রূপক বরন বড়ুয়া
আধুনিক সময়ের এক আলোচিত নাম কবি মালেক মুস্তাকিম। অসাধারণ এক সাবলীল ধারার তরুণ কবি এই মালেক মুস্তাকিম। তিনি জন্মেছেন সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলার গান্ধাইল গ্রামে এখানেই তার বেড়ে ওঠা। তুখোড় ও মেধাবী কবি উচ্চমাধ্যমিক পড়েছেন ঢাকা কলেজে এবং ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে এ তরুণ কবি লেখালেখির সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন। এ সময়ে সম্পাদনা করেছেন সাহিত্য পত্রিকা ‘ স্রোত’ ও ‘অন্তদীপন’। এরপর আর কোন থামাথামি নেই। ভিন্ন স্বরের এই কবি পেশায় সরকারি চাকুরিজীবী হয়ে ও এর মধ্যে বের করে ফেলেছেন ১) ভুলের ভূগোল ২)বিষন্নতাবিরোধী চুম্বনগুলো, ৩) তোমার সাথে হাঁটে আমার ছায়া ৪) ঘুণপোকা মন, ৫)একান্ত পাপগুচ্ছ, ৬) আমি হাঁটতে গেলে পথ জড়িয়ে যায় পায়ে, ৭) সেলাই করা হাওয়ার গান ২০২৪ এর মতো সাত সাতটি কাব্যগ্রন্থ।
কবি মালেক মুস্তাকিম তার কবিতায় শব্দচয়ন আর তার প্রয়োগে দেখিয়েছেন ব্যতীক্রমতা, স্বতন্ত্রতা এনেছেন জীবনের বহুবিধ রূপ প্রত্যক্ষ করে,আলো আঁধার, সত্য- মিথ্যার লুকোচুরি চারপাশের জীবনের চিত্র বিচিত্র দৌড়, মৃত্যু ও জীবনের মাঝখানের ঝাঁজালো উপকরণগুলো যে অভিজ্ঞতায় বেড়ে ওঠেছে সেগুলোকে রূপ দিয়েছেন অনন্য সাহজিকে। বলার ধরণ স্পষ্ট ও সাবলীল। কবি যেমনভাবে জীবনকে দেখেছেন যে অনুষঙ্গ খুঁজে পেয়েছেন তাতে প্রতিভাত হয়েছে বিভ্রম ও দ্বন্দ্ব। তাই কবিতায় উঠে এসেছে শূন্যবাদ, পরবাস্তবতাবাদ,আধ্যাত্মবাদ এরপরও কবিতা হয়ে উঠেছে চরম
উৎকর্ষে এক প্রগাঢ় বাস্তববাদিতা। কবি তাঁর কবিতায় এনেছেন ফুল পাতা, পাখি, বৃক্ষ, নদী, শস্যক্ষেত আর অরণ্য। নিদ্রাহীন বিষয়টাকে টানলেন শূন্যতায়, হাওয়ায় কলতানে।
কবির নিজের ভাষায় নিজেকে যে পরিচয় দিলেন তাতে বুঝা যায় কবির একান্ত স্বরূপ চোখের সামনে এক বিভ্রমের নাম মালেক মুস্তাকিম, কেন তাকে ভাবছো প্রেমিক? আমাকে প্রেমিক ভেবে যতবার খুলে দেবে ডানা- দেহের ভাঁজ ভেঙে নেমে যাবে বৈকুন্ঠের সিঁড়ি – এ শহরে ছায়াদের ঘুমহীন করোটিতে ঝুলে থাকে প্রণয়মেঘ।’
আজ এ কবির তিনটে কাব্যগ্রন্থ ১)একান্ত পাপগুচ্ছ, ২) আমি হাঁটতে গেলে পথ জড়িয়ে যায় পায়ে ও ৩) সেলাই করা হাওয়ার গান আলোচনা করার জন্য নিয়ে এলাম।
১) একান্ত পাপগুচ্ছ :
কবির কাব্যগ্রন্থ ‘একান্ত পাপগুচ্ছ ‘ অসাধারণ এক কাব্যগ্রন্থ। নিজেকে যেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করলেন বৌধিক চিন্তন ও মননে। জীবনবোধের দারুণ এক বাকচিত্র আঁকলেন শব্দের অনুপম সজ্জায় আর মাধুকরীতে। কবির বয়ান স্বতঃস্ফূর্ত, নির্মেদ এক চঞ্চল সাহজিকতা দীপ্যমান হয়ে ওঠে অনুপ প্রতীক আর উপমার অনির্বচনীয় প্রয়োগ ধারায়। আধুনিকতায় ছন্দের বাহার আহার করেছে নিসর্গের চারপাশ। প্রকৃতিপ্রেমী কবি কবিতার বিষয়বস্তুকে গ্রহণ করেছেন প্রকৃতির গহনে ঢুকে, চাক্ষুষ যা অবলোকন করেছেন তাই তুলে এনে সেঁটে দিয়েছেন কবিতার ক্যানভাসে শব্দের বর্ণাঢ্য
