বিচিত্রা সেন
ঘুম থেকে উঠে কিছুক্ষণ বসে থাকতে হয় মজনুকে। এসময় তার সাথে কেউ কথা বললে মেজাজটা খারাপ হয়ে যায় তার। এসময়টাতে কী ভাবে সে নিজেও জানে না। তবে ঝিম মেরে বসে থাকতে তার নিজের খুব ভালো লাগে। একসময় তার বউটা সোহাগ করে বলত,
-কই গো! বসে আছ কেন? মুখ ধুয়ে আসো। আমরা একসাথে চা নাস্তা খাই।
কিন্তু বউয়ের অমন সোহাগের কথায় চিড়ে ভিজতো না। বরং মুখে একটা খিস্তি খেউড় করে সে জবাব দিত,
-তোমারে না আমি অনেকবার বলছি,আমার সাথে এসময় কথা না বলতে? তারপরও এত সোহাগ দ্যাখাও ক্যান?
তার বউ লায়লা খুব মন খারাপ করত স্বামীর এমন ব্যবহারে। মাঝে মাঝে কান্নাও করে দিত। কিন্তু এসবকে কখনো পাত্তা দেয়নি মজনু। কারণ সে বিশ্বাস করে বউকে সবসময় দা এর নিচে রাখতে হয়। বেশি তেড়িবেড়ি করলে সোজা দা এর কোপে দুই টুকরা। অথচ লায়লা চাইত স্বামীর সাথে ওর একটা দারুণ রোমান্টিক সম্পর্ক হোক। কিন্তু বিয়ের দশ বছর কেটে গেল,সম্পর্কটা রোমান্টিকতার দিকে গড়ালোই না।
সম্পর্কটা রোমান্টিকতার দিকে গড়ালো না বললে আসলে ব্যাপারটা পুরোপুরি বলা হয় না। সম্পর্কটা দিনকে দিন তিক্ততার দিকে গড়িয়েছে। এর কারণ মজনুর মারমুখী স্বভাব,আর খিস্তি খেউড় করা মুখ। কথায় কথায় প্রাণ খুলে গালি দিতে না পারলে মজনুর যেন ভাত হজম হয় না। সে যেই হোক না কেন, কথায় না মিললে মজনু তাকে বাপ মা তুলে গালিগালাজ করবেই। প্রথম প্রথম স্বামীর এ স্বভাব দেখে হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকত লায়লা। কারণ ছোটবেলা থেকে সে জেনে এসেছে গালিগালাজ করে অশিক্ষিত লোকেরা। শিক্ষিত লোক যে গালি দিতে পারে এটাই সে জানত না। তার বাবার বাড়ির লোকেরা গালি দেওয়াটাকে অসভ্যতা মনে করে। লায়লার ধারণাও তাই। কিন্ত মজনুর অহর্নিশি গালি শুনতে শুনতে তার অনুভূতিও এখন ভোঁতা হয়ে যাওয়ার পথে।
তবুও মাঝে মাঝে তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। যেমন গত ডিসেম্বর মাসে একটা ছোট বিষয় নিয়ে প্রলয়ংকরী ঘটনা ঘটে গেছে। সেদিন সকাল থেকেই লায়লার শরীরটা খুব খারাপ ছিল। রান্নাঘরে চুলার আঁচে তার দমটা বার বার বন্ধ হয়ে আসছিল। এদিকে আগের রাতে বার বার বলা সত্ত্বেও মজনু বাজার আনেনি। তাই রান্না করার মতো ঘরে সে কিছুই খুঁজে পাচ্ছিল না। তার আট বছরের ছেলেটা সকালে নাস্তা না করে ভাত খেতেই পছন্দ করে। অথচ ঘরে একটা ডিম নেই যে ওমলেট করে ভাতের সাথে দেবে। ওদিকে মজনু তখনো ঘুমাচ্ছে। খুব তিরিক্ষি মেজাজ নিয়ে সে মজনুকে ডাকতে গেল। দুই তিনবার ডাকার পর মজনু চোখ মেললো বটে,কিন্তু উঠে বসল না। লায়লা চিৎকার করে বলল,
-উঠো না,আর কত ঘুমাবা? ঠিকমতো বাজার কর না,ছেলেকে আমি কী খেতে দিব? একটা ডিম পর্যন্ত ঘরে নাই!
মজনুর তো সেই ছোটবেলা থেকে অভ্যাস, ঘুম থেকে উঠলে তার সাথে কেউ কথা বলতে পারে না। তাকে দশ/বিশ মিনিট চুপ মেরে বসে থাকতে হয়। অথচ আজ ঘুম ভাঙার পর থেকে লায়লা সমানে চিৎকার করছে। মাথায় রক্ত চড়ে যায় মজনুর। ‘ওই খানকি, ওইভাবে চিল্লাস ক্যান? লাথ্থি খাইবার চাস? বলে সে লাফ দিয়ে বিছানা থেকে ওঠে। অন্যদিন হলে এসময় লায়লা সরে যেত। কিন্তু আজ ছেলেকে খেতে দিতে না পেরে সকাল থেকে তার মেজাজটা তিরিক্ষি হয়ে আছে। তার ওপর ছেলের সামনে এরকম গালি সে সহ্য করতে পারল না। দশটা বছর সে একতরফা সয়ে গেছে। ভেবেছিল,বয়স বাড়তে বাড়তে হয়ত মজনু ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে,বয়স বাড়ার সাথে সাথে ওর খিস্তি খেউড়ের প্রবণতাও বেড়ে যাচ্ছে। আর কত সহ্য করা যায়! তার ছেলেটাও তো বড় হচ্ছে। বাবার কাছ থেকে শুনে শুনে হয়ত একদিন সেও এরকম মানুষকে গালিগালাজ করবে। তাই সেদিন লায়লা একটা কা- করে বসে। লায়লা নিজেও কখনো ভাবেনি,সে এমন কা- করতে পারবে। কারণ তার বাবার পরিবার হয়ত নিম্নমধ্যবিত্ত ছিল,কিন্তু সংস্কৃতিমনা এবং রুচিশীল হিসেবে এলাকায় তাদের পরিচিতি ছিল। কিন্তু কথায় বলে, “সঙ্গদোষে লোহা ভাসে”। দশটা বছর অহরহ গালিগালাজ শুনতে শুনতে শব্দগুলো যে কখন তার মগজেও বাসা বেঁধেছে সে ভাবতে পারেনি। মজনু যখন তাকে ছেলের সামনে খানকি বলে গালি দিল,সেও মেজাজ হারিয়ে বলল,
-তুই খানকির পুত তো,তাই সবাইরে খানকি বলস। কুত্তার বাচ্চা একটা!
প্রথমে মজনু নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারে না,সে কী শুনল। কিন্তু মুহূর্তেই সে লাফ দিয়ে লায়লার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়,তারপর “ফকিরনির ঝি,মাগি,কী বলছস,তুই কী বলছস” বলতে বলতে বামহাতে লায়লার চুলের মুঠি ধরে ডান হাতে সর্বশক্তি দিয়ে লায়লার বাম চোখ বরাবর পাঁচ ছয়টা ঘুষি লাগিয়ে দেয়। এর আগেও মাঝে মাঝে রাগের মাথায় সে লায়লাকে কখনো সখনো দুয়েকটা চড় থাপ্পর দিয়েছে। কিন্তু এভাবে যে চোখ বরাবর নৃশংসভাবে আঘাত করবে তা লায়লা হয়ত কল্পনাও করতে পারেনি। মা গো, বাবা গো, বলে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। চোখ ফেটে বেরিয়ে আসে গল গল করে রক্ত। মায়ের চোখে রক্ত দেখে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে ছেলে তাহসিন। মজনুও হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। কিন্তু তার জেদ
তো গোখরো সাপের মতো দুর্দমনীয়। তাই লায়লাকে রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে কাতরাতে দেখেও সে তাকে হাসপাতালে না নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
লায়লা মাটিতে শুয়ে দেখে মজনুর বাইরে বেরিয়ে যাওয়া। ছেলে তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। সে উঠে বসতে চায়,কিন্তু পারে না। এমন হট্টগোল শুনে পাশের বাসার ভাবি দরজা খোলা পেয়ে ভেতরে ঢোকেন। মা ছেলেকে জড়াজড়ি করে কাঁদতে দেখে তিনি হয়ত যা বোঝার বুঝে নেন। তিনিই সেদিন লায়লাকে নিয়ে হাসপাতালে গিয়েছিলেন। লায়লার চোখ দেখে ডিউটিরত তরুণ ডাক্তার জিজ্ঞেস করেছিলেন,
-কীভাবে হল এমন?
লায়লার সেই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল,কোনো উপায়ে যদি মিঃ ইন্ডিয়া ছবির নায়ক অনিল কাপুরের মতো অদৃশ্য হয়ে যাওয়া যেত। না, অদৃশ্য হয়ে যাওয়া সিনেমায় সম্ভব হলেও বাস্তবে সম্ভব নয়।বরং প্রশ্নের জবাবে উত্তর দিতে হয়। তাই ডাক্তারের প্রশ্নের জবাবে সে বলেছিল,
-হঠাৎ করে মাথা ঘুরে সিঁড়িতে পড়ে গেলাম।
ডাক্তার ধমক দিয়ে বলেছিলেন,
-ডাক্তারের কাছে কখনো মিথ্যা বলবেন না। আপনার অক্ষিগোলক ফেটে রক্ত বেরিয়েছে। আঘাতটা সরাসরি আপনার চোখেই করা হয়েছে। নিশ্চয় আপনার স্বামীর কাজ এটা? আমি প্রেসক্রিপশনে সব লিখে দিব। আপনি মামলা করতে পারবেন।
না,মামলার করার সাহস লায়লার হয়নি। কারণ মামলা চালানোর মতো লোকবল,অর্থবল ওর কোনোটাই নেই। তাছাড়া তাহসিনকে নিয়ে অনিশ্চিত জীবনে সে যেতে চায়নি। বরং গালিগালাজ, চড়-থাপ্পর খেয়ে তাহসিনকে মানুষ করে নেওয়াটাকেই সে শ্রেয় মনে করেছিল। তবে মজনুকে সে ক্ষমা করতে পারেনি। বাইরের লোকের কাছে মনে হতে পারে, সে কীভাবে এরকম মার খেয়েও এমন স্বামীর কাছে পড়ে আছে? কিন্তু সে তো জানে, একক সংগ্রাম করার জন্য যতটুকু মানসিক শক্তি দরকার তা তার নেই। তবে একটা জিনিস সে পারে। সে মন থেকে প্রবলভাবে মজনুকে ঘৃণা করতে পারে। একই ছাদের নিচে ওরা আছে। মাঝে মাঝে শারীরিক সম্পর্কও ওদের হয়,কিন্তু মজনুকে সে ক্ষমা করে না। কোনো প্রয়োজন ছাড়া মজনুর সাথে সে কথাও বলে না। ওই ঘটনার পর থেকে বাম চোখে সে ঝাপসা দেখে। মাঝে মাঝে চোখটাতে তার তীব্র যন্ত্রণাও হয়। তখন সে বিছানায় গিয়ে আশ্রয় নেয়,আর ভাবে,তার একটা চোখ নষ্ট করে দেওয়ার কোনো শাস্তিই কি মজনু পাবে না?
