শাহানারা স্বপ্না
খুব ব্যস্ত-সমস্তভাবে হাঁটতে থাকে মালো পাড়ার সুখেন মাঝি। একহাতে তিন সের চিঁড়ে আর ছোট পুঁটুলিতে সামান্য গুড়। আরেক হাতে খালি সয়াবীন তেলের সাদা প্লাষ্টিকের বড় বোতলভরা পানি। হপ্তাখানেকের জন্যে নদীতে থাকতে যাবে, তারই আয়োজন। শরীরে আগের সেই তাগদ, বল কিচ্ছু নেই , সেকথা সুখেনের প্রায়ই মনে থাকে না। হনহনিয়ে পথ চলা চাই। হাঁটতে গিয়ে আজও দু’চারবার হোঁচট খায়। ছোটবেলায় বাবা বলতেন–
-’হাঁটার আগে দৌড়াইস ক্যান রে বাপ?’
শিশুকাল থেকেই দৌড়ানো অভ্যেস সুখেন মাঝির। ধীরস্থির আর হতে পারল কই? তাই কি তার এমন কপাল পোড়া জীবন? মাঝে মাঝে সুখেনের তাই মনে হয়। কিন্তু এর ওপর তো তার কোন হাত নেই। ঈশ্বর যাকে যেমন তৈরী করেন এর বাইরে কি কেউ যেতে পারে?
মন থেকে সব খেদ ঝেড়ে ফেলে সুখেন মালো, না সে ভালোই আছে। যতক্ষণ এ কপোতাক্ষের বুকে পানি আর নিজের নৌকাখানি আছে, ততক্ষণ প্রানের সুখ-শান্তি সবই আছে।
এই নদীর বুকে ঝাঁপিয়ে কেটেছে শৈশব। নদীর পাড় ঘিরেই কৈবর্তপাড়া। নদীর শস্য-মাছ তাদের সবক’টি পরিবারের জীবনের রশদ যুগিয়েছে। ওপাড়ার মেয়ে মালতীর জলভরা কলসীর দেখা এখানেই পেয়েছিল। দুজনে মিলে বড় বড় মাছমারা আর অনেক বড়ো একখান নৌকার স্বপ্ন নিয়ে ঘর বাঁধলো, সংসার হলো। মানব ফুলেরা এসে তার ছোট্র উঠোন কলরবে ভরিয়ে তুলল। এখানকার জল-কাদামাটির মিশেলে বড় হওয়া ছেলে মেয়েরাও নতুন ঘর বাঁধলো। সুখেন ঘুরে ঘুরে তাদের খবর লয়, তত্ত্ব-তালাশে দিন যায় ভালোই। দেখে চোখ জুড়ায়। তাদের সাধ্য বেশী নেই। মাঝে মাঝে ক’দিন তাদের সঙ্গেও কাটিয়ে আসে। কিন্তু সুখেন কারোর বোঝা হতে চায় না। সে কেবল নদীর কাছাকাছি থাকতে চায়, পানির শব্দ শুনতে পারলেই হলো!
একটাই দু:খ যে কপোতাক্ষ শেষ হয়ে যাচ্ছে। লোভীদের হিংস্র দাঁত ছিঁড়ে খুঁড়ে নিচ্ছে নদীর মাটি। কোথায় সেই উম্মত্ত যৌবনা ঢেউ টলোমলো বিরাট নদী! যার বুকের ছলাৎ ছলাৎ ঘূর্ণি বহুদূর অব্দি গর্জন করে মালোদের বুকে নেশা জাগিয়ে তুলতো। পুরো বোয়ালিয়া তখন ছিলো সুখে টইটুম্বুর। কি খাতির ছিল মালোদের। নদীর কোমল-তরল বুকে খালি মাছ আর মাছ। কত রকমফের ছিল সেইসব মাছের। খলবল করা মাছেরা চোখের সামনে চটফট করে। কালো জালভর্তি সোনালী রূপালী মাছের লাফালাফি উ:! মনে হতেই সুখেন মাঝির বুকটা মুচড়ে ওঠে। শিউরে উঠে সে আরো জোরে পা চালায়।
বাজারের জিনিস-পত্তর রেখে আবার গঞ্জে যাওয়া লাগবে। আগের জালটা ছিঁড়ে গেছে। নতুন জাল নিতে হবে একটা। অল্পকিছু টাকা দিয়ে বাকীর খাতায় লিখিয়ে নেবে, পরে শোধ দিয়ে দিবে। সুখেন দ্রুত ছুটতে থাকে নদীর দিকে।
কপোতাক্ষকে দেখলে এখন মনে হবে বড়সড় একটা খাল। জীবনভর মানুষকে কেবল দিয়েই এসেছে, আজ বুঝি তার মরনদশা ঘনিয়ে আসছে। সেই সাথে টান লেগেছে সুখেন মাঝিদের জীবনেও। মাছের জীবিকা আর নেই বলেলেই চলে। পানিই নাই তো মাছ হবে কোত্থেকে! নদীর তো একলা মরন নয়, সে মরন মালোপাড়ার কৈবর্ত্যদের সকলের। আগে পুরো পাড়া ছিল সরগরম। লোকজন গম গম করতো। এখন লোকজন নেই। পাড়াটাই প্রায় উচ্ছেদের পথে। অনেকে ছেড়েছে পেশা। দখলবাজরা ওসব কিছু বুঝতে চায় না। নদী দখলের উৎসবে কৈবর্তদের রক্তে ওরা হোলি খেলে। চারদিকের নানা অবিচার সুখেন মাছের চোখে চেয়ে চেয় দ্যাখে শুধু। কিছু তো করার শক্তি ক্ষমতা তার নেই। না হয় এসব নদী খেকোদের ঘাড় মটকে নদীতেই ফেলে দিতো সে! এরা দৈত্যের মত পানি চুষে নদী গিলে ফেলছে। দখল করে ঘরবাড়ি তুলছে! দিনকে দিন ছোট হয়ে যাচ্ছে নদীর বিস্ততি, ঢেউয়ের বিস্তার। সুখেন নদীর মায়া কিছুতেই ছাড়তে পারে না। সে ভাবে আর কতদিনই বা সে বাঁচবে, বাকী ক’টা দিন এ নদী আঁকড়েই পড়ে থাকি!
সুখেন মালোকে আসতে দেখে নৌকার ছইয়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে মালতী। চোখ পড়ে মাঝির হাতের দিকে। মালতীর শূন্য মুখটা ঝুলে পড়ে- চাল নিশ্চয় যোগাড় করতে পারেনি। পানির বুকে এ শুকনো চিড়ে খেয়েই থাকতে হবে! কিন্তু মুখে কিছু বলে না। সুখেনের উৎসাহের কমতি নেই-
-’হেই! নে তুলে রাখ’!
বলে পলিথিনের প্যাকেটটা বাড়িয়ে ধরে। নৌকার ভেতর থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসে মালতী। হাত বাড়িয়ে জিনিসগুলো নেয়। আগে সুখেন বাজারে যাওয়ার সময় চটের ব্যাগ মুড়িয়ে নিত হাতের ভেতর। তখনকার বাজার ছিল যেমন তাজা তেমনি সস্তা, পুরো ব্যাগ উপচে পড়ত কপোতাক্ষের পানির মত। বাজার থেকে ফিরে সে ব্যাগটা ঘরের আড়ার সাথের আংটায় ঝুলিয়ে রাখত। এখন আর সেসব দরকার হয়না। বাজারে মাছওয়ালা, তরকারী ওয়ালারাই পলিথিনের ব্যাগে সব গুছিয়ে দেয়। আর বাজারই বা এমন কি! আক্রার বাজার, তায় সুখেনে মাঝির সেই সুদিনও নেই!
