কাজী লাবণ্য
পৌষ সংক্রান্তির হিমহিম বিকেল। আসরের নামাজ শেষে বিছানায় বসে, জানালায় মুখ চেপে মা নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকেন থই থই প্রজাপতি আকাশের দিকে। নীল আকাশটা ঢাকা পড়েছে নানা রঙয়ের ড্রাগন, পাখি, প্রজাপতির ডানায় ডানায়।
পুরনো দিনের মতো না হলেও জব্বর শীত পড়েছে। সংক্ষিপ্ত বিকেলগুলোতে ঘরের বাইরে বের হওয়া যায় না। হিমেল বাতাস চামড়ায় সুঁইয়ের মতো বিঁধতে থাকে। ওদিকের ঘরটা ভেঙে ফেলাতে বাতাস একেবারে বিনা বাধায়, তোলপাড় করে বাড়িতে ঢোকে।
বেড়ার ঘর ভেঙে পাকার ঘর উঠছে। বাইরে মিস্ত্রিদের হাঁকডাক, সফুরার বাবার তদারকি। পেছন দিকটায় ইট, সুরকি, সিমেন্ট, বালির স্তুপ। আরেকদিকে মিস্ত্রিদের কোদাল, কড়াই, ছেনি, কন্নি, বেলচা, হাতুড়ি, ঘরের বারান্দায় ঝকঝকে উজ্জ্বল রঙিন টিনের বান্ডিল রাখা।
যেদিন ঘরের ভিত্তি দেওয়া হয় সেদিন মেয়েরা, জামাইরা, পাড়াপড়শিরা এসেছিল। মিলাদ হয়েছে, মিলাদের তবারক খেয়ে, দোয়ায় অংশ নিয়ে সবাই চলে গেছে। মেয়ে জামাইরা পরদিন গেছে।
সকলের চোখে মুখে তৃপ্তির আভা। এ বাড়ির ছেলে বিদেশ থেকে টাকা পাঠাচ্ছে তা দিয়ে বাড়িতে ঘর উঠছে, পাশাপাশি তিনটে পাকার ঘর, টানা বারান্দা, পায়খানা।
মায়ের চোখ আটকে থাকে, আকাশভরা রঙ বেরঙয়ের পাখ পাখালি, উড়োজাহাজ, প্যাঁচা, রকেটের উড্ডয়নে। সেগুলো কত বড় আর কিযে সুন্দর! মা তাকিয়েই থাকেন, পলক পড়ে না। অত উপরে মা কি ধুসর চোখে দেখতে পায়? পায়, কিছু চর্মচক্ষে আর কিছু মানসচক্ষে।
-মা, টাকা দেও না, ঘুড়ি কিনব। মা আশিরনখ চমকে ওঠেন। কে ডাকে! কে টাকা চায়! ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেন লিকলিকে পাতলা হাফপ্যান্টের উপর সোয়েটার পরা ছোট্ট একটা ছেলে গুড্ডি কেনার টাকা চায়।
-গুড্ডি তো হাতে বানান যায় বাজান, কেনা আবার লাগে!
-লাগে মা, লাগে। আজকাল কি কেউ খাতার পাতার হাতে বানানো ঘুড়ি নিয়া খেলে? কি যে সব ঘুড়ি কিনতে পাওয়া যায় মা।
মা মনে মনে বিপদ গোণেন। তার হাতে তো একটা আধুলিও নাই, কোনোদিন থাকেও না। তিনি মরমে মরে যান। আহারে বাজান আমার একটা গুড্ডিই তো চায়। তাও দিতে পারি না। কিন্তু তার মাথায় ঢোকে না গুড্ডি আবার কেউ কেনে! কি যামানা যে আইলো! তিনি ছোটকালে দেখেছেন, পাতলা কাগজে চিকন কঞ্চি বেঁধে তার ভাই ভাইস্তারা গুড্ডি বানায়া সুতা দিয়ে উড়াইতো।
যুগ বদলে গেছে। তার মেয়েরা সব সময় বলে, পাখিপড়া করে বোঝায়,
‘মা যুগ বদলে গেছে’। মেয়েদের কথা তিনি মানেন। বিশ্বাস করেন। মেয়েরা সবাই স্কুল কলেজে পড়েছে, পাশ দিয়েছে, বিশ্বাস না করলে চলে! তারা যে এযুগের ছেলেমেয়ে, তারা শিক্ষিত।
কেবল ছেলেমেয়ে না এই জীবনে তিনি সকলের কথা মেনেছেন। মেনে মেনে জীবনের মেঠোপথে এতোদূর এসেছেন।
তার চারজন মেয়ে। সফুরা, সায়বা, সোনালি, রূপালি। বড় মেয়ে সফুরা আর সায়বা ম্যাট্রিক পর্যন্ত পড়েই বিয়ে হয়েছে। পরের দুই মেয়ে আইএ পাশ করে বিয়ে হয়েছে। আর শেষ বয়সের ছেলে সুজন সে বিএ পর্যন্ত পড়ে দূর বিদেশে চলে গেছে মানে তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
মা আবার মাথা ঘুরিয়ে জানালায় মুখ চেপে বিড়বিড় করেন, ‘আমার বাজান, আমার বেটা সুজন কোথায় চলি গেইছে, কতদূরে?। উড়োজাহাজে যাইতেও নাকি কত সময় লাগে। কতবচ্ছর হয় অরে দেখি না’।
চুপ থাকেন। আবার বলেন,
‘বাবা তুই কই বাবা? তোরে দেখার লাগি আমার কইলজা পুইড়া যায় বাজান। তুই কবে আসবি মানিক? তোর মুখটা একবার দেখমু বাবা’।
সারাটা জীবন তিনি কতকিছু মেনেছেন, এই একটা জিনিস মানে ছেলের যাওয়া মানতে পারেন না। এতদিনেও না, তবে মানার চেষ্টা করেন, হজম করার চেষ্টা করেন, তিনি বিশ্বাস করেন ‘যুগ বদলেছে, বিদ্যাশের পাম বাগানে, বিদ্যাশের কোম্পানিতে কাম করলে পাকার বাড়ি হয়, গরু হয়, জমি হয়’।
নিজে বই পড়েননি, স্কুল কলেজে যাননি, আগেরদিনের মানুষ তিনি শত চেষ্টা করেও এই জায়গায় বদলাতে পারেন না। তবে যুগের বদল তিনি মানেন। এই যে শেষ বয়সের, পেটমোছা একমাত্র মা ন্যাওটা ছেলে, মায়ের কোল, মায়ের বুক, ঘরবাড়ি শূন্য করে চলে গেল, কতবার তার মনে হয়েছে, কতবার ঠোঁটের কাছে এসেছে, ‘বাবা যাইস না, মাক ছাড়ি যাইস না। আমি বাঁচব কি করে! মা মরি গেইলে তারপর যাইস বাবা’।
জিভের ডগায় আসা কথা তিনি ভাতের গ্রাসের মতো গিলে খেয়ে নির্বিকার থেকেছেন। গোপনে চোখ মুছেছেন। মানতে না পারা বিষয় পাথর চাপা দিয়ে, টুঁটি চেপে নিথর থেকেছেন,
থেকেছেন বলে আজ পাকার ঘর উঠছে।
যোগ বিয়োগের এত সমীকরণ তিনি বোঝেন না, কিছুদিন ধরে শুনে আসছেন, ছুটিতে ছেলে বাড়ি আসবে, তিনি দিন গুনেছেন, তিনি আশায় বুক বেঁধে আছেন, তার বুকের ধন বুকে আসবে। আজ দুপুরে ছেলের বাপ ফাইনাল কথা বলেছে। সেই দুপুর থেকে ছেলের বাবার এই ফাইনাল সিদ্ধান্ত মানার জন্য মা নিজের সাথে নিরন্তর লড়াই করে যাচ্ছেন।
আবার সেই লিকলিকে ছেলেটি বলে,
‘মা, তুমি মন খারাপ কইরো না, ঘুড়ি না পাইলে কিচ্ছু হয় না, ঘুড়ি দিয়া কি হয় মা! এই যে বাজানের ঘর হচ্ছে, মা তুমি খুশি হও না কেন? পাকার ঘর তোমার ভালো লাগে না?’
কাঁটাহত মা কেঁপে ওঠেন, তার বুক এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যায়। তরাসে আঁচল তুলে চোখ মোছেন। আবার চোখ দুটো ভরে উঠলে তিনি এবার ডলে ডলে চোখকে শাসন করেন, খবরদার, আর যদি ভিজবি তো… দোহাই লাগে আর ভিজিস না। তিনি ছেলের দিকে তাকিয়ে বলেন,
‘বাবা, আমি খুব খুশি হইছি বাবা। আমাগোর পাকার ঘর হচ্ছে খুশি না হইলে হয়!’ বিছানা থেকে দ্রুত নেমে ছোট্ট ছেলেকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরেন। অন্তঃসলিলা বুক ভরে ওঠে। তার ছেলে, তার বুকের ধন, তার ছোট্ট মানিক। শক্ত করে, ভীষণ শক্ত করে বুকে ধরে রাখেন, হাতের চাপ আলগা করেন না। সন্তানের স্পর্শে গভীর তৃপ্তির একটা শ্বাস বুক থেকে বেরিয়ে যায়।
হিম বাতাসের সাথে জুম্মা থেকে মাগরিবের আজান ভেসে আসে। মিস্ত্রিরা চলে গেছে। ছেলের বাবা হাঁক পারেন, ‘এ্যাই সফুরার মা আমি জুম্মাত গেইলাম। বাড়িত কেউ নাই, বাইরোত আসি বইসো’। কপাল কুঁচকে তিনি ঘরের দিকে তাকান। বেশ কিছুক্ষণ থেকে স্ত্রীর সাড়া না পেয়ে ত্রস্ত ঘরে ঢোকেন। খাটের নিচে, খাটের পায়া বুকে জড়িয়ে স্ত্রীকে টোপলা হয়ে পড়ে থাকতে দেখে তিনি ভীত হয়ে পড়েন।
(শেষ)
কোম্পানির দেশে রাত নেমেছে। কেন যেন আজ আর খেতে ইচ্ছে করছে না। উঁচু বিল্ডিং এর আড়ালে এক চিলতে চাঁদ উঠেছে, পান্ডুর। আকাশে ডেলা ডেলা মেঘ। ছুটিতে অনেকেই দেশে যাচ্ছে। তার যাওয়া হচ্ছে না। এই ছুটিতে গেলে নিজের খরচে যেতে হবে, আর কয়বছর পরের ছুটিতে গেলে কোম্পানি যাওয়া আসার খরচ দেবে। বাবা বলেছে, ‘এখন নিজ খরচে দ্যাশে আইসা কি হইবে বাপ? বাড়ির কাম চলতেছে, হিসাবের বাইরে খর্চা হচ্ছে, এদিকে জমি বন্দক নেওয়ার বায়না হইছে, কোম্পানির খরচে একবারে আসিস। আমরা তো ভাল আছি। ফোনে তো নিত্যদিন কথাবার্তা হচ্ছেই’।
পাশে থাকা ফোনটা বেজে ওঠে, তাকিয়ে দেখে বড়বোনের নাম, কানে ধরলে একটা আর্তনাদ ভেসে আসে…
কোথা থেকে? দেশ থেকে? বোনের থেকে? নাকি মা আর্তকন্ঠে ডেকে ওঠে, ‘বাজান’…
কাজী লাবণ্য, গল্পকার