এখন সময়:রাত ১০:২৫- আজ: বুধবার-৯ই জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-২৫শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-বর্ষাকাল

এখন সময়:রাত ১০:২৫- আজ: বুধবার
৯ই জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-২৫শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-বর্ষাকাল

চাটগাঁ ভাষার বর্ণমালা- সমস্যা ও সম্ভাবনা

ড. শ্যামল কান্তি দত্ত

উনিশ শতক সমাপ্তির দুবছর আগে ‘ভাষাবিচ্ছেদ’ (১৮৯৮) প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লেখেন: ‘বাংলা ভাষার সহিত আসামি ও উড়িষ্যার যে-প্রভেদ সে-প্রভেদসূত্রে পরস্পর ভিন্ন হইবার কোনো কারণ দেখা যায় না। উক্ত দুই ভাষা চট্টগ্রামের ভাষা অপেক্ষা বাংলা হইতে স্বতন্ত্র নহে’ (রবীন্দ্রনাথ, ১৮৯৮: ৪৭)। তবু ব্রিটিশ বিভাজন-নীতিতে আসাম রাজ্যে অসমিয়া ও উড়িষ্যা রাজ্যে ওড়িয়া আজ পৃথক ভাষা হলেও চাটগাঁ ভাষা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা বা বাংলা ভাষার উপভাষা হিসেবেই সর্বজন স্বীকৃত। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদও তাঁর অভিভাষণে (১৯১৮) এবং ‘ইসলামাবাদ’ (১৯৬৪) গ্রন্থে স্বীকার করে নিয়েছেন:‘চট্টগ্রামের ভাষাও খাঁটি বাঙ্গালা ভাষা এবং তাহার উচ্চারণ ও গঠন-প্রণালীও একেবারে নিয়ম পরিশূন্য নহে’ (আবদুল করিম, ২০১৭: ১০০)। আবদুররশিদ ছিদ্দিকী তাঁর ‘চট্টগ্রামী ভাষাতত্ত্ব’ (১৯৩৫) গ্রন্থে এবং  বিশিষ্ট বাংলা বৈয়াকরণ ড. মুহম্মদ এনামুল হক তাঁর ‘চট্টগ্রামী বাঙ্গালার রহস্য-ভেদ’ (১৯৩৫) গ্রন্থেও চট্টগ্রামের ভাষাকে বাংলার উপভাষা বলেই গণ্য করেছেন। ড. মনিরুজ্জামান, ড. আবুল কাসেম, ড. মাহবুবুল হক ও ড. রবীন্দ্রকুমার দত্ত প্রমুখ ভাষাবিজ্ঞানীগণও চট্টগ্রামের ভাষাকে বাংলার উপভাষা ধরেই এর বিশ্লেষণে-

প্রয়োগে-প্রচারে আত্মনিয়োগ করেছেন। অবশ্য সিলেট-চট্টগ্রামের অনেকেই নিজেদের মুখের বুলিকে পৃথক ভাষা ভেবে আত্মশ্লাঘা অনুভব করেন। তাঁরা ভুলে যান পৃথিবীতে যে-একশতটি ভাষায় দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হয় এবং স্কুল-কলেজে শিক্ষা দেওয়া হয় সে-তালিকায় ভাষাদুটি নেই। উপরন্তু এমন বিচ্ছিন্নতাবাদী চিন্তা বাঙালি জাতীয়তাবাদেরও বিরোধী বলে আমরা মনে করি। উল্লেখিত ভাষাগবেষকগণের মতো ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সম্পাদিত ‘আঞ্চলিক ভাষার অভিধান (১৯৬৫), আহমেদ আমিন চৌধুরী সংকলিত চট্টগ্রামী বাংলার শব্দসম্ভার (১৯৯৮), নূর মোহাম্মদ রফিক সম্পাদিত ‘চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান’ (২০০১), আহমেদ আমিন চৌধুরী সংকলিত চট্টগ্রামী ভাষার অভিধান ও লোকাচার (২০০৯), মাহবুবুল হাসান সম্পাদিত ‘চট্টগ্রামী বাংলার অভিধান’ (২০১০) সর্বত্রই বাংলা লিপিতে চট্টগ্রামী উপভাষা বা চাটগাঁইয়া ভাষা লিখিত হয়েছে।

