জ্যোতির্ময় নন্দী
বিশ্ববিশ্রুত আলবেনীয় ঔপন্যাসিক, কবি, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, চিত্রনাট্যকার ইসমাইল কাদারে চলতি বছরের জুলাই মাসের পয়লা তারিখে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। একনায়কতন্ত্রের বিরোধিতা করার দুঃসাহস দেখিয়ে সবার নজরে চলে আসা এই শক্তিমান লেখক ইহজীবনের ইতি টানলেন ৮৮ বছরের পূর্ণ পরিণত বয়সে। তাঁকে অনেকেই বিংশ ও একবিংশ শতকের বিশ^ সাহিত্যের সেরা লেখকদের অন্যতম বলে মনে করেন।
কাদারের সবচেয়ে পরিচিত ও পঠিত দুটো কাজ হলো ব্রোকেন এপ্রিল এবং দ্যা জেনারেল অব দ্য ডেড আর্মি। প্রথমোক্ত বইটিতে রূপক কাহিনির মধ্যে দিয়ে আলবেনিয়ার একসময়কার একনায়ক আনোয়ার হোজ্জা’র স্বৈরশাসনামলের ঘটনাপঞ্জী তুলে ধরা হয়েছে। বর্তমানে প্রয়াত কম্যুনিস্ট স্বৈরশাসক হোজ্জা তখনো ক্ষমতায়। কাদারের মতো হোজ্জাও ছিলেন আলবেনিয়ার অটোমান দুর্গনগরী জিরোকাস্টেরের সন্তান। কাদারে তাঁর বিভিন্ন লেখায় যুগপৎ হোজ্জার প্রশংসা আর তীব্র সমালোচনা দুটোই করেছেন।
কাদারে তাঁর দেশে প্রথম সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন একজন কবি হিসেবে। তবে তাঁর গদ্যই তাঁকে বিশ^ব্যাপী খ্যাতি এনে দেয়। তাঁর সবচেয়ে বেশি পরিচিত উপন্যাস ‘জেনারেলি ই উশট্রিসে সে ভদেকুর’ (দ্য জেনারেল অব দ্য ডেড আর্মি) প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ সালে।
এ বইটিই সর্বপ্রথম তাঁকে আন্তর্জাতিক পাদপ্রদীপের আলোয় তুরে ধরে। ১৯৮৩—তে একই নামে বইটির চলচ্চিত্ররূপ দেয়া হয়। এ উপন্যাসে একজন ইতালীয় জেনারেলের কথা বলা হয়েছে, যাকে পাঠানো হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধকালে আলবেনিয়ায় নিহত ইতালীয় সৈন্যদের দেহাবশেষ দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে।
আলবেনীয় ইতিহাস—নির্ভর কাদারের অন্যান্য কাজের মধ্যে রয়েছে, পনেরো শতকে অটোমান তুর্কিদের বিরুদ্ধে আলবেনীয় জনগণের সশস্ত্র প্রতিরোধের কাহিনি সম্বলিত কেশটিয়েলা’ (দ্য ক্যাসল, ১০৭০), এবং ১৯৬১—তে আলবেনিয়া ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যেকার সম্পর্ক ছেদের ইতিবৃত্ত সম্বলিত ‘দিমরি ই মাধ্’ (দ্যা গ্রেট উইন্টার, ১৯৭৭)। ১৯৭১—এ প্রকাশিত ‘ক্রোনিকে নে গুর্’ (ক্রনিকল ইন স্টোন) কাদারের আত্মজৈবনিক উপন্যাস, যেখানে দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধকালীন আলবেনিয়ায় তাঁর শৈশব তথা তাঁর জন্মশহর জিরোকাস্টেরের কথা তুলে ধরা হয়েছে।
মধ্যযুগীয় আলবেনিয়ার পটভূমিতে লেখা কাদেরের আরেকটি উপন্যাস উরা মে ত্রি আর্চে’ (দ্য থ্রি—আর্চড ব্রিজ)—ও আলোচকদের ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করে। মস্কোর গর্কি ইনস্টিটিউটে থাকার সময় নিয়ে কাদারের লেখা ‘মুজগু ই পেরেন্দিভ টে স্টেপেস’ (টুইলাইট অব দ্য ইস্টার্ন গডস, ১৯৭৮) এমন একটি উপন্যাস, যেখানে বাস্তব চরিত্রগুলোকে ছদ্মনামের আড়ালে ঢেকে রাখা হয়েছে।
এর পর একে একে প্রকাশিত হয় কাদারের উপন্যাস নেপুনেসি ই পালাটিট তে এন্ড্রাভে’ (তা প্যালেস অব ড্রিমস, ১৯৮১), ডোসিয়া এইচ. (দা ফাইল অন এইচ., ১৯৯০), পিরামিদা’ (দ্যা পিরামিড, ১৯৯৫), বলকান নেতৃবৃন্দ ও অটোমান সাম্রাজ্যের মধ্যেকার চতুর্দশ শতাব্দীর যুদ্ধের তিনটি কাহিনির সঙ্কলন ট্রি কেঙ্গে পের কসোভেন (থ্রি ইলেজিস পর কসোভো, ১৯৯৯), কম্যুনিস্ট শাসনোত্তর আলবেনিয়ায় এক চিত্রশিল্পীর কাহিনি লুলেৎ এ তোহতা তে মার্সিৎ’ (ফ্লাওয়ারস অ্যান্ড ফ্রস্ট অব মার্চ), হোজ্জার এক অনুমিত উত্তরাধিকারীর নিয়তি নিয়ে লেখা পাসারধেসি’ (দ্যা সাক্সেসর, ২০০৩), ইতালীয় দখল থেকে সবেমাত্র মুক্তি পাওয়া জিরোকাস্টেরে ১৯৪৩—এ নাৎসি সৈন্যদের অনুপ্রবেশের পর দুজন আলবেনীয় ডাক্তারের জীবনে ঘটে যাওয়া অদ্ভুত কয়েকটি ঘটনা সম্বলিত ডার্কা এ গাবুয়ার’ (দ্যা ফল অব দা স্টোন সিটি, ২০০৮), গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া এক দম্পতির জীবনের রহস্যময় পটভূমিতে একজন গবেষকের আলোকপাতের চেষ্টার কাহিনি আক্সিদেন্তি’ (দ্য অ্যাক্সিডেন্ট, ২০১০), লেখকের সঙ্গে তাঁর মায়ের সম্পর্ক নিয়ে লেখা কুকুলা’ (দ্যা ডল, ২০১৫) প্রভৃতি।
কাদেরের লেখা উপন্যাস—বহিভূর্ত বইগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দুটো হলো ‘এস্কিলি, কি হুম্বেস ই মাধ্’ (এস্কাইলাস, দিস গ্রেট লজার, ১৯৮৮) এবং ঙ্গা ন্যে দ্যেতর নে ত্যেত্রিন’ (ফ্রম ওয়ান ডিসেম্বর টু অ্যানাদার, ১৯৯১)। প্রথমোক্ত বইটিতে প্রাচীনকাল থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত গ্রিক সংস্কৃতির সঙ্গে আলবেনীয় সংস্কৃতির সম্পর্ক ও সাদৃশ্য পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। দ্বিতীয় বইটাতে ব্যবচ্ছেদ করা হয়েছে ১৯৪৪ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত সময়ে আলবেনীয় রাজনীতি ও সরকারের স্বৈরাচারী চরিত্রের।
কাদারে তাঁর লেখার রসদ যোগাড় করেছেন প্রধানত তাঁর নিজের জীবন ও পরিপাশ^র্ থেকে, যার মধ্যে অনিবার্যভাবে চলে এসেছে আলবেনীয় ইতিহাস, রাজনীতি, লোককাহিনি, রক্তাক্ত সংঘাতময় ঐতিহ্য এবং জাতিসত্তা। তাঁর উপন্যাসগুলোতে একাধারে রোম্যন্টিকতা, বাস্তবতা আর পরাকাস্তবতার উপাদান পাওয়া যায়।
সাহিত্যের জন্যে রাষ্ট্রের চাপিয়ে দেয়া নির্দেশিকা প্রত্যাখ্যানের জন্যে কাদারেকে প্রায়শ তুলনা করা হয় রুশ কবি ইয়েভগেনি ইয়েভতুশেঙ্কোর সঙ্গে। অন্যদিকে আবার অদ্ভুত আর পরাবাস্তবের প্রতি আকর্ষণের জন্যে তাঁকে কলম্বীয় উপন্যাসিক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের সঙ্গেও তুলনা করা হয়।
কম্যুনিস্ট শাসকরা কাদারেকে বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে চিহ্নিত করায়, এবং তাদের ক্রমাগত হুমকির মুখোমুখি হয়ে তিনি ১৯৯০—এ ফ্রান্সে পালিয়ে যান এবং সেখানে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করেন। তাঁর চলে যাওয়ার পর অল্প কয়েক মাসের মধ্যেই প্রবল ছাত্র বিক্ষোভের মুখে কম্যুনিস্ট শাসনের অবসান ঘটলেও কাদারে তখন দেশে ফেরেন নি। পরবর্তী দুদশকেরও বেশি সময় প্যারিসে থাকার পর সম্প্রতি তিনি আলবেনিয়ায় ফিরে এসেছিলেন।
পনেরো বার নোবেল পুরস্কারের জন্যে মনোনীতদের শর্ট লিস্টে ইসমাইল কাদারের নাম এলেও শেষপর্যন্ত তাঁর ভাগ্যে এ পুরস্কারের শিকে ছেঁড়ে নি। কাদারের নোবেল পুরস্কার না পাওয়াটা অনেকে পুরস্কারটির জন্যেই দুর্ভাগ্যজনক বলে মনে বরেন।
তবে নোবেল না পেলেও কাদারে তাঁর সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতি হিসেবে অন্য অনেক আন্তর্জাতিক সম্মান ও পুরস্কার পেয়েছেন। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়ের মাক্রঁ গত বছর তাঁর দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতাব ‘গ্রঁ অফিসিয়ে দ্য লা লিজিয়ঁ দ্য’নর’—এ কাদারেকে ভূষিত করেন। ফরাসি রাষ্ট্রপতি নিজে আলবেনিয়ার রাজধানী তিরানায় গিয়ে এই বয়োপ্রবীণ বরেণ্য কথাসাহিত্যিককে লিজিয়ন অব অনর পদক প্রদান করেন। স্মর্তব্য, ইতোপূর্বে ২০১৬ সালে কাদারেকে ‘কমাদ্যুঁ দ্য লা লিজিয়ঁ দ্য’নর’ পদকও প্রদান করা হয়েছিল। তারও আগে ১৯৯৬ সালে ফরাসি সরকার তাঁকে জাতীয় নৈতিক ও রাজনৈতিক একাডেমির বিদেশি সহযোগী হিসেবেও নির্বাচিত করেছিল। ২০০৫—এ তিনি ম্যান বুকার আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করেন। ২০২০ সালে তিনি পান নিউস্টাট আন্তর্জাতিক সাহিত্য পুরস্কার।
কাদারের মৃত্যুতে আলবেনিয়ার রাষ্ট্রপতি বৈরাম বেগাজ এক বার্তায় যথার্থই বলেছেন, “আলবেনিয়া ও আলবেনীয়রা হারিয়েছে তাদের সাহিত্য প্রতিভাকে, তাদের আত্মিক মুক্তিদাতাকে, বলকানরা হারিয়েছে তাদের পুরাণ কাহিনির কবিকে, আর ইউরোপ হারিয়েছে আধুনিক সাহিত্যের সবচেয়ে খ্যাতিমান একজন প্রতিনিধিকে।
জ্যোতির্ময় নন্দী, কবি ও অনুবাদক