রেদওয়ান খান :
হয়তো জীবনের প্রতি একটা কাক্সিক্ষত বিতৃষ্ণা অনুভব করার পর, অন্তকরণের অন্ধকারে, করোটিতে, একদা সে নিজেকে আর খুঁজে পায়নি। জগতের বাহিরে যে আলো তারও যথার্থ অর্থ হলদে পাতার মতো ঝ’রে যাবার কাল হয়ে এলে,একদিন সে ঘরের বার হয়ে এসেছিলো। বাইশ-তেইশ বছর ধরে তার প্রচলিত নাম ‘মল্লিকা অথবা মঞ্জুলিকা, মাফিয়া অথবা মর্জিনা, বিন্দুবালা অথবা শৈলবালা এরকম একটি নাম তার নিশ্চয় ছিলো লোকসমাজ থেকে উধাও হয়ে যাওয়ার পর,নানা জনপদ ভ্রমণ শেষে, ক্ষুধা-ক্লান্তির অনুভূতিহীন মেয়েটি অর্থাৎ পাগলী,কুমিল্লা শহরে,প্রাচীন রাজাদের পুণ্যদিঘি-ধর্মসাগর-এর পাশেই গোরস্তানের জীর্ণ উঁচু দেয়ালের পাদদেশে, সোনালু গাছটিতে কাকের নির্মিতব্য বাসার ঠিক নিচে, সাত রাজ্যের তেনাতুনা সংগ্রহপূর্বক আগুনহীন চুলায় কী যেন কি- রান্না করে যায় সারাদিনমান।
রান্নার আয়োজনে পাগলিনী যেন বা কাক যেখানে যা পায়, মনে ধরলে সেসব নিয়ে এসে জড়ো করেছে- পুঁতির মালা থেকে শুরু করে চুলের নকল গুছি- সবই তার রসুইঘরে রন্ধনশিল্পের অত্যাবশ্যকীয় উপকরণ হয়ে উঠেছে। সুতরাং দিঘির পাড়টিতে, গোরস্তানের লাগোয়া পলেস্তরা-খসা দেয়ালটির পাদদেশে পাগলিনীর অদ্ভূত রান্নার মূল দর্শক অল্পবয়সী স্কুল পড়ুয়ারা। বয়স্করাও তার কা-কারখানা উপভোগ করে বৈকি।
হয়তো তার জন্মভিটা কাছাকাছি কোথাও নয়, এই রকম হলে আত্মীয়রা এতদিনে তাকে সন্ধান করে বাড়ি নিয়ে গিয়ে গোসল করিয়ে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখার চেষ্টা করতো অথবা হতে পারে এমন যে, ভূত-তাড়ানো তাবিজ-তুমার, পানি-পড়া,আঙুলের নখে আয়না-পড়া ব্যর্থ করে দিয়ে সে বেরিয়ে গিয়েছিলো পৃথিবীর পথে। হয়তো শত্রুতাবশতঃ ধুতুরা বিষও তাকে কাবু করে নাই, সে মরে নাই,পাগল করে দিয়েছে। সংসার তারে আশ্রয় দিতে পারে নাই, দিয়েছে পৃথিবী পৃথিবী কী এই প্রশ্নের অর্থবোধক কোনও সদুত্তর তার কাছে নাই । লোকেদের কাছে সে এখন ধর্মসাগরের পাগলী।
দূরবর্তী, ধুলোপড়া নিয়ন বাতির জবুথবু আলোয় পথচারীরা কৌতুহলে পাগলিনীর অন্তহীন রান্নার আয়োজন দেখে টিপ্পনী কাটে, ‘কি রে পাগলী রান্না শেষ অইবো কবে ? আইজ কি রানলি গো ?’
সে কখনও কারো প্রশ্ন-কৌতুহলের উত্তর দেয় নাই।
তবে পথচারী লোকেরা স্মরণে আনতে পারে নাই এই পাগলিনী কোথা থেকে এসেছে, কবে থেকে দখল করেছে ধর্মসাগর। কোনদিন আবার উধাও হয়ে যাবে তারও কোনও ঠিকঠিকানা কারো মনে ঠাঁই পায় নাই। পাগল নিয়ে মানুষের ভাবনা ক্ষণস্থায়ী।
ত্রিপুরা রাজাদের বিশাল দিঘি ও গোরস্তানের পাশেই, ইহজাগতিক রান্নাবান্নার এই অশেষ প্রচেষ্টা নাম-পরিচয়-গোত্রহীন, কয়লা-আংরা কাষ্ঠবৎ এই নারী পাগলিনীটির কর্মযজ্ঞ বেশির ভাগ মানুষেরই দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। মানুষ মূলতঃ ছুটে চলে নিজের ও নিজ নিজ পারিবারিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট দৌড়াদৌড়িতে। রাজনীতির গরম সিঙাড়ায় ফুঁ দিয়ে। ধর্মসাগরের গোরস্তানে আত্মায় নিদ্রাকুসুম মেখে ‘চিরঘুম’ দিতে আসা নিথর শরীরগুলো নড়েচড়ে না, পাগলিনীটি বেশ সচল উদাসীন নিরুদ্বিঘœ-দুর্বিনীত-দুঃসাহসী। কাউকে পরোয়া না করে সে, দিনরাত আগুনহীন চুলায়, কোত্থেকে কুড়িয়ে আনা মাটির চিটচিটে হাঁড়িতে ভীষণ সেই রান্না। মাঝে মাঝে আবার একলা কথার ফাঁকে, জটাধরা চুলে পলিথিনের ফিতা-ফুল করতে করতে, বাঁশের শুকনো ভাঙ্গা কঞ্চি দিয়ে খুব করে কষে নেড়ে দিচ্ছে, হাতে নিয়ে দেখছে নুন হলো কি না। জিহ্বা বার করে চকাস চকাস শব্দের ভেতর রান্নাটি যে অতি সুস্বাদু হয়েছে- সন্দেহাতীতভাবে তা প্রকাশের প্রয়োজনে, বিদ্যুতের তারে ভিড় করা কাকদের ‘ওই চোৎমারানি যাঃ যাঃ!’ বলে একটা তাড়ানি দেয়। আকাশ থেকে কাকদের চুনাহাগা মাঝে মাঝে রান্নার হাড়িতে এসে পড়লে খুব হাসে সে । যেন কাকেরা হেগে দেবে- এইটাই নিয়ম।
পাগলিনীর সেই ঝগড়া-হাসিতে,কাকেদের মূল আশ্রয় সোনালু গাছটির হলদে ফুলেরাও ঝ’রে ঝ’রে পড়ে– যেন বৃষ্টি।
চৈত্রের ঝাঁ ঝাঁ রোদে ধর্মসাগর পাড়ের পুরনো বৃক্ষতলে লোকেরা ছায়ার বাসনায় স্থবির। জোয়ার-ভাটাহীন দিঘিটি নীলচে-সবুজ শ্যাওলা-পানায় ভরা । কিন্তু বালক-কিশোরদের দল যখন পানির উপর ঝুঁকে-পড়া কাঁচা বৌলে ভরা আম গাছটিতে উঠে, কেউ বা পরনের লেবাস খুলে ফেলে ন্যাংটা হয়ে ঝাঁপ-সাঁতার কাটে, কিংবা ইটের টুকরা পানির তলে লুকিয়ে রেখে ‘লুবি লুবি’ খেলে, তখন মাঝে মাঝে নিন্দাপতি পোকাদের সুতাকাটা চরকা মাথার ভেতর চক্কর দিলে, পাগলিটির করোটি আলগা হয়ে যায়। সে তার সূক্ষ্ম স্মৃতিরই ক্ষণেক বিচ্ছুরণ। ক্ষণেকের জাগরণে সে ভাবে তার বাড়িটি কোথায় ছিল ? তবে বর্ষাকালে সেই বাড়ির পুকুরের পাড়ে কালো কুঁচকুঁচে গাবগাছ থেকে ঠিক এমনি করেই ন্যাংটা হয়ে লাফিয়ে পড়তো একটি ছেলে মুনসুর। কিন্তু মুনসুর তার কে ছিল- করোটির তলায় সে-সবের হদিস পাওয়া যায় না,কারণ, ততক্ষণে আকাশ অন্ধকার করে মেঘ জমেছে। বড়ো বড়ো মোটা মোটা কিছু ফোঁটাও ঝরছে। ফলে নিজের ভেতর পুনরায় ডুব মেরে যায় পাগলি। জড়ো-করা তৈজস এখন কোথায় রাখবে সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নাই। রান্নাটা শেষ করার একটা তাড়া অনুভবে তার মুখভর্তি হলদে দাঁতের ফাঁক গ’লে লালা বের হতে থাকে।
দিঘির মায়ায় পড়া ছায়া ও ঠা-া বাতাসের প্রত্যাশা পূরণ হওয়ার পর, ফিরতি পথে বোরকা-হিজাবে আপাদমস্তক ঢাকনা দেয়া রমণীগণের কেউ কেউ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, তাদের মানবিকতা প্রকাশের তাগিদ অনুভব করে বলে, ‘আহারে কার মা’র ঝি গো ! চেহারাখান দেইখ্যা ত মনে অয় ভালা ঘরের মাইয়্যা। আল্লায় কহন যে কারে কি হালে রাখে !’
বিশেষতঃ বয়স্ক মহিলারা,কালো নেকাবের মুখাবরণটি সামান্য সরিয়ে, দয়াবতী-অশ্রুময়ী হয়ে ওঠেন। কারণ তাঁহারা তো মা। পাগলির হাতে তাঁহারা পাউরুটি-কলা, কেউ কেউ টাকাও দেয় দু’চারটা। পারলৌকিক একটা ‘ছোয়াবে’র আকাঙ্খা কেউ ছাড়তে পারে না। পাগলি কখনও সখনও সেই ছোয়াব প্রত্যাশী অচিন রমণীদেরকে হতাশ না করে কিছুটা খায়, বেশিরভাগ ভাগ সময় অন্তঃসখা এক ঠ্যাং ভাঙা নেড়ি কুত্তাটাকে দেয়। ‘ওই খা কইলাম’ বলে কুকুরটিকে ধমকায়। কুঁই কুঁই করে ঠ্যাং-লাফানো কুকুরটি পাগলির কথা শোনে, খায়। তারপর তার শরীরটি ঘেঁষে কু-লী পাকানোর ব্যবস্থায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মহিলারা তখন তাঁদের সঙ্গে থাকা নাতি-নাতনিদের বলেন,‘দ্যাখ রে, আল্লার কি লীলা বোবা কুত্তাও পাগলের কথা শুনে ! আহারে !’