মালতীর হাতে ব্যাগ গছিয়ে দিয়ে সুখেন ছুটলো জাল কিনতে। এখনো নতুন পানির মাছ শিকারের নামে শরীরে আসে জোশ্! পানির নেশা কি সহজে কাটে? সুখেন মাঝি বুকের ভেতর টগবগিয়ে ওঠে ঢেউ।
আগে সুখেন মাঝির নিজেরই ঘর-বাড়ি ছিল। একবার কপোতাক্ষ নদের প্রচণ্ড ঝড়ো-বাতাসে সুখেনের ঘর ভাঙ্গে। স্রোতের টানে ঘর-বাড়ি ভেসে গেলেও নৌকাটা আস্ত থাকে। সুখেন মালো ভেঙ্গে পড়েনি নাওখানির জোরে। নৌকাটি তাদের বেঁচে থাকার সম্বল হয়ে জিইয়ে রইলো। সুখেন মাটির সংসার তুলে এনে পানির ওপর জুড়ে দিল। নদীভাঙ্গা সংসার নদীতেই জোড়া লাগে। তার ভাগ্যই চেয়েছে হয়তো সে নদীর কোল জুড়ে থাকুক। মাছ ধরার নৌকোতেই এখন এঁটে গেছে তাদের দুজনের জীবন। শুরু হলো তার নদীর বুকে বসবাস।
মাটির সংসার হলো বাড়ন্ত সংসার। অনেকটা গাছের মতো। শেকড় বাকড়ে মজবুত হয়ে বসতে না বসতেই আসে ফুল, ফলদল। চারপাশ জমিয়েতোলে নবীন গাছেরা। সুখেনেরও তিন ছেলে মেয়ে। তারা বড় হয়ে পাখ ওঠা পর্যন্ত ছিলো তার আশ্রয়ে। এখন যে যার মতো ডাল বেছে নিয়েছে। কৈবর্ত্য পাড়ার ভাঙ্গনে তারা একটু দূ্রইে বসবাস করে।
সুখেনের কোনো খেদ নাই মনে। মালতী এখনো শক্ত আছে এটাতেই সে খুশী। না হলে জীবনটা টেনে নিতো সে কি করে? শীতের সময় একটু কষ্ট হয়। বাকী দিনে তেমন কষ্টই হয় না। নদীর ওপর থাকতে সুখেনের ভালোই লাগে। জল, আলো, হাওয়ায় নৌকার মত তরতরিয়ে কেটে যায় দিন। কঞ্চির ঘর ভেঙ্গে গেলে দুজনে নদীর ঘর-নৌকাতেই সংসার পেতেছিল। মাটির ঘর আর বাঁধা হয় না। সুখেনের সে ইচ্ছেও নেই! মালতী আগে অনেকবারই বলতো ঘর তোলার কথা। সুখেন তা কানেই তোলে না।
-’কি রে বা! ঘর তুলবা না নাহি’?
-’ঘর দিয়া কি কাম! এহানেই ত্ত্ব ভালা আছি’!
-’তা বইলে পানির মইধ্যে থাকবা সারা জেবন’?
-’কই আর যাইতাম। পানি ছারা আমরা বাঁচবাম? এ নদীই আমাগো মা-বাপ!”
ক’দিন ধুম বৃষ্টি গেল। কপোতাক্ষ নদ এখন পানিতে টইটুম্বুর। জোয়ারের পানি তীর ছাড়িয়ে উঠছে প্রায়। পানি না হলে জীবন বাঁচে না আবার এ পানিতেই ডুবে দুর্গতির একশেষ হয়। পুরো পাড়ের ঘরবাড়ি ভেঙ্গেচুরে ছুটে চলে। তবে সুখেন মালো এখন আর ভরা নদীর বান দেখে ভয় পায় না। বরং নদী যত ফুলে ওঠে ততই সে খুশী। দিব্বি হাওয়ার পালে নাও ভাসিয়ে দিয়ে দূরান্তর যাত্রা সহজ হয়। অনেকদিন নদীর সাথে সংসার করে এর ভালোমন্দ সুরেখনের নখ-দর্পনে। নদীর মতি-গতি সে ভালোই বোঝে।
সুখেন মাঝি জালের সাথে নতুন একটা টর্চও কিনে আনে। কয়েকদিন পানির ওপর কাটানোর প্রস্তুতি নিয়ে সুখেন নৌকোয় ওঠে। নতুন পানির প্রচুর মাছ পাওয়া যাবে এখন। নিজেরা খেয়ে কিছু শুকিয়ে ছেলেমেয়েদের দিয়ে আসে। বাকীটা বেচাকিনি করে দুজনের খরচ তুলে নেয়। সড়কি, টাঙ্গা আর দুরকম মাছ ধরার জাল দেখেশুনে নৌকোয় তোলে। তারপর কিনার থেকে নদীর গহীন বুকের দিকে নাও ভাসিয়ে দেয়।
শাহানারা স্বপ্না, আইনজীবি ও কথাশিল্পী, ঢাকা