রং তুলিতে। কবিতা তাই প্রজাপতি হয়ে রং ছুড়েছে সুকুমার চিত্তে, অলংকারের তেজে বৈষয়িক হয়ে উঠেছে সমস্ত অনুভব কাব্যের পাতায় পাতায়। এক কবিতা টেনে নিয়ে গেছে আরেক কবিতায়। কাব্যগ্রন্থের ৫২ টি কবিতা একেক ধরনের অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করেছে, কবির মনের কথাকে করেছে প্রকাশ। কাব্যগ্রন্থে রয়েছে আক্ষেপ, পরবাস্তবতাবাদ, মানবিকতার চরম উৎকর্ষ।
‘বৃষ্টিরেখা’ কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা। অসাধারণ বৌধিক চেতনের এক স্বচ্ছ দর্পণ। বৃষ্টির সীমারেখা খুঁজতে গিয়ে কবি হারিয়েছেন আপন দৃষ্টিরেখা, আপন সত্তাকে।বললেন ; “আলমারিতে গুছিয়ে রেখেছি নদী, তার ঘুম চুরি করে নিদ্রার ভেতর বয়ে চলেছে প্রিয়তম সংসার- ঝাউপাতার প্রলাপ ”
তারপর কি সুন্দর ঢুকে পড়লেন পরবাস্তবতার জগতে, কত সহজে উচ্চারণ করলেন ;
‘আমাকে খুঁজতে এসে না পেয়ে ফিরে গেছি আমি নিজেই।’
পুনঃজন্ম কবিতায় রয়েছে পুনরায় ফিরে আসার একান্ত ইচ্ছে। মৃত্যুর পর ফিরে আসার সুন্দর ধারণাকে কাব্যময় করতে তিনি লিখলেন ;
‘পুনজন্ম হলে একবার প্রেমিক হবো-
হাওয়া বদলে গেলে যেমন জোছনায় চোখ রেখে ঘুমঘোরে জেগে ওঠে কুমারী নদী, মৃতের শহরে দেবদারু গাছ হয়ে ওঠে প্রিয়তম পুরুষ। ‘
অসাধারণ এক শব্দচিত্র শব্দময় হলো হাওয়া বদলে কুমারী নদীর জাগরণ মৃতের শহরে দেবদারু গাছের প্রিয়তম পুরুষ হওয়ার যে উপমা আর প্রতিকী সঞ্চালন কবিতায় পুনঃজন্মকে বিন্যাস করেছে।
কাব্যগ্রন্থের ‘ নক্ষত্রের শোকসভায় ‘ কবিতায় নক্ষত্রের মৃত্যুকে উপলক্ষ করে কবিকে বলতে দেখা যায় শোকসভার কথা। জলের ভিন্ন অর্থ প্রকাশের অনুুপ ধারা ;
‘ জল থেকে উড়ে যায় অশ্রু
কিছুটা সমুদ্রে
কিছুটা চোখে। ‘
এই দু- জায়গায় জলের লবনাক্ততা একই। শোকের আবহ যেন প্রতিরাতে মিশে যায় সমুদ্র জলে। কি গভীর কান্না মৃত্যুতে মৃত্যুতে।
জীবনবোধের প্রাত্যহিক কথাগুলো সজ্জিত হয়েছে কবিতা ‘ জীবন গিলে খেয়েছে পঞ্জিকার পাতা ‘।এখানে কবি দেখেছেন জীবন যেন এক উড়ন্ত পাখি যে পাখির হৃদয়ে নদী, সে নদীর চোখে বৃক্ষের পতন,অরণ্য লোকালয়, ঘরবাড়ি স্বদেশ সব যেন এক নৈয়মিক রেখায় লীন হয়ে যাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে।কবি তাই বিস্ময়ে বলে উঠলেন ‘ক্যালে-ারের ব্লাকহোলে বুঁদ হয়ে পড়ে আছে মাতাল জীবন ‘ জন্মান্তরবাদী কবি লিখলেন তার কবিতা ‘ জন্মান্তরের ট্রেন’। কত সুন্দরভাবে আপ্ত করলেন ‘পাতার সম্মুখে জলের নাভি– গ্রোতের আঙুল দুচোখে বুদবুদ মেখে বুকে ভর দিয়ে হেঁটে যায় কাচের বয়াম জন্মান্তরের ট্রেন ঘুমের স্যা-েল!’
‘আমাকে পাবেনা কোথাও ‘ কবিতায় কবিকে বোঝা যায় কবি একদিকে অদৃষ্টবাদী অন্যদিকে হতাশাবাদী । জীবনকে খুঁজতে গিয়ে কবি দেখেছেন শেষমেষ জীবনটা যেন মৃত্যুর কোলে শুয়ে আছে। তাই জীবনের অন্তিম সময়ের কথা ভাবতে গিয়ে অস্ফুট স্বরে বললেন ‘ আমাকে পাবে না একান্ত পাপে, প্রার্থনার গুঞ্জনে,নিজস্ব রাতে পায়ের তলায় লুকিয়ে রেখেছো মহাকাল- অথচ একটি সেকে- পেরুতে পেরুতে তুমি জেনে যাবে – সময় কেবলি বুকের বাঁপাশে ভেঙ্গে পড়া বেইলি ব্রিজ, অথই আঁধার, ধূপছায়া বৃষ্টি। ‘
‘পথ’ কবিতায় কবিকে বলতে দেখা যায় ;
‘পা বাড়ালেই হয় না পথ
হাত বাড়ালেই শপথ
পায়ের জন্মের বহু আগেই আমি হেঁটে এসেছি পুরো পথ’
পুনঃজন্ম বা জন্মান্তরবাদের একটা ছায়া কবিতায়, এটা তার চিন্তা চেতনা ও মননে লালন করে এসেছেন বারবার।
‘বেদনায় গুম হয়ে গেছে মসলিন রাত ‘ কবিতায়
অপূর্ব প্রেমের ছবি উদ্ভাসিত হয়েছে এক মায়াবী
টানের। জাগতিক এ টানের প্রতি অনুরক্ত হয়ে
কবি বললেন ;
‘আটকা পড়ে গেছি শাহানায়,স্মৃতির কফিনে।
চোখ বন্ধ করে দেখছি
ছাদহীন স্নানঘরে শাহানা গোসল করছে
জল ঢালছে কিন্তু তার শরীর ভিজছে না
আমি ভিজে যাচ্ছি, কিন্তু জল খুঁজে পাচ্ছি না।’
করোনার দিনে ‘লকডাউনের দিনরাত্রি’ কবিতার শেষলাইন মন ছুঁয়ে যায়। সত্যি বলতে কি লকডাউনের সময় প্রিয়জনের মৃত্যুতে মুখ লুকাতে হয়েছে একান্ত স্বেচ্ছায়। মানবতা হারিয়ে গিয়েছিলো তখন ;
‘এই দুর্দিনে কাকে বলি- যাও কাকে বলি – আসো’
‘এই করোনার দিনে ‘ কবিতায় মানবতার কথা হয়েছে উচ্চারিত;
‘ এই করোনার দিনে বুকের ভেতর গুছিয়ে রাখি পথ এই করোনার দিনে নবায়ন হোক- সেই পুরানো শপথ।’
সর্বশেষ কবিকে দেখা যায় পরিপূর্ণভাবে আধ্যাত্মবাদী হতে। কবির দৃষ্টিতে জীবনটা পরিচালিত হয় আমাদের সৃষ্ট পাপ পুণ্যে।মানুষ তার একান্ত পাপগুলোকে কাটাতে নিরন্তর নিয়োজিত থাকে একান্ত প্রার্থনায়। একান্ত পাপগুচ্ছ জীবনে ডেকে আনে ফুল ভুল,বসন্ত আর এখান থেকেই জেগে ওঠে বোধের আকর মানুষ বসে পড়ে একান্ত প্রার্থনায়।
২.
আমি হাঁটতে গেলে পথ জড়িয়ে যায় পায়ে ‘
মালেক মুস্তাকিম তার কাব্যগ্রন্থ ‘ আমি হাঁটতে গেলে পথ জড়িয়ে যায় পায়ে’ সাজিয়েছেন ৫৪টি ছোট ছোট কবিতার স্তবকে। জীবনবোধ আর তার অনুধাবনকে শব্দময় করেছেন অনন্য শৈল্পিকে। জীবনের নিঃসঙ্গতা, বহুগামিতা, আনন্দ, বেদনা প্রতিদিনকার হাসি-কান্না, উচ্চারিত, অনুচ্চারিত কথোপকথন,প্রেম অপ্রেম মুখ- বিমুখতা,বিপুল বিস্ময়ে, দৃশ্য-অদৃশ্যের মিলন মেলায় ঘুরতে ঘুরতে চারপাশ অবলোকনে যে রসায়নে খাবি খেয়েছেন তা থেকে তুলে এনেছেন এক অতুলনীয় শাব্দিক নান্দীপাঠ। শব্দালয়ে জেগে উঠেছে এক জাগতিক তৃষ্ণা যারা একা নিঃসঙ্গ, অনিদ্রায় যাদের ঘুম উবে গেছে চোখ থেকে যেন তাদের অন্তরের কথাগুলো উচ্চারিত হয়েছে কবির ভাবনায়, চিন্তা চেতনা ও মননের উৎসারে। এই অনুভব, এই চিন্তন কোন শিরোনাম মেনে চলেনি খালি অন্তরের কথাগুলো ভাবনায় জেগে ওঠা বহুভাষিক খ- খ- ব্যঞ্জনে ভরা স্বপ্নের বাস্তবিক রূপকে যেন সাক্ষাৎ করেছে আবেগের তাড়নায়।তাই শব্দ ঢেউ খেলেছে নিত্যকার রোজনামচা নিয়ে।
শুরুতেই বলে উঠলেন ;
‘অনেক রাতের পরে বুঝলাম রাত হতে অনেক দেরি,এখনো ঘোমটা সরিয়ে বাহুর কিনারে দুলছে বারান্দা,স্তনঘুঙুর,আঁকাবাঁকা নদী ও বসন্ত, আঁধারের এমন তরবারি, দৃশ্যত বিমুখতা,ধানের পৃষ্ঠে লেপ্টে আছে রাত্রিভেজা জলের ঘুম ‘
দুশ্চিন্তার বলিরেখা বেয়ে নেমে গেছে অতূপ্ততার ঘাম,ঘুম চলে গেছে দূর কোথাও সুখদ সব তৈজস ঝুলছে বুকের নদীতে, চোখের কার্ণিশে ঝুলে থাকে স্বপ্নময় ঘুম খরা। মনে হয় ‘আমাদের রাত্রি জুড়ে দৃশ্যের মাতলামি, তন্দ্রামগ্নতা- ঘুমাতে ঘুমাতে স্বপ্নে দেখি,বহুদিন ঘুমাই না।’
এসব দেখতে দেখতে, শুনতে শুনতে জেগে ওঠে মন কেমনের পালা। মন ভারী হলে মগজে চর্চিত হয় আশা-নিরাশা, দুঃখের করুণ কান্না। ইচ্ছে হয় সংসার ধর্ম ছেড়ে উড়াল দিতে ;
‘অপেক্ষা উপেক্ষায় পর্যবসিত চন্দনপুষ্পে,মৃত মানুষের হাঁটাহাঁটি বুকের পৃষ্ঠাজুড়ে, এখানে জলের পাদটীকা বৃষ্টির তলপেটে, এসো আরেকবার হত্যা করি নিজেকে, নিজের লাশের উপর দিয়ে হেঁটে যাই,হেঁটে যাই।’
তারপরও আমাদের যাওয়া যাওয়া করে ও যাওয়া হয় না। ফিরে এসে ঢুকে পড়ি সেই চেনা প্রাচীন কন্দরে। সেই পুরানো ভাবনা মাথা চাড়া
দিয়ে ওঠে। এখানে এসে কবি বললেন ;
‘পড়তে পড়তে ওঠে দাঁড়াই, দাঁড়াতে দাঁড়াতে পড়ে যাই,যেতে যেতে জীবনের নামে ভেঙ্গে যায় পথ, পথের ধারে, পথের ঐপাড়ে ছায়ার মতো
আরো পথ,অস্থির হাঁটাহাঁটি – পতনের লিফলেটে ভিন্নতর একা। ‘
উড়ে যেতে যেতে আবার ফিরে আসা এক পথ শেষ হতে না হতে অন্য পথে জড়িয়ে পড়ার কাহিনি বিরল নয় বরং সাহজিক, সরল রৈখিকে
আবিষ্ট হওয়ার পালা। এক পথ সাজায় অন্য পথকে, জীবন বেছে নেয় তার পথ;
জীবন উড়ে যায়,পাখাবিহীন, শ্যাওলাঘাটে, ঘুমঘোরে বুকের পাঁজরে হাত দিলে টের পাই, ঘন্টা বেজে যাচ্ছে মৃত্যুর, অথচ আমরা মরে গেছি জন্মের বহু আগেই কিংবা মৃতদের মহল্লায় ঢুকে পড়েছি অনুচ্চারিত সংলাপে, উৎসবে। ‘
জন্মের সাথে সাথে মৃত্যু নিয়ে আসে তার পয়গাম বুকের ভেতর তার সরগম বাজে টানা লয়ে, মনে হয় মৃত্যুর আগে মরে যায় সব,মনে হয় চেনাজানা এ শহর মৃত্যুর, মৃতদের সাথে চলছে আমাদের ঘরকন্যা, গেরস্থী।এসব দেখে কবি ভাবলেন বললেন;
‘ এই অনাত্মীয় পৃথিবীতে বুকের ভেতর কী ব্যথা নিয়ে ঘুরে বেড়াই,কেউ জানে না,কেউ জানে না। কোথায় থামি কোথায় লুকাই কেউ জানে না।একলা আমি আমায় খুঁজি, ভোরের জলে, পেয়ালা ভরা দহনবিলে,ছায়ার মাঝে হারিয়ে গেছে মুখটি আমার, লোনাজলের লোকান্তরে কেউ জানে না।’
তারপরও জীবনের প্রতি এক গভীর টান, অদম্য এক ভালোবাসা প্রতিভাত হয় সৃষ্টির ঊষালগ্নে। মৃত্যু ও ভালোবাসা অনিন্দ্য সুন্দরে একই সাথে
হেঁটে যায় পরমপরায়। কবি এখানে বলে উঠলেন;
জন্মের আগেই তোমার হাত ধরে হেঁটে গেছি,মাতৃগর্ভে, ভ্রূণপর্বে – শিশুর মতো আমাদের প্রেম ছিলো,আমাদের প্রেম ছিল দুধের মতো সাদা ও স্বচ্ছ,আমাদের আকাশ ছিলো অবারিত সমুদ্র।
আমাদের সময় ছিলো বৃষ্টির ঝাপটায় দুরন্ত কদমফুল, ভেজা রোদ্দুর গন্ধম রাত্রির ভুলেভরা যাওয়া- আসা দরজার খিল,গোপন তিল। ‘
এতোকিছুর পরও সংশয়ের সৃষ্টি হয়! আমরা কি জেগে আছি, আমরা কি আদৌ হেঁটে চলেছি,না পথ থেমে গেছে চলতে চলতে। কিন্তু জীবন তো থেমে থাকতে পারে না। মৃত্যু অবধি পথের পর অসংখ্য পথ জড়িয়ে যায় পায়ে পায়ে জেগে ওঠে পথের দিশা। আবেগে আপ্লুত হয়ে কবি বললেন
এখানে হয়তো আদৌ কোন পথ ছিল না,হয়তো নদী ছিল,হয়তো ধু ধু মাঠ।পথ ভেবে হেঁটে এসে দেখি,আমরা থেমে আছি নিজস্ব দুয়ারে,সিঁড়িতে,গলির শেষ প্রান্তে। আমি হাঁটতে গেলে পথ জড়িয়ে যায় পায়ে,পায়ে পায়ে পথের জড়াজড়ি। ‘
বহুমুখী পথে হাঁটতে হাঁটতে নিজেই অচীন হয়ে পড়ে তখন নিজেকে চেনা কষ্টকর হয়ে পড়ে। প্রশ্নজেগে ওঠে মনে আমি কি সেই পথভোলা পথে এসে দাঁড়িয়েছি নিজেরই অজান্তে। মনে হয় পথে পথে নিজেকেই রেখে এসেছি। এখানে এসে কবি মুখে নিঃসৃত হলো ;
‘ তুমি একে একে পেরিয়ে যাচ্ছ অজগ্র তুমিকে।
তুমি হয়তো নিজেকেই চিনতে পারছো না,কোনটা আসলে একান্ত তুমি! ‘
চেনা অচেনা এ মায়ার খেলায় একই অঙ্গে রূপের ভিন্ন ভিন্ন বিভূতি তাকে ঘিরে হৃদয়রঙের আরতি একেকসময় মনোভূমে জাগিয়ে তোলে চিত্র বিচিত্রতার খেলা। একসময় পরম শূন্যতায় পেয়ে বসে, খাবি খাই এতে! একাকীত্ব পেয়ে বসে আমাদের, আমরা একা হয়ে যাই;
‘ কী এক মহান বৈরাগ্য,একাকিত্ব আমাদের তন্দ্রায়, প্রচ্ছন্ন ঘুমে।’
একাকিত্বকে পুঁজি করে মানুষ যেন একরকম দ্রোহী হয়ে ওঠে যদিও গন্তব্য এক ও অভিন্ন এই একা হওয়াটা যেন মানুষের সহজাত। একা একা যাওয়া আসার প্রক্রিয়া শাশ্বত, নির্ধারিত। এটা চিরসত্য বলেই দ্রোহটা জেগে ওঠে বারবার ;
‘জ্বললে তবে জ্বলুক, জ্বলেপুড়ে মরুক, মরার আগে আরেকবার নিজের মতো মরুক। কেউ জানে না – একটি পাতা কেমন করে ঝরে, কেউ জানে না বৃক্ষ কেন কেঁদে কেঁদে মরে। ঝরে যাওয়াই পাতার গান, বনের উৎসব,বৃক্ষ কি জানে এসব মিথ্যে কলরব।’
কবিতার প্রতিটি স্তবক ভারী হয়েছে হতাশার করুণ দীর্ঘশ্বাসে, হাহাকারে,জীবনের প্রতি পঙক্তি কথা বলেছে জীবনযুদ্ধে ব্যাপৃত হয়ে পাওয়া না পাওয়া, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি বঞ্চনার নিদারুণ ধারাপাতে। নিসঃঙ্গতা গিলে খেয়েছে ঘুম, অনিদ্রার সোপান বেয়ে নেমে এসেছে দ্বিধা দ্বন্দ্ব প্রেম অপ্রেমে, বিরহ। দুঃখের আবর্তে ডুবতে ডুবতে ভাসতে ভাসতে মানুষ হয়েছে দিকহীন, যাত্রায় হয়েছে এলোমেলো কলমি লতার মতো মাচাঙের নিচে বাণিয়েছে আবাস। দিকবিদিক দুলতে দুলতে শুধু খুঁজেছে পথ। পথের দিশা খুঁজতে গিয়ে অসংখ্য পথে জড়িয়ে ফিরে এসেছে অবশেষে আপন আলয়ে। চরম সত্যকে জমা দিতে অমল ভোরের কাছে এসে চিৎকারে বলেছে ;
‘ বিবর্ণ মানুষের তহবিলে জমা থাক দীর্ঘায়িত কুসুমঞ্জরি, বঞ্চনা, অবলুন্ঠন।’
পরম আক্ষেপে উচ্চারিত হয়েছে জীবনবোধের গাঢ় সত্য;
খুব শখ করে এই জীবন আমি কামড়ে খেয়েছি, গিলে ফেলেছি পানের বোঁটার মতো দীর্ঘস্থায়ী অন্ধকার, এরকম অনেক জোছনাসমেত রাত্রি আমি গিলে খেয়েছি নির্বিঘ্নে।’
পথভোলা উদভ্রান্তের মতো আমি তারপরও ছুটে চলি, চলতে চলতে আমার আমিকে হারিয়ে ফেলে বলি ;
‘আমাকে পেছনে ফেলে আমি চলে যাই সামনে। আমার সামনে চলে যায় আরেক আমি! অথচ আমাকে কোথাও খুঁজে পাই না।
৩.
কবির কাব্যগ্রন্থ ‘ সেলাই করা হাওয়ার গান ‘
নামকরণের সাথে সাথে এর অর্থ ও অনেক গভীর। হৃদয় এফোঁড় ওফোঁড় করা জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনারাজীর মেলবন্ধন খুঁজতে গিয়ে সংবেদনশীল মনের ভেতর যে ছায়া পড়েছে সেগুলোকে সংরক্ষণ করার এক প্রখর আকুতির প্রক্ষেপকে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছেন কাব্যের দর্পণে। কবির মেজাজ ফুরফুরে হলেও গম্ভীর। শৈল্পিকতা ঠাঁই করে নিয়েছে শব্দের প্রয়োগধারায়। কবিতায় শব্দের নড়াচড়ায় এসেছে ফুল, পাতা, পাখি ও আরণ্যক বসতি যথার্থ উপমা ও প্রতীকের আলোক। অনুভব আর অনুভূতির সাজঘরে কবিতা সেজে ওঠে আপন মনে কবি এখানে এসে বারবার হারায় বারবার জেগে ওঠে, শূন্যে ভাসতে ভাসতে নবতর শাব্দিক নন্দনে। কবির ভাবনা জীবনবোধের চরম সত্যকে উপলব্ধি করে। হৃদয়ে যা ধারণ করেছেন যে সুর হৃদয় ছুঁয়েছে সেগুলোকে পরম যতেœ সেলাই করে জীবনের গান বেঁধেছেন।হাওয়ার গান মানেই তো হৃদয়ের গান।
কাব্যগ্রন্থে তাই এসেছে প্রেম ভালোবাসা, বিরহ আর মৃত্যুকে তরান্বিত করার এক মায়া। জীবনকে পরিদৃষ্ট করিয়েছেন কবি চারপাশের উপকরণে শব্দের ইন্দ্রজালে নিসর্গের বহুমাত্রিক আলোড়নে আবিষ্ট করে।
‘পাখিদের ভাষা’ কবিতায় জীবনবোধের এক সুন্দর শব্দচিত্র প্রকট হয়েছে কবির বলার সাহজিক ধারায়;
‘ভাসতে ভাসতে কোথায় চলে যায় মানুষ, ঝরাপাতায়
পাখির পায়ের তলে ভাগ হয়ে গেছে সময়ও শস্যদানা
এই নাগরিক গুহাবাস,পৌরাণিক প্রণয়-
প্রতিরাতে পাখিটির দুটি ডানা দুই দিকে উড়ে যায়
একটি তোমার দিকে
অন্যটি নদীর দিকে ‘
কবির উপমা সার্থক, আসলে জন্মের পর থেকে মানুষ জল- হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে তার অন্তিমে পৌঁছে যায় শেষাবধি। কতসুন্দর করে আপ্ত করলেন পাখির পায়ের তলায় ভাগ হয়ে যায় নির্দিস্ট সময় ও তার আহার। দুটি দিকে ধাবিত হয় জীবন একটা সংসার অভিমুখী অন্যটি মৃত্যুর জলতরঙ্গে।
‘রোদে শুকাতে দিয়েছি অভিমান’ জীবনের পরম দুঃখগুলোকে অনুধাবন করেছেন হৃদয়ের গভীরতা দিয়ে,প্রকাশ করলেন অদ্ভুত সুন্দরে ;
‘রোদে শুকাতে দিয়েছি অভিমান-
অভিমানগুলো রোদ হতে হতে
রোদগুলো দুঃখ হতে হতে
ছদ্মবেশে মিলিয়ে যাচ্ছে হাওয়ার গিলোটিনে
আসলেই দুঃখগুলো পুড়ে পুড়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। এখানে এসে কত সহজেই অদৃষ্টকে মেনে নিলেন কবি। কবিতায় পড়েছে বাস্তবতার সাথে নিত্য সমরে জড়িয়ে পড়া মনো কথাগুলো অদৃষ্টবাদকে স্বীকার করতে বাধ্য হয়ে ওঠে।
হাওয়া ঘুরে ঘুরে পাখি
যতই উড়ুক
কখনো নিজের ডানাকে অতিক্রম করতে পারে না।’
মানুষ যেন ইচ্ছের অধীন ইচ্ছেরা যেন তার সীমান্ত রক্ষায় অতন্দ্র প্রহরী। ইচ্ছের বাইরে আমাদের কোন কিছুই করা হয়ে ওঠে না। কবি এখানে বললেন ;
আমরা মূলত বোবা- যে কথা বলতে চাই – বলতে পারি না
মূলত বধির – যা শুনতে চাই – শুনতে পারি না
বস্তুত অন্ধ- যা দেখতে চাই – দেখতে পারি না। ‘
এই দুঃখবোধ কবিকে কুরে কুরে খাচ্ছে।। তাই বলে উঠলেন ;
ডানাভর্তি চিৎকার নিয়ে লুকিয়ে রাখি শোকার্ত
অক্ষর। ‘
কবি এতে পরম দুঃখে মৃত্যু কামনা করলেও পূর্ব নির্ধারিত নিয়মের শৃঙ্খলে বন্দি বলে সবকিছু নিয়তির হাতে রুদ্ধ। কবি প্রখর অনুধাবনে দ্রোহী স্বরে উচ্চারণ করলেন ;
মৃত্যুকে ফিরিয়ে দেবে – বেঁচে থাকা এখনো শেষ হয়নি বলে।
কবি বাস্তববাদী, জীবনমুখী, জীবনের চরম সত্যকে নিয়ে আবেগ তার গতিকে চর্চিত করলেও কবি শাশ্বত প্রেমকে অস্বীকার করেন নি। তাই এক পৃষ্ঠার জীবন কবিতায় কবি আবেগাপ্লুত হয়ে বললেন;
কোথাও ঘুরে ঘুরে আমি পাইনি খুঁজে এমন কামিনীসন্ধ্যা
যাওয়া বলতে তোমার হৃদয়ই দূরত্ব – ফেরা বলতেও তাই
সমগ্র ভ্রমণ শেষে এখনো বসে আছি তোমার মুখোমুখি
এ কেবল ধুম মেরে বসে থাকা – কেবল এক পৃষ্ঠার জীবন।’
জীবনের কঠিনতম মূহূর্তগুলোকে কবি হৃদয়ে ধারণ করেছেন শব্দের মসলিন মসৃণে অথচ ধারাল অভিজ্ঞতায়।কবির কাব্যপ্রতিমা সবসময় সেজেছে আশপাশের বিষয়বস্তুকে ঘিরে। কবিতায় গভীর টান রেখেছেন পরোক্ষভাবে শৈল্পিক উপমা ও প্রতীকে। কবিতাগুলো পড়লে প্রথম চোটে মনে হবে কবি দারুণ হতাশাবাদী, শূন্যবাদ ও কবির কাব্যের আবহে বিরাজমান। তারপরও মনে হয়েছে কবি জীবনের চরম সত্যকে আড়াল করতে নারাজ। বরং ধ্রুব সত্যগুলো প্রকট হয়েছে অনায়াসবোধে ও স্বাচ্ছন্দ্যে। জীবনের কষ্টগুলোকে অনাবৃত করে এক এক করে সেলাই করে বা গেঁথে রাখতে চেয়েছেন রীতিতে, গীতিতে।
‘ভাঙা কাচের মতো উড়ে যাচ্ছে সময়-ঘামপাতা থেকে খসে পড়ছে কুয়াশাচূর্ণ মৃত মানুষের মতো শুয়ে আছি – প্রতিটা শুয়ে থাকাই ইউনিক – যেন সেলাই করা হাওয়ার গান ‘
আসলে মানুষের জীবনটাতো বহমান সময়ের গ্রোতে দুঃখরাশি পুঞ্জীভূত করে নেতিয়ে পড়া। মানবের নিঃসাড় শুয়ে পড়াটা সত্যিকার অর্থে সেলাই করা মানে একীভূত করা এক হাওয়ার গান।হাওয়ার গান মানেই পোড়া হৃদয়ের গান কবি এখানে বললেন ;
‘হাওয়ার ক্যানভাসে মূলত হৃদয় সেলাই করে অলীক উড়াল।’
কবিতা ‘ ঘুমের সাইরেন ‘ অসাধারণ এক কবিতা।
কবিতার গর্ভগৃহে ফুটে আছে দোটানার ফুল।
নৈরাশ্যবাদিতা কবিতার মর্মমূলে বারবার টোকা
মেরে গেছে। কেউ আছে কী? এই সংসারে অথচ থাকাটা ও অবিদ্যমান হয়ে ওঠে প্রশ্নবাণে।কবিতার একাংশে দেখা যায়
‘ উড়ে যেতে যেতে যৌথ আঙুল থেকে ছিঁড়ে গেছে ভাষা –
ইশারায় যা কিছু বলি সবুজ শস্যময়, অনর্থক তার কিছুটা পাখি, কিছুটা পাথর নদী ও ফুলের মতো কিছুটা পায়ে হাঁটা গোপন ঘ্রাণ।
আমাদের আসা যাওয়ার ভেতর কোনো আসা যাওয়া নেই।’
জীবনের দুঃখগুলো এমনভাবে ঘুরে ঘুরে আসে যা সুন্দরতম মুহূর্তগুলোকে অস্থির করে তোলে সেখানে স্বাভাবিক যাপনটাই অর্থহীন হয়ে ওঠে।জীবন সেখানে আর জীবন থাকে না একটা ঘোর লাগা দুঃখের আগুনের লেলিহান শিখায় আত্মসমর্পণের হোমে জেগে থাকে। কবি তাকে বলেছেন নিদ্রাহীনতা আর নিদ্রাহীন রাতে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়বে তাড়া খাওয়া পথের ক্যাটালগ নিদ্রাহীন রাতের কোলাজ ;
‘তোমার শরীর ভুলে যাবো একদিন, ভুলে যাব বিকলাঙ্গ এইসব দিনের তাড়া খাওয়া পথের ক্যাটালগ দাঁড়িয়ে থাকা মৃতদেহ – এই শহরের ধূলিপত্রে লিখে যাব নিদ্রাহীন রাতের কোলাজ।’
কবি হৃদয়ে নিজ মাতৃভাষার জন্য রয়েছে সুগভীর টান ও ভালোবাসা। তাই কবি তার ‘মুক্তির ভাষা ‘নামক কবিতায় লিখলেন ;
এসো হে বালক,তোমাকে গাইতে হবে জাগরণের গান শ্লোগানের অক্ষরে উড়াবে তার আঙুল – বিক্ষুব্ধ বর্ণমালায়।
মুক্তির কথা ছাড়া আর কী হতে পারে মানুষের ভাষা? ‘আসলে যে ভাষায় মুক্তির কথা লিখা থাকে না সেটা কিভাবে একটা জাতির ভাষা হতে পারে!
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সর্বোপরি ৭ মার্চের ভাষণকে স্মরণ করতে গিয়ে কবিতা মার্চের গানে লিখলেন ;
‘ পাখির শ্লোগানে বিজয়ের গান
গাছের মিছিলে স্বাধীনতার সুর
হাওয়ায় হাওয়ায়
মুক্তির বর্ণমালায়
কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না
বলে তখন মানুষের ঢেউ জাগে
বাংলার অন্তরে
মাচের্র প্রান্তরে।’
তিনটি কাব্যগ্রন্থ আলোচনায় দেখা যায় ‘একান্ত পাপগুচ্ছ’ জীবনবোধের এক অসামান্য কাব্যগ্রন্থ। পাপ-পূণ্যের মিলিত রসায়নেই তো জীবন।প্রতিটি মানুষের রয়েছে নিজস্ব কিছু পাপ আর এর জন্য থাকে প্রেম ও প্রার্থনা। প্রেম দিয়ে কাটি পাপ আর পাপ দিয়ে প্রেম। কাটাকাটির এ খেলায় মানবজীবন ডুবে আছে প্রগাঢ় প্রেমে ও পাপে। কবি বললেন এক পাপে ফুটে ফুল এক পাপে ভুল, এক পাপে বসন্ত। ভুল আর ফুল নিয়েই হলো আমাদের এ জীবন ৪ ফর্মার এই বইটি প্রকাশিত হয়েছে ‘অন্যপ্রকাশ’ প্রকাশনা থেকে একুশে বইমেলা ১৯২১ চমৎকার সজ্জায় বইটি বেশ সুন্দর,পরিষ্কার পরিুছন্ন মুদ্রণ ও ছাপায় বইটি নান্দনিক। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন মাসুম রহমান।
‘আমি হাঁটতে গেলে পথ জড়িয়ে যায় পায়ে ‘
কাব্যগ্রন্থটির অদ্ভুত স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্যতা রয়েছে। জীবনে চলার পথের চারপাশে ঘিরে থাকা নিঃসঙ্গতা, বহুগামিতা, উচ্চারিত অনুচ্চারিত ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন যুগল জীবনের অন্ধতা,প্রেম-অপ্রেম,মুখ-বিমুখতা, জীবনের বহবিধ বিস্ময়, দৃশ্য-অদৃশ্যের কোন্দল নিয়ে জীবনের অভিজ্ঞতা একেক সময়ে পথ খুঁজতে গিয়ে পথের মাঝে ডুকে পড়া,জড়িয়ে পড়া নিয়ে কবির কাব্যবিন্যাস।৪ ফর্মার বইটি প্রকাশিত হয়েছে অনিন্দ্য প্রকাশ থেকে ২০২২। প্রচ্ছদ করেছেন অরূপ বাউল। বইটির মুদ্রণ ও ছাপা ঝকঝকে ও পরিষ্কার।
‘সেলাই করা হাওয়ার গান’ কবির ৭ম কাব্যগ্রন্থ।
মৃত্যু নয় কবিতাই কবির শেষ গন্তব্য। কবি এখানে আলোকপাত করেছেন প্রতিটি মুহুর্ত কবিকে ভাবায়, আবেগতাড়িত মনগহিনে কবি হারায়,অনুভবে অনুভবে কবি হারিয়ে ফেলে তার আবাস। কবির এ অনুভবের সাথে বাংলাদেশের আরেক খ্যাতিমান আধুনিক কবি ময়ুখ চৌধুরীর সাথে সাদৃশ্যতা দেখতে পাই। ময়ুখ চৌধুরী তাঁর অনিদ্রার কারুকাজ’ কাব্যগ্রন্থের ‘ আর কোন নবী আসিবে না ‘ কবিতার শেষ পঙক্তিতে লিখেছেন ;
‘কারা খোঁজে উজ্জ্বল উদ্ধার!
কার হাতে বাঁচার সম্বল?
আর কোন নবী আসিবেনা,
কবিরা আসিবে কেবল।
আসলেই ধোঁয়া আর ধুলোর ভেতরে জীবন এক মিথ্যে প্রতিপাদ্য।বেঁচে থাকা এক অলৌকিক মূহূর্তের অভিজ্ঞতা ছাড়া আর কিছুই নয়। জন্ম মৃত্যুর মধ্যখানে আমাদের প্রেম প্রীতি ভালোবাসা, বিরহ কেবল মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করার একটা নিস্ফল প্রয়াস। কবি তার কাব্যগ্রন্থে এসবকে পুঁজি করে শব্দঘর তৈরি করতে সচেষ্ট হয়েছেন। বুকের অলিন্দে যে সব দুঃখ কষ্টের স্বরূপ দেখেছেন তাকে সেলাই করে সংযোজিত করে হাওয়ার গান বেঁধেছেন। ৪ ফর্মার বইটি প্রকাশিত হয়েছে ‘অন্যপ্রকাশ ‘প্রকাশনা থেকে একুশে বইমেলায় ২০২৪। প্রচ্ছদ করেছেন আনিসুজ্জামান সোহেল।মুদ্রণ ও ছাপা ঝকঝকে ও পরিষ্কার।
মূলত তিনটি কাব্যগ্রন্থ জীবনাশ্রয়ী,জীবনবোধের মৌল কাঠামোকে ভেঙে কবি অন্তরের নির্যাসকে প্রকটকরেছেন অনন্য শব্দ ধারায়। কবি হতাশাগ্রস্থ মনে হলেও কবি অপটিমিস্ট বা আশাবাদী। কবি সত্য প্রকাশে দ্রোহী। কোন রাখঢাক নেই আপন মনের কথাকে প্রকাশ করেছেন সাহসী উচ্চারণে। দার্শনিক চিন্তনে জীবনের আসল রূপ, পরাবাস্তববাদী মন নিয়ে লেখার নৈকট্যকে সাজিয়েছেন অপূর্ব সৃজনে ও নান্দনিকতায়। কবিতা আপন স্বতন্ত্রে স্বতঃস্ফূর্ততায় আসীন হয়েছে কাব্যগ্রন্থে। বিভ্রম ও ধোঁয়াটে জীবন নিয়ে কবি অস্থির হলেও বাঙময়। জীবনের জটিল রূপকে খোঁজাই যেন কবির আরাধনা। তিনটে কবিতার বই পড়ে আলোচনা করতে বেশ ভালো লেগেছে। তবুও বলতে হয় আলোচনা একজন কবির ৭০ ভাগ বের করে আনা যায় পুরোপুরি কখনও নয়। তাই আলোচনার ভাগ্য ও প্রসন্নতা পাঠকের ওপর রইলো। আমি বই তিনটের পাঠকপ্রিয়তা আশা করছি।
রূপক বরন বড়ুয়া, কবি ও প্রাবন্ধিক