ধর্মসাগরের পাড় এখন নিন্দাপতি পোকাদের চরকা কাটার দারুণ ব্যস্ততায় মগ্ন। লালচক্ষু ফর্সা যুবক নাইমুলও তার চায়ের দোকানটি নিয়ে ব্যস্ত। মাঝে মাঝে এমন হয় যে একার পক্ষে কুলানো কঠিন হয়ে ওঠে। শহরটি ক্রমশঃ ঘিঞ্জি হয়ে ওঠায় মানুষের আদিম একাকিত্বের বাসনা-বিলাসও ক্ষীণতর হয়ে আসছে। তবে ত্রিপুরার রায়বাহাদুর-মানিক্যবাহাদুর ইত্যাদি লোকহিতৈষী রাজারা ধর্মসাগর নামের দিঘিটি খনন করে রেখে গিয়ে ভালোই করেছেন। দম ফেলবার এই আশ্রমটিকে মানুষ ভালোবাসে। মানুষের ক্রমবর্ধমান আনাগোনায় মুখর হয়ে থাকে দিঘি ও দিঘির চার পাড়। চৈত্রের খরতাপে ঘরের বার হওয়া মানুষেরা শান্তি অণ্বেষায় ঘুরে বেড়ায়, নাইমুলের বেচাবিক্রি বাড়ে। কবে কখন এক পাগলিও তার নিজস্ব ঘরকন্যায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছে, ধর্মসাগরেরই পাড়ে, নাইমুলের দোকানটির নিকটবর্তী, প্রথম প্রথম কৌতুহল হলেও, পরে মানুষেরা ভুলে যায় কবে থেকে সে এইখানে রান্নাবান্না খেলছে আপন মনে। মাঝে মধ্যে নাইমুল নিজেও পাগলিকে এটা সেটা খেতে দিয়েছে, দেয় নাই এমন নয়। আড়চোখে চেকিতে কখনওবা নজর গেছে, ভেবেছে, দেখি পাগলিটা করে কি !
পাগল মেয়েছেলের প্রতি মায়া জন্মানো লৌকিক কর্তব্যেরই অংশ। নাইমুলের চওড়া সিনার ভেতর থেকে কলিজা পর্যন্ত পাগল-পাগল আউলা-ঝাউলা মায়া।
পাগলিটা এখন আকাশ থেকে নেমে-আসা কালবৈশাখী জড়ের মুখোমুখি। তবে নির্লিপ্তির মুখস্থবিদ্যা পাগলদের আয়ত্বাধীন। হঠাৎ নেমে আসা ঝড় ও বৃষ্টির প্রতিবাদে কাকের দল বার কয়েক কা কা করে কোন ঝোপে লুকিয়েছে কে জানে। এই ফাঁকে লাঠি উঁচিয়ে নানা অঙ্গভঙ্গি করে পাগলী ধর্মসাগরটি এখন শাসন করছে। মূলতঃ নানা অভিযোগ ও বৃষ্টিস্নাত শীতল শূন্যতার দিকে ছুঁড়ে দেয়া নালিশ বকাবাদ্য বৃষ্টিপাগল বালক-কিশোরদের কাছে কৌতুহল-আনন্দের খোরাক। ঝড়ের ভেতর ধর্মসাগর দিঘিতে সাঁতরাবে বলে ছুটে আসা বাউন্ডুলেদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত দুষ্টরা পাগলিকে ঢিল ছুঁড়ে মারে ।
কেউ কেউ কাছে ঘেঁষে তার কিম্ভূত জোড়াতালি দেয়া পরল পরল আবরণ ধরে টান দেয়। এসময় আকস্মিক করোটিগত স্মৃতির দুয়ার খুললে, বিদ্যুৎঝলক-সম্বভ কথা কয়ে ওঠে পাগলিনী- ‘তোরা আমারে মারছস ? আমার বড়োভাই আইলে তোগো ঠ্যাং মোছড়াইয়া দিব’ একথা বলার সময় একটা বুক-ভাঙা কষ্ট বেরিয়ে এসেছিলো তার। তারপর স্মুতি-বিদ্যুৎ নিভে, করোটি স্তব্ধ হয়ে গেলে বিভ্রান্ত পাগলিনী, ভেজা কাউয়া যেন, হঠাৎ চুপ হয়ে যায়।
সভ্যবভ্য এক কিশোর , সম্ভবত দয়া-রহমত তার উপর ভ’র করলে সে বলে, ওই তোরা বেডিরে মারছ ক্যান ? গুনাহ অইবো , বেডি কিছু বুজে ? না তগো কোনো ক্ষতি করছে ?
বালকের দলটি ঝপাৎ করে দিঘির পানিতে ঝাঁপ দেয়। কেউ কেউ পিঠ উপুড় করে পুরো শরীরটি ভাসিয়ে রেখে টুপুর টুপুর বৃষ্টির বাজনা শোনে।
চায়ের দোকানে এসময় দু’একজন কাস্টমার। চা শেষ করে তারা এখন বিড়ি মুখে কাব্যময় হয়ে উঠেছে, বৃষ্টি নিজেই এক মহাকবি। দোকানে অলস কাটানোর সময় পেয়ে পাগলির দিকে একটু নজর দেয়ার ফুরসত পায় নাইমুল। অবিরল বৃষ্টিতে পাগলিকে ভিজতে দেখে মনটা একটু হু হু করে তার। থামার কোনও লক্ষণ নাই, ক্রমশঃ চৈত্রের আকাশটি দিনদুপুরে ঘন আষাঢ় হয়ে যায়। নিন্দাপতি পোকাগুলো কখন তাদের চরকাকাটা কিরকিরকিরকিরকিরকির সঙ্গীত থামিয়ে মেঘ-বাদলের কাছে পরাজিত হয়ে বোবা হয়ে গিয়েছিলো , কারো খেয়াল হয়নি । তাছাড়া লোকজন আস্তে আস্তে কমতে শুরু করেছে ।
নাইমুল ভাবে পাগলিকে তো তেমন কিছু খেতে দেখি না। বেঁচে আছে কিভাবে ? ভিজা কাউয়ার মতো থরথরিয়ে কাঁপছে।তবু ডাকলে আসবে না চালের নিচে বসবে না।এদের সাথে সম্ভবত জ্বীন পরী থাকেই।নইলে কিভাবে সম্ভব ?
