অনুবাদ: জ্যোতির্ময় নন্দী
লেখক পরিচিতি : ফুয়াদ আল—তাকার্লি ইরাকের অগ্রণী কথাসাহিত্যিকদের একজন। তাঁর জন্ম ১৯২৭ সালে বাগদাদ শহরের কেন্দ্রস্থলে বাব এল্—শেখ এলাকায়। ১৯৪৯—এ তিনি বাগদাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে স্নাতক হন এবং বিচার মন্ত্রণালয়ে কাজ করেন। ১৯৫৬—তে তিনি একজন বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান। পরে তিনি বাগদাদের আপিল কোর্টের প্রধান হন। ১৯৬৪ থেকে ’৬৬ সাল পর্যন্ত তিনি প্যারিসে আইন অধ্যয়ন করেন এবং ১৯৮৩—তে চাকরি থেকে অবসর নেয়ার পর পূর্ণকালীন লেখালেখি শুরু করেন। ১৯৫১ সাল থেকে তিনি বেশ কয়েকটি ছোটগল্প, এককাভিনয়ের নাটক এবং তিনটি উপন্যাস প্রকাশ করেন। কিন্তু ১৯৮০—তে আরবি ভাষায় তাঁর যুগান্তকারী প্রথম উপন্যাস ‘আল—রাজিয়া আল—বাইদ’ (দীর্ঘকাল ধরে) প্রকাশিত হওয়ার পর তাঁর নাম চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৮৫ সালে বইটির ফরাসি অনুবাদ প্রকাশিত হয়। ‘দা লং ওয়ে ব্যাক’ নামে বইটির ক্যাথরিন কোভাম—কৃত ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয় ২০০১ সালে। সংযুক্ত আরব আমিরাত সরকার ২০০০ সালে আরবি ভাষার উপন্যাস ও সাহিত্যের জন্য ফুয়াদ আল— তিকারলিকে ওয়ায়েস পুরস্কারে ভূষিত করে। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর আল— তিকারলি ১৯৯০ সালে তিউনিসিয়ায় চলে যান। পরে তিনি দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে তিউনিসিয়ার ঔপন্যাসিক রাশিদা তুর্কিকে বিয়ে করেন। আল—তাকার্লি ১১ ফেব্রুয়ারি,২০০৮ সালে জর্ডানের আম্মানের একটি হাসপাতালে অগ্ন্যাশয়ের ক্যান্সারে মারা যান ৮০ বছর বয়সে। ২০০৩ সালের ইরাক যুদ্ধের পর ইরাকে যে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছিল তা থেকে বাঁচতে তিনি এবং তাঁর পরিবার তার আগের তিন বছর ধরে জর্ডানে বসবাস করে আসছিলেন। মৃত্যুকালে তিনি রেখে গেছেন তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী আর তাঁদের এক পুত্র, এবং সেইসাথে তাঁর আগের স্ত্রীর গর্ভজাত তিন কন্যাকে। এখানে অনূদিত গল্পটি নেয়া হয়েছে আল—তিকারলি ‘টেলস ফ্রম দা ইনভিজিবল ওয়ার্ল্ড’ (ইংরেজি অনুবাদ) থেকে। এতে তিনি দেখানোর চেষ্টা করেছেন, নিজের অবস্থায় সন্তুষ্ট থেকে এবং তাকে মেনে নিয়ে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে চেয়েও মানুষ শেষপর্যন্ত কিভাবে ব্যর্থ হয়।] আল—রাজিয়া আল—বাইদ (দ্য লং ওয়ে ব্যাক) বইটিতে ইরাকি রাজতন্ত্রের পতনের পরের বছরগুলিতে প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনসহ বেশ কয়েকজন নিপীড়ক ইরাকি শাসকের অধীনে বাগদাদের একটি পরিবারের চার প্রজন্মের নানা নিগ্রহ ও বিচার চিত্রিত করা হয়েছে। আল—তিকারলি এ উপন্যাসটি ছিলো এমন কয়েকটি বইয়ের মধ্যে একটি, যেগুলোতে প্রকাশ্যে ইরাক সরকারের সমালোচনা করা হয়েছে। আল—তিকারলি কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ছিল না এবং আরব সমাজতান্ত্রিক বাথ পার্টি বা সাদ্দাম হোসেনের শাসনের সাথে তিনি যুক্ত ছিলেন না। আল— তিকারলি আরো কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বই হলো: ‘আল ওয়াঝ আল আখার’ (অন্য চেহারা), ‘মাওয়িদ আল নার’ (অগ্নিকাল), ‘আল কাফ’ (খজুর্র বৃক্ষ), ‘খাতাম আল রামল’ (বালুর বলয়), ‘আল আওজাওয়াল মাসাররাত’ (আনন্দ ও বেদনা), ‘আল সাখরা’ (পাথর), ‘বাসকা ফি ওয়াঝ আল হায়াত’ (জীবনের মুখে থুতু) প্রভৃতি।
সবার না হলেও, কিছু কিছু মানুষের ভেতরে তৃপ্তি আর সন্তুষ্টির একটা ভাণ্ডার থাকে, যেটা মাঝে মাঝে উপচে পড়ে, এবং কখনো কখনো জীবনের চাপ আর তিক্ততাগুলোকে সহনীয় করে তোলে। মানসিক সন্তুষ্টির এই প্রাচুর্য দারিদে্র্যর অভিশাপকে পরিণত করে একটা সহনীয় পরিস্থিতিতে আর বঞ্চনাকে পরিবর্তন বা বিস্মরণযোগ্য কিছুতে।