এমন বাস্তবতায় চাটগাঁ ভাষা পরিষদ’র উদ্যোগে বিগত ১৮ই ডিসেম্বর ২০১০ এক সেমিনারে আমন্ত্রিত ভাষাবিজ্ঞানী  সিদ্ধান্ত জানান: সুতরাং দেখা যাচ্ছে অন্য লিপির চেয়ে বঙ্গ লিপিতেই চট্টগ্রামের উপভাষা প্রপঞ্চ সবচেয়ে বেশি লিপিধৃত হয়েছে। লিপিধারণের ঐতিহ্য বিচারে ‘বঙ্গলিপি’তেই চট্টগ্রামি ভাষা নমুনা নিবন্ধিত হওয়া ভালো মনে করি (মনসুর, ২০১২: ৪৩)। এর পরও কেউ কেউ চট্টগ্রামী ভাষাকে রোমান হরফে কিংবা আরবি হরফে লিখবার পক্ষে প্রবন্ধ লিখছেন কিংবা যুক্তি উপস্থাপন করছেন। অতি সম্প্রতি কেউ কেউ সিলেটি নাগরি লিপি দিয়ে চট্টগ্রামী ভাষা লেখার কথা ভাবছেন। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে—পাকিস্তান সৃষ্টির প্রাথমিক পর্যায়ে চট্টগ্রাম অঞ্চলের কয়েকজন লেখক-প্রকাশক এবং পাকিস্তানের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী বাংলা ভাষাকেও আরবি হরফে লেখার প্রয়াস চালান। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ তখন ২১ এপ্রিল ১৯৪৯-এ দৈনিক আজাদে প্রকাশিত ‘আরবি হরফে বাংলা ভাষা’ প্রবন্ধে লেখেন, ‘যাহারা বাংলা হরফে বাংলা লেখা অপেক্ষা আরবি হরফে বাংলা লেখা সহজ মনে করেন তাহারা ধ্বনিতত্ত্ব সম্পর্কে অজ্ঞ। … আমার বিশ্বাস আরবি হরফ প্রবর্তনের ফলে পূর্ব-পাকিস্তানে জ্ঞানের স্রোত রুদ্ধ হইয়া যাবে’(শহীদুল্লাহ, ১৯৮৫:২১৬)। এ কথা কেবল আরবি নয়, বাংলা ভিন্ন যেকোনো লিপি প্রয়োগের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। বাংলা ভিন্ন অন্য লিপিতে লিখতে গেলে ঐ লিপির পাঠক কারা হবেন তা ভেবে দেখা দরকার। ভেবে দেখা দরকার আমাদের বাংলা লিপি থাকতে আরেকটি নতুন লিপি শেখানোর প্রয়োজন কতোটা। ইদানীং চট্টগ্রামী শিক্ষিত লোকেরা চট্টগ্রামী শব্দকে বাংলা বর্ণমালা দিয়ে লেখেন বটে, কিন্তু প্রত্যেকে নিজস্ব ঢংয়ে। ব্যানারে, পোস্টারে, বিজ্ঞাপনে কিংবা সাইনবোর্ডে বাণিজ্যিক স্বার্থে বাহারি চমক সৃষ্টির জন্য আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে অনাদরে-অবহেলায়। যেমন— ‘মেজ্জান হাইলে আইয়ুন’। কথাসাহিত্যিক ও সিরিয়াল নির্মাতারা বাণিজ্যিক ভাবনায় অপ্রয়োজনে গালিবাচক শব্দ বা বদবুলি ব্যবহার করছেন যথেচ্ছভাবে। অবশ্য অস্বীকার করছি না যে, ‘গালি বা বদবুলিও মানুষের সভ্যতা-সংস্কৃতির অংশ। … চট্টগ্রামী ভাষায় সংস্কৃত চুদ্ ধাতু থেকে উদ্ভূত শব্দের বহুল ব্যবহার লক্ষ করা যায়। … চুদানির পোয়া বা চুদানির ছেলে বা মেয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে অপ্রিয় সত্য বুলি’ (কমরুদ্দিন, ২০২১:১৯১)। তবু সাহিত্যের ভাষার এর ব্যবহারের পরিমিতি বোধ থাকা প্রয়োজন বলেই আমাদের বিশ্বাস। চাটগাঁ ভাষা পরিষদ’র সভাপতির প্রত্যাশাও তাই: চট্টগ্রামী বাংলা শব্দের বানানের সমতা আনতে গেলে আমাদেরকে এই ভাষার ধ্বনিপরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা এবং তার ভিত্তিতেই প্রণীত একটি অভিন্ন বানানরীতি প্রণয়ন করা দরকার (কাসেম, ২০২০: ১৪৪)। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে বাংলা কথাসাহিত্যে-কবিতায়-গানে ও প্রবন্ধে-গবেষণায় ব্যবহৃত চাটগাঁ ভাষার বিভিন্ন নমুনায় চোখ বুলানো যেতে পারে।

 

১.  সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর নয়নচারা (১৯৪৫) গল্পগ্রন্থের ‘জাহাজি’ গল্পে ব্যবহৃত চাটগাঁ ভাষার নমুনা:

ক.  —ইবা কন? (হন লিখেননি। প্রত্যুত্তরে) — আঁই, মজিদ (ওয়ালীউল্লাহ, ২০২২: ৮) ।

খ. —কী অ’ডা ছাত্তার?  …   —যা, আঁই দেইক্যুম (পৃ. ৯)। … যা যা—দেইক্যুম আঁই। … হেতেরা কি মানুষ? (পৃ.১১)।

গ.  ছাত্তারগারে ফাডাই দিয়ো তো— (পৃ.১২)।

ঘ. —অ’ডা, খালি লাথি এনা খাইয়ছ দে— । … —বারিৎ কন আছে তোর? … —যা; এ’নে ডাক্যিলাম দে (পৃ. ১৩)।

ঙ. —না, এনে আস্যি দে। (এএনে লিখেননি)। … —বারির লাই মন কাঁদে। —আর, বারির তুন পলাই আস্যি আঁই—ইয়ল্লাই মন আরো ব্যাশ কাঁদে জে (পৃ.১৩)।

ছ. —অ’ডা গেয়া, খতা হুনি যা। … তুই বারিৎ যা গই, আর ন আইছ্ (পৃ. ১৪)।

 

২. আলাউদ্দিন আল আজাদের (১৯৬২) উপন্যাসে ব্যবহৃত চাটগাঁ ভাষার সংলাপ:

ক. কামার: রাখ চোরাগ্ গুয়া ধরাই। …রমজান:  কারিগর, কালিয়া নওয়ার মইধ্যে চাই। বুঝতে পাইরছনি? (পৃ.৯)।

খ. কি? হইয়ে নি? (ইসমাইলের উত্তরে মিস্ত্রি ) ইক্কানি থিও, ইত্তারই করি দিয়ুম(পৃ.১০)।