পাগলিকে খেতে দেখেনি নাইমুল। কিন্তু তার কালো চিমসানো মুখখানি যে একসময় ‘সোন্দর’ ছিলো- বুঝতে অসুবিধা হয় না নাইমুলের । কতোকাল হয়তো চুলে তেল দেয়নি, তবু কেঁপি কেঁপি নারকেলি চুল বড়ো ভালো লাগে তার। অন্তরে দয়াময় হয়ে ওঠে সে মাঝে মাঝে, ধোঁয়া-ওড়া চা-বিড়ি বিক্রির ফাঁকে ফাঁকে, লোকেদের নানান কিচ্ছা-গল্প-রাজনীতি-দেশোদ্ধারের অশ্লীল ছলনা-চর্চার ভেতরেও পাগলিনী উঁকি দেয়।
বৃষ্টির একটা আরামদায়ক অনুভূতি অন্তরে চারিয়ে দিয়ে নাইমুলও একটা সিগারেট ধরায়। পাগলীটির চেহারা সুরত তো এককালে ভালোই ছিলো মনে হয় তার। মনে হয় কোনও ভালো বংশের মাইয়া। কাছ থেকে যতবার দেখেছে, মেয়েটির কেঁপিকেঁপি নারকেলী চুল, শরীরের রঙ কালো কিন্তু একটা মায়া মায়া ভাব আছে। বিয়াশাদী অইছিলো কিনা কে জানে। নাকি সতীন ধুতুরা বিষ খাওয়াইয়া মাথা পাগল কইরা বার কইরা দিছে কে জানে !
সেদিন রাতে, দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে বাড়ি ফেরার সময়, দীর্ঘসময় জমে থাকা কাজের চাপে করা হয় নাই প্রশ্রাবের বেগ আসায়, তলপেট হালকা করার তাগিদে ধর্মসাগরের অন্ধকারকেই পুরুষেরা বেছে নেয় লুঙ্গি ফাঁক করে বসতে গিয়েছে, দিঘির পাড়ের অন্ধকারে হঠাৎ পাগলির চেঁচামেচিতে ভয় পেয়েছিলো নাইমুল। প্রশ্রাবের উষ্ণ পানি তার হাত-পা, লুঙ্গি সব একাকার করে তাকে নাপাক করে দিয়েছিলো। সে-সময়, নাইমুল জ্বীনে-পাওয়া পাগলীটির উপর বিরক্ত হয়েছিলো। মাগী চেঁচানোর আর সময় পাইলি না !
বৃষ্টি থামতে থামতে আসরের ওয়াক্ত শেষ। গোরস্তানের পাশের মসজিদ থেকে নামাজ শেষে, নামাজিরা তাদের পাঞ্জাবির লম্বা পকেট হাতড়িয়ে পাগলিকে দু’চার টাকা দেয়। কেউ একজন সম্প্রতি হজ্ব করে দেশে ফিরেছেন । তিনি, একহাতে নীল পাথরের তসবিহ-মালা, ‘বিসমিল্লাহ সোবহানাল্লাহ’ উচ্চারণপূর্বক কাগজে মোড়ানো মক্কাশরীফের কিছু খুরমা খেজুর দেন তাকে। নির্লিপ্ত হাতে সে-সব দানখয়রাত নেয় পাগলিনী। নিজে কিছু খায়, বেশির ভাগই তার অন্তঃসখা কুকুরটিকে দেয়। বৃষ্টি তুমুল বেগে আসবে অনুভব করে কুকুরটি বর্তমানে পালাতক । এখন বৃষ্টি থামা শুরু করেছে,হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই সে ফিরে এসে লেজ নাড়াতে শুরু করবে।
ঝড়-বাদল থেমে যাওয়ার পর, ধীরে ধীরে, পুনরায় নিন্দাপতি পোকাদের সুতো কাটার চরকা জেগে উঠেছে । কিরকিরকিরকিরকিরকির– গাছের ছাল-বাকল-পাতায় শরীরের রঙটি লেপ্টে রেখে নিন্দাপতিদের সুতো কাটার ধূম পড়ে যায়। নাইমুলের দোকানেও ভিড় শুরু হয়, বিশেষতঃ মাগরিবের আজানের আগে পরে, এশা পর্যন্ত ধর্মসাগরে হাওয়া খেতে আসা মানুষের ভিড় থাকে। বিক্রিবাট্টা ভালো হয় এই সময়টায়। মসজিদের মুসল্লীরা নামাজ শেষে চা বিড়ির ধূম লাগায়, নাইমুল অনেক সময় একা পেরে ওঠে না, বাপকে সঙ্গে রাখে। নাইমুলের বানানো মসলা মিশানো চা লোকেদের পছন্দ। তারা লাইন ধরে খায়। বিশেষ করে বিস্পতিবার, সামান্য দূরের কল্কিশাহের মাজারে গানবাজনা হয়, লোকসমাগম অন্যান্য দিনের তুলনায় বাড়ে। লোকেরা কল্কিশাহর মাজার ভ্রমণের পূর্বে অথবা পরে একবার ধর্মসাগরের হাওয়া খেতে ভোলে না। ফলে নাইমুলের দোকানেও তাহাদের পদচারণা। পাগলিও মাঝে মধ্যে তার নিজস্ব জীবনঘড়ি মিলিয়ে কুকুরটিকে সঙ্গে নিয়ে কল্কিশাহের চত্বরে চক্কর মেরে আসে। পলিথিনে মোড়ানো মানৎ-এর খিচুড়ি হাত-পা-গায়ের সাত পরল জোব্বাজাব্বি চ্যাড়াবেড়া করে কিছুটা খায়। তারপর একলা একলা রাজ্যের বিচার-আচার করতে করতে ঠিকঠাক মতোই দিঘির পাড়ে নিজের আখড়াটিতে ফিরে আসে। নাইমুলের দোকানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়, নাইমুল চায়ের কেটলিতে হাতের ব্যস্ততা সত্বেও চকিতে দেখেছিলো, বেডি এট্টু আগেই না ঝড়-বাদলে ভিজলো, শরীর দেইখ্যা তো মনে অয় খটখটা শুকনা। এরকম ভাবনার ভেতর সে পুনরায় ভেবেছে , পাগলি টা তো দেখতে খারাপ না!