আমার বাবা যখন বেঁচে ছিলেন, আমার মা, বোনেরা আর আমি একটা মোটামুটি সচ্ছল জীবনযাপন করতাম। আমাদের ভালো খাবার দাবার আর পোশাক আশাকের কোনো অভাব ছিলো না। আমরা ছিলাম যাকে বলে একটা অভিজাত আর সম্মানিত পরিবারের বংশধর। পরিবারটা ছিলো ভাগ্যের অনেক ওঠাপড়ার সাক্ষী, যার ফলে এটা ক্রমে ক্রমে তার সম্পদ আর সামাজিক মর্যাদা অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছিলো। বাবা বুড়ো হয়ে চাকরি থেকে অবসর নেয়ার পর তাঁর স্বল্প অবসর ভাতা দিয়ে কোনোমতে আমাদের চলতে হচ্ছিলো।
আমার মা ছিলেন আমার বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী। মায়ের গর্ভে যখন আমার আর আমার তিন বোনের জন্ম হল, তখন বাবার বয়স পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে। এমনটা বাবা তাঁর নিজের বা স্ত্রী—সন্তানদের জন্যে চান নি। অবশ্য কোনো বিয়ের কত বছর পর বাচ্চাকাচ্চা জন্মাবে সেটা নিয়ে কোনো ভবিষ্যদ্বাণী করা তো সম্ভব নয়। সর্বশক্তিমান আমার বাবা—মাকে দয়া করলেন বিয়ের মাত্র দশ বছর পর এবং তাঁরা আমাদের পেলেন। একদিকে আমরা ছিলাম তাঁদের একাকিত্বে সান্ত্বনার প্রলেপ, কিন্তু অন্যদিকে আমরা তাদের আর্থিক বোঝা বাড়িয়ে তুলেছিলাম।
দীর্ঘদিন ধরে উপশম না হওয়া এক রোগে ভুগে বাবা মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমার তিন বোন আর আমাকে কখনোই কোনো আর্থিক কষ্টের মধ্যে পড়তে হয় নি। আমার বয়স তখন মাত্র ষোলো বছর, আর আমাদের অজানা কোনো কারণে আমাদের দুনিয়াটা ভেঙেচুরে গেলো আর নিয়তি আমাদের সঙ্গে কঠোর আচরণ করতে লাগলো।
আমি তখন ছিলাম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষে, আমার বিশ^বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করার জন্যে সাগ্রহে অপেক্ষমান। অবশ্য এ ব্যাপারে আমি যে খুব একটা স্থিরপ্রতিজ্ঞ ছিলাম তা নয়। আমার মনোযোগকে বিক্ষিপ্ত করে রাখা পরিপাশ^র্কেও আমি এড়াতে পারছিলাম না। বাব এল্—শেখ মহল্লার প্রান্তসীমায় রা’স আল্—চোলে আমাদের বাড়িতে যখন বাড়িওয়ালা এসে আমাদের দুমাসের বকেয়া ভাড়া চাইলো, আমি তার কাছে ঠিকমতো ক্ষমাপ্রার্থনা পর্যন্ত করতে পারি নি, আর সে আমার সঙ্গে যেরকম রুক্ষ আর রূঢ় ভাষায় কথা বলেছে, অজানা কোনো কারণে আমি তার সমুচিত জবাবও দিতে পারি নি। ছোটলোকের বাচ্চা বাড়িওয়ালাটা কিভাবে আমার বাবার স্মৃতির আর আমাদের পারিবারিক মর্যাদার অমর্যাদা করেছে, তার বিবরণ মাকে দেয়ার সময় আমার দুচোখ জলে ভরে গেলো।
মা আমাকে সস্নেহে জড়িয়ে ধরে বললেন, “আল্লাহ্ তাকে মাফ করুন! তুই ঠিক বলেছিস, বাছা, তোদের পরিবারের অনেক টাকা না থাকতে পারে, কিন্তু একটা মর্যাদা আছে… ওটা ঠিক হয় নি, কারুরই ওটা সহ্য করার কথা নয়। চল্, আমরা সবাই মিলে একটা ব্যবস্থা করি।”
আমরা অবশ্যই একটা ব্যবস্থা করলাম, সেটা হলো অপেক্ষাকৃত ছোট একটা বাসায় চলে যাওয়া। আমি আমার পড়াও ছেড়ে দিলাম, এবং আমার চাচা আমাকে তেল শোধনাগারগুলোতে হাতে কলমে পেট্রোকেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার জন্যে একটা টেকনিক্যাল কলেজে অ্যাপ্রেন্টিসশিপ যোগাড় করে দিলেন। এতে আমি পড়াশোনার পাশাপাশি কিছু টাকাও কামাতে লাগলাম।
আমার নিরক্ষর কিন্তু কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন মা আমার বাবার সঙ্গে তাঁর আনন্দের দিনগুলোর কথা স্মরণ করতেন না, আমরা যা যা হারিয়েছি সেসব নিয়ে খুব একটা দুঃখও করতেন না। তার বদলে তিনি খুব স্বাভাবিকভাবে আর ভালোবাসার সঙ্গে সমস্ত মনোযোগ দিয়েছিলেন তাঁর এখন যা আছে, অর্থাৎ তাঁর তিনটি কন্যা আর পুত্রটি, যে কিনা ইতোমধ্যেই সৎভাবে কিছু টাকা উপার্জন করছে, তাদের ওপর।
তাঁর মধ্যে এই তৃপ্তি আর সন্তুষ্টির দুর্লভ সঞ্চয় ছিলো। তিনি যখন আমার প্রথম বেতন প্রাপ্তি উদযাপন করলেন, তখনো আমার বয়স আঠেরোও হয় নি। তিনি আমাদের সবাইকে জড়ো করলেন একটা ছোট টেবিল ঘিরে, যেটার ওপর তিনি মোমবাতিসহ একটা সুন্দর কেক রেখেছিলেন। ঘরের অলোর সুইচ অফ করে দিয়ে তিনি আমাদের সবার উদ্দেশ্যে বললেন, “তোমাদের নিজেদের দিকে তাকাও! দেখো, তোমরা কত সুন্দর! কী সুন্দর সব তাজা তরুণ মুখশ্রী! চলো আমরা অতীতের সব কথা ভুলে যাই, আর এখন আমাদের যা আছে—— আমাদের সুস্বাস্থ্য আর সুন্দর চেহারা—— এগুলো নিয়ে আনন্দ বোধ করি!”
