হোসাইন আনোয়ার
ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্ত দিয়ে অর্জন এই বাংলাদেশ। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ বিকেল ৪.৩০ মিনিটে ভারত-বাংলাদেশ সম্মিলিত বাহিনীর প্রধান লে.জেনারেল জগজিৎ সিং আরোরার নিকট লে.জে.নিয়াজির আত্মসমর্পণ দলিলে সই করার মাধ্যমে বাংলাদেশ চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করেছিল।
১৭ ডিসেম্বর চীনের প্রধানমন্ত্রী মি. চৌ.এন.লাই ঘোষণা দিয়েছিলেন, ঢাকার পতন ভারতের বিজয়ের পথে অগ্রগতির স্বাক্ষর নয় বরং এনিয়ে উপমহাদেশে এক অন্তহীন যুদ্ধের সূচনা মাত্র। ১৯ ডিসেম্বর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো ঘোষণা দিলেন, ভারতের এই বিজয় চিরস্থায়ী নয়। পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তানের অবিচ্ছেদ্য ও অবিভাজ্য অঙ্গ।
এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলো ও পরাশক্তিরা (বড়) ধরেই নিয়েছিলো সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া বাংলাদেশ হয়তো আর টিকবেই না। ’৭২ সালে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মি. কিসিঞ্জার বলেন, বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল বটমলেস বাস্কেট। এ সময় সি.আই.এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল এত অল্প জায়গায় এত দরিদ্র মানুষের বাস, দেশটির প্রতিবেশী ও বিশ্বের জন্য বড় উদ্বেগের কারণ হতে পারে।যে বাংলাদেশকে দীর্ঘ নয় মাসে পোড়ামাটি নীতি অবলম্বন করে শ্মশানে পরিণত করেছিল লুটেরা পাকিস্তানি বাহিনী, রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট, সমুদ্রবন্দর, নৌ-বন্দর, বিমানবন্দর, ব্যাংক, ট্রেজারি, পাটের গুদাম, সবকিছু ধ্বংস করেছিল আত্মসমর্পণের আগে। বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল যেন বাংলাদেশ মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। যেন মেধাশূন্য হয়ে যায় দেশটি।
সেই বাংলাদেশ আজ সুজলা-সুফলা বাংলাদেশ। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিসিঞ্জারের সেই কুখ্যাত উক্তি বটমলেস বাস্কেট আজ রূপ: মাধুর্য-ঐশ্বর্য এতটাই লোভনীয় হয়ে উঠেছে যে, এখন বিশ্বের সকল পরাশক্তির নজর বাংলাদেশের দিকে।
দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় মার্কিন নীতি ও সমর্থনের তোয়াক্কা না করেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। পাকিস্তানে তখনকার রাষ্ট্রদূত যোসেফ ফারল্যান্ড ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে সাক্ষাত করে বঙ্গবন্ধুকে স্পষ্ট করে বলেছিলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার যে কোনো উদ্যোগ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশ নীতির পরিপূরক নয়। বরং এই ধরণের প্রচেষ্টাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করতে পারে না। তখন ফারল্যান্ড পরিষ্কার উপলব্ধি করেছিলেন শেখ মুজিবের হাতে স্বাধীনতার বিকল্প কিছুই নেই।
এ কথা বুঝতে পেরেই শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানের জন্য ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর গণহত্যার যে ব্লুপ্রিন্ট হাতে নিয়ে কাজ করেছিল, সে ব্লুপ্রিন্ট রচনায় সাহায্য করেছিল মার্কিন গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্য রবার্ট জ্যাকসন। ’৭০এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হওয়ার পরপরই তিনি ঢাকায় এসেছিলেন এবং পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সাথে সর্বক্ষণ যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন। এই রবার্ট জ্যাকশনের ছিল গণহত্যা পরিকল্পনার অতীত অভিজ্ঞতা যা তিনি অর্জন করেছিলেন দক্ষিণ ভিয়েতনাম ও ব্রাজিলে গণহত্যা ও ধ্বংসের পরিকল্পনা সরবরাহ করে।