পূর্ণিমার কোনও চৈত্র-আশ্বিন নাই। এক দুপুর এক বিকেল বৃষ্টি হওয়ার পর ধর্মসাগর দিঘির ওপর এখন , রাত্রিকালের আকাশের চন্দ্রটা চোখ ধাঁধানো জ্যোৎস্নার ঢল নামিয়েছে। মসজিদের শেষ নামাজিটি চলে যাবার পর , খাদেম সাহেব সামান্য আগে বাতি নিভিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন। যেহেতু আজ বিস্পতিবার, কল্কিশাহের মাজারে অশ্রুঝরা গান হবে , সেহেতু বেশির ভাগ লোক আস্তে আস্তে নাইমুলের দোকানের ভিড় ছেড়ে মাজারের ভেতর চলে গেছে। অবশ্য এইখান থেকেও গানবাদ্যের আওয়াজ কানে বাজে।
পাগলিনী তার সখা ন্যাংড়া কুকুরের সঙ্গে অনেক্ষণ গল্প করার পর, আসমান থেকে নেমে আসা জ্যোৎস্নার ঢলের আঘাতে ক্ষণকাল নিজেকে ফিরে পেয়েছিলো। ফকফকা চান্নি রাইতের দিকে তাকিয়ে তার মনে পড়েছিলো বাড়ির উঠোনে শীতলপাটি বিছিয়ে আসমানের তারা গোণার ধূয়া তোলা হতোঃ ‘একথাল সুপারি গুনতে পারে কোন বেপারী ?’ একথা মনে পড়ায় সে আরো ভেবেছিলো, ও মা গো, রাবিয়ার বাপে অর্থাৎ হালিম জেঠা কী বকাই না দিতেন, ‘শুয়োরের ছা, রাইত জাইগা আসমানের তারা গনতেছস ? মৌলভিরে কইয়া সব কয়ডারে পিঠের ছাল-বাকল তুইল্যা দিতে অইবো। মল্লিকার মায় কই গো ?’ তার একটু হাসি আসতেছিলো এক্ষণে নিজের নামটিও স্মরণে আসার কারণে মনে মনে শরমিন্দা।
কিন্তু নিশাচর বাদুড়েরা এ-সময় কই যেন উড়ে যাচ্ছিলো। ডানা ঝাপটানির সঙ্গে পাগলিনীর স্মৃতিকেও টেনে নিয়ে গেল। এ-সময় কুকুরটা এক দৌড়ে দিঘির কোন পাড়ে চলে যায় , বোঝা যায় না। সম্ভবত, সে ভৌতিক কোনও ছায়া দেখেছে।
বিস্পতিবার নাইমুল বাড়িতে যায় না। চায়ের লিকার শেষ হয়ে এলে ঝাঁপ বন্ধ করে দোকানেই ঘুমিয়ে নেয়। আজ সে একা নয়।ঝড়-বাদল মাথায় কইরা তার ছোটো ফুপু একগাদা পোলাপান নিয়া বেড়াতে এসেছেন।বয়সে তার চেয়ে কম হলেও ফুপাতো ভাই ইউসুফের সঙ্গে নাইমুলের বোঝাপড়াটা ভালো। রাতের খাবারের পর, ইউসুফও, মামার বাড়িতে ঘুমানোর জায়গার টানটান অবস্থা দেখে বলেছে , আমি নাইম ভাইয়ের লগে দোকানে থাকমু।
রাত্রি গভীরের সঙ্গে কল্কিশাহ মাজারের বাদ্যবাজনা ভৌতিক জ্যোৎস্নায় একাকার হয়ে যায়। ততক্ষণে নিন্দাপতি পোকাদেরও, সম্ভবত, চরকা কাটার গান সমাপ্ত। আগামী কালের প্রস্তুতিতে এখন ঘুমঘোরে আচ্ছন্ন।
সারাদিনের পরিশ্রম সত্ত্বেও, দোকানের ভেতর, শীতলপাটি বিছানো সরু বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়ে কী জানি কী কারণে নাইমুলের চোখে নিদ্রা নাই। পাশেই তার ফুফাতো ভাই ইউসুফ টের পেয়েছিলো ,নাইম ভাই বড়ো বেশি ছটফট করতেছে। বার কয়েক তার গলায় উরুতে অকারণে হাত এসে পড়েছে। স্বভাবে অন্তর্মুখি লাজুক ইউসুফ ভেবেছে, ব্যাপার কি এই লোক না জানি আমাকেই ধরে বসে! ইউসুফ একবার বলেছে, ও ভাই, চলেন কল্কিশাহ’র মাজারটা ঘুইরা আসি।
‘ধুর! বালের মাজার। ওইখানে দাঁড়ান যায় নি ? ভিড়ের মইধ্যে দাঁড়াবি, পোলারা তোর ধন হাতাইয়া গরম কইরা দিব। বাদ দে।’
ইউসুফ কিছু বলে নাই।লাজুক হাসিতে অন্ধকার দোকানটি চাঙা করে তুলেছিলো সে। মাজারের ঘটনা সে নিজেও কিছু কিছু জানে। কিন্তু মশার ভ্যানভ্যানানিতে এখন প্রকৃতপক্ষেই দু’জনের একজনেরও স্বস্তি লাগছে না। অস্থিরতা বাড়ছে।