একটা চমৎকার সন্ধ্যা ছিলো ওটা। আমার বোনেরা আর আমি ওটার কথা সারা জীবন মনে রাখবো। এর পর আমাদের জীবনে যত দুঃখ—কষ্ট, আনন্দ, সঙ্কট এসেছে, আমাদেরকে তা মেনে নিতেই হয়েছে। পেট্রোকেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট থেকে আমার পাস করে বেরুনোটা খুব একটা সহজসাধ্য হয় নি। ওখানে চূড়ান্ত পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে আমাকে বাড়তি আরো এক বছর পড়তে হয়েছিলো। এই বাড়তি এক বছর পড়াটা যে আমার জন্যে খুবই লাভজনক হয়েছে, এ ব্যাপারে আমার মায়ের মনে কিছুমাত্র সন্দেহ ছিলো না।
টেকনিক্যাল কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েট হওয়া পর আমি বাগদাদের অদূরে এক তেল শোধনাগারে সরাসরি চাকরি পেয়ে গেলাম। এর ফলে আমাদের অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলো, বস্তুগত ও মনস্তাত্ত্বিক উভয় দিক থেকেই, এবং আমরা বহু লোকের ঈর্ষার পাত্র হয়ে দাঁড়ালাম। কম ভাড়ার ছোট বাসাটা আমরা আর বদলালাম না, কারো কাছ থেকে কোনো ধারদেনাও করলাম না। কেটে যাওয়া সময় আমাদের পারিবারিক সম্প্রীতিতে এবং স্নেহ—ভালোবাসা আর সহমর্মিতা দিয়ে আমাদেরকে ডুবিয়ে রাখা একজন নারীর সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ট বন্ধনে কোনো প্রভাব ফেলতে পারলো না। আমার বোনেরা পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারছে, এজন্যে তাদের প্রতি আমার কোনো ঈর্ষা ছিলো না। বরং তার উল্টোটা—— তাদেরকে নিয়ে আমার খুব আনন্দই হতো। আমার বয়স যখন পঁচিশ বছর, এক বোনের বিয়ে হয়ে গেলো। সে—সময়ে যদিও আমার নিজের বিয়েশাদি নিয়ে কোনো ভাবনাচিন্তা ছিলো না, তবুও বিষয়টা নিয়ে মাঝে মাঝে নিরিবিলিতে মায়ের সঙ্গে আলোচনা করতাম। শুভকাজটা হতে আর খুব বেশি দেরি নেই, এই আনন্দদায়ক আশাবাদের মধ্যে দিয়ে আমাদের আলোচনা শেষ হতো।
বিপ্লবের পর আমাকে দৌরা তেল শোধনাগারের পরিষেবা বিভাগের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেয়া হলো। এতে আমার বেতন বাড়লেও আমার উচ্চাকাক্সক্ষা একটুও বাড়ে নি। মায়ের মতো আমার মধ্যেও একটা সন্তোষের ভাব ছিলো, যা আমার মনকে ভালো লাগায় ভরিয়ে রাখতো। জীবন নিয়ে আমার কোনো দার্শনিকতা ছিলো না। আমার মনে হতো, জীবন, অথবা বলা চলে জীবন আমাদের যেসব বস্তুগত অধিকার এনে দেয় সেগুলো, তাদের পেছু নেয়ার জন্যে মানুষকে বাধ্য করে নি বা প্রলোভিত করে নি। আসলে মানুষের নিজের মধ্যেই মালিকানা আর নিয়ন্ত্রণ লাভের একটা কামনা লালন করে, আর এজন্যে বৈধ উচ্চাভিলাষের ছদ্মাবরণে নানা অপরাধ করে। এ নিয়ে আমি মায়ের সঙ্গে কথা বলেছি। আমি আগেই জানিয়েছি তিনি নিরক্ষর, কিন্তু আমার চিন্তার ধরণটার তিনি প্রশংসা করলেন আর তার মর্মার্থটাও ধরতে পারলেন। এটা তাঁকে এতটাই স্পর্শ করলো যে, তিনি উঠে এসে আমাকে চুমু খেলেন আর আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলেন আমাকে সুস্থ নীরোগ রাখার জন্যে।
আমার তিন বোনের সবার একে একে বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর আমি আর মা আমাদের ছোট বাসাটায় নিজেদের মতো থাকতাম। তবে আমরা এতে মোটেও মন খারাপ করতাম না। কারণ আমাদের সমাজে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেয়া আর স্বামীগৃহে গিয়ে তাদের জীবন তাদের নিজেদের মতো চালিয়ে নেয়াটাই স্বাভাবিক রীতি।
শরতের শুরুর একটা দিনের কথা। আমার বয়স তখন আঠাশ বছর। আমি তখন কাজে ব্যস্ত ছিলাম, তবে বিশেষকিছু যে করছিলাম তা নয়। এমন সময় তেল শোধনাগারটির গবেষণাগারগুলোর মহাব্যবস্থাপক আহমেদ রাগিব আমাকে ডেকে পাঠালেন। তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্যে আমি হাত ধুয়ে কাপড় বদলে আসতে গেলাম। কিছুটা অদ্ভুত ধরনের এ আমন্ত্রণটার কারণ নিয়ে আমি তেমন মাথা ঘামাই নি বা ব্যাপারটাকে তেমন একটা গুরুত্বও দিই নি। রিসেপশানে কয়েক মিনিট অপেক্ষার পর আমাকে তাঁর সুবিশাল ও সুসজ্জিত অফিস কক্ষে নিয়ে যাওয়া হলো। ভালো পোশাক আশাক পরা, মোটাসোটা শরীর আর তীক্ষè দৃষ্টির একজন লোক ছিলেন উনি।
তিনি আমাকে স্বাগত জানালেন খানিকটা যেন গাম্ভীর্যের সঙ্গে। আমার সঙ্গে করমর্দন করার জন্যে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “আসুন, জনাব আবদুল রহমান। বসুন।”
