খায়রুল আনাম:
১৯২৯ সাল। ‘চট্টগ্রাম এডুকেশন সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠা অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত সভাপতি হিসেবে চট্টগ্রামে আসেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। এখানে তিনি এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। নব্বই বছরের পুরোনো ভাষণটি পড়লে তাঁকে মনে হবে কোনো কবি নন, কোনো সংগীতজ্ঞ নন, বরং একজন সামাজিক চিন্তাশীল ভবিষ্যদ্রষ্টা। মনে হয় তিনি যেন এই এখন আমাদের আজকের দিনের সমস্যা ও তার সমাধান নিয়ে কথা বলছেন। তাঁর ভাষণটি ছিল মূলত শিক্ষা ও অর্থনৈতিক দিক থেকে অনগ্রসর মুসলিম সমাজকে উদ্দেশ্য করে। অথচ লক্ষণীয় তিনি সাম্প্রদায়িক সংহতি রক্ষা ও পুরো ভারতবাসীর উন্নতির পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে কথাগুলো বলেছেন। কী আছে তাঁর ভাষণের মধ্যে?
জাতীয় কবি বলছেন, ‘কিছু বলবার আগে আমি স্মরণ করি সেই বিরাট পুরুষকে, যাঁর কীর্তি সারা বাংলার মুসলিম সমাজকে নর-নারী নির্বিশেষে মহিমান্বিত করেছে। তিনি আপনাদেরই এবং আমাদেরও পূণ্যশ্লোক মরহুম খান বাহাদুর আব্দুল আজিজ সাহেব (১)। শাহজাহানের তাজমহল গড়ে উঠেছিল শুধু মমতাজের ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে-তাজমহল সুন্দর। কিন্তু এই আত্মভোলা পুরুষের (আজিজ সাহেব) তাজমহল গড়ে উঠেছে সকল কালের সকল মানুষের বেদনাকে কেন্দ্র করে। এ তাজমহল শুধু বিউটিফুল নয়, এ সাবলাইম-মহিমময়!
তাঁকে (আব্দুল আজিজ সাহেবকে) দেখিনি। কিন্তু তাঁকে অনুভব করেছি এবং আজও করছি আপনাদের জাগরণের মাঝে-আমাদের নারী-জাগরণের উদয়-বেলায়। তিনি আজ আমার সালাম নিবেদনের বহু ঊর্ধ্বে, বহু দূরে। তবু এ ভরসা রাখি যে, আমার এ অকুলে ভাসিয়ে দেওয়া ফুল তাঁর চরণ ছুঁয়ে ধন্য হবেই। চট্টলের আজিজ নাই, কিন্তু বাংলার আজিজরা, দুলাল ছেলেরা আজও বেঁচে আছে। তাদেরই মধ্যে তাঁকে ফিরে পাব পরিপূর্ণরূপে, এই হোক আপনাদের- এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের সাধনা! এর চেয়ে বড় প্রার্থনা আমার নেই।
তাঁর কাজ তিনি করে গেছেন। তাঁর ‘বাহারে’র (২) মতো বাহার হয়তো বা থাকতেও পারে, কিন্তু তাঁর ‘নাহারে’র মত ‘নাহার’ (৩) আপনাদের চট্টলের মুসলমানদের ঘরে কটি আছে আমার জানা নেই। তিনি সুর ধরিয়ে দিয়ে গেছেন, এখন একে ‘সমে’ পৌঁছে দেওয়া আপনাদের কাজ। ওস্তাদ নেই, শিষ্যরা তো আছেন। একজন ওস্তাদের অভাব কি শত শিষ্যেও পূরণ করতে পারে না?
আপনাদের শিক্ষা-সমিতিতে আমি এসেছি আরেকটি উদ্দেশ্য নিয়ে। সে হচ্ছে, আপনাদের সমিতির মারফতে বাংলার সমগ্র মুসলিম সমাজের, বিশেষ করে ধনী ও শিক্ষিত সম্প্রদায়ের কাছে আমি যে মহান স্বপ্ন দিবা-রাত্রি ধরে দেখেছি-তা-ই বলে যাওয়া। এ স্বপ্ন যে একা আমারই তা নয়। এ স্বপ্ন বাঙলার তরুণ মুসলিমের, প্রবুদ্ধ ভারতের, এ স্বপ্ন বিংশ শতাব্দীর নব-নবীনের। আমি চাই আপনাদের এই পার্বত্য উপত্যকায় সে স্বপ্ন রূপ ধরে উঠুক। আপনাদের সমিতির উদ্দেশ্য হোক: আদাওয়াতি করে শাসন করা নয়-দাওয়াত দিয়ে মনের সিংহাসন অধিকার করা।
আজ নবজাগ্রত বিশ্বের কাছে বহু ঋণী আমরা, সে ঋণ আজ শুধু শোধই করব না-ঋণ দানও করব। আমরাও আমাদের দানে জগৎকে ঋণী করব-এই হোক আপনাদের চরম সাধনা। হাতের তালু আমাদের শূন্য পানেই তুলে ধরেছি এত দিন, আজ আমাদের হাত উপুড় করার দিন এসেছে। আমি বলি, রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনের মতো আমাদেরও কালচারের সভ্যতার জ্ঞানের সেন্টার কেন্দ্রভূমির ভিত্তি স্থাপনের মহৎ ভার আপনারা গ্রহণ করুন-আমাদের মতো শত শত তরুণ খাদেম তাদের সকল শক্তি-আশা-আকাঙ্ক্ষা জীবন অঞ্জলির মতো করে আপনাদের সে উদ্যমের পায়ে অর্ঘ্য দেবে। ইরানের শিরাজের মত শত শত সাদি, হাফিজ, খৈয়াম, রুমী, জামী, শমশি-তবরেজ এই শিরাজবাগে-এই বুলবুলিস্তানে জন্মগ্রহণ করুক। সেই দাওয়াতের আমন্ত্রণের গুরুভার আপনারা গ্রহণ করুন। আপনাদের বদ্ধ প্রাণ-ধারাকে মুক্তি দিন।
আমি এইরূপ “কালচারাল সেন্টারের” প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি নানা কারণে। একটি কারণ তার রাজনৈতিক। পলিটিক্সের নাম শুনে কেউ যেন চমকে উঠবেন না। আমি জানি, আপনাদের এই সমিতি রাজনীতি আলোচনার স্থান নয়, তবু যেটুকু না বললে নয়, আমি শুধু ততটুকুই বলব। এবং সেটুকু কারুর কাছেই ভয়াবহ হয়ে উঠবে না। আমি তাই একটু খুলে বলব মাত্র।
ভারত যে আজ পরাধীন এবং আজও যে স্বাধীনতার পথে তার যাত্রা শুরু হয়নি-শুধু আয়োজনের ঘটা হচ্ছে এবং ঘটও ভাঙছে—তার একমাত্র কারণ আমাদের হিন্দু-মুসলমানের পরস্পরের প্রতি হিংসা ও অশ্রদ্ধা। আমরা মুসলমানেরা আমাদেরই প্রতিবেশী হিন্দুর উন্নতি দেখে হিংসা করি, আর হিন্দুরা আমাদের অবনত দেখে আমাদের অশ্রদ্ধা করে। ইংরেজের শাসন সবচেয়ে বড় ক্ষতি করেছে এই যে, তার শিক্ষা-দীক্ষার চমক দিয়ে সে আমাদের এমনই চমকিত করে রেখেছে যে, আমাদের এই দুই জাতির কেউ কারুর শিক্ষা-দীক্ষা সভ্যতার অতীত মহিমার খবর রাখিনে। হিন্দু আমাদের অপরিচ্ছন্ন অশিক্ষিত কৃষাণ-মজুরদের-আর তাদের সংখ্যাই আমাদের জাতের মধ্যে বেশি-দেখে মনে করে, মুসলমান মাত্রই এই রকম নোংরা, এমনি মূর্খ, গোঁড়া। হয়তোবা ‘যথা পূর্বং তথা পরং’। দরিদ্র মূর্খ কালিমদ্দি মিয়াই তার কাছে অ্যাভারেজ মুসলমানের মাপকাঠি।
জ্ঞানে-বিজ্ঞানে শিল্পে-সংগীতে-সাহিত্যে মুসলমানের বিরাট দানের কথা হয় তারা জানেই না, কিংবা শুনলেও আমাদের কেউ তাদের সামনে তার সভ্যতার ইতিহাস ধরে দেখাতে পারে না বলে বিশ্বাস করে না; মনে করে-ও শুধু কাহিনি। হয়তো এক দিন ছিল, যখন হিন্দুরা মুসলমানদের অশ্রদ্ধা করত না। তখন রাজভাষা ছিল ফারসি। কাজেই হিন্দুরাও বাধ্য হয়ে ফারসি শিখতেন-এখন যেমন আমরা ইংরেজি শিখি। আর ফারসি জানার ফলে তাঁরা মুসলমানদের বিশ্ব-সভ্যতায় দানের কথা ভালো করেই জানতেন। কাজেই সে সময় অর্থাৎ ইংরেজ আসার পূর্ব পর্যন্ত তারা কোনো মুসলমান নোয়াব বাদশার প্রতি বিরূপ হয়ে উঠলেও সমগ্র মুসলমান জাতি বা ধর্মের ওপর বিরূপ হয়ে ওঠেননি। শিবাজি-প্রতাপ যুদ্ধ করেছিল আওরঙ্গজেব-আকবরের বিরুদ্ধে, মুসলমান ধর্ম বা ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে নয়। তখনকার সেই অশ্রদ্ধা ছিল ব্যক্তির বিরুদ্ধে গোষ্ঠীর বা সমগ্র জাতটার ওপর একেবারেই নয়।
কিন্তু আজ আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডিই হচ্ছে, আমার সবচেয়ে কাছের মানুষটিকেই সবচেয়ে কম করে জানি। আমরা ইংরাজের কৃপায় ইংরেজি, গ্রিক, ল্যাটিন, হিব্রু থেকে শুরু করে ফ্রেঞ্চ, জার্মান, ইতালিয়ান, স্প্যানিশ, চেক, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান, চীন, জাপানি, হনলুলুর ভাষা জানি, ইতিহাস জানি, তাদের সভ্যতার খবর নিই, কিন্তু আমারই ঘরের গায়ে গা লাগিয়ে যে প্রতিবেশীর ঘর, তারই কোনো খবর রাখিনে বা রাখবার চেষ্টাও করিনে। বরং ওই না-জানার গর্ব করি বুক ফুলিয়ে। একেই বলে বোধ হয়, ‘পেনি ওয়াইজ, পাউন্ড ফুলিশ।’
হিন্দু আরবি, ফারসি, উর্দু জানে না, অথচ আমাদের শাস্ত্র-সভ্যতা জ্ঞান-বিজ্ঞান সবকিছুর ইতিহাস আমাদের ঘরের বিবিদের মতোই ওই তিন ভাষার হেরেমে বন্দী। বিবিদের হেরেমের প্রাচীর বরং একটু করে ভাঙতে শুরু হয়েছে, ওঁদের মুখের বোরকাও খুলছে, কিন্তু ওই তিন ভাষার প্রাচীর বা বোরকা-মুক্ত হলো না আমাদের অতীত ইতিহাস, আমাদের দানের মহিমা। অতএব অন্য ধর্মাবলম্বীদের আমাদের কোনো কিছু জানে না বলে দোষ দেওয়ার অধিকার আমাদের নেই। অবশ্য আমরাও অনুস্বরের সঙিন ও বিসর্গের কাঁটা বেড়া ডিঙিয়ে সংস্কৃতের দুর্গে প্রবেশ করতে পারিনে বা তার চেষ্টাও করিনে। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর হিন্দু তবু কতকটা কিনারা করেছে সে সমস্যার। তারা প্রাদেশিক ভাষায় তাদের সকল কিছু অনুবাদ করে ফেলেছে। সংস্কৃতের উঁচানো দুর্গ থেকে রূপ-কুমারীকে গোপনে মুক্তিদান করেছে। তার ভবনের আলো আজ ভুবনের হয়ে উঠেছে। মাতৃভাষায় সে সবের অনুবাদ হয়ে এই ফল হয়েছে যে, অন্তত বাংলার মুসলমানরা হিন্দুর কালচার, শাস্ত্র, সভ্যতা প্রভৃতির সঙ্গে যত পরিচিত, তার শতাংশের একাংশও পরিচিত নয় সে তার নিজের ধর্ম সভ্যতা ইত্যাদির সঙ্গে।
কোনো মুসলমান যদি তার সভ্যতা, ইতিহাস, ধর্মশাস্ত্র কোনো কিছু জানতে চায়, তাহলে তাকে আরবি-ফারসি বা উর্দুর দেয়াল টপকাবার জন্য আগে ভালো করে কসরত শিখতে হবে। ইংরেজি ভাষায় ইসলামের ফিরিঙ্গি রূপ দেখতে হবে। কিন্তু সাধারণ মুসলমান বাংলাও ভালো করে শেখে না, তার আবার আরবি-ফারসি। কাজেই ন’মণ তেলও আসে না, রাধাও নাচে না। আর যাঁরা ও ভাষা শেখেন, তাঁদের অবস্থা “পড়ে ফারসি, বেচে তেল!” আর তাঁদের অনেকেই শেখেনও সেরেফ হালুয়া-রুটির জন্য। কয়জন মৌলানা সাহেব আমাদের মাতৃভাষার পাত্রে আরবি-ফার্সির সমুদ্র মন্থন করে অমৃত এনে দিয়েছেন জানি না। সে অমৃত তাঁরা একা পান করেই “খোদার খাসি” হয়েছেন।
কিন্তু এ খোদার খাসি দিয়ে আর কত দিন চলবে? আপনাদের অনুরোধ করতে এসেছি এবং আপনাদের মারফতে বাংলার সব চিন্তাশীল মুসলমানদেরও অনুরোধ করছি, আপনাদের শক্তি আছে, অর্থ আছে-যদি পারেন মাতৃভাষায় আপনাদের সাহিত্য-জ্ঞান-বিজ্ঞান-ইতিহাস সভ্যতার অনুবাদ ও অনুশীলনের কেন্দ্রভূমি যেখানে হোক প্রতিষ্ঠা করুন। তা না পারলে অনর্থক ‘ধর্ম ধর্ম’ বলে ‘ইসলাম’ বলে চিৎকার করবেন না।
আমাদের ঘর-লাগোয়া পড়শির মন থেকে আমাদের প্রতি এই অশ্রদ্ধা দূর হবে এই এক উপায়ে, আর তবেই ভারতের স্বাধীনতার পথ প্রশস্ত হবে। সকল সাম্প্রদায়িকতার মাতলামিরও অবসান হবে সেদিন, যেদিন হিন্দু-মুসলমান পরস্পর পরস্পরকে পরিপূর্ণ শ্রদ্ধা নিয়ে আলিঙ্গন করতে পারবে। সেদিন যে প্রতিযোগিতা হবে, তা হবে সংস্কৃত মনের সভ্য প্রতিযোগিতা, খেলোয়াড় সুলভ প্রতিযোগিতা।’
পাদটিকা
১. খান বাহাদুর আব্দুল আজিজের (১৮৬৩ – ১৯২৬), জন্ম ফেনী, নোয়াখালী। তিনি একজন শিক্ষাবিদ, লেখক ও সমাজকর্মী ছিলেন। ঢাকা কলেজ থেকে ১৮৮৬ সালে বৃহত্তর নোয়াখালীর প্রথম স্নাতক ছিলেন তিনি। পেশায় শিক্ষকতা, পরে সাব-ইন্সপেক্টর অব স্কুলস হন। ১৮৮৩ সালে তিনি ‘ঢাকা মুসলমান সুহৃদ সম্মিলনী’ ও পরে চট্টগ্রামে ‘মুসলমান শিক্ষা সভা’ প্রতিষ্ঠা করেন।
২. বিখ্যাত নাতি ‘হাবিবুল্লাহ বাহার চৌধুরী’
৩. খান বাহাদুর আব্দুল আজিজের নাতনি ‘বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদ’। এঁদের সঙ্গে নজরুলের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ও চিঠিপত্র বিনিময়ের নথিপত্র আজও স্মরণীয় ও অম্লান হয়ে আছে।
৩. তথ্যসূত্র-নজরুল সম্পর্কিত রচনাবলি থেকে আহরিত, সংক্ষেপিত ও পরিমার্জিত।
খায়রুল আনাম, প্রাবন্ধিক