনই বলেন নি। শুধু এতটুকু বলেছিলেন — ও হয়তো আমাকে মিস করছিলো। আর আপনি বলছেন উনি খুনি? সেদিন আসাদ সাহেব এতোটাই উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিলেন যে ওনার শরীর কাঁপছিলো। ওনার শরীর এমনি এমনিই কাঁপেনি রে নানুভাই। কেঁপেছিলো এক অসত্য ভাবনাকে তক্ষুণি গলা টিপে ধরার জন্য। কিন্তু উনি সংযম সর্বোচ্চটা প্রদর্শন করে সেদিন সঙ্গে সঙ্গে বাসা থেকে বেরিয়ে গেছেন। তারপর থেকে আমার মানসিক অবস্থা খারাপ হতে শুরু করে। আমি আমার সর্বোচ্চ দিয়ে তোর বাবাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করি। জানতে পারি ও নাকি স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে কোথায় যেনো চলে গেছে। ভেবেছিলাম ওকে খুঁজে বেড় করে ক্ষমা চাবো আর তোকে আসল সত্য কথা খুলে বলবো। কিন্তু, কিন্তু….
শারমিন ফোন কানে লাগিয়ে শুনছিলো রূপকথার গল্পের মতো ঘটনাগুলো। হঠাৎ ওর হৃদপিণ্ড জড়িয়ে আসলো। কেমন যেনো সব ওলটপালট হয়ে গেলো। প্রচণ্ড শব্দ করে কেঁদে উঠে ও।
রুমের শেষ প্রান্তে বসে শারমিনকে কাঁদতে দেখে সবাই একসাথে ঘুরে তাকায়। ছোট্ট মিষ্টি আসাদ সাহেবের কোল থেকে জোর করে নেমে মায়ের দিকে দৌড়ে আসে। মায়ের ওমন কান্না দেখে সেও কাঁদতে কাঁদতে মায়ের কোলে মুখ রাখে। শারমিন একহাতে মেয়েকে নিজের সাথে জড়িয়ে নেয়।
এখানে কি হচ্ছে সে সব কারোরই বোঝার ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। সবাই নিঃশব্দে শারমিনের অঝোরে কান্না দেখছে। ফোনের ওপাশ থেকে নানা কথা বলে যাচ্ছেন, আমাকে ক্ষমা করে দিস নানুভাই। আমি আমার অজান্তেই মেহমুদের সাথে অবিচার করেছি। তোর সাথে অবিচার করছি। আমার গাড়িতে চলাচলের একটু ক্ষমতা থাকলে আমি এক্ষুণি মেহমুদের কাছে যেতাম। নানুভাই, আর দেরি করিস না। পারলে এক্ষুণি তোর বাবার কাছে যা। আর যদি পারিস আমায়…….।
ফোনের লাইন কেটে গেলো।
আরো কিছুক্ষণ ফোন কানের সাথে লাগিয়েই রাখলো শারমিন। তারপর কান্না থামিয়ে ভরা গলায় বললো আসাদ ভাই, আমিও যাবো মেহমুদ সাহেবের বাসায়। তার আগে আমি হামিমের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসি। বলে মিষ্টিকে কোলে নিয়ে হামিম সাহেবের বিশেষ আই, সি, ইউ, কেবিনের দিকে যেতে শুরু করলো।
রাত আড়াইটা। মেহমুদ সাহেবের সেই রহস্যময় বাড়ির সামনে তিনটা গাড়ি এসে হাজির। প্রধান গেটে লাগানো কল ইন বেল টিপতেই বাড়ির ভেতর থেকে সেই দোকানী চাচা গেট খুলে অবাক হয়ে যায়।
শারমিনই প্রথমে কথা বলে, চাচা আপনার কাকা কি ঘুমিয়েছেন?
আর ঘুম। একটু কষ্টের সুরে বলেন দোকানী চাচা। আপনারা যাবার পর থেকেই সেই অস্থির হয়ে পড়েন, সেই অস্থিরতায় ঘুম টুম বাদ দিয়ে ওই মেঘওয়ালা রুমে গিয়ে শুধু পায়চারী করছেন তো করছেনই।
মেঘওয়ালা রুমের কথা শুনেই শারমিনের বুকটা আবার কেমন জানি মুচড়ে উঠে। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারছে সে। কেবলই বুক ভেঙে কান্না পাচ্ছে। কোলে রাখা মিষ্টি তখনো ঘুমায় নি। সে বারবার মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মায়ের মুখের অনুভূতির পরিবর্তন দেখছে। এমন অবস্থা যে মা কান্না শুরু করলেই সেও কান্না শুরু করবে। এদিকে ডা. আহমেদ এবং আসাদ সাহেবও ব্যাপারটা পর্যবেক্ষণ করছেন বেশ আগ্রহ এবং বিস্ময় নিয়ে।
শারমিন কোনো মতে বললো, চলুন চাচা। আমরাও যাবো ওই রুমে ওনার সাথে দেখা করতে।
দোকানী চাচা কি ভেবে সবাইকে নিয়ে গেলো ওই শ্রাবণ মেঘের ছবি ওয়ালা রুমের সামনে। দরজা পুরোপুরি লাগানো না। বোঝাই যাচ্ছে ধাক্কা দিলেই খুলে যাবে। তারপরও শারমিন কাঁপা হাতে দরজায় টোকা দিলো। আর নিজেকে ধরে রখতে পারলো না বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে এলো।
সঙ্গে সঙ্গেই ভেতর থেকে সেই কাকার কন্ঠ ভেসে এলো, কে? কে কাঁদে ওখানে?
আমি।
আমি কে?
আমি শ্রাবণ। তোমার মেয়ে, বাবা!
সৈয়দ মনজুর কবির, গল্পকার