এ লোকটার কর্মদক্ষতা আর ব্যবস্থাপন কুশলতা সম্পর্কে অনেক শুনেছি। ভাবলাম, ইনি হয়তো আমাকে অন্য একটা প্ল্যান্টে পাঠিয়ে দেবেন। কোথায় পাঠাতে পারেন তা নিয়ে আমার অতো মাথাব্যথা ছিলো না। শেষে দেখা গেলো, ব্যাপারটা অত গুরুতর কিছু না। কলকব্জা মেরামতে আমার অভিজ্ঞতার কথা তাঁর জানা ছিলো। উনি আমাকে বললেন, তাঁকে অফিস থেকে বরাদ্দ দেয়া বাসভবনের অয়েল হিটিং সিস্টেমটা ব্যবহারের আগে ওটা ঠিক আছে কিনা একটু দেখতে। আগের বছর ওটা বিকল হয়ে গিয়েছিলো, এবং তারপর আর ঠিকমতো সারাই করা হয় নি। উনি আরো জানালেন যে, উনি যে—বাড়িটায় থাকেন ওটার মালিক সরকার এবং তিনি ভয় পাচ্ছেন কোনো আনাড়ি মেকানিকের হাতে পড়লে ওটা ভালোর বদলে আরো খারাপ হয়ে পড়বে। আমি তাঁর কথার সঙ্গে একমত হলাম এবং একটু হাসলাম। ভদ্রভাবে তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, কাজটা কখন শুরু করবো। তিনি বললেন, সম্ভব হলে সোজা এখনই শুরু করে দিতে। তারপর তিনি তাঁর সেক্রেটারি মেয়েটাকে ডেকে নির্দেশ দিলেন, তাঁর গাড়ির ড্রাইভারকে যেন বলে দেয় আমাকে তাঁর বাড়িতে পৌঁছে দিতে এবং পরে আবার অফিসে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে।
মহাব্যবস্থাপকের বাড়িটা শোধনাগার থেকে খুব বেশি দূরে নয়। গাড়িতে মাত্র মিনিট দশেকের পথ যাওয়ার পর চালক একটা পরিষ্কার—পরিচ্ছন্ন রাস্তার শেষপ্রান্তে দেখা দেয়া একটা সাদা দোতলা বাড়ির দিকে আঙুল তুলে দেখালো। বাড়িটার চারপাশে অনেকটা জায়গা জুড়ে বিশাল বাগান, যেখানে সবুজ সব গাছপালা সেপ্টেম্বরের সূর্যের নিচে যেন ঝলমল করছিলো। আমার আসার কথা বাড়ির ভেতরে জানানো হলো। বাগানের মালি বসে ছিলো বাড়িটার বাইরের দরজার পাশে, আর কাজের মেয়েটা প্রধান প্রবেশপথের মুখোমুখি ব্যালকনিতে। মেয়েটা আমাকে বাড়ির পেছনে বয়লার রুমে নিয়ে গেলো। সে ছিলো সাফসুতরা কাপড়চোপড় পরা ভদ্র আচার—আচরণের একজন তরুণী, আমাদের স্তরের লোকজনের সাথে একধরণের তাচ্ছিল্যের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে একদম পটু।
আমি প্রধান বয়লারটা কিছুক্ষণ খুব ভালো করে খুঁটিয়ে দেখলাম। দেখতে পেলাম, ওটাতে সামান্য একটু গলদ তৈরি হয়েছে আগেকার কোনো মিস্ত্রির আনাড়ি হাতের একটা ঝালাইয়ের কারণে। ওটা মেরামত করতে আমার কোনো কষ্টই হলো না। এর পর বাড়ির ভেতরে গিয়ে পুরো লাইনটা পরীক্ষা করে দেখার জন্যে কাজের মেয়েটাকে ডেকে অনুরোধ জানালাম, বাড়ির গিন্নিকে খবর দিয়ে আমাকে ভেতরে নিয়ে যেতে। ওটা করতে আমার মাত্র কয়েক মিনিট লাগলো, এবং পুরো হিটিং সিস্টেমটার আর কোথাও কোনো ত্রুটি আমার চোখে পড়লো না। তারপর ভাবলাম, সুইচ অন করে সিস্টেমটা ঠিকমতো কাজ করছে কিনা সেটা একটু দেখে নিলে ভালো হবে। কাজের মেয়েটাকে সে—কথা জানালাম, যাতে সে বাড়ির গিন্নিকে খবরটা দিতে পারে। মেয়েটা একটু ইতস্তত করে, তারপর আমাকে বাইরে ঝুলবারান্দায় দাঁড় করিয়ে রেখে ভেতরে গেলো তার মনিবানিকে খবর দিতে। বয়লারের তেলকালি লেগে আমার হাতটা ময়লা হয়ে গিয়েছিলো, তাই আমি একটা টিস্যু কাগজ দিয়ে সেটা মুছতে লাগলাম। ঝুলবারান্দায় দাঁড়িয়ে আমি তাকিয়েছিলাম বাগানটার বিশাল বিস্তারের দিকে, যেটাকে মনে হচ্ছিলো অন্তহীন, দীর্ঘ আর দোদুল্যমান বৃক্ষরাজি যার দিগন্তরেখা ঢেকে রেখেছে। ওদিক থেকে মুখ ফেরানোর আগেই আমি একটা পরিচিত, উষ্ণ কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম।
“মাফ করবেন, এটার কি সত্যিই কোনো দরকার…”
সে দাঁড়িয়ে ছিলো দরজার মুখে, হালকা নীল পোশাকে উজ্জ্বল হয়ে ওঠা চেহারায়। আমি তার দিকে ফেরার পর সে আমার মুখের দিকে তাকালো।
“ওমা, আবদুল রহমান! জনাব আবদুল রহমান? সত্যিই এটা তুমি?”
সে তার অনেকগুলো আংটি পরা হাত তুলে মুখে চাপা দিলো।
আমার সারা জীবন ধরে আমি বিশ^াস করে এসেছি যে, শান্ত অবস্থার পর কখনো ঝড় আসে না, এবং অতীতকে পেছনে ফেলে এসে শেষপর্যন্ত একটা ধীর, শান্ত জীবনযাপন সম্ভব। আমার এ মনোভাব ত্যাগ করতে আমি রাজি ছিলাম না, কিন্তু আমার মা তাতে বাদ সাধলেন।
তিনি বললেন, “খাদিজাকে তুই ভুলে গেলি কী করে, বাছা? হঠাৎ করেই সে আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলো সেটা তো খুব বেশিদিন আগের কথা নয়! কিন্তু… কী বোকার মতো কথা বলছি! এটা দশ বছর আগের কথা… না… বারো বছরও হতে পারে, বা তার চেয়েও বেশি। ওহ্, খোদা! আমার মনে হচ্ছে যেন কয়েক ঘণ্টা আগের ঘটনা! তু্ই কি বলছিস যে, আমার সঙ্গে দেখা করার জন্যে সে খুব আগ্রহ দেখিয়েছে?”
আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম।
মাঝে মাঝে সে আমাদের বাড়িতে আসতো, তার মায়ের সঙ্গে। সে তখন ছিলো তেরো বছরের কিশোরী—— কালো চুল, কালো চোখ আর ফ্যাকাশে সাদা গায়ের রঙের এক অসম্ভব সুন্দর মেয়ে। তার মা তাকে আমাদের সঙ্গে রেখে যেতো। কেন, সেটা আমি কখনো জানতে পারি নি। খাদিজা আমাদের বাড়ির কাজকর্মে আমার মা আর বোনদের সাহায্য করতো। আমার প্রতি তার অনুরক্তি সে গোপন করতো না। আমি কিছু চাইলে সে কখনো প্রত্যাখ্যান করে নি, এবং আমাকে খুশি করার জন্যে সবসময়ে ছিলো একপায়ে খাড়া। অন্যদিকে আমি তখন বছর চৌদ্দর বুনো বয়সে, একটু চাপা আর লাজুক স্বভাবের, এবং পুঁচকে মেয়েদের দিকে নজর দেয়ার সময় একদম নেই এমন দেমাকি হাবভাবের। খাদিজা আমার দিকে ঝলমলে চোখে তাকাতো, আর যখনই আমি তার সঙ্গে কথা বলতাম বা তাকে কিছু করতে বলতাম, তার গাল দুটো লজ্জায় লাল হয়ে যেতো।
মা আরো বললেন, “সে কে, এটা তুই জিজ্ঞেস করলি কী করে? তা হলে… তুই কি জানিস না? সে আলি আসগরের মেয়ে। উনি ছিলেন তোর চাচার গ্রুপের একজন সার্জেন্ট মেজর আর তাঁর সহকারী। খাদিজার বেচারি মা’টা আমাকে খুব ভালোবাসতো। সে আমাকে প্রায়ই দেখতে আসতো আর খাদিজাকে আমাদের কাছে রেখে যেতো, যাতে সে তোর চাচার বাসার কাজ থেকে ফেরা পর্যন্ত মেয়েটা আমাকে বাড়ির কাজে সাহায্য করতে আর তোর বোনদের সঙ্গে খেলা করতে পারে। মানুষের কপাল সবকিছুকে কত পাল্টে দিতে পারে! সে তোদের ব্যবন্থাপনা পরিচালকের স্ত্রী বললি, তাই না? ভাগ্য পুরো উল্টে যাওয়ার কথাটা একবার ভেবে দেখ্ তো!”
এর পর আমার সরল আর উত্তেজনাহীন জীবনের গোপন ভারসাম্যটা পুনরুদ্ধার করার একটা প্রয়োজন দেখা দিলো। কিন্তু দুর্ভাগ্যের ব্যপার হলো, অতীতের স্মৃতিগুলো আমাকে সেটা করতে দিচ্ছিলো না।
গরমের সেই ছুটির দিনে আমরা ছিলাম পাখির মতো মুক্ত। আমার বোনেরা, খাদিজা আর আমি শৈশবের নিষ্পাপ মন নিয়ে আমাদের বড় বাড়িটার সর্বত্র প্রাণভরে ছোটাছুটি করে খেলা করছিলাম। যে খেলাটা আমরা সবচেয়ে বেশি খেলতাম, সেটা হলো লুকোচুরি। খেলাটায় প্রচুর উত্তেজনা আর ফন্দিফিকির ছিলো, আর আমরা অন্য যেকোনো খেলার চেয়ে এটাকেই বেশি পছন্দ করতাম। সেদিন হলো কি, আমি আর খাদিজা একবার গিয়ে লুকালাম বাড়িটার কামরাগুলোর একটাতে স্তূপ করে রাখা লেপতোশকের পেছনে এক অন্ধকার কোণে। আমার সবচেয়ে ছোট বোনটার চোখে পড়ে যাবো, এ আশঙ্কা নিয়ে আমরা দুজন একসাথে ঘেঁষাঘেঁষি করে দেয়ালের সঙ্গে গা মিশিয়ে বসেছিলাম। এভাবে তার পাশ ঘেঁষে বসে থাকার সময় হঠাৎ করেই আমাদের দুজনের নবীন দেহের মিলিত উত্তাপ আমি অনুভব করতে লাগলাম। অনুভব করলাম, আমার কাঁধ তার উদ্ভিন্ন স্তনের সঙ্গে ঘষা খাচ্ছে। তার নিবিড় কালো কেশরাশির মাঝখানে তার উজ্জ্বল চোখ দুটো আনন্দে ঝলমল করছিলো। আমার সারা শরীর তখন কাঁপছিলো, অবচেতনভাবে ইচ্ছে করছিলো তার আরো কাছে ঘেঁষে হাত বাড়িয়ে তাকে জড়িয়ে ধরতে। এক বিবশ মাতাল আনন্দে আমি তাকে বুকে টেনে নিলাম। আমি তাকে আমার বুকের মধ্যে পিষে ফেলছিলাম, আর সে তার শরীর পুরোপুরি আমার ওপর ছেড়ে দিলে আমি তার শরীরের উঁচু—নিচু ঢেউগুলো অনুভব করতে পারছিলাম।
মানুষের মন থেকে কোনো স্মৃতি অকারণে মুছে যায় না। কেউ সতর্ক না হলে এটা তার সর্বনাশের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
আমি তখন কী একটা যেন করছিলাম আর কাজটাতে মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করছিলাম। এমন সময় মহাব্যবস্থাপক আমাকে আবার ডেকে পাঠালেন।
“অনেক ধন্যবাদ, মি. আবদুল রহমান! হিটিং সিস্টেমটা আমরা গতকাল থেকে চালু করেছি। চমৎকার কাজ করছে ওটা। এর জন্যে অবশ্যই একটা বিরাট ধন্যবাদ আপনার প্রাপ্য।” কথাগুলো বলার সময় সারাক্ষণই তিনি তাঁর ডেস্কের একটা ড্রয়ার টানাটানিতে ব্যস্ত ছিলেন, মুখ তুলে আমার দিকে একবারও তাকান নি। “আচ্ছা, কয়েক বছর আগে আমার স্ত্রী আর আপনি কি পরস্পরের পড়শি ছিলেন?”
আমি ছিলাম বলে জানানোর পর তিনি মাথা তুলে আমার দিকে তাকালেন, তাঁর হাতে একটা প্যাকেট। তাঁর চোখের দৃষ্টিটা আমার ভালো লাগলো না। প্যাকেটটা আমার দিকে বাড়িয়ে ধরে তিনি বললেন, “আপনার চমৎকার কাজের মূল্যায়ন হিসেবে আমার পক্ষ থেকে এই সামান্য উপহারটা নিন। আশা করি বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে এটা আপনি গ্রহণ করবেন।”
আমি একটু বিব্রত হয়ে পড়ে তোতলাতে লাগলাম। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে আবার বললেন, “আজকে আপনি আমার গাড়িটা নিয়ে আপনাদের বাড়ি পর্যন্ত যাবেন, যাতে ড্রাইভার বাড়িটা চিনে আসতে পারে। আমার স্ত্রী কালকে আপনার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে যেতে চান। অবশ্য এতে যদি আপনাদের কোনো
আপত্তি না থাকে।”
পরে মা আমাকে খাদিজার এই বেড়াতে আসার পুরো বিবরণ দিয়েছেন: “সে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমুর পর চুমু খেতে লাগলো—— আমার হাতে, গালে, কাঁধে, চুলে—— সর্বত্র। আমার ভয় হচ্ছিলো, সে তার কোলের বাচ্চাটাকে মাটিতে ফেলে দেবে। তোর প্রতি ভালোবাসার জন্যেই সে বাচ্চাটার নাম রেখেছে তোর নামে—— আবদুল রহমান। বুঝতে পেরেছিস?
“তার বাবা চাকরি থেকে অবসর নেয়ার পর, এবং আরো পরে কিকুর্কের কাছে তাদের তুর্কমেন গ্রামে তাঁর মৃত্যুর পর, তাদের যে কঠিন সময় গেছে আর যেসব কষ্ট সইতে হয়েছে, সেসব শুনে খুব দুঃখ পেয়েছি। সে আমাকে বলেছে, তার মা কিভাবে বাগদাদে আমাদের কাছে ফিরে আসতে চেয়েছে। অবশ্য অসুস্থতার কারণে সে অক্ষম হয়ে পড়েছিলো। আল্লাহ্ তার আত্মাকে শান্তি দিন!
“শেষপর্যন্ত খাদিজার বিয়ে হয়ে গেছে পাঁচ বছর আগে। সে এখন এখানেই থাকে। সে আমাকে জিজ্ঞেস করছিলো, বাব এল্—শেখের সঙ্গে কোনোরকম যোগাযোগ আছে এমন কারো কথা আমাদের জানা আছে কিনা। মজুরের ওভারঅল পরা আর হাতে তেলকালি মাখা অবস্থায় তোকে সামনে দেখতে পেয়ে তার কলজেটা নাকি প্রায় থেমে গিয়েছিলো। সে সত্যিই একজন খাঁটি মানুষ! আমার জন্যে আর তোর বোনদের জন্যে সে কত যে উপহার এনেছে যদি দেখতিস!”
পরে আমি যেখানেই যাই, স্মৃতিগুলো আমাকে ক্রমশ পেয়ে বসছিলো, আর ওগুলোকে বার বার মনের মধ্যে ডেকে আনা ছাড়া আমার আর কী করার আছে বুঝতে পারছিলাম না। ভাবতাম, ওগুলোকে হয়তো আমি শেষপর্যন্ত হজম করে ফেলতে পারবো আর আমার মন থেকে ওগুলোর প্রভাব দূর হয়ে যাবে।
আমাদের সেদিনের সেই আকস্মিক ঘনিষ্টতার সময় বুঝতে পেরেছিলাম, নারী—পুরুষের সম্পর্ক আর তার আনন্দ সম্পর্কে সে আমার চেয়ে বেশি জানে। তাকে চুমু খাওয়ার জন্যে আমি অনেক দ্বিধার সঙ্গে তার গালে আমার ঠোঁট রাখার সাথে সাথে আমি অনুভব করেছিলাম, তার কোমল দুটো বাহু আমাকে জড়িয়ে ধরছে আর তার ঠোঁট চেপে বসছে আমার ঠোঁট দুটোকে খুঁজে নিয়ে তাদের ওপর। ওটা ছিলো একটা মৃদু কিন্তু উত্তপ্ত চুম্বন। চুমুটা আমাকে একেবারে বিহ্বল করে ফেললো আর আমরা দুজনকে বাকি জগৎ থেকে আলাদা করে দূরে কোথায় নিয়ে গেলো। আমাদের এই কাণ্ডটা কিন্তু আর কারো চোখে পড়ে নি, এবং একসময় আমরা আমাদের লুকানোর জায়গা থেকে বেরিয়ে এসে ফের খেলায় যোগ দিলাম। আমার চুমুর কোনো চিহ্ন তার উষ্ণ, চকচকে ঠোঁটে কোথাও অবশিষ্ট ছিলো না, কারণ সে তার জিভ দিয়ে ওগুলো চেটে নিয়েছিলো।
খাদিজার স্বামীর বাড়িতে তার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকে আমার কী যে হয়ে গেলো জানি না। আমি এক সার্বক্ষণিক বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে গেলাম, যেটা আমার মায়ের চেয়েও বেশি আমাকে চিন্তিত করে তুললো। আমার জীবনে নতুন কিছুই যে ঘটে নি, সে—ব্যাপারে আমি নিশ্চিত ছিলাম। কিন্তু তারপরও কেন যে কাজকর্মে আমার মন বসছিলো না আর আমার চারপাশের যন্ত্রপাতির জগতের প্রতি অস্বাভাবিকভাবে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছিলাম, সেটা বুঝতে পারছিলাম না। সবকিছুই স্বাভাবিক ছিলো, আর স্মরণাতীত কাল থেকে তাদের নিজ নিজ জায়গাতেই ছিলো। শুধু আমার হৃদয়টাই অবিরাম আলোড়িত হচ্ছিলো।
সে তার গুরুত্বপূর্ণ স্বামীর মাধ্যমে তাদের অভিজাত বাড়িতে আমাদের সবাইকে নৈশভোজের নিমন্ত্রণ জানালো—— আমাদের সবাইকে: আমার মা, তিন বোন, তাদের স্বামীরা আর বাচ্চাকাচ্চারা, আর আমি—— সবাইকেই। “তোমরা সবাই… একেবারে সবাই আমাদের বাড়ি আসবে!” এরকম আন্তরিক কামনার পর কৃতজ্ঞচিত্তে নিমন্ত্রণটা গ্রহণ করা ছাড়া আমাদের আর কিছু করার ছিলো না।
অন্যদের চোখের আড়ালে আমাদের দুজনের একসাথে থাকার মুহূর্তগুলো আর চুমুগুলো মনে হলো যেন আমার কপালে আর আকাশে খোদাই হয়ে আছে। আমার মনের মধ্যে দিয়ে ওগুলো ছুটে গিয়ে আমাদের আরো কিছু আবেগতপ্ত সান্নিধ্যের কথা মনে পড়িয়ে দিচ্ছিলো। আমার মনে পড়লো তার জন্যে আমার ক্ষুধার কথা—— এক বিশেষ ধরনের ক্ষুধা, যা দেহ আর মনকে আর তাদের মাঝখানের সবকিছুকে গ্রাস করে নিতো। সংক্ষিপ্ততম কয়েকটি মুহূর্ত ছাড়া বাকি সময়ে এক মুহূর্তও আমি তার কাছ থেকে দূরে থাকা সহ্য করতে পারতাম না, আর শুধুমাত্র তার সঙ্গে সময় কাটানোর জন্যে আমি সবকিছু করতাম। সবসময় এটা সম্ভব হতো না, আর যখনই সে আমাকে ছেড়ে যেতো, তার জন্যে আমার ক্ষুধা এক প্রতিশোধাত্মক রূপ নিয়ে ফিরে এসে আমার বুক আর সমস্ত সত্তা পুড়িয়ে দিতো।
ওদের বিশাল বাগানের মধ্যে দিয়ে বাড়ির প্রবেশপথের দিকে আমরা সাবধানে এগিয়ে গেলাম। তখন শরৎকাল চলে এসেছে আর আমাদের ঘিরে ধরেছে তার সন্ধ্যা আর আকাশের ঘন নীল দিয়ে। আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণের আর বাড়িতে যেমন করি তেমন আচরণের জোর চেষ্টা করতে করতে মায়ের পাশে পাশে হাঁটছিলাম। নৈশভোজ অনুষ্ঠানটা ছিলো নানান আবেগ প্রকাশের, দুঃখের স্মৃতিচারণের, অন্তহীন আকুলতার, ঝলমলে আলোর, উল্লসিত কলরব আর বাচ্চাদের গানবাজনার এক উৎসব। তাকে তার স্বামী আর সুন্দর বাচ্চাটার সাথে বেশ মানানসই দেখাচ্ছিলো।
সে আমাকে কিছু বলছিলো ক্বচিত—কদাচিত। তবে আমি কোনো কথা বললে তা শুনছিলো সবকিছু বাদ দিয়ে কান খাড়া করে। মাঝে মাঝে আমার চোখে পড়ছিলো, সে কেমন যেন অন্যরকমের একটা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, যদিও সেটা হয়তো খুব বেশি হলে সেকেন্ড খানেকের জন্যে। সে ঝকঝকে মুক্তো দিয়ে এমব্রয়ডারি করা একটা কালো স্যুট পরে কাঁচের বাসনের শেল্ফটার সামনে দাঁড়িয়ে সে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো গভীর মনোযোগী আর জ¦লজ¦লে চোখে, যাতে খানিকটা গোপন দুঃখও হয়তো ছায়া ফেলেছিলো। আমাদের চোখাচোখি হতে গেলেই সে মার্জিতভাবে সরে যাচ্ছিলো কামরার অন্যপাশে। অনেকগুলো বছর আগে সে যেভাবে তাকাতো, এখনো তার তাকানোটা ওরকমই।
হৈচৈ আর আনন্দে ভরা সেই সকালটায় আমরা সময় থেকে কিছু অমূল্য মুহূর্ত চেয়ে নিয়েছিলাম, কোনোকিছুর তোয়াক্কা না করে। আমরা সেই ছোট কামরাটায় চলে গিয়েছিলাম, যেটাকে আমরা বলতাম ‘কাফ্শ্কান’। আমরা বেশি কথাবার্তা বললাম না, বিশেষ করে সে। আমরা একটা ওয়ার্ডরোবের পেছনে একটা সঙ্কীর্ণ কোণায় চলে গিয়ে আকূলভাবে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরলাম। আশ্চর্য মেয়েটার জন্যে আমার খিদে তখন তুঙ্গে। আমাদের চুমুগুলো আমাদেরকে ডুবিয়ে দিলো বাকি জগৎ সম্পর্কে এক বিশাল বিস্মৃতির সাগরে, আর আমি আমার কাঁপতে থাকা হাতে তার পোশাক খুলে ফেলার জন্যে উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলাম। আমি তাকে নিয়ে যা কিছু করছিলাম সবকিছুতে একান্ত বাধ্যের মতো আর নিঃশব্দে সে নিজেকে পুরোপুরি ছেড়ে দিয়েছিলো। আমাকে সে চুমুর পর চুমু খাচ্ছিলো তীব্রভাবে, আর নিজেকে ডুবিয়ে দিচ্ছিলো আমার চোখের মধ্যে। খুব শিগগিরই আমরা নগ্ন হয়ে গিয়ে চুমু খেতে লাগলাম। আমরা যে সৃষ্টির সেই অদ্ভুত লীলাখেলাটা শুরু করতে যাচ্ছি তাতে কোনো সন্দেহ ছিলো না। এমন সময় তার চোখের দিকে তাকিয়ে একটা গোপন ভয় আর গভীর বিষাদ দেখে হঠাৎ এক অভাবিতপূর্ব ভয় আমাকে পেয়ে বসেছিলো…
নৈশভোজের সে—অনুষ্ঠানেও সে খানিকটা দূরে চকচকে কাঁচের বাসনপত্রগুলোর পেছনে দাঁড়িয়ে একই ভঙ্গিতে আমার সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করছিলো। সময়ের দিক থেকে পরস্পরের এত দূরের এ দুটো ছাউনির মধ্যে সম্পর্কটা কী? এটা আমি তখন বুঝতে পারি নি, আজও আমার বোঝা হয় নি।