২৫ মার্চ ১৯৭১। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পর চীনের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত হয় ১১ এপ্রিল পিপলস্ ডেইলিতে। জেনারেল ইয়াহিয়ার প্রতি চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌ এন.লাই এর চিঠির মাধ্যমে। বাংলাদেশকে সমর্থন দানের জন্য পিপলস ডেইলিতে চৌ.এন.লাই. সোভিয়েত ইউনিয়নের কড়া সমালোচনা করেন। শুধু তাই নয়, একমাত্র ’৭১ সালেই চীন পাকিস্তানকে ৪৫ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র সরবরাহ করেছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে স্তব্ধ করার জন্য।
শুধু তাই নয় ১৯৭২ সালের ২১ আগস্ট চীন বাংলাদেশের জাতিসংঘ সদস্য অন্তভুক্তির প্রশ্নে ভেটো প্রয়োগ করে।
১৯৭১ সালের ২১ এপ্রিল মাওলানা ভাসানী বহু কাকুতি মিনতি করে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান মাওসেতুং এবং প্রধানমন্ত্রী চৌ.এন.লাই এর নিকট মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে সমর্থন ও সাহায্যের জন্য পত্র লেখেন। কিন্তু ইতিহাস বলে, চীনা নেতৃবৃন্দ মাওলানা ভাসানীর সেই চিঠির কোনো গুরুত্বই দেননি।
অথচ ঘটনা প্রবাহে চীন আজ আমাদের সবচেয়ে কাছের বন্ধু। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ১৯৭২ সালে দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর ঘোষণা করেন ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব কারো সঙ্গে বৈরীতা নয়’ এই নীতির আলোকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতি পরিচালিত হবে। এই নীতির ভিত্তিতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ১৯৭৫ সালের ১৯ মে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সরাসরি বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপন করে। সেই তখন থেকেই চীন বাংলাদেশের বন্ধু।
১৯৭১ সালে ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা, ২ এপ্রিল সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট পদগর্নি সর্বপ্রথম কড়া কূটনৈতিক ভাষায় ২৫ মার্চের গণহত্যার প্রতিবাদ করে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে বার্তা পাঠান। এবং ২ এপ্রিল থেকেই সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে। ২৮-২৯ সেপ্টেম্বর ইন্দিরা গান্ধীর সফর কালে তিনজন সোভিয়েত শীর্ষ নেতা লিওনেদ ব্রজনেভ, নিকোলাই পদগর্নি, আলেক্সি কেসিগিন একসঙ্গে দীর্ঘক্ষণব্যাপী বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আলাপের ফলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সকল প্রকার সোভিয়েত বৈষয়িক সাহায্যের বৈপ্লবিক রূপান্তর ঘটে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পাকিস্তান সমর্থক বৃহৎ শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের তৎপরতা এবং বিরোধীতার মোকাবেলায় বাংলাদেশের হয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নকে একাই লড়তে হয়েছে। বাংলাদেশের অভ্যুদয় রোধের জন্য সাধারণ পরিষদ ও নিরাপত্তা পরিষদে তিন তিনবার যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব আনে মার্কিনযুক্তরাষ্ট্র ও চীন। সোভিয়েত ইউনিয়ন তিন তিনবারই ভেটো প্রয়োগ করে তা বাতিল করে দেয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সোভিয়েতে তিন ভেটো প্রয়োগ এক অনন্য ইতিহাস হয়ে আছে।
বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ বিরোধী ভূমিকায় ছিলো। পাকিস্তানের অস্তিত্ব যখন চরম বিপন্ন তখন মার্কিন সরকার অ্যাডমিরাল মুরারকে নির্দেশ প্রদান করে ৭ম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরে পাঠানোর জন্য। মার্কিন সরকারের নির্দেশ মোতাবেক ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ ভিয়েতনামের টংকিন উপসাগরে অবস্থানরত ৭ম নৌবহরকে সিঙ্গাপুর পৌঁছতে বলা হয়। ১০ ডিসেম্বর এই বহর সিঙ্গাপুরে পৌঁছে। ১২ ডিসেম্বর ৭ম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরের দিকে যাত্রা শুরু করার নির্দেশ প্রদান করা হয়। কিন্তু তার আগেই রাশিয়া ৬ ডিসেম্বরের মধ্যেই ভারত মহাসাগরে রণফোর্সের প্রথম টাক্সফোর্স পাঠিয়ে দিল, এবং সপ্তম নৌবহরকে যথারীতি মোকাবেলার জন্য রাশিয়া দ্বিতীয় টাস্কফোর্সও পাঠায়। অবস্থা বেগতিক দেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার সপ্তম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগর থেকে ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়।
১৬ ডিসেম্বর এর বাংলাদেশের বিজয় কিসিঞ্জার কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেননি। মার্কিন প্রশাসন বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট নিক্সন হেনরি কিসিঞ্জার স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্ব থেকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ঠেকানোর জন্য গোপনে ১৯৭১ এর জুলাই থেকেই গোপনে প্রবাসী সরকারের অত্যন্ত একজন ঘনিষ্ঠ আওয়ামী লীগের নির্বাসিত সদস্য জনাব কাজী জহিরুল কাইয়ুমের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে। ১৪ আগস্ট জনাব জহিরুল কাইয়ুম কলকাতাস্থ মার্কিন দুতাবাসে উপস্থিত হন। তার প্রস্তাব ছিল পাকিস্তানের সঙ্গে সমঝোতায় শেখ মুজিবকে উপস্থিত থাকতে হবে। নাহলে তার গ্রুপ ছ’দফার ভিত্তিতে স্বাধীনতার চেয়ে কিছু কম’ পাকিস্তানের সাথে সমঝোতায় আসতে রাজি আছে। এ প্রসঙ্গে জহিরুল কাইয়ুম আরও বলেন, ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে সমঝোতার এই প্রস্তাব অসম্ভব হয়ে পড়বে।
কিসিঞ্জার জোশেফ ফারল্যান্ডের মাধ্যমে ইয়াহি খানকে বাংলাদেশ প্রবাসী সরকারের সঙ্গে গোপন যোগাযোগের কথা জানালে ইয়াহিয়া খান এই উদ্যোগকে স্বাগত জানান।
এরপর কলকাতার মার্কিন দূতাবাস জনাব কাইয়ুমকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের আয়োজন করতে বলে। কিন্তু জনাব কাইয়ুম উল্টো শেখ মুজিবের মুক্তি দাবি করেন। এবং তিনি বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানি বাহিনী প্রত্যাহার এবং জাতিসংঘ কর্তৃক বাংলাদেশের নিরাপত্তার গ্যারান্টি দাবি করেন।
জহিরুল কাইয়ুমকে বাগে আনতে না পেরে সি.আই.এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে বিপথগামী করার জন্য কমপক্ষে আটটি কন্ট্রাক্ট ফোর্স নিয়োগ করে একটি ফোর্স মুজিবনগর প্রবাসী সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাকের মধ্যে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়। কথা ছিলÑপাকিস্তানের রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যেই বাংলাদেশকে অধিকতর স্বায়ত্তশাসনের গ্যারান্টি দেয়া।
সবকিছু ঠিকঠাক হলো। অক্টোবর মাসে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের বৈঠক হবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক সেখানে যাবেন। এবং তৎক্ষণাৎ মার্কিন নীতির কাছাকাছি একটি ঘোষণা দেবেন, পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার বিকল্প হিসেবে। পাকিস্তান রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে অধিকতর স্বায়ত্তশাসন। তিনি মুজিবনগর সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে পাল্টা একটি সরকার গঠন করেন। টিকিট পর্যন্ত কাটা হয়ে গেছে। এমন সময় ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে পড়লো।
কিন্তু দুর্ভাগ্য মোশতাকের ’৭১ সালের ২৬ অক্টোবর যুগস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো মার্কিন সি.বি.এম. নেটওয়ার্কের এক সাক্ষাৎকারে এই চাঞ্চল্যকর ষড়যন্ত্রের কথাটি ফাঁস করে দেন। তিনি এও বলেন, তথ্যটি তিনি ইরানের শাহের কাছ থেকে পেয়েছেন।
মার্কিনিদের সরাসরি বিরোধীতা এবং শেখ মুজিবকে ফাঁসিতে লটকানোর ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হওয়া এবং বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং শেখ মুজিবের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের জন্য প্রকৃত পরাজয়। যা এই দুই দেশ আজো মেনে নিতে পারেনি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরে এসেই ঘোষণা দিলেনÑ‘পাকিস্তান কর্তৃক ঋণের দায় তিনি বহন করবেন না। এটি ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার ক্লায়েন্ট পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রথম উচ্চারণ। শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধু মার্কিন প্রভাব ও বলয়কে উপেক্ষা করে দক্ষিণ ভিয়েতনামের অস্থায়ী সরকারকে স্বীকৃতি প্রদান করেন এবং বাংলাদেশ দক্ষিণ ভিয়েতনামে ঢাকার মিশন খোলার অনুমতি প্রদান করে। সেই সঙ্গে পি.এল.ওকে ঢাকায় তাদের মিশন খোলার অনুমতি প্রদান করেন। একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধু ইসরাইলকে মিশন স্থাপনের মার্কিন মৌন ইঙ্গিতকে প্রত্যাখ্যান করেন। কিউবার সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি, আলজিয়ার্সে জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদী শোষক শ্রেণির বিরুদ্ধে দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা প্রকৃত পক্ষেই দক্ষিণ-পূর্ব মার্কিন বিদেশ নীতির প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হয়ে ওঠেন জ্বলন্ত থ্রেট। ফিদেল কাস্ত্রো যেমন ল্যাটিন আমেরিকায়, মুজিব তেমনি দক্ষিণ
-পূর্ব এশিয়ায় এক সার্বক্ষণিক সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে এটাই ছিল সি আই এর স্টেটমেন্ট।
জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনকে বঙ্গবন্ধুর দুই পৃথিবী তত্ত্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভয় পেয়ে গেল। বঙ্গবন্ধু এই সম্মেলনে ঘোষণা দিলেন, পৃথিবী দুই ভাগে বিভক্ত। এদিকে শোষক আর অন্যদিকে শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।”
এই ভাষণের পর ফিদেল কাস্ট্রো বঙ্গবন্ধুকে বুকে জড়িয়ে ধরে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন ‘বন্ধু একটি বুলেট আজ থেকে অহরহ তোমার পিছু নেবে। ঘটনা ঘটেছিলও তাই। একটি বুলেট নয় ২৮টি বুলেট বঙ্গবন্ধুকে ঝাঁঝরা করে দিয়েছিলো সিআইএর এ দেশীয় এজেন্টরা।
কিসিঞ্জার আগেই বুঝে গিয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে খাঁচায় বন্দি করে রাখা সম্ভব নয়, তাই তাকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল।
কিসিঞ্জারের গৃহীত বিদেশ নীতির মূল কথাা ছিল ‘নো পারমানেন্ট ফ্রেন্ডস আর এনিমিজ, অনলি পারমানেন্ট ইন্টারেস্ট। এই চিরস্থায়ী স্বার্থের কথা বিবেচনা করেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭২ সালে ৪ এপ্রিল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে।
জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর ‘দুই পৃথিবী’ তত্ত্বে কিসিঞ্জার বুঝে ফেলেন, শেখ মুজিবকে কিছুতেই পোষ মানানো যাচ্ছে না। এই কিসিঞ্জারের পলিসি হলোÑগেট আওয়ার পিপল ইন অ্যান্ড দেয়ার পিপল অডিট। এর পর থেকে সি আই এর খেলা হল গেট ইন আর গেট আউটের খেলা। অর্থাৎ বাংলাদেশ থেকে মুজিবকে গেট আউট করো, মোশতাককে বসাও, অথবা জিয়াকে বসাও। ঘটনা ঘটেছেও তাই।
১৫ আগস্ট ১৯৭৫ এর দীর্ঘ ৪৮ বছর ধরে বাংলাদেশ সি.আই.এর এই খেলাই চলছে। কিসিঞ্জারের সেই তলাবিহীন ঝুড়ি এখন আর বাংলাদেশ নয়। বাংলাদেশের দারিদ্র বিমোচনের সাফল্য এখন বৈশ্বিক আলোচনার বিষয়। বিশ্বব্যাংক কর্তৃক নির্ধারিত মান অনুযায়ী ২০০৯ সালে বাংলাদেশের শতকরা প্রায় ৪১ ভাগ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল। ২০২২ সালে এটা নেমে এসেছে ১৮ ভাগে। গত ১৪ বছরে প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ দারিদ্র্য মুক্ত হয়েছে। এটি একটি বিশ্বরেকর্ড।
২০২০ সালে জানুয়ারিতে শপথ নেয়ার সময় প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ঘোষণা করেন তিনি, বিশ্বের দারিদ্র বিমোচনে কাজ করে যাবেন। সেই সূত্রে ২০২১ সালে ১০ মার্চ নিউইর্য়ক টাইমসে নিকোলাস ক্রিস্টড এক নিবন্ধে বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট বাইডেন দারিদ্র্য বিমোচনে কাজ করতে চাইলে বাংলাদেশের শেখ হাসিনাকে অনুসরণ করতে পারেন। এটিও মার্কিন প্রশাসন মেনে নিতে পারেননি। তাই এখন শেখ হাসিনাকে সরানোর জন্য মার্কিনীরা উঠে পড়ে লেগেছে।
’৭০ এ কিসিঞ্জারের নীতি ছিল ‘গেট আওয়ার পিপল্ ইন অ্যান্ড দেয়ার পিপল আউট’Ñসেই খেলা আজও চলছে। হাসিনাকে সরাও ইউনুসকে বসাও অথবা রেজা কিবরিয়াকে। সব থেকে ফিদেল ক্যাস্ট্রোর মুখের কথাটি কেড়ে নিয়েই বলছিÑএকটি বুলেট প্রতি মুহূর্তেই শেখ হাসিনাকে খুঁজছে। অতএব সাবধান, বাংলাদেশের জনগণ, সাবধান।
হোসাইন আনোয়ার, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট