জিল্লুর রহমান শুভ্র
জাদুঘরের মতো দাঁড়িয়ে আছে লালটিনের ডাকঘর; তার সামনে এসে কপালের ঘাম মোছার পর দীর্ঘশ্বাস ফেলল ফাতিমা, ’এ দুনিয়ায় আমার কে আছে বল?’
তার আসল নামটা চাপা পড়েছে সেই শৈশবে। জিরাফের মতো গলা আর লম্বাটে মুখ; তাই তাকে সবাই ঘোড়ামুখী বলে ডাকে। উপরন্তু গায়ের রং আবলুশি। ফলে আইবুড়ো মেয়েটা বাবা-মায়ের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিয়ের সম্বন্ধ এলে বাড়ির সবাই চনমনে হয়ে ওঠে, আশায় বুক বাঁধে; কিন্তু মেয়েকে দেখার পর পাত্রপক্ষ যখন বিভিন্ন ছুতোয় পালিয়ে যায় তখন তার উপর খড়গ নামে।
জন্মের পরই সে তার মাকে হারিয়েছে। সে থেকে সৎমা’ই তার মা। সেই মা যখন তার চুলের মুঠি ধরে পেটাতে পেটাতে বলে, ’ঘোড়ামুখী, তুই সত্যি সত্যিই ঘোড়া হতে পারিস না! তবুও তো বাজারে বেচতে পারতাম। পয়সার কী আকাল!’
মা মরা মেয়েটা অসহ্য যন্ত্রণায় কুঁকড়ে ওঠে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। তাকে সান্ত্বনা দিতে কেউ এগিয়েও আসে না। এক নির্বিকার অসহায়ত্ব তাকে গ্রাস করে। মাটিতে কুঁজো হয়ে বসে হাঁটুতে মাথা রেখে ভাবে, আচ্ছা ঘোড়া দেখতে কেমন?
কোনোদিন ঘোড়া দেখেনি সে।
তাদের বাড়ি থেকে যে রাস্তাটা হ্যাবলাকান্তের মতো ঢলতে ঢলতে চলে গেছে উত্তরদিকে, কয়েক ক্রোশ দূরে প্রকাণ্ড বটগাছ, চৈক্রসংক্রান্তি এলেই তার নিচে ঘোড়ার মেলা বসে। গৎবাঁধা জীবনকে তুড়ি মারতে সেই মেলায় যাওয়ার মনস্থির করল সে। ছেঁড়া-জীর্ণ কাপড়েই তার অষ্টপ্রহর। লুকিয়ে লুকিয়ে মায়ের নতুন শাড়ি ও গয়নাগাটি পরে সৎভাই পটুকে কাছে ডাকল সে। তার কানে পড়ে ফিসফিসিয়ে বলল, ’যাবি?’
পটু আমতা আমতা করে বাল্যকালের চৌকাঠ পেরোচ্ছিল, অপটু ভাব দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, ’কোথায়?’
’ঘোড়ার মেলা দেখতে,’ শাড়ির আঁচল ঠিক করতে করতে বলল সে।
’না, যাব না!’ পটুর অস্থির জবাব।
হাওয়াই মিঠার লোভ দেখালে যেতে রাজি হলো সে। কিন্তু সমস্যা হলো তার শার্ট বলতে একটিই। সেই শার্টের বোতাম আবার খোলা। মন ম্যাড়মেড়ে করলে ঘোড়ামুখী সাহস দিল তাকে, ’কোনো ব্যাপার না! আমি আছি না! সেলাই করে দিচ্ছি।’ কিন্তু এক্সট্রা বোতাম খুঁজে পাচ্ছিল না কোথাও। অবশেষে বুদ্ধি করে বোতামের পরিবর্তে সুতো বেঁধে সুতোর গোড়া দাঁত দিয়ে কাটতে কাটতে বলল, ’এবার হয়েছে, চল!’
বিভিন্ন গ্রাম থেকে বিক্রেতারা এসে জড়ো হয়েছে। তাদের পোশাক-আশাকও অদ্ভুত ধরনের। দর্শক সমাগম প্রচুর। মেলাজুড়ে সাধারণ মানের কয়েকটি ঘোড়া। লালচে, কালো ও শাদা। ঘোড়ামুখী কালো বলেই হয়ত কালো রঙের একটি ঘোটকী তার মন কেড়ে নিল। শরীরের কোথাও শাদা ফুটকি নেই; একেবারে নিকষ কালো। পটুকে টেনে নিয়ে সেই ঘোটকীর দিকে গেল। দুর্বল স্বাস্থ্যের ঘোটকী। মাথার উপর খাড়া কানদুটো মন্বন্তরের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার মালিক তাকে ঠিকমতো খেতে দেয় কিনা সন্দেহ আছে! তার প্রতি মায়া হলো তার। তার পাশে দাঁড়িয়ে তার ঘাড়ে ঘাপটি মারা কেশরে আলতো করে হাত ছোঁয়ালো সে। উদাস চোখে দাঁড়িয়েছিল ঘোটকী, চিঁহি করে উঠে সামনের পা’দুটো একটু উপরে তুলে আবার নামাল; যেন কোনও একটা বার্তা দিতে চাইছিল তাকে।
পেছনে একটু সরে গিয়েছিল সে, আবার এগিয়ে এসে ঘোটকীর মুখ স্পর্শ করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার মতো দেখতে লাগল। বিক্রেতা তাকে খদ্দের ভেবে জিজ্ঞেস করল, ’পছন্দ হয়েছে? দাম কম রাখব।’
’আমরা কিনতে আসিনি,’ ঘোড়ামুখী বলল।
’তো দেখতে এসেছ?’ বিক্রেতা তার ভ্রু তুলে মশকরা করার ভঙ্গিতে বলল।
তার মশকরা গায়ে মাখল না ঘোড়ামুখী । মাথা দোলাল সে। অদ্ভুত পোশাকের বিক্রেতা তার পুরুষ্টু ঠোঁটের নিচে এক চিলতে বাদাইমা হাসি ফুটিয়ে তুলল, ’এত কষ্ট করে কেন এসেছ গো? তোমার মুখটাই তো ঘোড়ার মতো।’
তাকে নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা কিংবা হেয় করার উদ্দেশ্যে অপমানজনক কথাবার্তা কোনোটাই তাকে তেমন বিচলিত করে না; কারণ, জন্মের পর থেকেই এসব এন্তার শুনতে হয়েছে তাকে। পটুকে শক্ত করে ধরে বলল, ’এই…চল!’
ভিড় ঠেলে মেলা থেকে বেরোচ্ছিল তারা। পটু হাওয়াই মিঠার কথা ভোলেনি, বোনকে স্মরণ করে দিলে, যেতে যেতে বলল সে, ’লক্ষ্মীভাই আমার, আরেকদিন। সঙ্গে কানাকড়িও নাই।’ পটু চিমসে মুখে ঢোক গিললে আবার বলল সে, ’হাওয়াই মিঠাই প্যাট ভরে না, বুঝলি? আমরা গরিব মানুষ। যা খাইলে প্যাট ভরবে, আমরা তাই খাব। যাওয়ার পথে হামদুলদের ক্ষ্যাত থেকে বাঙ্গি চুরি করে দু’ভাইবোন প্যাট ভরে খাব।’
এমন আশ্বাসের পরও ভাইয়ের চিমসে মুখে জিল্লা ফিরছিল না দেখে অভিমানী গলায় বলল সে, ’সবাই তো আমাকে ঘোড়ামুখী বলে। তুইও বলিস। আমাকে বেচে দে ভাই। অনেক টাকা পাবি। তা দিয়ে হাওয়াই মিঠা কিনিস। পারবি?’
এবার পটুর টনক নড়ল। তাদের দু’ভাইবোনের সম্পর্ক এতটাই মধুর ও মজবুত, ঘোড়ামুখী তার সৎবোন, তা-ও সে মনে করে না। তার কথায় বুবু কষ্ট পেয়েছে ভেবে বুবুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদল সে। কাঁদতে কাঁদতে বলল, ’বুবু, মাপ করে দাও, আর কোনোদিন হাওয়াই মিঠার কথা বলব না।’
বাড়িতে ফেরার পর অনেক হ্যাপা। সৎমা তেড়ে এল, ’ঘোড়ামুখী, কোথায় গেছিলি আমার পটুকে নিয়ে? ভাতার ধরতে? তোকে কে গছবে বল? এককুড়ি সম্বন্ধ এল, কেউ তো তাকাল না।’ এতক্ষণ ভালোমতো খেয়াল করেনি, এবার করল, ’ওম্মা, আমার যত্ন করে রাখা শাড়িটাও পরেছে! কানের দুল, দেখি দেখি!’ হেঁচকা টানে এক্কেবারে সামনে নিয়ে আবার বলল, ’খোল মাগি, এসব খোল!’ পরক্ষণে শাড়িতে টান দিয়ে, ’এটা কি তোর বাপের কেনা শাড়ি! পরেছিস? পটুর মামা এই ভাদ্রমাসে আমাকে শাড়িটা কিনে দিয়েছিল।’
ঘোড়ামুখীর মুখে রা নেই। চুপচাপ কানের দুল খুলছিল, সৎমার তর সইছিল না, নিজেই টান দিয়ে শাড়িটা খুলে নিল। গামলায় আধোয়া কাপড় ছিল, সেখানে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, ’যা, এক্ষুনি কলতলায়। সব কাপড় কাচবি। কাচতে না পারলে রাতে শুকনা মরিচ খেতে দিব!’
তাকে শুকনা মরিচ খেতে দিল না সত্য, দিল পোকায় খাওয়া আধাসিদ্ধ ছোলা। থালাটা তার সামনে ধপাস করে রেখে তার সৎমা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করল, ’ঘোড়া তো এগুলোই খায়। খা, হাটে যখন বিক্রি হয় না, ফেলে দিয়ে কী করব। তুই যদি খেতে পারিস চাল তো বাঁচবে।’
ঘোড়ামুখী বেশুমার নাকাল। কাপড় কাচার ফলে তার খিদে এতটাই বেড়ে গিয়েছিল তার জিহ্বা লকলক করছিল। সৎমা কী খেতে দিল, ছাই না পাথর, তা দেখার ইচ্ছে হচ্ছিল না তার। গবগব করে গিলতে লাগল। হৃষ্টচিত্তে সৎমা বলল, ’বাঃ বেশ! আরও এনে দিচ্ছি।’
বলেই সে ঘরে ঢুকল।
বারান্দায় বসে খাচ্ছিল সে, খুঁটি ধরে দাঁড়িয়েছিল পটু, তার কষ্ট হচ্ছিল। কাঁদছিল সে। কাছে এসে বলল, ’বুবু, আমিও খাব।’
’কেন, তুই ভাত খাসনি?’ আড়চোখে তাকাল সে।
’খাইচি, তবুও খাব। মাকে শিক্ষা দিব,’ পটু বলল।
পটুর মা ঘর থেকে ফিরে এসে বলল, ’এই হ্যাদারাম, তুইও কি ঘোড়া হয়েছিস? পচা ছোলা খাচ্ছিস কেন?’
পটুর ভেতরটা ক্ষোভে ফেটে যাচ্ছিল, তবুও শান্তভাবে বলল, ’হ্যাঁ মা, আমিও ঘোড়া।’
চপেটাঘাত খাওয়ার মতো তার মুখে চড়া পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে বলল, ’বেশ! তোরা দু’ভাইবোনেই ঘোড়া। এখন থেকে খরচটা বাড়বে, এই আর কি!’
দু’ভাইবোন বারান্দার এক কোণে একই খাটে ঘুমোয়। বারান্দার নিচে কতকগুলো বকরি রাতযাপন করে। তাদের প্রশ্রাবের উৎকট গন্ধ দু’ভাইবোনের নাকসওয়া হয়ে গেছে। পটু ঘুমে চিৎপটাং হলেও ঘোড়ামুখীর দু’চোখে ঘুম ঠাঁই নিল না। অনেকবার একাত-ওকাত হলো সে। আধভাঙা খাট ক্যাঁ-কোঁ শব্দ করে তার সামর্থের কথা বারবার জানিয়ে দিচ্ছিল——বেশি গড়াগড়ি করিও না।
বাড়ির পেছনে আমগাছ। ফাল্গুনে আত্মপ্রকাশিত সোনারঙা মুকুল চৈত্রের শেষ দিকে এসে দৃষ্টি কাড়তে শুরু করে। বাতাসে সৌরভ ছড়াচ্ছিল। আম কুড়ানোর সখ হলো তার; কিন্তু আম কি মাটিতে পড়ছে? গুমসা বাতাস। তবে তার মনে পড়ে চৈত্রের শেষে বড় ঝড় হয়। আকাশে মেঘ জমছিল। একটু পরেই ঢাকুর-ঢুকুর শব্দ; সঙ্গে বিজলির লম্ফঝম্ফ। দ্রুতই গুমসা বাতাস খোলস পাল্টিয়ে বিদ্রোহের রূপ নিল। শুরু করল তাণ্ডব। এটাই হয়ত বোশেখের আগমনী বার্তা।
ঝড়ের মধ্যে আমকুড়ানোর মজা আছে। সর সর শব্দে ডালপালা ভেঙে পড়বে, ভয়ে শিহরণ জাগবে, ভেজা ত্বকে নুইয়ে পড়া লোম মাথাচাড়া দেবে। ধীরে ধীরে বারান্দা থেকে নামল সে। দুরুদুরু বুকে এগিয়ে গেল গাছতলায়। মাটিতে কয়েকটা কেরুল আম পড়ে ছিল, বিজলির আলোতে দাঁত কেলিয়ে হাসছিল; কোঁচায় তুলে নিয়ে তাদের হাসি বন্ধ করল।
সেই আম খাওয়ার পরদিন থেকে পটুর গায়ে জ্বর। জ্বরের মাত্রাটা বেশ। কাঁপুনি দিচ্ছিল জোরেশোরে। হুজুরের পানিপড়ায় ও জলপট্টিতেও কোনও কাজ হচ্ছিল না। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মায়ের সন্দেহ হলো কেরুল আম খাওয়াতেই এমনটা হয়েছে। অবধারিতভাবে দোষটা এসে পড়ল ঘোড়ামুখীর উপর। কারণে-অকারণে বা অত্যন্ত তুচ্ছ বিষয়ে গায়ে হাত তোলা তার অভ্যেসে পরিণত হয়েছিল। অষ্টপ্রহর একবারের জন্যে হলেও পোড়ামুখীর গায়ে তার হাত তোলা চাই, না তুলতে পারলে পেটের ভাত হজম হত না তার। কাছে ডেকে ঘোড়ামুখীকে বেধড়ক পেটাল সে। তাতেও তার মনের ঝাল মিটছিল না। পোড়ামুখীর ঘাড় ধরে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে গেল বকরির লাদির কাছে, মুতের সঙ্গে লাদি লেপ্টালেপ্টি করে ছিল; সেখানে ঘাড় ঠেসে ধরে চেঁচিয়ে উঠল সে, ’খা মাগি, বকরির লাদি খা! খায়ে মর!’
পটু সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে, ’মা, বুবুর সঙ্গে এরকম ব্যবহার কেন করছ?’
তার মা মুখ বিকৃত করে বলল, ’তোর দরদ হচ্ছে? তাহলে শোন, আমার নানা মরার আগে বলে গেছিল ঘোড়া পেটালে হাতি পাওয়া যায়। ঘোড়া নাই তাই ঘোড়ামুখীকেই পেটাচ্ছি।’
অসহায় ঘোড়ামুখীর কান্না করা ছাড়া কোনও উপায় ছিল না। কাঁদতে কাঁদতে মাঠে গেল সে। বকরিগুলোর দেখভাল করার দায়িত্ব তার উপর। সেখানেও এক উপদ্রপ অপেক্ষা করছিল তার জন্যে। খোলা মাঠে ছেড়ে দেওয়া বকরিগুলো ঘাস খাচ্ছিল, কিন্তু সেখান থেকে একটা নাদুসনুদুস খাসি দলছুট হয়ে হোসেনের মরিচখেতে ঢোকে। খেত নষ্ট করে ফেলে। হোসেনের মাথায় মস্তবড় টাক। সবাই তাকে ’চ্যান্দা’ বলে ডাকে। এমনকি তার গর্ভধারিণী মা-ও তাকে এনামেই ডাকতেন। বড় ভয়ের বিষয়, তার মাথা সবসময় হট; সামান্যতেই রেগে যেত সে। সেই চ্যান্দার পুরনো অভ্যেস এক গেলাস চাল-পানি খেয়ে খেত-খামার দেখতে বের হত। খেতের বিচ্ছিরি অবস্থা দেখে তার মেজাজ তিরিক্ষে ওঠে। মালকোচা মেরে ছায়াশত্রুর সঙ্গে যুদ্ধংদেহী ভাব প্রদর্শন করে; তারপর খাসিটা ধরে নিয়ে নদীর ওপারে মণ্ডলের খোঁয়াড়, ফসলের ক্ষতিপূরণ বাবদ যৎকিঞ্চিৎ বিনিময়ে সেখানে ঢুকিয়ে দেয়।
খোঁয়াড় থেকে বকরি ছোটাতে গেলে জরিমানা হিসেবে ঘোড়ামুখীকে গুনতে হবে পঞ্চাশ টাকা; কিন্তু তার কাছে ফুটো পয়সাও নেই। অগত্যা খোঁয়াড়বন্দি বকরি ছাড়াই বাকি বকরি নিয়ে বাড়িতে ফিরল সে। কিন্তু তার মনের মধ্যে ভয় গেড়ে বসল। তার সৎমা জানলে তাকে আস্ত রাখবে না। শুকনো রুটির মতো ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে। ভয়টা ক্রমশ এতটাই শক্ত হয়ে উঠল কাঠঠোকরার মতো ঠোকরাচ্ছিল তাকে। রাতে শোয়ার পর তার শরীর কাঁপিয়ে জ্বর এল। গা পুড়ে যাচ্ছিল তার, প্রলাপও বকছিল; কিন্তু কে তাকে স্নেহ দেবে, মাথায় জলপটি দেবে, ডাক্তার-কবিরাজ ডাকবে! কেউ নেই। শিয়রে দাঁড়ানো মায়ের হাত, এসময় কে না প্রত্যাশা করে!
সৎমা তার শশ্রুষা না করে বকরি ঠিকঠাক আছে কিনা তা দেখতে গেল। পালের গোদা খাসিটাই নেই। তার মাথায় হাত। খুন্তি গরম করে ছুটে এল। খুন্তিটা ঘোড়ামুখীর মুখের কাছে নিয়ে কর্কশ স্বরে বলল, ’বল, খাসিটা কোথায়? খুঁজে পাচ্ছি না কেন?’
ঘোড়ামুখী ভয়ে কুঁকড়ে উঠল । আমতা আমতা করে বলল সে, ’মণ্ডলের খোঁয়াড়ে।’
’কে দিয়েছে?’ ভয়ঙ্কর গর্জন তার।
মানসিক বিকারগ্রস্ত মহিলা। অন্যের দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা, চিৎকার তাকে বিন্দুমাত্র টলায় না। চ্যান্দার নাম শোনার পরও ক্ষান্ত হলো না সে। খুন্তির ছ্যাঁক দিয়ে বলল, ’ভং ধরা বাদ দিয়ে এক্ষুনি খাসিটা নিতে যা। হাঁড়িতে একমুঠো চাল নাই। খোঁয়াড়ের টাকা দিব কোত্থেকে! কোন ভাতারের কাছ থেকে টাকা নিবি, নে! আনতে না পারলে আমার চাইতে খারাপ আর কেউ হবে না।’
অসহ্য যন্ত্রণায় চিৎকার করল ঘোড়ামুখী। চিৎকার শেষে কষ্টেসৃষ্টে বিছানা থেকে নামল। ছ্যাঁকা জায়গাটা হাত দিয়ে চেপে ধরে ক্লিষ্টদেহে বাইরে এল সে। ঘুটঘুটে অন্ধকার। গ্রামটা তার চেনাজানার তালুতে বন্দি হলেও কোথায় যাবে সে? এ মুহুর্তে কারও নাম মনে পড়ছে না। হঠাৎ নুরুল হক তার মনের পাশ দিয়ে গেল। ঠাওরালো তাকে। এই নুরুল হক লুচ্ছা প্রকৃতির মানুষ। তার সামনে গেলেই ড্যাবড্যাব করে তাকায়। এ বিপদের মুহুর্তে টাকা দিতে পারে এমন কাউকে খুঁজে পাচ্ছিল না সে।
বাড়িটা গ্রামের শেষ প্রান্তে; জঙ্গল দিয়ে ঘেরা। বাড়িতে ঢোকার চিকন রাস্তাটার দুপাশে লতাপাতা। খিরকি দরজা পর্যন্ত পুরো রাস্তায় পাতাদের লাশ। দিনের বেলাতেও সেখানে ঢুকতে গা ছমছম করে। ঘোড়ামুখীর কলিজায় অচেনা মানুষ বা ভুতের ভয়-ডর এখন অনুপস্থিত। কারণ, খাসিটা খোঁয়াড় থেকে ছাড়াতেই হবে তাকে। না পারলে কী ভয়াবহ পরিণাম তার জন্যে অপেক্ষা করছে, তা সে ভালোভাবেই জানে!
পেল্লায় সাইজের কাঠের দরজা। দরজার উপর লোহার কড়াটা কারও হাতের স্পর্শ পাওয়ার জন্যে অধীর অপেক্ষা করছিল। অবশেষে তার অপেক্ষার অবসান হলো। তবে ভেতর থেকে কেউ সাড়া দিল না। এবার সজোরে কড়া নাড়ল সে। একই অবস্থা। ভুতুড়ে বাড়িটার কোথাও যেন পিনপতনের শব্দ নেই। ঠেলা দিলে দরজা হাট হয়ে খুলে গেল। আস্তে আস্তে ভেতরে ঢুকল সে।
একটামাত্র ঘরে লন্ঠন জ্বলছিল। সাহস করে সেই ঘরেই ঢুকল।
নুরুল হক আরামকেদারায় হেলান দিয়ে বসা। হাতে মদের গ্লাস। অনেকক্ষণ ধরেই পান করছিল। ভয়-তড়াশে মানুষ নয় সে; তবুও পায়ের আওয়াজ পেয়ে সোজা হয়ে বসল। লন্ঠনের আলোয় ঘোড়ামুখীকে ঝাপসা দেখালেও চিনতে বেগ পেতে হলো না তাকে। প্রথমে চমকে উঠল; তারপর ঢুলুঢুলু চোখে বলল, ’তুমি? কী চাই? এ বাড়িতে আমি একা থাকি। তোমার ভয় করেনি?’
কোনও ধরনের ঠসক জানে না ঘোড়ামুখী। ভারাক্রান্ত গলায় এখানে তার আসার কারণটা বলল। তার হাত বারবার কপালে নিচ্ছিল সে, নুরুল হক অনেকটা জোর করে সেখানে তার কদলীসদৃশ আঙুল ছোঁয়াল; তারপর আঁৎকে উঠল, ’এম্মা, তোমার গা তো পুড়ে যাচ্ছে! এত জ্বর নিয়ে কেউ বাইরে বেরোয়?’ দয়াল বাবা কোত্থেকে এসে যেন তার উপর ভর করল, দেরাজ খুলে টাকা বের করতে একটুও কালক্ষেপণ করল না সে। তবে ঘোড়ামুখীর উপর তার যে বদনজর ছিল সেবিষয়ে বলতেও দ্বিধা করল না। টাকাটা ঘোড়ামুখীর হাতে দিয়ে আফসোসের সুরে বলল, ’তোমার মুখটা ঘোড়ার মতন লাগলেও বডিটা বেশ টাইট। তোমাকে দেখলেই লুঙ্গির নিচে আমার মেশিনটা কেমন-কেমন করে!’ পরক্ষণে জিহ্বা দিয়ে নিজের ঠোঁট চেটে নিয়ে আবার বলল, ’ভাবলাম সুযোগ যখন পেয়েছি তখন তোমার জমিতে কলাচাষ করে তারপর টাকাটা দিব। কিন্তু তোমার শরীরের যে কন্ডিশন, এই অবস্থায় কলাচাষ করলে পুলসিরাত পার হতে পারব না রে। আল্লাহ ক্ষমা করবেন না। টাকাটা শোধ দিতে হবে না।’ পরক্ষণে তার চিবুক উঁচিয়ে ধরে বলল সে, ’টাকা তো দিলাম। এখন একটু হাসো।’ বলতে বলতে ঢেঁকুর তুলল সে।
যার কাছে পূর্ণিমা বিষাদের রং, যার মনের বারান্দা স্বপ্নবিহীন অন্ধকারে ঢাকা এবং ঠোঁটে লেপ্টে থাকে দুঃখ, তার কি হাসি আসে? কষ্ট করে ফিকে হাসি দিল ঘোড়ামুখী।
মণ্ডলের খোঁয়াড় থেকে খাসি নিয়ে ফেরার পরও সৎমায়ের কোপ থেকে রক্ষা পেল না সে। এক ফোঁটা দানাপানি খেতে দিল না তাকে। বরং উল্টো ধমক, ’তোর মন থাকে কোথায়? আজকে পটুর সঙ্গে শুতে পারবি না। তোকে আলাদা বিছানা করে দিব।’
বকরিদের পাশে খড় বিছিয়ে শুতে দিল তাকে। রাক্ষুসে খিদে বজ্রসমান হুঙ্কার দিচ্ছিল। তাল সামলাতে না পেরে, রান্নাঘরে ঠ্যাঁটা অন্ধকার কিলবিল করছিল, ভাতের সন্ধানে সেখানে ঢুকল সে; কিন্তু ভাঁড়ে মা ভবানী। মুখখানা হাঁড়িপানা করে ফিরছিল, রান্নাঘরের খুটখাট আওয়াজ শুনতে পেয়েছিল পটু; সতর্ক ছিল সে, ’বুবু, পেয়ারা খাবে? পেয়ারা খেলে মুখে স্বাদ আসে, তাই মা দিয়ে গেছে।’
ঘোড়ামুখী অভিমান করে উঠল, ’না, থাক! আমি মরলেই কার কী! তবুও তোর মুখে স্বাদ ফিরে আসুক। তুই তোর মায়ের একমাত্র ছেলে। আমি কে? এ্যাঁ! এক পোড়ামুখী মায়ের হতভাগ্য মেয়ে ঘোড়ামুখী। ’ পটু তার বালিশের নিচ থেকে একটা পেয়ারা বের করে বুবুর হাতে দিয়ে বিগলিত কণ্ঠে বলল, ’তুমি আমার মায়ের চাইতেও বড়। তোমাকে খুব বেশি ভালোবাসি রে বুবু।’
বলেই সে চোখের জল মুছল।
ঘোড়ামুখীর তর সইছিল না। পেটের ভেতর খিদের ঘোড়াটা বড় বেশি লম্ফঝম্ফ করছিল, তার জায়গায় ফিরে এসে পেয়ারায় কেবল কামড় বসিয়েছে, অমনি শাঁ করে তার ঘাড়ের উপর ভয়াল থাবা। ’হারামজাদি, সারাপাড়া ঢুঁরে পেয়ারা দুটা এনেচি, আর তুই কিনা ফুসলিয়ে নিয়ে আসলি? তোর মাকে খেয়েছিস, এখন পটুকে খাবি? দে হারামজাদি, দে!’ তার হাত থেকে পেয়ারাটা কেড়ে নিল।
পটু ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে, মায়ের সামনে এসে উঁচু স্বরে বলল, ’মা, আমিই বুবুকে খেতে দিয়েছি! বুবু নিতে চায়নি।’
’আমার দরদি ছেলে রে!’ পেয়ারাটা পাঁচিলের উপর দিয়ে পুকুরের দিকে ছুঁড়ে ফেলে তার মা আবার বলল, ’তোদের কাউকেই খেতে হবে না।’
অন্ধকার তখনও দশাসই চেহারায়। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গেল ঘোড়ামুখী।
অন্ধকার তার আস্ফালন শেষে ফিরে গেছে। কাকভোর তন্ত্রমন্ত্র সেরে আলোতে স্নানের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, ঠিক সেসময় দুঃস্বপ্নের প্রজনন কেন্দ্রে ভিন্নরূপে ভিন্নসত্তায় জন্ম নিচ্ছিল ঘোড়ামুখী। তার সৎমা ছেলের জ্বর কমেছে কিনা দেখতে এসে বারান্দা থেকে নিচে তাকাল, বকরিগুলোকে শান্তশিষ্ট মনে হলেও ঘোড়ামুখীকে মনে হচ্ছিল অশান্ত। থরথর করে কাঁপছিল সে। গোঁ গোঁ শব্দের বিকট আওয়াজ তুলছিল যা স্নেস্বাধ্বনির মতো শোনাচ্ছিল। তার মুখটা অবিকল ঘোড়ার মতো দেখাচ্ছিল। কাঁধে অল্পস্বল্প কেশর গজিয়েছে। কান দুটো খাড়াখাড়া। ছেলের জ্বর দেখার কথা ভুলে গিয়ে দৌড়ে যাচ্ছিল স্বামীর কাছে, আবার ফিরে এল সে; ভ্রম না তো! খানিকক্ষণ দাঁড়ানোর পর যখন নিশ্চিত হলো তখন দৌড়ে গেল সে। ঝাঁকুনি দিয়ে ঘুম ভাঙাল স্বামীর; তারপর তার কানে কানে বলল, ’এবার ঘোড়ামুখীকে সার্কাস পাটিতে চড়াদামে বেচতে পারব গো! তার মুখটা এক্কেবারে ঘোড়ার মতন হয়েছে । আল্লাহ আমাদের দিকে মুখ ফিরে তাকিয়েছে। দেখতে চাইলে চলো—চলো।’
স্ত্রীর সঙ্গে এসে মেয়েকে দেখে সেও তাজ্জব। মেয়েটা তার কাঁধে বোঝা হয়ে ছিল, কাজেই যত তাড়াতাড়ি বোঝাটা সরানো যায় ততই মঙ্গল। বাসিমুখে সাত তাড়াতাড়ি ছুটে গেল সে সার্কাসের মালিককে ডাকতে।
সার্কাসের মালিক তার সঙ্গে দুজনকে নিয়ে এলেন। এদের মধ্যে একজন ঘোড়ার তত্ত্বাবধায়ক। কোন ঘোড়া দর্শক টানতে পারবে, সে বিষয়ে যথেষ্ট অভিজ্ঞ সে। টাকা খরচ করে আলতুফালতু জিনিস কিনলে তো হবে না! তাকে কিম্পুরুষের মতো আজব কিছু হতে হবে। মুখ ঘোড়ার বডি মানুষের কিংবা বডি ঘোড়ার মুখ মানুষের মতো হতে হবে। চা আপ্যায়নের পর তারা ঘোড়া দেখতে এল।
দুঃস্বপ্ন শেষে ঘোড়ামুখী আগের মতো। মুখের পরিবর্তন পরিলক্ষিত হলো না। কেমন ম্যাড়মেড়ে হয়ে মেয়েটা পড়ে আছে খড়ের বিছানায়! নাকের ফুটো দুটো মনে হচ্ছিল আরও সরু। তাজা ও ক্ষেপাটে না হলে সার্কাস জমে না। হাততালি পড়ে না। কেউ বাজি ধরে না। খেপে গেলেন মালিক, সেসঙ্গে তত্ত্বাবধায়কও।
’ধুর মিয়া! এসব পচা মাল দেখতে কেউ টিকিট কাটবে? যেদিন ওর মুখটা ঘোড়ার মুখের মতন নয়, সত্যি সত্যিই ঘোড়ামুখ হবে, সেদিন আমাদের জানাবেন। সময়টা বৃথা গেল। ওয়াক থু!’
তারপর তারা গজ গজ করতে করতে চলে গেলেন।
সেই থেকে অত্যাচারের নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলল ঘোড়ামুখীর উপর। মুখ বুজে সহ্য করা ছাড়া তার কোনও উপায় ছিল না। তার কানের কাছে নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনির মতো অনবরত বাজত সৎমায়ের বকুনি——হারামজাদি, সত্যি সত্যিই ঘোড়া হতে পারিস না? তোর বাপ বাঁচে, আমিও বাঁচি।
একসময় নিজেকে ঘোড়া হিসেবে ভাবতে লাগল সে। সেই ভাবনার স্ফুলিঙ্গ তার মস্তিষ্কের অণু-পরমাণুতে ছড়িয়ে পড়ল। ক্রমশ রূপান্তরকামী বিভ্রমে ডুবে গেল সে। এক বিষণ্ন সকালে ঘুম থেকে উঠে আবিষ্কার করল তার মুখখানা অলৌকিকভাবে সত্যিই ঘোড়ার মুখে রূপান্তরিত হয়েছে; তবে তার কণ্ঠস্বরের তেমন হেরফের ঘটেনি। ভয়-আতঙ্কে, মনোবৈকল্যে দুমড়ে-মুচড়ে গেল সে। স্বাভাবিক হতে তার সময় লাগল; কিন্তু শরম-লজ্জা পিছু ছাড়ল না। কাপড়ে মুখমণ্ডল ঢেকে ঠায় বসে রইল সে।
খানিকক্ষণ বাদে সৎমা এসে গলা চড়ালেন, ’জমিদারের বেটি পা তুলে বসে থাকলেই চলবে? বকরিগুলা মাঠে নিবে কে?’
ঘোড়ামুখী হঠাৎ কেঁদে উঠল। তার কান্নার স্বর কেমন যেন ঠেকল সৎমায়ের কাছে। মনের মধ্যে হোঁচট খেল সে। আস্তে আস্তে তার কাছে গিয়ে তার মুখের উপর থেকে কাপড়টা একটানে সরাল; তারপর খুশিতে বগল বাজাল। এমনটাই দির্ঘদিন ধরে চেয়েছিল সে। পটাপট চুমু খেল তার ঘোড়ামুখে।
সৎমায়ের কাছে এখন সে তুরুপের তাস। সঙ্গে সঙ্গে তাকে নিয়ে গেল সার্কাসের সেই মালিকের কাছে। চড়াদামে বিক্রি করল তাকে।
তত্ত্বাবধায়ক হৃষ্টচিত্তে বললেন, ’এবার খেলা জমবে!’
ঘোড়ামুখীকে নিয়ে কঠোর অনুশীলনে নামলেন তিনি। বিশেষভাবে কাঠের তৈরি খাঁচার ভেতর থেকে ড্রাগনের মতো মুখ দিয়ে কীভাবে আগুনের গোলা ছুঁড়তে হয়, তা শেখাতে লাগলেন। ঘামঝরা অনুশীলনে ঘোড়ামুখী শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়ল। নরক থেকে পালাতে ফন্দি আঁটছিল সে।
সার্কাসের মালিক একটা টুলে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছেন। তার সামনে একজন কর্মচারী রসগোল্লার হাঁড়ি হাতে তার দিকে সামান্য ঝুঁকে আছে। হাঁড়ি থেকে রসগোল্লা শিক দিয়ে ফুঁড়ে ফুঁড়ে একটার পর একটা তুলে তুলে খাচ্ছেন, আর অহংবোধে চুর হয়ে গল্প শোনাচ্ছেন তিনি, ’বুঝলিরে হরি! আমার দাদা এভাবেই রসগোল্লা খেতেন। হাতে রস ভরাতেন না। তিনি শিখেছিলেন তার বাবার কাছ থেকে। আর তার বাবা শিখেছিলেন বৃটিশদের কাছ থেকে। লম্বা ইতিহাস।’
এমন সময় তত্ত্বাবধায়ক তার সামনে এসে কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়ালেন। তার দিকে মুখ তুলে তাকালেন তিনি, ’কী…নিশ্চয় কোনো খারাপ সংবাদ?’
’মালিক, ঘোড়ামুখী পালিয়েছে,’ তত্ত্বাবধায়ক মাথা নিচু করে বললেন।
’আমার দায়িত্ব কি তাকে খুঁজে নিয়ে আসা?’ গম্ভীর কণ্ঠ তার। শিকটা কর্মচারীর হাতে দিলেন, যেন রসগোল্লা খাওয়া শেষ করেছেন; তবে তার ভাবসাবে মনে হচ্ছিল আসল কথাটা এখনও বলেননি। আটঘাট বেঁধে বসার মতো স্থির হয়ে আবার বললেন, ’এখন পর্যন্ত একটা শো হয়নি। আমি বেনিয়া বৃটিশদের মতো; লস করতে শিখিনি। একশ টাকা ইনভেস্ট করব দুশো টাকা ঘরে তুলব। যাও, যেখানেই পাও ধরে আনো তাকে।’
ডাকঘরের সামনে থেকে ধরে আনা হলো ঘোড়ামুখীকে।
ধরা পড়ার পর থেকে ঘোড়ামুখী ধীর, স্থির, অবিচল। সে বুঝে গেছে নিয়তির নিষ্ঠুর জাঁতাকল থেকে তার নিস্তার নেই। যে ঈশ্বরকে সে ঈশ্বর বলে মানে তার চোখে হয়ত ছানি পড়েছে; নইলে একজন মানুষকে এত দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা দেয় কীভাবে! সমস্ত বেদনার বিষ নীলকণ্ঠ পাখির মতো ধারণ করে ঈশ্বরকেই মুখ ভেংচাল সে।
এরপর চলতে থাকল তার সার্কাসজীবন। সার্কাস দেখতে আসা মানুষের উপচে পড়া ভিড়। টিকিট বিক্রি হু হু করে বাড়ল। সার্কাসের মালিক বেজায় খুশি। তার কড়িসমাগম হচ্ছে। স্টাফদের বেতন বাড়ছে। তত্ত্বাবধায়কের জন্যে বিশেষ উপহার। তবে তরতর করে সবকিছু সামনে এগোয় না; একদিন বাঁক পরিবর্তন হয়। সে বাঁক কখনও খাদের দিকে ধাবিত। তখন হরিষে বিষাদ নামে।
সকাল থেকেই ঘোড়ামুখীর মনটা উড়ুউড়ু। শরীরও ম্যাজম্যাজ করছিল। খুব বেশি করে মনে পড়ছিল মাকে, মনে পড়ছিল পটুকে। আহা, তাকে যদি হাওয়াই মিঠা কিনে খাওয়াতে পারত! দুচোখ বয়ে অশ্রু নামছিল তার। কাতর কণ্ঠে খসখসে গলায় তত্ত্বাবধায়ককে বলে, ’আজ আর সার্কাসে নামব না। বিরতি চাই।’
’বিরতি! কীসের বিরতি?’ তত্ত্বাবধায়ক তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। ওজর-আপত্তির ধার ধারেন না তিনি। মালিকের চাইতেও এক কাঠি সরেস। তার হুকুম অগ্রাহ্য করলেই তার মাথায় রক্ত ওঠে; চাবকিয়ে রক্তাক্ত করেন যে-কাউকে।
অবশেষে রক্তাক্ত শরীরে দর্শকদের বিনোদন দিতে গেল সে। খাঁচাবন্দি ঘোড়ামুখী কখনও মুখ দিয়ে আগুনের গোলা ছুড়ছিল, কখনও ঘোড়ার আওয়াজ শোনাচ্ছিল, কখনও জোকারের মতো অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শন করছিল। দর্শকরা হা করে উপভোগ করছিল।
অনাসক্ত বিকেল। বাতাস গুমোট, গম্ভীর। হঠাৎ সার্কাস প্যান্ডালে আগুন ধরে। গম্ভীর বাতাস মেজাজ হারায়। তেজোদ্দীপ্ত হয়ে দেঁতো হাসে। লেলিহান শিখা গ্রাস করতে থাকে পুরো প্যান্ডেল। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে দর্শকদের মাঝে। তারা প্রাণভয়ে ছোটাছুটি করতে থাকে। মালিক, তত্ত্বাবধায়ক এবং স্টাফরা জান বাঁচাতে তারাও পালাতে থাকেন। আগুন নেভানোর দিকে কারো মনোযোগ ছিল না।
দুর্ঘটনার আকস্মিকতায় বিহ্বল ঘোড়ামুখী। তার চোখের সামনেই ভেঙে পড়ছিল প্যান্ডেলের পোড়া অংশবিশেষ। আগুনে দগ্ধ দর্শকদের কান্নার রোল শুনতে পাচ্ছিল; তবে একদম ভেঙে পড়ল না সে। আগুনের আঁচ সে-ও পাচ্ছিল। খাঁচা বাইরে থেকে তালাবন্দি। বেরোনোর পথ ছিল না। মৃত্যু অবধারিত জেনেও চিৎকার-চেঁচামেচি করল না সে। এমনকি বাঁচার চেষ্টাও।
নিষ্পেষিত, বীতশ্রদ্ধ, জংধরা জীবনের প্রতি তার অনুরাগ বা মোহ আগে থেকেই ছিল না। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করবার জন্যে কেবলমাত্র একটা মঞ্চ দরকার ছিল তার, এখন পেয়েছে; ব্যস! পুড়তে পুড়তে যখন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছিল তখন সে খেয়াল দেখছিল তার মা শাদা শাড়ি পরে হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসছিল তার দিকে। শিশুসন্তানকে যেভাবে কোলে তুলে নেয় সেভাবে তুলে নিল তাকে।
তখন তার মুখে পরম শান্তির অস্ফুট একটা আওয়াজ ওঠে, মা…
জিল্লুর রহমান শুভ্র, গল্পকার