সে—মুহূর্তেই আমি এক ঝটকায় নিজেকে তার কাছ থেকে সরিয়ে নিয়েছিলাম। আমার এখনো সব মনে আছে… ওহ্, কত স্পষ্ট মনে আছে তার তলপেট আর স্তনের উষ্ণতা, তার শরীরের কোমলতা আর আমাদের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সেই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা। ঝড় কেটে গিয়ে পরিস্থিতি শান্ত হয়ে এলো। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমার জীবনের অন্যান্য দিকের মতো আমার মানসিক অবস্থাও এর পর থেকে খারাপের দিকে মোড় নিলো।
চমৎকার সব ভোজের অনুষ্ঠান যেভাবে শেষ হয়, ওদের বাড়িরটাও সেভাবেই শেষ হলো, উপহার আর ফোন নম্বর বিনিময়, চুমু আর আবারো বেড়াতে আসার প্রতিশ্রম্নতির মধ্যে দিয়ে। আমরা খুব খুশিমনে নিজ নিজ বাড়িতে ফিরেছিলাম।
যেটা ঘটে গেছে, আমি সেটা স্রেফ উপেক্ষা করতে চাইলাম, এবং ভাবলাম এতে সফল হওয়ার জন্যে আমার গোপন ভাণ্ডার থেকে কিছু সন্তুষ্টি আর তৃপ্তি নিয়ে নেবো। কিন্তু তার আরেক চাউনিতে আবার আমার সব ওলটপালট হয়ে গেলো। আমরা চলে আসার আগে সে খুব উৎসাহের সঙ্গে আমার মাকে তার ফোন নম্বর লিখে দিচ্ছিলো। এমন সময় সে যেন কিছু ভুলে গেছে এভাবে একটু থেমে গিয়ে আমার দিকে তাকালো, মাত্র একটি মুহূর্তের জন্যে। তার চেহারাটা ছিলো জ¦লজ¦লে, এবং আমার দিকে তার ওই তাকানোতে যে একটা গোপন আর অস্পষ্ট কামনা ফুটে উঠলো, আমার বিভ্রান্ত অবস্থা সত্ত্বেও সেটা আমি বুঝতে পারলাম।
ফোনে কথা বলার সময় সে তার উষ্ণ কণ্ঠস্বরে বললো, “ফোন করার জন্যে তোমাকে ধন্যবাদ, আবদুল রহমান। অনেক অনেক ধন্যবাদ। আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলাম, আর তুমি এটা আমার জন্যে সহজ করে দিলে। তোমাদের সবাইকে দেখে আমি যে কত খুশি হয়েছি, সেটা যদি তুমি জানতে!”
“আমাদের সবাইকে দেখে?”
“তোমাদের সবাইকে যে আমি কোন্ চোখে দেখি, তোমাদের পরিবারের সবাইকে, আর অবশ্যই সবার ওপরে তোমাকে যে আমি কত মূল্য দিই তুমি জানো না। তোমার সঙ্গে দেখা করতে পারছি না বলে আমাকে মাফ করে দিয়ো, আবদুল রহমান। আামার সবকিছুর জন্যেই আমি তোমার কাছে ঋণী।”
“আমার কাছে ঋণী! তুমি কী বলছো বুঝতে পারছি না।”
“ওহ্, এটা তুমি কী বললে? তোমার কি কিছু মনে নেই? তুমি চাইলে আমাকে নষ্ট করে দিতে পারতে, কিন্তু তুমি সেটা করো নি। তোমার মনে নেই, তুমি আমাকে ছেড়ে দিয়েছিলে? তুমি আমার জীবন বাঁচিয়েছো, যেটা আমি কখনো ভুলতে পারবো না। আমি এখন যে—জীবন কাটাচ্ছি, সেটা তোমারই দান। যাই হোক, তুমি এখন কেমন আছো? তুমি কি জানো, সেদিন তোমাকে দেখার পর আমার কী হয়েছিলো?” সে এক মুহূর্তের জন্যে থমকালো, যেন কথা বলাটা চালিয়ে যাওয়ার জন্যে তাকে
নিজের সঙ্গে লড়াই করতে হচ্ছে। তারপর আবার বললো, “তোমার মা বললেন, তাঁর সঙ্গে তুমি ভালোই আছো। কথাটা কি সত্য, আবদুল রহমান? আমাকে বলো যে তুমি সত্যিই ভালো আছো। তুমি কি ভালো নেই?”
“ভালোই আছি বলতে পারো। আরো সঠিকভাবে বলতে গেলে, আমার বর্তমান অবস্থায় আমি সন্তুষ্ট। আমার মনে সন্তুষ্টির কোনো কমতি নেই।”
“সেটাই যথেষ্ট! সেটাই যথেষ্ট বলে মনে করছো তুমি?”
“আমি আর কী করতে পারি?”
আমি তার দীর্ঘশ^াসের শব্দ শুনতে পেলাম। “আমি তোমাকে কোনোভাবে সাহায্য করতে পারি… একজন বন্ধু হিসেবে?”
আমি এর কোনো জবাব দিলাম না। এক বিব্রতকর নীরবতা নেমে এলো।
তারপর আবার সে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি কি এখনো অসুস্থ? মানে, আমি বলছিলাম…”
“কম—বেশি অসুস্থই বলতে পারো। আমি আর কারো কোনো কাজে আসবো না।”
“সত্যিই! হায়, খোদা! আমাদের সুখের সময়গুলো এতই ক্ষণস্থায়ী হলো!”
এর পরদিন আমি আবার আমার সেই সন্তোষ আর তৃপ্তির অনুভবের ভাণ্ডারে আশ্রয় খুঁজে নিতে চাইলাম, যার কথা আমি সগর্বে তাকে বলেছি। কিন্তু আমি খুঁজে পেলাম শুধুমাত্র ক্ষুধা, ভুল বোঝাবুঝি আর কিছু ফাঁকা প্রতিধ্বনি, যাতে অনুরণিত হচ্ছিলো শুধু একটা নাম—— “খাদিজা”।
জ্যোতির্ময় নন্দী, কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক