এখন সময়:দুপুর ১:৪৪- আজ: মঙ্গলবার-২৫শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-১১ই চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-বসন্তকাল

এখন সময়:দুপুর ১:৪৪- আজ: মঙ্গলবার
২৫শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-১১ই চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-বসন্তকাল

দিল্লীর সুরমাওয়ালা : মূল লেখক : শিবকুমার রায়

ভাষান্তর : আলমগীর মোহাম্মদ 

তুফান এক্সপ্রেস প্রতিদিন সকালে হাওড়া স্টেশন ছেড়ে যেতো। সিগনাল পোস্ট পার হতে না হতে এটা বাতাসের মতো চলতে শুরু করত। বর্ধমান, বারাকার, রাণীগঞ্জ ও আসানসোল – হকি খেলার জন্য স্কুল পালানো বালকের মতো একের পর এক স্টেশন   পেছনে ফেলে আসতো।  যখন গতি তুলতো তখন হুইসেলের আওয়াজের কারণে ঝকঝকাঝক আওয়াজটা ভালো মতো কানে আসতো না।

আজকের এই দিনে খুবই কম সংখ্যক যাত্রী ছিল — সর্বমোট আট- দশজন বাঙালি। তাঁরা বর্ধমানে নেমে গেলেন। হঠাৎ করে দুইজন পাগল ট্রেনে ঝাঁপ দিয়ে উঠল এবং বাংকের উপর শুয়ে বেঘোরে নাক ডাকতে লাগলো।

কৃষ্ণবীর ও হরিভক্ত সবসময় ভাবনায় থাকতো কখন বিশ্ববিদ্যালয় তাদের ঘাড় ধরে বের ক’রে দেবে অথবা নিজেরাই বেরিয়ে পড়বে। এবার মনে হচ্ছে তারা নিজেরাই বেরিয়ে পড়েছিল। তারা মায়ের কানের দুল চুরি করে ও বাবার টাকার বাক্স খালি করে বেরিয়ে পড়লো লালদুর্গ ও আগ্রার তাজমহল দেখতে। যতকিছুই ঘটুক না কেন তারা নিজেদেরকে ইতিহাসের ছাত্র দাবি করতে ভালোবাসতো। ‘জিঙ্গে দাও’ খেলে যে কয় পয়সা পেয়েছিল  সেগুলো দিয়ে কয়েক দফা কলকাতা ঘুরে এসেছিল কৃষ্ণবীর।

সে নিজেকে এজন্য  খুব চালাক মনে করতো। কিন্তু হরিভক্তের  এটাই প্রথম ঘরের বাইরে যাওয়া,  তাও আবার পালিয়ে।

 

 

প্রথম বারের মতো সে বড়বড় রেলগাড়ী ও বিমানের দেখা পেল।

কৃষ্ণবীর ও হরিভক্ত  জানালা দিয়ে বাইরে অপলক তাকিয়ে রইল। কৃষ্ণবীর একজন অহংকারী যুবক যে তার অভিজ্ঞতা নিয়ে গর্বিত।

“বাইরে দেখ,” সে চিৎকার করে বললো “ধানের দিকে! দেখ এদিকে, এগুলো পাটক্ষেত। রোদ থেকে বাঁচাতে তারা ফ্যাক্টরির বাগানের চারপাশে বেড়া দিয়ে রেখেছে। কিন্তু তারা এটা কেন করল সে সম্পর্কে তোমার কোন ধারণা আছে? ঐটা পুরোটা পাটক্ষেত।  পাটক্ষেত এভাবেই বেড়া দিয়ে রাখতে হয়।”

অনভিজ্ঞ হরিভক্তের কাছে সবকিছুই নতুন ও বিস্ময়কর ঠেকল।

 

বাটা স্টেশনে ট্রেন কিছুক্ষণের জন্য থামল। তাদের কম্পার্টমেন্টে একজন ভদ্রলোক ঢুকল। তার দু’হাতে টিনের বাক্স ধরা। লোকটি তাদের পেছনে ক’রে বসল। দুই ভাইয়ের কেউই লোকটার দিকে ফিরেও তাকালো না বা ফিরে তাকানোর গরজও অনুভব করলো না। কিন্তু, ট্রেন স্টেশন  ফেলে আসতে না আসতে ভদ্রলোক তাদের দুজনের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করলেন এবং বারবার হাক ডাকতে লাগলেন “তানসেল পিল,তানসেন পিল” বলে।

 

 

“তানসেন পিল বানানো হয় পাঞ্জাবে ” তিনি বলতে লাগলেন। টিনের বাক্সো থেকে দুটো ছোট বোতল বের করে তিনি বললেন, ” একটা মুখে দিয়ে দেখুন। আপনার ভালো লাগবে এবং শরীরের খুব উপকার হবে। বড় বোতলটার দাম মাত্র আট আনা, আর ছোটটার দাম চার আনা। নেন নেন,বাবুজি। খেয়ে দেখেন।”

কৃষ্ণবীর দুটো পিল  মুখে পুরে নিল এবং হরিভক্তের জন্য দুটো চেয়ে নিল লোকটার কাছ থেকে।

 

আরেকটা বোতল বের করে লোকটা বলতে লাগলেন,

“টাইগার বাম, বেঙ্গল কেমিক্যাল টাইগার বাম। তোমাদের যদি মাথাব্যথা  বা কাশি থাকে তাইলে এটা লাগাবে নিমিষেই ব্যথা উপশম হবে। ব্রণ,ফোড়া — এসবের জন্যেও ভালো।  সাপ অথবা বিছার কামড়েও। আহত স্থানে অল্প একটুকু বাম লাগিয়ে দাও, মুহূর্তেই ব্যথা উধাও! দাম মাত্র আট আনা। প্রতিটি ঘরে একটা ক’রে থাকা উচিত। ”

 

বোতলের ঢাকনা খুলে হাতে বাম নিয়ে তিনি যাত্রীদের কপালে ও কপালের দুই দিকের রগে লাগানো শুরু করলেন। কৃষ্ণবীর মনে করল যেকোন কিছুর বিনিময়ে এই সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না। সে তার মাথা বাড়িয়ে দিল লোকটার দিকে।

 

“হরিভক্ত, ” তুইও একটু মাখিয়ে নে। ওষুধটা খুবই শীতল।”  হরিভক্ত অসম্মতি জানাল।

 

যাত্রাপথে অনেক হকার ফ্লাশলাইট, টুথ পাউডার, চকোলেট, এবং আরো টুকটাক অনেক কিছু বিক্রি করতে ট্রেনে উঠল এবং বিক্রি শেষে নেমে পড়ল। ট্রেন দ্রুতগতিতে চলতে লাগলো।

 

“হরিভক্ত শোন,” কৃষ্ণবীর শুরু করল, ” বড় ট্রেনে আমাদেরকে অবশ্যই সতর্ক হতে হবে। এটা আমাদের ঘরে ফেরার ডিইএচ আর নয়। তুই পুতুলের মতো জানালা দিয়ে সবসময় হা করে আছিস কেন,  আমাদের তল্পিতল্পার দিকেও নজর দিতে হবে বিশেষ করে যখন বেশি মানুষ ওঠানামা করে। এখানে হাজার হাজার মানুষ  — এবং ওদের কেউ কিছু একটা নিয়ে গা ঢাকা দিতে পারে। আমাদেরকে সাবধানে থাকতে হবে।”

 

সে উপরের বাংকের দিকে তাকাতে বলল।

 

“ওখানে লোহার চেইনটা দেখছিস?” সে বলল, “এটা কি মনে হয় তোর? কোন বিপদ বা দুর্ঘটনা ঘটলে এটা ধরে টান দিলে ট্রেন থামবে। কিন্তু তুই যদি অকারণে চেইনে টান দিস, তাইলে তোকে পঞ্চাশ রুপি জরিমানা গুনতে হবে।  সুতরাং উপরের ঘুমানোর সময় খেয়াল রাখবি যাতে ওটাতে তোর হাত না লাগে।”

 

ট্রেন এগোতে লাগলো নিজস্ব ধ্যানে।

 

“এভাবে বাইরে মাথা বের করে রাখবি না। হঠাৎ  জানালা ধক ক’রে পড়লে তোর মাথায় ব্যথা পাবি। অনেক সময় হয় কি  দরোজা খোলা ট্রেন  অন্য দিক থেকে চলে আসলে মারাত্মক  দুর্ঘটনা ঘটে যায়।

 

বেচারা হরিভক্ত এখন আর বাইরেও তাকাতে পারছে না।

 

“আমি ঘুমাব এখন,” সে ক্লান্ত স্বরে এটা বলে উপরের বাংকে ঘুমুতে গেল।”

“ঠিক আছে, ঘুমা,” কৃষ্ণবীর বলল, তবে আমাদের পালা ক’রে ঘুমুতে হবে। আমরা দুইজন একসাথে  ঘুমিয়ে পড়লে আমাদের অগোচরে কেউ জিনিসপত্র নিয়ে পালাতে পারে।”

 

হরিভক্ত এক পলকও ঘুমাতে পারল না। রাতভর নানা ধরনের মানুষ ওঠানামা করছে। সে যাহোক, কৃষ্ণবীর আরামসে ঘুমিয়েছিল সারারাত।

 

এখন দিল্লি মাত্র দুই তিন ঘন্টার পথ বাকি। লাল দুর্গ ও কুতুবমিনারের চিন্তা বারেবারে তাদের নাড়া দিচ্ছিল। ট্রেন তুনদালা জংশনে এসে থামল।

 

“দেখ,” রেলওয়ের সময়সূচির দিকে তাকিয়ে দেখে কৃষ্ণবীর বলল, ” মাত্র দুই কি তিনটা স্টেশন বাকি। ভেবে দেখ আর মাত্র দুই ঘন্টা পর আমরা বীরলা মন্দির অথবা কনাটে অথবা ইন্ডিয়া গেইটে।”

 

দু’জন মুসলিম ছেলে ট্রেনে উঠল, তাদের পরনে নোংরা কাপড়চোপড়।  তারা হরিভক্ত ও কৃষ্ণবীরের দিকে তাকিয়ে কি কি যেন মুখের ভিতর ক’রে বলল এবং তাদের পেছনে গিয়ে বসল। তাদের দিকে ভালো করে থাকিয়ে কৃষ্ণবীর হরিভক্তকে বলল, ” এদের দিকে নজর রাখতে হহবে। গুন্ডার মতো লাগছে এদের….”

 

ট্রেন থামল।  হাতে লেদারসুট নিয়ে তৃতীয় একজন ব্যক্তি প্রবেশ করলেন তাদের কম্পার্টমেন্টে। সে ব্যাগ থেকে একটা রীড আর দুটো বোতল বের করে তাদের দিকে যাদুকরের ন্যায় ইশারা করল।

 

“বন্ধুরা,” সে বলতে শুরু করলো, “মনোযোগ দিয়ে শুনুন।  আপনার চোখ দিয়ে যদি পানি পড়ে, যদি চোখ রক্তলাল হয় এবং ভালো ক’রে না দেখেন,  তাইলে বোতল থেকে হাল্কা সুরমা নিয়ে  আপনার সুন্দর চোখে মেখে নিন। এটা চোখের সৌন্দর্য বাড়াবে ও সুস্থ ক’রে তুলবে।”

 

এই বলে সে মুসলমান ছেলে দুটোর চোখে অল্প সুরমা লাগিয়ে দিল।

 

” সে আবারো বললো,  ” বন্ধুরা চোখে একটু সুরমা লাগিয়ে দেখুন।  রাস্তায় হাঁটার সময় চোখে ধুলা পড়লে, ট্রেনে যাত্রার সময় ধোঁয়া ও বালিতে যদি আপনার চোখ জ্বলাতন করে এই সুরমা  আপনার চোখকে পরিস্কার ও উজ্জ্বল  করবে। জনাব, আপনাদের কারো লাগলে হাত তুলুন।”

 

লেকচারটা অনেক লম্বা ছিল এমনকি তাঁদের স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও এরকম লম্বা লেকচার কখনো দেন নি। কৃষ্ণবীরের পক্ষে বিশ্বাস না করার কোন যুক্তি ছিল না আর। সবচেয়ে বড় কথা হলো সে নিজেকে বোকা ভাবে না।  এটা ঠিক যে তাকে এক ক্লাসে তিন বছর থাকতে হয়েছিল, সেটা অবশ্যই পড়ালেখায় অমনোযোগীতার কারণে।

” দয়া করে আমাকে একটু দিন,” সে বললো।

 

” আপনার সুন্দর চোখে সুরমা দিন,” কৃষ্ণবীরের চোখে সুরমা লাগাতে লাগাতে লোকটি বলে যাচ্ছিল।

হরিভক্ত বেকুবের মতো চেয়ে রইল।

রীডটি হরিভক্তের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বিক্রেতা ভদ্রলোক  বললো, “তুমিও তোমার সুন্দর চোখে সুরমা লাগাও।”

 

হরিভক্ত না করতে পারলো না তাই সে চুপ ক’রে রইল। বিক্রেতা তার দুই চোখে সুরমা লাগিয়ে দিল। আচম্বিত দুইজনই মাথা ঘুরে  পেছন দিকে পড়ে গেল। তারা চোখে দশ হাজার তারা ও দশটি চাঁদ একসাথে দেখতে পেল। মনে হচ্ছিল যেন তাদের দুই চোখে মরিচের গুড়া ছিঁটিয়ে দিয়েছিল কেউ।  নাকমুখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। দুজনই পায়ের উপর ভর দিয়ে মাথা নিচু ক’রে বসে পড়ল।

পনের মিনিট পর আস্তে আস্তে তাদের চোখের জ্বালা কমতে লাগলো। মাথা তুলে চারিদিকে তাকিয়ে দেখল তারা। তুফান এক্সপ্রেস দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে কিন্তু কি এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটে গেল তাদের সাথে।

সুরমাওয়ালা ও মুসলমান ছেলে দুটো কেটে পড়েছিল আগেই। তাদের ব্যাগ-বিছানাপত্র সবই নিয়ে গেল। জাদুমন্ত্রের ন্যায় সবকিছু চোখের পলকে ঘটে গেল এমনকি গায়ের কোট দুটোও হারাতে হলো তাদেরকে।

চোখ পরিস্কার হওয়ার সাথে সাথে তারা চারদিকে তাকাল। কৃষ্ণবীর মাথায় হাত দিয়ে ভাবতে লাগলো কলকাতার এত এত বদমাইশ তাকে ফাঁকি দিতে পারেনি কখনো আর দিল্লি এসে সামান্য সুরমাওয়ালা তার চোখে ধুলা দিল!

 

আলমগীর মোহাম্মদ: সহকারী অধ্যাপক ও প্রভোস্ট, বাংলাদেশ আর্মি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, কুমিল্লা।

 

[ শিবকুমার রায় একজন নেপালী ভাষার লেখক এবং ভারতের দার্জিলিং বংশোদ্ভূত একজন রাজনীতিক। তাঁর  ছোটগল্পের জন্য ১৯৭৮ সালে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। তিনি পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র গোরখা মন্ত্রী। ]

লাহোর প্রস্তাব বিকৃতির কারণে একাত্তর অনিবার্য হয়ে ওঠে

হোসাইন আনোয়ার ২৩ মার্চ ১৯৪০। পাকিস্তানিরা ভুলে গেছে ২৩ মার্চের ইতিহাস। একটি ভুল ইতিহাসের উপর ভিত্তি করেই ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবস পালিত হয় সমগ্র পাকিস্তানে।

ইফতার পার্টি নয়, সেদিন যেন তারার হাট বসেছিল পিটস্টপে

রুহু রুহেল সমাজ ও সংস্কৃতির বড় পরিচয় সম্প্রীতির অটুট বন্ধনে সামনের পথে অবিরাম এগিয়ে চলা। সাম্য সুন্দর স্বদেশ গঠনের জন্য প্রয়োজন বিবিধ মত ও পথকে

নভোচারী সুনিতা মহাকাশে ফুল ফোটায় পৃথিবীতে নারীর পায়ে শেকল পরায় কে?

প্রদীপ খাস্তগীর চমৎকার একটি সফল মহাকাশ সফর শেষ হয়েছে গত ১৮ মার্চ মঙ্গলবার দিবাগত রাত ৩টা ৫৭ মিনিটে। গত বছরের ৬ জুন মাত্র ৮ দিনের

দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ: দর্শনের বিজ্ঞান

রাজেশ কান্তি দাশ দর্শনের ক্ষেত্রে বস্তু ও ভাবের দ্বন্দ্ব অতি প্রাচীন। খ্রিষ্টপূর্ব সময়ের। বস্তুবাদী দার্শনিকেরা মনে করেন বস্তু থেকে জাগতিক সব কিছুর উৎপত্তি। গ্রীক দার্শনিক

মানুষ ও মঙ্গল মানব

সরকার হুমায়ুন দুজন মহাকাশচারী- একজন পুরুষ এবং একজন মহিলা মঙ্গল গ্রহ অভিযানে গেলেন। তারা নিরাপদে মঙ্গল গ্রহে অবতরণ করেন। সেখানে তাদেরকে অতিথি হিসেবে মঙ্গলবাসীরা সাদরে