নাইমুল বলল, ‘ও ইছুফ, চলছেন, দিঘির পাড়ডা ঘুইরা এট্টু ঠা-া অইয়া আসি। চোৎমাতের মোশার জ্বালায় ত ঘুমান যাইবো না আইজ । মশারি টাঙাইলে ত দম আটকাইয়া যায় আমার। চল, এট্টু ঘুইরা আসি।
মশারি না হলেও ইউসুফের সমস্যা হয় না। চৈত্রমাস কি জ্যৈষ্ঠমাস, সে ভারী কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘাম ও লালায় একাকার হয়ে দিব্যি রাত কাটায়। এ-নিয়ে নাইমুল তাকে ‘পাঁঠা-বলদ’ বলে ক্ষেপায়।
তেলতেলে কালো সুঠাম লাজুক, আঠারো-ঊনিশের ইউসুফ তার মামাতো ভাই নাইমুলের ভক্ত। বয়সের পার্থক্য থাকলেও মামার বাড়ি, ফুপুর বাড়ির মধ্যে পারিবারিক সখ্যতা-সম্পর্কের যৌথ রজ্জু তাদেরকে সবসময় দু’দিক থেকেই টানে। তারা ধর্মসাগর দিঘির ঠা-া বায়ু সেবন করতে রাত দুপুরে বের হয়ে পাতার বিড়ি ধরায়। পাতার বিড়ি কুমিল্লায় পাওয়া যায় না। আখাউড়ার তিতাস-কংসনগর থেকে আগরতলা বেশি দূরে না। ইউসুফ তার নাইম ভাইয়ের জন্য প্রতিবারই শুকনো খসখসে লাল সূক্ষ্ম সুতা পেঁচানো তাবিজের মতো পাতার বিড়ি নিয়ে আসে। দুই ভাই ঘুমানোর আগে পাতার বিড়িতে ‘সুকটান’ মারে। কখনওবা, বিড়ি টানতে টানতে নাইমুল অশ্লীল কথা বলে ইউসুফের গাল লাল করে দেয়। ‘কিরে ইছুফ, তুই দিন দিন এ্যাতো শুকাইতেছস ক্যান? খেঁচাখেঁচি বন্ধ কইরা মাইয়াগো দুধমুধ খাইছ মাঝে মইধ্যে, বুঝলি কিছু ! হা হা হা !’
এক বিছানায় দুই মামাতো-ফুফাতো ভাই বন্ধুসুলভ সখ্যতায় নানারকম হাস্যরস করে। রাত্রি গভীর হয়ে এলে, পাশাপাশি ঘুমের ভেতর পরস্পরের গলায়, নিম্নদেশে হাত চালায়। সকাল বেলা ঘুম থেকে জেগে পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়িতে লাজুক- এমন ভান করে যেন রাত্রিকালে কিছুই হয়নি।
তবে এখন ধর্মসাগর পাড়ে, দোকানের ভেতর নয়, তারা বাইরে, জ্যোৎস্নায় একটু শরীরটা ভিজিয়ে নিতেই এসেছে। মফস্বল শহর, তার উপর ধর্মসাগর দিঘি শহরের এক প্রান্তে হওয়ার মানুষের আনাগোনা নাই বললেই চলে। কাকপক্ষীও, গভীর নিরবতায়, সম্ভবত, কল্কিশাহের ভক্তবৃন্দের তা-বে স্তব্ধ। তারা শুনছে তাহাদের নিজ নিজ তন্দ্রার ভেতর।
পাগলীটি এখন আসমানের চাঁদের দিকে মুখ কইরা নিজমনে কী যেন বলছে। সম্ভবত, জ্যোৎস্নার ঢলকে আরো জোরেসোরে নেমে আসছে না কেন এই জন্য হঠাৎ হঠাৎ বকাঝকা করছে। সেসব শব্দ জোড়াতালি দিয়ে কোনও পূর্ণাঙ্গ অর্থবোধক বাক্য নির্মিত হয় না। তবে পূর্ণিমার চাঁদ ও তার ঝরানো আলোর ঢল চিরকালই বাকরুদ্ধ, ফলে পাগলিনীর কথায় নাইমুল নিদারুণ মজা পেলেও জ্যোৎস্নরাতের কিছুই যায় আসে না।
নাইমুল ইউসুফের ঘাড়ে হাত রেখে আরামে পাতার বিড়ি খাচ্ছে, যেন-বা, নিম্বপত্র নেশা নাই তবু একটা ভাব এর ছলনা যুবক মাত্রেরই আরধ্য। একা একা মানুষ ভাব দেখাতে পারে না। নাইমুল তার উচ্চমার্গের ভাব প্রকাশের জন্য অন্ততঃ একজনকে মাঝে মাঝে পায়। সে হচ্ছে ইউসুফ।
‘কি রে , করবি নি ? ’ জ্যোৎস্না-মাতাল শীর্ণকায় ভৌতিক কালো পাগলিনীকে ইংহিত করে বলে নাইমুল ।
এসময় নিম্বপত্রে সুকটান হেতু সুখাবেশে ইউসুফ তার লুঙ্গির ভেতর সরীসৃপের নড়ে ওঠা টের পেয়েছিলো । নাইম ভাইয়ের কথার ইংগিতে সে প্রথমতঃ কিছু না বলে গোপন সাপের আরামদায়ক নড়াচাড়া অনুভব করতে করতে চুপ হয়েছিলো।
