তৌফিকুল ইসলাম চৌধুরী
জীবনানন্দ দাশ বাংলা সাহিত্যের একজন শক্তিমান কবি, বাংলা কবিতায় যার আগমন সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও নিজস্ব কাব্যভাষা নিয়ে। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ ঝরাপালক ‘ (১৯২৭) থেকেই তা টের পাওয়া যায়। কিন্তু তার পরিচিতি ও প্রসার ঘটে বেশ বিলম্বে। জীবনকালেতো তিনি একরকম অবহেলিতই ছিলেন। অবশ্য কালান্তরে তার ‘কবিখ্যাতি’ আজ সর্বব্যাপী, সর্বোমুখী। স্বভাবে কিছুটা উদাসীন ও নিভৃতচারী এই কবির নির্জনতা বেশ পছন্দের বিষয় ছিল। স্বভাবতই তিনি নির্জনে নিজের মধ্যে নিজে মগ্ন থেকেই সাহিত্য চর্চার মাধ্যমে আপন অস্তিত্ব সম্প্রসারিত করেন। আত্নমগ্ন প্রকৃতির রূপ পিয়সী এই কবি সর্বক্ষণ বাংলার রপ দর্শনে বিভোর থাকতেন এবং তা-ই নানা কাব্যিক অবয়বে তার কবিতায় উঠে আসত। এজন্য দেখা যায় তার কবিতায় প্রকৃতি অনবদ্য অলঙ্কারে শোভিত। বাংলার নৈসর্গিক উপাদান দিয়ে তিনি নির্মাণ করেন তাঁর কবিতার শরীর। মূলত তার কবিসত্তার শিকড় বাংলার মাটির গভীরে প্রোথিত। তিনি নিজেই বলেছেন,
“তোমার যেখানে সাধ চলে যাও –আমি এই বাংলার পরে রয়ে যাব “/ ( (তোমার যেখানে সাধ, রুপসী বাংলা )
অথবা, ” একদিন জলসিঁড়ি নদীটির পারে এই বাংলার মাঠে /
বিশীর্ণ বটের নীচে শুয়ে রব ; /
( একদিন জলসিঁড়ি নদীটির, রুপসী বাংলা )
কারণ, ” কোথাও দেখিনি, আহা- এমন বিজন ঘাস –/
প্রান্তরের পারে নরম বিমর্স চোখে চেয়ে আছে —“/
( কোথাও দেখিনি, রুপসী বাংলা )
রুপসী বাংলার রুপমুগ্ধ কবির কণ্ঠে তাই দৃঢ উচ্চারণঃ
“বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি/
তাই আমি পৃথিবীর রুপ খুঁজিতে যাই না আর, “/
( বাংলার মুখ আমি, রুপসী বাংলা )
রুপসী বাংলার সৌন্দর্যে বিভোর কবি এই বাংলায় পুনঃফিরে আসতে আগ্রহী —
” আবার আসিব ফিরে ধান সিড়িটির তীরে — এই বাংলায় /
হয়তো মানুষ নয় — হয়তো শঙ্খ চিল শালিকের বেশে ” । /
( আবার আসিব ফিরে, রুপসী বাংলা )
কবি আসলে বাংলার প্রাকৃকিক রুপ বৈচিত্র ও নান্দনিক ঐশ্বর্যে ছিলেন বিমুগ্ধ। এদেশের মাটি, মানুষ, ফুল-পাখি, লতা-গুল্ম, পাহাড়-নদী -আকাশ কবির কবিতায় অনন্য ব্যঞ্জনায় সমুপস্হিত।
জীবনানন্দ শুধু রূপসী বাংলার রূপ-মুগ্ধতার কবি নন , তিনি সমকালীন এবং আধুনিক কবিও। সমকাল স্রোতস্বিনী নদীর মতো তার কবি আত্নাকে নাড়া দেয়, যা চলমান আধুনিকতাকেও ছুঁয়ে যায়। তার কবিতায় আধুনিকতার সব দিক পরিস্ফুট। সম-সাময়িক সাম্রাজ্যবাদী শাসন- শোষণের নিষ্ঠুর পীড়ন ও দেশ-সমাজ তার কবিতায় প্রতিভাত। ১৯২৭ সালে প্রকাশিত তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ “ঝরা পালক ” এর অনেক কবিতা দেশকে নিয়ে লেখা। ” ধূসর পা-ুলিপি “তে তা এসেছে আরো নিবিড়ভাবে । তার ‘শকুন’ , ‘অবসরের গান ‘ কবিতায় সাম্রাজ্যবাদের নিষ্ঠুর পীড়নকে নগ্নভাবে তুলে ধরা হয়েছে। তার মাঝে নির্জনতা বাসা বাঁধলেও তার কবিতায় আধুনিকতা ও জীবনের প্রতি দুর্বার ভালোবাসা বহমান। তিনি বলেন,
” মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব/
থেকে যায়। “/
জীবনানন্দ দাশ তার কবিতায় শব্দচয়ন ও বাক্য গঠনে যথেষ্ট পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন। উপমা ও চিত্রকল্পে তিনি প্রকৃতি নির্ভর। তার কবিতায় কথার বুনন, শব্দের গাঁথুনী ও অলঙ্কারিক প্রয়োগ পাঠক চিত্তে এক মধুর আবেশ তৈরী করে। বলা হয়ে থাকে, “গভীর অনুভুতির স্বাভাবিক প্লাবনই কবিতা “– (ওয়ার্ডসওয়ার্থ)। জীবনানন্দের কবিতায় এই অনুভূতির প্রকাশ এক আশ্চর্য ব্যঞ্জনায় বাঙময় হয়ে উঠে। তার কবিতার কয়েকটি লাইন লক্ষ করুনঃ
০১.” সূর্য অস্তে চলে গেলে কেমন সুকেশী অন্ধকার খোঁপা বেঁধে নিতে আসে –” / — (১৯৪৬-৪৭, শ্রেষ্ঠ কবিতা ) ।
০২. ” আকাশ ছড়ায়ে আছে নীল হয়ে আকাশে–আকাশে “/
–( সন্ধ্যা হয় -চারিদিকে শান্ত নীরবতা ) ।
০৩.” সারা রাত বিস্তীর্ণ হাওয়া আমার মশারীতে খেলেছে ; /
মশারীটা ফুলে উঠেছে কখনো মৌসুমী সমুদ্রের পেটের মতো “।/
অথবা,
” জ্যোৎস্না রাতে বেবিলনের রাণীর ঘাড়ের ওপর চিতার উজ্বল চামড়ার /
শালের মতো জ্বলজ্বল করছিল বিশাল আকাশ ” /
— ( হাওয়ার রাত, বনলতা সেন ) ।
০৪. ” এই পৃথিবীর পরিচিত রোদের মতন তোমার শরীর ” /
— ( সুদর্শনা ঃ বনলতা সেন ) ।
০৫. “বেদনাকে গোধূলির জাফরান সমুদ্রের মতো সুন্দর করে তোলে /
উচুঁ উচুঁ গাছ– অন্ধকার রাতের বাতাস ও প্রান্তরকে করে তোলে /
মায়াবী নদীর পারের দেশের মতো ; “/
— (কোকিল, অগ্রন্থিত কবিতা ) ।
০৬. “সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন /
সন্ধ্যা আসে ; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল , /
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পা-ুলিপি করে আয়োজন /
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল। ; /
সব পাখি ঘরে আসে – সব নদী ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন ; /
থাকে শুধু অন্ধকার , মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।” /
— ( বনলতা সেন, বনলতা সেন।) ।
লক্ষ করলে দেখা যায়, কবির এসব কবিতায় এক যাদুকরী সম্মোহন সর্বক্ষণ পাঠককে মোহাবিষ্ট করে রাখে। তার ব্যবহৃত প্রতীক, উপমা, উৎপ্রেক্ষায় একটা নিজস্ব ষ্টাইল আছে, যা জীবনানন্দের কবিতাকে সহজেই চিনিয়ে দেয়। তার”ধূসর পা-ুলিপি ” পড়ে ১৯৩৬ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, “তোমার কবিতাগুলো পড়ে খুশী হয়েছি। তোমার লেখায় রস আছে, স্বকীয়তা আছে এবং তাকিয়ে দেখার আনন্দ আছে “। একইভাবে ১৯৩৫ সালে বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘ কবিতা ‘ পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় জীবনানন্দের ‘মৃত্যুর আগে’ কবিতাটি পড়ে কবিগুরু মন্তব্য করেছিলেন ‘চিত্ররুপময় ‘বলে। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরাপালক’ (১৯২৭) আগাগোড়াই চিত্ররুপময়। ‘রূপসী বাংলা’ (১৯৫৭) এর চিত্র রুপময়তা বাংলাদেশের প্রকৃতির মতোই মনোমুগ্ধকর। বাংলাদেশের নিসর্গ এতে যেভাবে রুপায়িত হয়েছে, তা অন্য কোথাও নজরে পড়ে খুব কম।
জীবনান্দ দাশ একজন গুণী কবি। নিজে ইংরেজি সাহিত্যে এম. এ. এবং শিক্ষিত পরিবারে জন্ম হলেও তিনি ছিলেন আত্নপ্রচার বিমুখ, নির্জনতা প্রিয়, আত্নভোলা স্বভাবের এক চিন্তাশীল মানুষ। জীবনের প্রয়োজনে তিনি মফস্বল শহর বরিশাল ছেড়ে দিল্লী, কোলকাতা ছুটে যান ; কিন্তু সেখানেও নির্জনতা তাকে ভর করে। তিনি কোন সভা-সমিতিতে যেতেন না, কোথাও আড্ডা দিতেন না। তিনি কথা বলতেন কম, সর্বদা গম্ভীর থাকতেন। কিন্তু কবিতার প্রতি তিনি ছিলেন একাগ্রচিত্ত। অনেক রাত পর্যন্ত তিনি লিখতেন — পড়তেন। তিনি তার লেখা মূল কবিতাকে বার বার সংশোধন করতেন, যতক্ষণ না তার আঙ্গিকে শব্দের কারুকার্যখচিত শ্রুতিমধুর অলঙ্কার শোভিত না হতো , ঠিক তেমনি কবিতার নামকরণের ক্ষেত্রেও পছন্দ না হওয়া পর্যন্ত পরিবর্তন চলতো।
বাংলা ১৩২৬ বঙ্গাব্দের বৈশাখে পিতা সত্যানন্দ দাশ ( ১৮৬৩–১৯৪২) সম্পাদিত ‘ব্রম্মবাদী’ পত্রিকায় জীবনানন্দের প্রথম কবিতা ” বর্ষা আবাহন ” প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে তার কাব্যাঙ্গনে পথ চলা। কিন্তু কবিতার ক্ষেত্রে জীবনানন্দ নিবেদিত-প্রাণ হলেও আশ্চর্যের ব্যাপার ছিল, কবিতার প্রকাশ ও প্রসারের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন সমভাবে উদাসীন। যে ‘ রুপসী বাংলা’র জন্য আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে ‘ জীবনানন্দের রূপসী বাংলা ‘ বলা হয়, সে ‘রূপসী বাংলা’ প্রসঙ্গে কবির ছোটভাই অশোকানন্দ বলেন, “রূপসী বাংলা’ দাদার কবিতার পা-ুলিপি আমার হাতে আসে তার মৃত্যুর পর। আমি তখন কেন্দ্রীয় সরকারের আবহাওয়া বিভাগে কাজ করি। অবসর গ্রহনের পূর্বে শেষ কয়েক বৎসর কর্মস্থল ছিল কলকাতা। সুতরাং কাজের ফাঁকে ফাঁকে দাদার নানান কাগজপত্র, কবিতা ও অন্যান্য খাতা দেখবার সময় পাই। একথা ভেবে অবাক হয়ে যাই যে, ‘ রূপসী বাংলা’র কোন কবিতাই তিনি পূর্বে কোন পত্র-পত্রিকায় ছাপান নি “। সুতরাং অকপটে এটা বলা যায়, অনেকটা প্রচার বিমুখতা, কবিতার প্রচার-প্রসারে উদাসীনতা তাকে বাংলা সাহিত্যের পাদ-প্রদীপ থেকে অনেকটা দূরে সরিয়ে দেয়। এ কারণে একসময় তিনি বাংলা সাহিত্যের ভুবনে অনেকটা উপেক্ষিত, অনালোচিত ছিলেন , যদিও তাকে বাদ দিয়ে ১৯৩০ পরবর্তী বাংলা কবিতার পর্যালোচনা যথার্থ হতে পারে না। জীবনানন্দ দাশ সম্পর্কে কবি আবুল হোসেন ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকায় লিখেন, “আধুনিক বাঙ্গালি কবিদের মধ্যে জীবননান্দ দাশই প্রধান ব্যক্তি, যার সম্পর্কে আলোচনা সাহিত্যিক-অসাহিত্যিক সব মহলেই অত্যন্ত সীমাবদ্ধ। মফস্বলবাসী এবং স্বভাবতই নিঃসঙ্গ বলেই তার এই বদনসিব কি-না জানি না , মনে হয় আধুনিক বাংলা কাব্যের প্রধান গতিপথ থেকে তার অসংকুচিত নিঃশব্দ পলায়নই এ অবহেলার মূল। অথচ বিংশ শতকের তৃতীয় দশকের মাঝামাঝি থেকে যে নতুন কাব্য ধারার প্রবর্তন এবং রবীন্দ্র-ঐতিহ্য থেকে মুক্তির প্রচেষ্টা, জীবনানন্দ তার একজন প্রধান, অক্লান্ত অথচ নির্জন কর্মী “। অবশ্য পরিবর্তনের প্রবহমান ধারায় জীবনানন্দের কাব্যের বিচার-বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নে আজ আমাদের সামনে এক নতুন প্রতিভাময় জীবনানন্দ আপন স্বাতন্ত্রে সমুজ্জল। তার অনুভুতির গভীরতা, উপমা চিত্রকল্পের বর্ণাঢ্যতা, সৃষ্টি বৈচিত্র্যের আকর্ষণীয়তা রীতিমত বিস্ময়কর। তার মৃত্যুর পূর্বাপর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ — ঝরা পালক, ধূসর পা-ুলিপি, রুপসী বাংলা, বনলতা সেন, মহাপৃথিবী, সাতটি তারার তিমির, বেলা-অবেলা-কালবেলা, সুদর্শনা, আলো পৃথিবী, শ্রেষ্ঠ কবিতা’য় তারই স্বাক্ষর মেলে। তাছাড়া তার উপন্যাস—- জলপাই হাটি, বাসমতির উপাখ্যান, মাল্যবান, কারুবাসনা, জীবন প্রণালী, বিভা, প্রেতিনীর রুপকথা, বড়গল্প— নিরুপম যাত্রা, পূর্ণিমা, প্রবন্ধ—কবিতা ও কঙ্কাবতী, ছোটগল্প— সঙ্গ নিঃসঙ্গ, হিসেব নিকেশ, ছায়ানট, আকাক্সক্ষা কামনার বিলাস, রক্তমাংশহীন, জামরুলতলা, পালিয়ে যেতে, মেয়ে মানুষ, কথা শুধু কথা —– এসব জানিয়ে দেয় তিনি সৃজন-মননের এক বড় মাপের মানুষ ; যদিও জীবদ্দশায় তা অপ্রকাশিত ছিল।
জীবনানন্দ দাশ কবিতার ক্ষেত্রে একনিষ্ঠ হলেও পেশাগত জীবনে ছিলেন গন্তব্যহীন, বিচিত্রমুখী। তিনি শিক্ষকতাকে অন্যতম মহৎ পেশা হিসেবে বেছে নিলেও জীবনের প্রয়োজনে তিনি কখনো বীমা কোম্পানীর এজেন্ট হয়েছেন, কখনো ব্যবসা করেছেন, কখনো অধ্যাপনা করেছেন— চাকরীচ্যুত হয়েছেন, বেকার থেকেছেন, আবার অধ্যাপনা করেছেন। তার অধ্যাপনা জীবনের শুরু বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ থেকে, এরপর তিনি কোলকাতা সিটি কলেজ, খুলনার বাগেরহাট কলেজ, দিল্লীর রামযশ কলেজ, তারপর কিছুদিন বেকারত্ব ও বীমা কোম্পানির এজেন্টের কাজ, এরপর ভাই অশোকানন্দের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে কিছুদিন ব্যবসা এবং এতে মার খেয়ে পুনরায় বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে যোগদান। এরপর তিনি