গ. রমজান: গেয়া তুই কইত্তনে আইয়দ্দে? তরে খুঁইজতে ছিলাম।   … ইসমাইল:  ঠেকাৎ পইজ্জ ফান্লার ; চুরুট-ফুরুট দও উগগা টানি লই! … রমজান: বহুৎ রুই-কাতল চড়াই, আঁর উপর টেক্কা মারে ভাইপুৎ? দে মানিব্যাগ্ গুয়া ফেরৎ দে। … তাইলে কালিয়া দশ্ শুয়া বাজে কালুরঘাটৎ আইস্ । …ইসমাইল: কিছু টেঁয়া দও। বাড়িৎ দেওন পড়িব (পৃ.১৪)।

ঘ. রমজান: ইবা কন? নানি নাকি? অত বেজার ক্যা? নাগর ন আইয়ের?  বুড়ি: আর ভাই হেই বয়সকাল কি আছে যে আইবো! — কনে কয় নাই হাতী মরলেও লাখ টেঁয়া। … চুরুট দে খাই। —তা র্দি। রমজান বলল, এ্যা আঁরও আজিয়া বড় ভুখ্ লাইগ্যে, ভালো খাওন চাই। বুড়ি বলল, তা অনব। জানস তো নাতি হাঁজইন্যা অত খাতির নাই।

ঙ.  কেরামত: আহ্! কণ্ডে যওদ্দে? আর ইক্কিনি দে, কোমরৎ বিষ কর্রে। … মানুফুফু: ইবা কন? জুলি না? আয় মা ইক্কানি বয় আঁই আর ন পার্রি। আজরাইল আঁরে ক্যা যে চোখে ন চায়!  কোন্ বিয়ানে গেইয়ে, আর ইত্তারি আইয়েদ্দে, এগুন্ আঁই আর দেখিৎ পাত্তাম না। … তোরার ঘরৎ তো লাকড়ি আছে, ইক্কানি দি যানা মা। বিয়ানতন ন খায় (পৃ. ২০)।

 

৩. আবুল ফজলের ‘রহস্যময় প্রকৃতি’ (১৯৬৪) গল্পে শরৎ কবিরাজের সাথে বসিরের কথোপকথনে চাটগাঁ ভাষার ব্যতিক্রমী বানানের প্রয়োগ দেখা যায়। যেমন—

ক. এত ভারী ঔষধেও যেঅন কোন্ ফল ন আইল্ তঅন্ মনে তঅর যে তোঁয়ারে গ্রহদোষে পাইয়ে।

—গরদোষ অইলে খি খইত্থ অইব বাবু।

—খনঅ ভালা জ্যোতিষীরে দিয়ে স্বস্ত্যয়ন খরাইতে অইব (আবুল ফজল, ২০০৮: ৬৩)।

 

৪. আহমদ ছফার সূর্য তুমি সাথী (১৯৬৭) উপন্যাসে চট্টগ্রামের ভাষায় সংলাপ লিখে পাশে প্রথম বন্ধনীতে প্রমিত বাংলা জুড়ে দিয়েছেন সমগ্র বাংলাভাষীদের বোধগম্যতার কথা চিন্তা করে। যেমন—

ক. হাসিম: তেজেনদা এত রাতিয়া কিল্লাই বাইর আইয়স যে। … কী তেজেনদা রাগ অইয়স যে না, কথা ন কস ক্যা? (আহমদ, ২০১৫: ৯)।

খ. ছতুর বাপ: আত্মহত্যা মহাপাপ। কায়ের এনে তো যাইত দোযখত্। এক্কই কথা। (পৃ.৯)।

গ. হাসিমকে সুফিয়া: টেঁয়ার নামে কাঁইচ কেলা দিব, নিষ্কর্মা মরদ, ভাত দিত ন পাইরলে বিয়া গইরত কনে কইয়ে? … আল্লা, তুই আঁরে নে, এই দুন্যাই বিষ অই গেইয়ে (পৃ. ১৩)।

ঘ. দোকানদার নবী: অ জলিল ভাই, তুঁই আজুয়া কিছু ন দিলে চইল কিনিত পাইত্যাম নয়, পোয়া মাইয়া উয়াস থাইব। দুয় টেঁয়া দ্য, বাকি টেঁয়া পরে দিয়। (প্রত্যুত্তরে) আরে আজিয়া কন পরকারে সামালি ল, অমাবস্যার যো আইয়ুক … বেবাক টেঁয়া শোধ গরি দিয়ম (পৃ. ১৩)।

ঙ. নাজিম: বেডার পুতে দুনিয়ার হক্কল কুকাম করে হেই খেয়াল নাই। পরের খুঁতা পাইলে তাঁই কাজি, তাঁই মাঝি। আর মাইয়ারে যা একখান বানাইয়ে (পৃ.১৪)।

 

৫. সেলিনা হোসেনের পোকামাকড়ের ঘরবসতি (১৯৮৬) উপন্যাসে অধিকাংশ সংলাপ-ই চাটগাঁ ভাষার চমৎকার উদাহরণ রূপে উপস্থাপিত।  যেমন—

ক. মালেকের উদ্দেশে তমিজের কথা: মিছা কথা। তুঁই আইয়ো দ্বীপর লাই। তয় দ্বীপডা দেইখতে সোন্দর। ওই শামুক ঝিনুকের পাহাড় আঁরে নিশির মতো টানে। মাঝে মাঝে আঁইও তোঁয়ার নান পাগল হই যাই। ওই ফুটু, চা ন দিলি ? কতক্ষণ লাগে সুমনদির পুত! (পৃ.২৩৭)।

খ. মালেক-বসিরের কথায়: আঁরার ব্যাগ্যুনর জাল ন হয় ক্যা, ট্রলার ন হয় ক্যা, হক্কলে পত্যদিন ভাত ন পায় ক্যা ?

—আঁর মনত হয় তোঁয়ারে ভূতে ধইজ্যে। বেগ্যুনের কথা ভাবিয়ারে লাব নাই। নিজের আখের গুছাও (পৃ.২৪৬)।

গ. মেহের-মালেকের কথায়: অ মা, অ্যাতাক্কিন ? অ্যাত কম সময়ত ক্যানে পারিলা ?

—হালা দিয়ম পোন্দে লাথি। হুদা ত্যালানি (পৃ.২৬১)।

ঘ. মালেকের মায়ের কথায়: তুঁই উগ্যা বিয়া কর বাবা! … তোর বউর লগে আঁই কইজ্যা ন কইরগ্যম। যিয়ান কইব হিয়ান হুইন্যম। তুই চাই লইস, বাজান (পৃ.২৯৩)।

ঙ. সালেকের কথায়: তোঁয়ার নান ভালা মানুষর কাছত ঠিক ন হয়। আঁই তোঁয়ার নান ফেরেসতা হইত ন পাইজ্যম। চালাকি করি উডিত ন পারিলে কেউ হাতর কাছত আনি ন দেয় (পৃ.২৯৬)।

 

৬. হরিশংকর জলদাসের ‘দহনকাল’ (২০১০) উপন্যাসে ব্যবহৃত চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা কথাসাহিত্যের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়িয়েছে বৈকি। যেমন—

ক. রাধানাথ বলে: আর ইক্কিনি জোরে হাঁট অ-বাআজি। ঠিক সমত্ পৌঁছন পড়িবো (পৃ.৭)। …মাস্টরবাউ, আঁই অশিক্ষিত একজন জাইল্যা, রাধানাথ আঁর নাম। আঁর এই পোয়াউয়ারে তোঁয়ার পাআর উধর রাই গেলাম। হিতারে মানুষ গইয্যো (পৃ. ৮)। … হরিদাসরে আঁই পড়াইয়ম। মাছ মারইন্যা জাইল্যা হইতাম দিতাম নো। পড়ালেখা শিখইন্যা জাইল্যা বানাইয়ম। তুঁই কী কও? (পৃ.১৩)।

খ. হরিদাস বলে: বাবা ইক্কিনি ইক্কিনি শিখিয়েছে (পৃ. ৯)। …  তুঁই কডে যাইবা? আর বাড়ি তো জাইল্যাপাড়া। আঁই তো দইজ্যার পাড়র জাইল্যাপাড়াত যাইয়ম (পৃ. ১০)। … তোঁয়াত্তোন বিদ্যা আছে কী নাই হিয়ান আঁই জানি, এই পাড়ার মাইনষে জানে, দশ গেরামে জানে। তুঁই আঁরে নো ফিরাইও জেডা (১৬)।

গ. ভূপাল বলে: তোঁয়ার নাম হরিদাস, আঁই ভূপাল চৌধুরী। কেলাস টু-ত পড়ি। তোঁয়ার হাতের লেখা বঅর সুন্দর। স্যারে কইয়ে, আঁরাও দেক্খি। … জাইল্যাপাড়া নো কইও, কইবা জেলেপাড়া, ন্যারের বাড়ির ঘাটার মাথাত্ আঁরঅ বাড়ি। তোঁয়ার-আঁর একই পথ, চল (পৃ. ১০)।

ঘ. বসুমতি বলেছিল: তুঁই ঠিক কইও। আঁরার উগগা পোয়ারে অন্তত আঁরা শিক্ষিত গইয্যম (পৃ. ১৩)। … খেলা খাইতো গেইয়ে পাআনলার (পৃ. ১৪)।

 

৭. কাফি কামালের মেইট্টাল (২০১১) গল্পগ্রন্থ পুরোপুরি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় লেখা প্রথম ও সফল একটি গ্রন্থ। এখানে শুধু সংলাপ নয় গল্পকারের বয়ানও চট্টগ্রামের ভাষায় লেখা হয়েছে। গ্রন্থের শুরুতে চার পৃষ্ঠা ব্যাপ্ত প্রমিত বাংলায় চট্টগ্রামী ভাষা সম্পর্কিত ভূমিকার পাশাপাশি ১২৭ পৃষ্ঠার বইয়ে পাঁচটি গল্পের শেষেই গল্পে ব্যবহৃত চট্টগ্রামী শব্দের বাংলা অর্থ জুড়ে দেওয়া হয়েছে যাতে গল্প পাঠে বাঙালি পাঠকের সুবিধা হয়। লোহাগাড়ার এ গল্পকারের ভাষায় দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রভাব বেশি এবং মান বাংলা উপভাষা থেকে দূরবর্তী বানান ব্যবহারের প্রবণতা লক্ষণীয়। যেমন—

ক. গল্পক্রম: ‘র্মা বদিয়ালম’, ‘আজারুদ্দিন লেই ল’, ‘রইত্থার পোয়া চৈইত্থা’, ‘কুর কুরাইন্না আঁসি’ ও ‘মেইট্টাল’ (পৃ. ৭)।

খ. কিন্তু হনে ওনের হার হতা। …নাস্তা পানি হাইতে হাইতে ফোয়াইরগা অক্কলে বদিয়ালমর অওর গোষ্ঠীর নাম গরে। … আত্তু গম লাই¹ে—আমার ভালো লেগেছে (পৃ. ২৬-৩২-৩৪)।

গ. মন্টুত্তুন জোয়ান হালর হতা মনত পরে।… মন্টু তারা মেডি হাইট্টে হাইট্টে মাছ চাইত আসসে দে মাইনসর হান্ড দেহে। দইনপারার মাইজ্জার পোয়া নুইন্না মিয়া বউতক্ষন ধরি তোধার মুখত জাল বা’র। নুইন্নারে দেই মেইট্টাল অক্কলে নানান রহম ডক মশকারী গরে। … বউদ্দিন ধরি কেচা মরিচদি রাইন্দা মাছর তরহারি হা ন’র (পৃ. ১১৩-১২২)।

ঘ. হয়েপ্পরল—কয়েক প্রস্ত, হল্লা—কল্লা, হাইট্টাম—কাটতাম, হাডানি—কাটাতে, হাড়িবাল্লায়—কাটাতে, হাঁদর কা—কাঁদছ কেন, হান ছেদানি—কান ছেদানো অনুষ্ঠান, …হোজার—খোঁজার, হোদাল— কোদাল (পৃ. ১২৭)।

 

৮. আজাদ বুলবুলের ‘অগ্নিকোণ’ (২০১৮) উপন্যাসে ঐতিহাসিক চরিত্রের পাশাপাশি সাধারণ চরিত্রের মুখে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক বুলি-বদবুলির প্রয়োগ উপন্যাসের ভাষাকে প্রাণবন্ত করে তুলেছে। যেমন—

ক. গোলতাজীর বাপ বলে:  ইতার চনুরে কাডিয়েরে কুত্তারে খাবন দরকার। বেয়াদপ, বেত্তমিজ। বদমাসি গরনের অউস অইলে গোয়াচি বাগানত্ যা। এডে ন ফাইলে রেয়াজুদ্দিন বাজারত্, নইলে সাআব পাড়াত যা। এত্তর সহস, হানকির পোয়া বাড়ির বউর মিক্যা নজর দ্যায়! তারে ল্যাংটা গরি পোন্দর ভিৎরে জুম্মা মরিচ গল্লাই দঅন দরহার (পৃ. ১২)। … আঁর নাতিন ত কোন দোষ নঅ গরে। উত্তর পইরত্ একলা পাইয়েরে তে তারে বেইজ্জত গরনের চেষ্টা গইজ্জে। আঁই নাতিনেরে মুখ দেহাইন্নফারি। তোঁয়ারা সমাজর দশজন থাইকতে আঁরার ইজ্জত লই লন্ডা পোয়াঅল ছিনিমিনি খেলিবো, আর তুঁই চৌধুরী চাই থাইবা (পৃ. ১৫)?

খ. ফজু চৌধুরী বলে: ওয়া হাক্কু। বিচার চাইবাল্লাই আইস্যদে? এ বিচারত্ মরদপোয়ার কনঅ বদনাম অইত ন। বদনাম অইবু মাইয়াপোয়ার। তোয়ার নাতিনর (পৃ.১৫)।… তুই দেইদ্দি ইন্দুঅলর তারিফে পাঁচমুখ অই গেইয়চ। তারার দুই চাইর জন বোমা বন্দুক দিয়েরে কার বাল ফালাইবো? তারার লয় কি দেশ গেরামর মানুষ আছে? আঁরা আছি? তোঁয়ারা আছো (পৃ. ১৬)?

গ. রহম বলি বলে: আছে, আছে। তারার লয় ইসকুল কলজর পোয়াঅল আছে। তারার মাইয়াপোয়াঅল আছে। ইতিরাও দলত্ নাম লেখাইয়ে। পোয়াঅলর লয় তারা আঁধাইজ্জা জঙ্গলত্ মিটিং গরে। বন্দুক পিস্তল চালনার ট্রেনিং লয়। কতো কতো গোপন বুদ্ধি পরামর্শ গরে। হেই পোয়াউন কিন্ত মাইয়াপোয়ার মিক্যা বদনজর ন দেয়। তারা লয় কু কাম গরনের কথা চিন্তাও ন গরে। আর আরার মোছলমান পোয়াঅল পইর ঘাডত একলা পাইয়ারে মাইয়াপোয়ারে বদমাইসি গরিবার লাই লেডাই পরে (পৃ.১৬)।

 

৯. মনওয়ার সাগরের ‘ষোলশহর জংশন ও শাটল ট্রেন’ (২০১৮) উপন্যাসে মর্জিনা ও তার বাপ-মায়ের কথোপকথনে চাটগাঁ ভাষার ব্যবহার কলহকে কল্লোলিত করে তুলেছে। যেমন—

ক. পিতা: আঁয় যেডে পছন গইজ্জুম তোর্তুন হেডে বিয়া গরন পরিব, এ্যান গম পোয়া আর পাইয়ুমনে? মর্জিনার মা তুই তোর মাইয়াপোয়ারে বোঝা, কথা না পুনিলে তোর মাইয়াপোয়ারে আয় আস্ত ন রাইক্কুম।

মেয়ে বলছে, আঁয় পড়ালেখা গইজ্জুম, বিয়া ন গইজ্জুম দরকার অইলে কচু গাছের ল গলাত দড়ি দি পরান দি পেলায়ুম, তারপরও বিয়া ন গইজ্জুম।

মর্জিনার মা বলে, অনে এ্যানগা গরন, মাইয়াপোয়া বড় অইয়েযেননে, এত্তর মাইয়াপোয়ার গাত আত তুলিলে মাইনষে কী কইব?  (পৃ. ১০)।

 

১০. কমরুদ্দিন আহমদ ব্যবহৃত (কমরুদ্দিন, ২০২১: ১৯২) কিছু বদবুলি:

ক. চুদানির পোয়া তরে আঁই সুযোগে পাইলে জ’রাই দিয়ম। (এর প্রত্যুত্তরে) মাগির পোয়আ তুই আঁর বালঅ আঁরিত ন পারিবি।

খ. এই শুয়রর বাইচ্চা, তরে আগে ন হই? কুত্তির বাইচ্চা এতক্কন হড়ে গেইয়ছ?

গ. বাদরর নান ফালর কিয়র লাই? এই বেড়া চামারর পোয়ার নান কা হতা হঅর?

ঘ. আলার পোয়া এতক্কন হড়ে ফোন মারাই ত গেইয়ছ?

ঙ. এই হানকি হত্তুন আইয়র?

চ. মগর পোয়া নে তুই—হতা ন উনর কা? (এর প্রত্যুত্তরে) মগর পোয়া অইলে আঁর জন্ম তো মগরমুলুকত অইত।

 

১১. মধ্যযুগের বাঙালি কবি আবদুল হাকিম থেকে শুরু করে আরও অনেকের গানে-কবিতায় চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার শব্দ প্রয়োগের প্রমাণ পাওয়া গেলেও কবি মুহম্মদ নূরুল হুদাই প্রথম চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার পূর্ণাঙ্গ বাক্য আধুনিক বাংলা কবিতায় প্রয়োগের নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন (শ্যামল, ২০২২: ১৭৯)। দইজ্জার পারের দিলদরিয়া মানুষের বৈশিষ্ট্য তুলে আনতে দক্ষিণ চট্টগ্রাম বা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কবি লেখেন:

ক. এই নগরত থাইক্কুম বাঁচি হাজার বছর। …

ফণার উয়র ফেণা ধরি দইজ্জার নাচানাচি

হেই দইজ্জার নুন-বিষ খাই আঁইও আছি বাঁচি।

দইজ্জা আঁআর রাইতর ডাকাইত, দউজ্জা দিনর ভাত

দইজ্জার লগে কবুল আঁআর জনম বরাত। (দইজ্জার মানুষ; দরিয়ানগর কাব্য)।

 

১২. দরিয়ানগর কাব্য (২০০১) রচনার পরে আর কোনো কাব্যে কবি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা প্রয়োগ না করলেও তাঁর প্রদর্শিত পথে পরবর্তী প্রজন্মের কবিগণ {দ্র: সিরাজুল হক সিরাজ, রূপচাঁদা কঙ্কাল (২০০৯) ও বোআঁড়ি (২০১১); কমরুদ্দিন আহমদ, গন্ধরাজের ঘ্রাণ (২০১৭); নিলয় রফিক, নোনা মানুষের মুখ (২০১৭)} নিষ্ঠার সাথে নিয়োজিত থেকে সাফল্য পেয়েছেন এবং এই ধারাকে বেগবান ও জনপ্রিয় করে তুলছেন। যেমন—

ক. কন কডে যাইবা আইয়ো

মহেশখালী, মাতারবাড়ি, বাতিঘর জিঞ্জিরা

ক্যঁ-কু-রু-দ, ক্যঁ-কু-রু-দ ( স্বপ্নদ্বীপ, রূপচাঁদা কঙ্কাল)।

 

সাহিত্য-নমুনা লিখনরীতি পর্যবেক্ষণ শেষে মূল আলোচনায় ফিরে যাওয়ার কালে মনে রাখা চাই—মধ্যযুগে বাংলা পুঁথি সাহিত্যে ‘করিয়া’ বানানটি বারো রকম লেখা হতো: কইরিআ, কঅইরা, কইর‌্যা, কঅইরিআ, কঅইরআ কঅইর‌্যা কইরিঅ্যা, কোঅইরা, কোইর‌্যা, কোইরিআ, কঅইএরা ও কএইর‌্যা। সেখান থেকে বিদ্যাসাগর ‘করিয়া’ লিখলেন। আমরা এখন ‘করে’ লিখছি, কখনো ‘কোরে’ উচ্চারণ করছি। এভাবে ভাষার লিপি সুস্থির হতে সময় লাগাটাও অস্বাভাবিক নয়, তবে অবশ্যই সাহিত্যিকের সুচিন্তিত প্রয়োগ এবং তাঁর প্রভাব-বিস্তারি প্রতিভা প্রয়োজন। বিজ্ঞাপন তথা প্রচারমাধ্যমও ভাষার বানানকে ছবির আকারে মানুষের মনে স্থির করে দেয় বা মান্যতা এনে দেয়। এ প্রসঙ্গে আসে— ‘মেজ্জান হাইলে আইয়ুন’ লেখা হোটেলের সাইনবোর্ড। ফারসি মীয্বান এবং মিহ্মান শব্দদুটি থেকে জাত মেজবান। চট্টগ্রামী ভাষা ও সংস্কৃতিতে ‘মেজ্জান’ প্রচলিত শব্দ। কিন্তু ‘খাইলে’ না লিখে ‘হাইলে’ শব্দটি বিভ্রান্তিকর যেমন— ‘৭খ’ ও ‘৭গ’। তবে উপর্যুক্ত নমুনা ‘১ঘ’, ‘২ঘ’, ‘৬ঘ’, ‘৮ক’ এবং ‘১১ক’ সবগুলোতেই ‘খা’ ধাতুজাত ক্রিয়াপদের উচ্চারণ অপরিবর্তিত আছে। এমনকি  আবদুল করিম (আবদুল, ২০১৭:১১৩), আবদুররশিদ সিদ্দিকী (আবদুর, ১৯৩৫:৪৮-৪৯), মুহম্মদ এনামুল হক (এনামুল, ১৯৩৫:৬) সকলেই খাই/ খাইতে লিখেছেন। কেবল মনিরুজ্জামান ধ্বনি পরিবর্তনে ‘খ>হ’ হওয়া না দেখালেও প্রযোজক ক্রিয়ার আলোচনায় লিখেছেন: ‘হা(<খা)—> হাবায় ‘খাওয়ায়’। মা/ মাঁআয় পোয়ারে/ পুওয়ারে দুদ হাবায়/ খাবায় (মনিরুজ্জামান, ২০১৩:১০৯)। মনে হয় আমাদের পণ্ডিতদের বিকল্প চিহ্ন দিয়ে লেখাও এই বিকল্প বানানের জন্য কম দায়ী নয়। এই বিকল্প বানান দেওয়া হয়েছে চট্টগ্রামে দুইরকম উচ্চারণই আছে বোঝাতে। অথচ ব্যবহারকারীরা যদি বাংলা থেকে দূরবর্তী বানান গ্রহণ করেন তাহলে প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক: আমরা চট্টগ্রামের কোন অঞ্চলের উচ্চারণকে মান্যতা দেব? ‘আসেন/ আসুন’ বাংলা শব্দের চট্টগ্রামী রূপ ‘আইয়ুন’ চলতেই পারে।

বাংলা আত্মবাচক সর্বনাম ‘আমি’ চাটগাঁ ভাষায় ‘আঁই’ রূপে লিখেছেন প্রায় সকলে। উল্লেখিত ‘১ক’, ‘৫ক’, ‘৬ক’, ‘৮ক’, ‘১০ক’ ও ‘১১ক’ উদাহরণে নিম্নরেখ দিয়ে দেখানো হয়েছে। ব্যতিক্রম উদাহরণ : ‘৭খ’ তে আমার অর্থে ‘আত্তু’ এবং ‘৯ক’ তে আমি অর্থে লেখা হয়েছে ‘আঁয়’; এটি মূদ্রণপ্রমাদও হতে পারে। তবে আবদুল করিম লিখেছেন: ‘আঁঞি’ শব্দের পরিবর্তে সময় সময় ‘মুই’ শব্দেরও ব্যবহার হয় (আবদুল, ২০১৭:১০৩)। অবশ্য ‘আঁই’ এর বিকল্প প্রয়োগ বড় চোখে পড়ে না বর্তমানে। প্রমিত বাংলা উপভাষার ‘কে’ চাটগাঁ ভাষায় ‘কন’ হয়। এর প্রমাণ উদাহরণ ‘১ক’, ‘২ঘ’, ‘৪গ’ ও ‘১২ক’ এর নিম্নরেখ শব্দ। গানের কথায় অনেকে যদিও ‘হন’ লিখেন। ‘কথা’ শব্দের প্রয়োগ পাই ‘৪ক’ ও ‘৫ক’ উদাহরণে, উদাহরণ ‘১ছ’তে কথা হয়েছে ‘খতা’, আর ‘৭খ’, ‘৭গ’ ও ‘১০চ’তে কথা হয়ে গেছে ‘হতা’। এ প্রসঙ্গে ভাষাবিজ্ঞানী লিখেছেন, ‘সূত্র ১৫: হ-কারী ভবন— ক —> হ হাম (কাম); হানফুল (কানফুল); হোত্তা ( কোর্ত্তা); হারবার (কারবার) (মনিরুজ্জামান, ২০১৩:৬৮)। আসলে হ-কারী ভবন সকল শব্দে হয় না; এখানে মনিরুজ্জামানের উদাহরণেও ‘হন/ হথা’ নেই। সাধারণত ক/খ এর সাথে নিম্নস্বরধ্বনি (অ ও আ) থাকলে সিলেট-চট্টগ্রামে অঘোষ কণ্ঠ্য স্পর্শ ধ্বনিদ্বয় (ক খ) একটু উষ্মতা প্রাপ্ত হয় তবে পুরোপুরি মহাপ্রাণ ‘হ’ হয় না। এনিয়মে ‘কাপ্তাই’ এর উচ্চারণ ‘হাপ্তাই’ এর মতো শোনালেও ‘কাসেম স্যার’ কে ‘হাসেম স্যার’ লিখলে ‘হাসেম স্যার’কে কী লিখব ভাবলেই সমস্যাটা অনুভব করা যাবে। সুতরাং আমরা মনে করি ‘কথা’ কে ‘হতা’ না লিখে ‘কথা’ অথবা কএর সাথে হস ( ্) চিহ্ন যুক্ত করে ‘ক্থা’ লেখা যেতে পারে। ‘খাইলে’ কে লেখা যেতে পারে খ্াইলে কিংবা খাইলে লিখলেও উচ্চারণের সময় খ এর সাথে উষ্মতা যুক্তকরে নিলেই হলো; বাংলায় যেমনটা ‘কবি/ কবিতা’ লিখি কিন্তু উচ্চারণ করি ‘কোবি/ কোবিতা’। বলাবাহুল্য পৃথিবীর কোনো ভাষাই উচ্চারণানুগ নয়। বাংলায় সংস্কৃতানুযায়ী ‘পদ্মানদী’ লিখি কিন্তু বলি ‘পদ্দাঁনোদি’। বাংলাদেশের আদিবাসীদের ভাষা ব্যতীত অন্য যেকোনো আঞ্চলিক ভাষার চেয়ে সিলেট-নোয়াখালি-চট্টগ্রাম—এই তিনটি উপভাষায় অনার্য (অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, সেমেটিক ও ভোটবর্মী) প্রভাব সর্বাধিক। এসব দিকে লক্ষ্য রেখে এদের একত্রে ‘প্রান্তবঙ্গীয়’ নাম প্রস্তাব করা হয় (শ্যামল, ২০১৮: ৮৯)। এই প্রান্তবঙ্গীয় ভাষার লিখিত রূপের ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা থেকে প্রান্তে পৌঁছানোর একটি প্রবণতা সাধারণ প্রয়োগকারীদের মধ্যে প্রবল। এর কারণ জার্মান-ইংরেজ-ফরাসিরা ল্যাটিনের স্মৃতির প্রতি যতটা শ্রদ্ধাশীল বাঙালিরা বাংলার প্রতি অনেকেই ততটা নন। বাংলাভাষীর রাষ্ট্র বাংলাদেশ। বাংলার বঙ্গলিপি দিয়ে লিখলে চট্টগ্রামের ভাষা ব্যবহার বা চর্চা বাঙালির নিকট যেমন সহজ হবে, নতুন বর্ণ শেখার সমস্যায় পড়তে হবে না; তেমনি বাংলা ভাষা ও চট্টগ্রামের ভাষা উভয় ভাষাই পরস্পরের আদান-প্রদানের মধ্যদিয়ে উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ হবার সম্ভাবনা বাড়বে।

 

সহায়কপঞ্জি

আজাদ বুলবুল (২০১৮)। অগ্নিকোণ। আমরা ক’জন, ঢাকা।

আবদুররসিদ ছিদ্দিকী (১৯৩৫)। চট্টগ্রামী ভাষাতত্ত্ব। চকরিয়া, চট্টগ্রাম।

আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ (২০১৭)। ইসলামাবাদ। বাতিঘর, চট্টগ্রাম।

আবুল কাসেম (২০২০)। ‘চট্টগ্রামী বাংলার লিখনরীতি’, সাগরলতা (সম্পা.)। টেকনাফ সরকারি কলেজ রজতজয়ন্তী স্মারক।

আবুল ফজল (২০০৮)। সাহিত্য সমগ্র। সময় প্রকাশন, ঢাকা।

আলাউদ্দিন আল আজাদ (১৯৬২)। কর্ণফুলী। মুক্তধারা, ঢাকা।

আহমদ ছফা (২০১৫)। সূর্য তুমি সাথী। হাওলাদার প্রকাশনী, ঢাকা।

কমরুদ্দিন আহমদ (২০২১)। নজরুল: অসাম্প্রদায়িকতার কবি ও অন্যান্য, বলাকা প্রকাশন, চট্টগ্রাম।

কাফি কামাল (২০১১)। মেইট্টাল, অগ্রদূত, ঢাকা।

মনওয়ার সাগর (২০১৮)। ষোলশহর জংশন ও শাটল ট্রেন। বেহুলাবাংলা, ঢাকা।

মনসুর মুসা (২০১২)। ‘কোন লিপিতে রাখা হবে চট্টগ্রামের কথাবার্তা’, চাটগাঁ ভাষার রূপ-পরিচয় (সম্পাদিত), চাটগাঁ ভাষা পরিষদ, চট্টগ্রাম।

মনিরুজ্জামান (২০১৩)। চট্টগ্রামের উপভাষা । চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।

মুহম্মদ এনামুল হক (১৯৩৫)। চট্টগ্রামী বাঙ্গালার রহস্য-ভেদ। কোহিনূর লাইব্রেরি, চট্টগ্রাম।

মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ (১৯৮৫)। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ স্মারকগ্রন্থ। বাংলা একাডেমি, ঢাকা।

রবীন্দ্র কুমার দত্ত (২০১২)। নোয়াখালি ও চট্টগ্রামের উপভাষা: একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ। প্রগ্রেসিভ পাবলিসার্স, কলকাতা।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৯৮)। ‘ভাষাবিচ্ছেদ’, শব্দতত্ত্ব। বিশ্বভারতী, কলকাতা।

শ্যামল কান্তি দত্ত (২০১৮)। সিলেটের উপভাষা: ব্যাকরণ ও অভিধান। আগামী প্রকাশনী, ঢাকা।

শ্যামল কান্তি দত্ত (২০২২)। ‘স্বতন্ত্র কাব্যভাষার কবি’, পাতাদের সংসার (মুহম্মদ নূরুল হুদা সংখ্যা)। ৯ম বর্ষ ৩২তম সংখ্যা, ঢাকা।

সেলিনা হোসেন (২০০৩)। উপন্যাস সমগ্র ৩ । অন্যপ্রকাশ, ঢাকা।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ (২০২২)। গল্পসমগ্র (হায়াৎ মামুদ সম্পাদিত)। প্রতীক প্রকাশনা, ঢাকা।

হরিশংকর জলদাশ (২০১০)। দহনকাল। মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা।

 

ড. শ্যামল দত্ত :  ভাষাবিজ্ঞানী ও কবি

রেম্ব্রান্টের জন্মশহর লেইডেন, ইনডেক্স পোয়েট্রি বুকস এবং কেইস নুটবুমের তিনটি কবিতা

আলম খোরশেদ বছর ছয়েক আগে জার্মান সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রকের আমন্ত্রণে বিশ্বখ্যাত নাট্যোৎসব থিয়েটার ট্রেফেন এর ছাপ্পান্নতম আসরে যোগ দিতে বার্লিন গিয়েছিলাম, পৃথিবীর আরও কুড়িটি দেশের

আমরাই শেষ জেনারেশন

বৈজয়ন্ত বিশ্বাস ভিক্টর আমরাই শেষ জেনারেশন, যারা গরুর গাড়ি থেকে সুপার সনিক কনকর্ড জেট দেখেছি। পোস্টকার্ড, খাম, ইনল্যান্ড লেটার থেকে শুরু করে আজকের জিমেইল, ফেসবুক,

আন্দরকিল্লা সাহিত্যপত্রিকা এবং স্মৃতিকাতর চাটগাঁ

প্রবীর বিকাশ সরকার “আন্দরকিল্লা” ম্যাগাজিনটি ২৭ বছর ধরে প্রকাশিত হচ্ছে, আদৌ কম কথা নয়! সাহিত্য, শিল্পকলা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, সমাজবিষয়ক একটি সাময়িকী বাংলাদেশের বন্দরনগরী চট্টগ্রাম শহর