নাইমুল জানে, ইউসুফ নিমরাজি। কিন্তু পাগলিনীকে আজকের এই চান্নি রাইতে অন্যরকম লাগছে কেন বুঝতে পারছে না নাইমুল। পাগলিকে যেদিন থেকে সে চোখের নজরে রেখে ভাবতে শুরু করেছিলো বিষয়টা এতখানি প্রবল হয়ে ওঠেনি কখনও। তাছাড়া সে ধর্মসাগরে দীর্ঘদিন ধরে চা দোকানটি সুনামের সঙ্গেই চালিয়ে আসছে। লোকসমাজ লোকলাজ বলে একটা জিনিস তার আগুন নিভিয়ে রেখেছিলো। মনে হয়েছিলো পাগল হাতানো তো এমন কিছু না। এখন, ইউসুফকে কাছে পেয়ে, সাহস বেড়েছে।তাছাড়া চাঁদে পাইলে যৈবন-ঢল পাগল-টাগল মানে না। নিম্বপত্রের ধোঁয়া-ওড়া নেশা দুই যুবককে চন্দ্রগ্রস্ত করে তুললে তারা ত্রস্তপদে পাগলিনীর কাছে চলে এসে তীক্ষè চোখে জ্যোৎস্নাঢলের তলে এক আত্মমগ্ন নারীকে আকাশের চাঁদের সঙ্গে তুমুল কথোপকথনে দোল-দোলায়মান দেখতে পায়।
ক্ষণে ক্ষণে স্মৃতি-বিদ্যুৎ চমকে উঠলে পাগলিনী চন্দ্রালোকের মহিমা অনুভবে নিজের ভেতরে বিস্মিত-বিহ্বল। ধর্মসাগর দিঘিও তাকে এ-সময়, আহ্বান করলে,সে ইচ্ছে করেছিলো একবার পানিতে নেমে সাঁতার কাটবে। সিঁড়িতে বসে,চকচকে রূপার ঢেউয়ের ভেতর সে দেখতে পেয়েছিলো মনসুরকে যে পুকুরের পাড়ে নুয়ে পড়া গাবগাছ থেকে টুব্বুর কইরা এক লাফ, পরনে কাপড় নাই সেই পরথম দেখা পুরুষ মানুষের উদাম শরীর বড়োই বে-শরম মনসুর, দক্ষিণকানির মোশরফের দাদির ভাঙা রসুইঘরে টাইনা নিয়া কয়,আয়, চুয়াচন্দন খেলবি ?
সেই সময় মা ডাক দিয়েছিলেন, ও মল্লিকা গো, তুই কই গেছচ..আর কত কইলজা পোড়াইবি আমার হারমজাদি শুয়োরনির ঝি !
মায়ের হাঁক-ডাক শুইন্যা পান-রাঙা মুখ মুনসুইরা পাগলা দিছিলো এক দৌড়–গুয়াগাছতলার গুয়ে আছাড় খাইছিলো মনে অয়। এরকম আত্ম-ইতিহাস-ভাবনা তাকে পেয়ে বসলে মুখভঙ্গিতে শাপলা ফুলের মতো একটা হাসি ফুটে উঠেছিলো।
ততক্ষণে নাইমুল তার ফুফাতো ভাই ইউসুফের অন্তরে চাঁদের আত্মঘাতী আগুনটি ধরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলো। উভয়ে লোলুপ চক্ষুতে দেখেছিলো, পাগলীটি কার সঙ্গে যেন একলা একলা কথা কয় আর হাসে।
তারা ঠিক করেছিলো, দিঘির পাড়-ঘেঁষা মসজিদের দেয়ালটির ওপাশটা অর্থাৎ গোরস্তানের সীমানায় বাসক ঝোঁপটাই অধিকতর নিরাপদ। মসজিদের আলো নিভানো বিধায় কেউ কিছু টের পাবে না।
ওই,তুই দ্যাখবি কেউ আসে কিনা , একথা বলেই চাঁদের আলোয় শাপলা ফুলের আধেক ফোটা হাসি নাইমুলের শক্ত হাতের তালুতে চাপা পড়ে। সে পাগলীকে পাঁজাকোলা করে একরকম চেঁচিয়ে বাসকমুড়ায় টেনে নিয়ে যায়। স্মৃতিরোমন্থনের এরকম একটা আকস্মিক বিঘœতার সাথে অপরিচিত পাগলী বার কয় কুঁই কুঁই করার চেষ্টা করে ভেবেছে , মুনসুর পাগলটার বাড়ি কই ? সে কোন দোকানের চাইল খায় গো?
কুকুরটি কোত্থেকে হঠাৎ ঘেউ করে উঠলে নাইমুলের অন্তরাত্মায় চিলিক মেরে একটা কামড় দেয়, কোন হারামখোর যেন বাসকতলার ঘাসে হাইগা রাখছে– বৃষ্টিভেজা কাঁচা গুয়ের ছিটায় পা পিছলে যায় তার। কিন্তু নাইমুল আজ আর শরীর পাতলা না কইরা ছাড়বে না।
মসজিদের কোণায় অবস্থান নেয়া ইউসুফ একটা ইটের টুকরা খুঁজে পেয়ে দরদি কুত্তাটিকে ধাওয়া করে সে।যদিও সে ভেবেছে , গোরস্তানে নেয়াটা কি ঠিক অইলো ? নাইম ভাই দোকানে নিলেই ত অইতো, এ্যাতো রাইতে ত আর কেউ চা খাইতে আইতো না !
বাসক গাছটি অনেক পুরনো। গোড়া শক্ত মোটা ভারী। সেখানেই পাগলিনীকে দাঁড় করিয়ে তার শরীরের বোটকা গন্ধময় সাত পরল জোব্বাজাব্বি ফাঁক করতে করতে, তাড়াহুড়ায়, তর সয় নাই ‘ওই মাগী, এত কম্বল পইরা আছচ ক্যান’ বলে সুড়ুৎ করে তার কামিনী-কাঞ্চনের নলটি, পাগলিনীর খটখটে কাষ্ঠবৎ সুড়ঙ্গে প্রবেশ করানোর সময়, অবলাটি ছাগলের মতো একবার ভ্যাঁ করার চেষ্টা করেছিলো। নাইমুলের হাতের থাবার চাপে সেই ভ্যাঁ ডাক জ্যোৎস্নার আলো দেখে নাই।
স্যা-েলে লাগা থিকথিকে গু আর গুয়ের গন্ধ নিয়ে দ্রুত কাজ সেরে অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে নাইমুল বলে, যা, এবার তুই যা। আমি পা টা ধুইয়া আইস্যা দাড়াইলাম।
সময় তো চোখের পলক বাতাসে বাইলপাতা নড়ে ওঠার মতো ।
নাইমুল হতবিহ্বল পাগলীকে যেভাবে দাঁড় করিয়ে চলে গেছে,যার কাছে মানব জীবনের কোনও বোধগম্য গন্তব্য নাই সে সেভাবেই স্তব্ধ হয়ে ছিলো ।
বয়স হয়ে এলে বৃক্ষদেরও অন্তর্গত চঞ্চলতা ঝাঁ ঝাঁ রোদ অথবা স্নিগ্ধ চন্দ্রালোকে কেঁপে ওঠে না । প্রাজ্ঞতার একটা ভাষাহীন স্তব্ধতা বাসক গাছটিকেও পেয়ে বসেছে, ফলে সে আচ্ছন্ন। একটি শীর্ণকায় অবলাকে বুক পেতে দিয়ে বাসক গাছটি শরমিন্দা হয়ে উঠেছিলো কথা কইতে পারে নাই।
ইউসুফের লুঙ্গি তুলতে দেরী হয় নাই। তার কাঠিতে আগুন তো ধরানোই ছিলো, তবু এই প্রথম তার আত্মহননের অভিজ্ঞতা, সারি সারি কবরের পাশে বাসক গাছটির অন্ধকারে, ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া পাগলিনীর কাছে ধরা খায় তার যৈবন রহস্য। বীর্য পতনের ভয়াবহ আরামের ভেতর, পাগলিনীর মুখের দিকে একবার ভালো করে তাকিয়েছিলো সে।
বাসক পাতার ফাঁক গ’লে চন্দ্রদিঘির চিরল-বিরল একটা ধারা মেয়েটির মুখে চোখে আবরণে একধরনের মায়াবিভ্রম তৈরি করেছে। আগুনের শেষ আঁচটি নিভে আসার পর, ইউসুফ দেখতে পেয়েছিলো গোরস্তানের সারি সারি কবর থেকে বেরিয়ে আসছে অসংখ্য কায়া। দৌড় দিতে গিয়ে ফিরে আসা কুকরটির ‘ঘেউ’ ডাকে সম্ভবত মসজিদের খাদেমটি জেগে ওঠে। দুয়ার খোলার শব্দ হয়। কুকুরের ডাকে আরো কুকুর কর্তব্য পালনে ছুটে আসতেছে এই ভাবনায় দ্রুত স্থান ত্যাগ করে পরস্পর অন্তরাত্মা দুই ভাই– নাইমুল আর ইউসুফ।
কল্কিশাহ’র মাজারও এখন কিছুটা চাঁদে পাওয়া বৈতাল। ধর্মসাগরে মুখ-হাত-পা ধুয়ে, দুই ভাই, নাইমুল-ইউসুফ কারো মুখে কোনও কথা নাই, প্রক্ষালণগত ‘অযু’র পবিত্রতা অন্তরে ধারণপূর্বক দোকানের ঝাঁপ খুলে ঘুমের আয়োজন করে।
পাগলিনী ভেবেছিলো আইজ এট্টু বেশি কইরা রান্না করবে । ঝড় তুফান মেঘ নামার কারণে চুলায় কিছুতেই আগুন ধরলো না। পোড়া কপালডা রে আমার ! অহন মেমান আইবো । তাগরে কি খাইতে দিমু ! কুত্তাডার পেডেও অনেক ভোক লাগছে।
বাসকতলে ভাবনার অতলে তলিয়ে যাওয়া পগলিনীকে খুঁজে পেয়ে ঠ্যাং-ভাঙা কুকুরটি তার রাত্রিকালীন কর্তব্যের সার্থকতা অনুভব করে লেজটি নেড়ে জ্যোৎস্নার নিচে কুঁই কুঁই করতে থাকে। তবে সেখানে কিছু অপরাধবোধও যে ছিল না তা নয় । ধর্মসাগরের চারপাশ তন্ন তন্ন করেও খাবার না পেয়ে সে, কুকুরটি, তিন ঠ্যাঙে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে গিয়েছিলো পূবালী চত্বরের দিকে। সেখানে, সারাদিনের ব্যস্ত নগরীর জমানো আবর্জনার ভেতর কিছু না কিছু খাবার পলিথিন মোড়ানো মুরগির নাড়ি-ভূড়ি-ঠ্যাং, ঘিয়ে ভাজা পোলাওয়ে গরুর হাড্ডিগুড্ডি- কিছু না কিছু মিলে।
রেদওয়ান খান, গল্পকার