আজ মজনু বিছানায় বসে আছে তো আছেই। অন্যদিন দশ/পনেরো মিনিট পরেই সে স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। আজ কেমন যেন লাগছে তার। মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে। পায়ের ওপর জোর দিয়ে দাঁড়াতেও পারছে না। এখান থেকেই সে দেখতে পাচ্ছে লায়লা রান্নাঘরে ব্যস্ত। কয়েকবছর আগে হলে সে হয়ত এতক্ষণে কয়েকবার তাড়া দিয়ে যেত। সেই তাড়ায় থাকতো আবদার মিশ্রিত সোহাগ। কিন্তু পাল্টে গেছে লায়লা। বিশেষ করে বামচোখটা নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর তার মুখে কখনো হাসি দেখেনি মজনু। কেমন যেন একটা দম দেওয়া পুতুলে পরিণত হয়েছে সে। একসময় সারাদিনই গুনগুন করে কিংবা সজোরেই গান গাইতো লায়লা। কতদিন তার মুখে গানের কলি নেই। জীবনে এই প্রথম তার মধ্যে কেমন একটা অপরাধবোধ জাগে। মনে হয়,লায়লার এতটা পাল্টে যাওয়ার জন্য সেই দায়ী। একবার ভাবে,লায়লার কাছে কি সে ক্ষমা চাইবে?
কিন্তু বউয়ের কাছে নত হতে তার যে খুব সম্মানে বাধে। তার মা বলত,বউকে নাকি দা এর তলার মাছের মতো রাখতে হয়। তাহলে বউ ঠিক থাকে। কিন্তু সেই ফর্মুলামতো চলতে গিয়ে তো লায়লা তার থেকে অনেক দূরে সরে গেছে।
সে আবারও উঠতে চায়। ঠিক এসময় মাথায় একটা ঝিলিক দিয়ে তার কানে খট করে একটা শব্দ হয়,এবং পরক্ষণেই শোঁ শোঁ শব্দ হতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই শোঁ শোঁ শব্দটা এমনই তীব্র হয়ে ওঠে, সে ভয় পেয়ে রান্নাঘরে লায়লার কাছে ছুটে যায়। চিৎকার দিয়ে বলে,
-লায়লা,আমার কানে প্রচ- আওয়াজ হইতাছে। আমার মাথায় আঘাতটা লাগতেছে। আমি এখন কী করব?
মজনুর আতংকিত চিৎকারে লায়লা প্রথমে ভয় পেয়ে গেলেও পরমুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে কী যেন বলে। কিন্তু মজনু একটি শব্দও শুনতে পায় না। সে শুধু লায়লার ঠোঁট নড়াটাই দেখে। সে চিৎকার দিয়ে বলে,
-লায়লা,আমি কিছু শুনতে পারতাছি না। তুমি জোরে বল।
লায়লা আবারও ঠোঁট নাড়ে। গলার রগ আর চোখ-ঠোঁটের ভঙ্গি দেখে বোঝা যায় সে চিৎকার করে কথা বলছে। কিন্তু একটি শব্দও মজনুর কানে ঢোকে না। মজনু উদ্ভ্রান্তের মতো চিৎকার করতে থাকে,
-লায়লা,আমি কিচ্ছু শুনতে পারতাছি না,কিচ্ছু না। এইটা কী হইল আমার? আমি শুনতে পারতাছি না ক্যান? লায়লা. লায়লা
বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ে লায়লাকে জড়িয়ে ধরে সে। লায়লা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে মজনুর দিকে। এসব কী বলছে সে? ও কিছু শুনতে পাচ্ছে না মানে! মনের অজান্তেই তার হাত চলে যায় নিজের বামচোখে। ডান চোখটা আপনাআপনি বন্ধ হয়ে যায়। বামচোখের দৃষ্টিতে ক্রন্দনরত মজনুকে বড্ড ঝাপসা মনে হয় তার।
বিচিত্রা সেন, প্রাবন্ধিক ও গল্পকার