কোলকাতায় গেলে সেখানে বেকার জীবন পুনঃশুরু, অতপর হুমায়ূন কবিরের দৈনিক ‘ স্বরাজ’ পত্রিকায় চাকরি লাভ করেন। কিন্তু সেখনে চাকরি খোয়ায়ে পুনরায় বেকার হয়ে পড়েন। মাঝখানে কিছুদিন খড়কপুর কলেজে অধ্যাপনা করেন, পরে স্বেচ্ছায় অব্যাহতি নেন। এরপর পুনরায় বেকারত্ব এবং অতপর বরিশাল কলেজে যোগদান করেন, এখানেও চাকরিচ্যুতি। ১৯৫৩ সালের জুলাই থেকে হাওড়া গার্লস কলেজের অধ্যাপনার চাকরিটাই ছিল তার চাকরি জীবনের শেষ চাকরি।
১৮৯৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি জন্ম নেয়া ৫৫ বছরের জীবন যন্ত্রণায় অস্থির কবি জীবনানন্দ দাশ ১৯৫৪ সালের ১৪ অক্টোবর কোলকাতার টালিগঞ্জে এক ট্রাম দুর্ঘটনায় মারাত্নকভাবে আহত হয়ে ২২ অক্টোবর কোলকাতার শম্ভুনাথপ-িত হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যু সম্পর্কে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য পাওয়া যায়। কেউ বলেন, প্রচ- ভিড়ের মধ্যে একহাতে ছাতা ও অন্যহাতে ট্রামের হাতল ধরতে গিয়ে পা ফসকে পড়ে গিয়ে পাজর, কণ্ঠি ও উরুদেশ ভেঙ্গে তিনি মারাত্নক আহত হন। আবার কারো কারো মতে, বার বার হর্ন বাজানো সত্বেও তিনি নাকি লাইনের উপর চলে আসেন এবং ট্রামের ধাক্কায় মারাত্নক আহত হয়ে পরে হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যু আত্মহত্যা নাকি নিছক দুর্ঘটনা সে বিতর্কে না গিয়েও বলা যায়, যে কবি একদিন রুপসী বাংলার রুপ পিয়াসী হয়ে বলেছিলেন, ” আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িঁটির তীরে –এই বাংলায় ” , নাগরিক ও জীবন যন্ত্রণায় পিষ্ট সে কবি একসময় বিষণœতা, অবসাদ, মৃত্যু-চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন এবং মৃত্যু কামনাই তার কাছে ছিল চরম পাওনাঃ
” ধান সিড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়ে থাকবো — /
ধীরে –পৌষের রাতে –/
কোনদিন জাগব না জেনে /
কোনদিন জাগব না আমি — কোনদিন আর “।/
নিজের সে চলে যাওয়ার কথা তিনি জানিয়ে যান তার অন্য এক কবিতায় —
” একদিন কুয়াশার এই মাঠে আমারে পাবে না কেউ খুঁজে আর, জানি /
হৃদয়ের পথ চলা শেষ হল সেই দিন —” /
— (একদিন কুয়াশার,রুপসী বাংলা )
তারপরও তিনি মরতে চেয়েছেন রুপসী বাংলাকে বুকের উপর জাগরুক রেখে । কারণ তিনি যে রুপসী বাংলার রুপ পিয়াসী কবিঃ
” কখন মরণ আসে কে বা জানে ——/
তবু যেন মরি আমি এই মাঠ-ঘাটের ভিতর ,/
কৃষ্ণা যমুনার নয় -যেন এই গাঙ্গুড়ের ঢেউয়ের আঘ্রাণ/
লেগে থাকে চোখে মুখে -রুপসী বাংলা যেন বুকের উপর /
জেগে থাকে ; তারি নীচে শুয়ে থাকি যেন আমি অর্ধনারীশ্বর “। /
( তোমার বুকের থেকে, রুপসী বাংলা ) ।
তৌফিকুল ইসলাম চৌধুরী, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও কবি