শোয়েব নাঈম
‘পাড়ভাঙা জলের চৌকাঠ’ কবি হাবিব আহসানের আত্মোপলব্ধির নির্যাসে পরিমাপ করা এক গভীর জীবনবোধ এবং অন্তরাত্মার সিদ্ধি ও শুদ্ধি-কে নিবিড়ভাবে ভাবিয়ে তোলা সীমাহীন নির্মল পথরেখা। অনুভূতির নৈঃশব্দ্যকেই আত্মার স্বরলিপি ভেবে কাবিতামত্ত হাবিব আহসান তাঁর কাব্যগ্রন্থের নামকরণ করছেন ‘পাড়ভাঙা জলের চৌকাঠ’। এই অভিব্যক্তিময় নামের অনুরণনে আছে চিত্ররূপময়তাকে ধারণ করে কাব্যে নিঃসৃত হওয়ার কবির ঘোর আর্তি। যেন প্রখর ভাবার্থের বাক্যবিন্যাসে কবির বাকবিভূতির এক তীব্র অনুভূতি। চিত্রকল্পের সামান্যতা থেকে সৃষ্টির অসামান্যতায় সমার্থক করেছেন। এই চিত্রকল্প দিয়েই চিত্রত করেন কবি তাঁর কবিতা সৃজনের উদ্দেশ্য ও বিধেয়। যেটি এক প্রবল স্ব-অস্তিত্ব অন্বেষণের আচ্ছন্ন থাকা গভীর কাব্যিক অনুনাদ। যে আচ্ছন্নতায়, নামের বাকবন্ধে জলের ঢেউ পাড়ের বা তীরের প্রান্তভাগে এক মেদুর স্নিগ্ধতায় আছড়ে পড়ে কবির আন্দোলিত সৃষ্টি। যা উপলব্ধির কাব্যগতি সঞ্চার করেছে উৎসাহী কবিতা পাঠকদের চিত্রকল্পের বোধে। সেই বোধের থেকে গ্রন্থের পাতা উল্টালেই চোখ পড়ে ‘পাড়ভাঙা জলের চৌকাঠ’ এর কবিতাগুলি
এক প্রগাঢ় নিবিড়তায় কবির আকুতিকে জাপটে ধরে আছে কবির আসক্তি। বেহিসাবির মতো উড়তে চাওয়া তাঁর আসক্তিতে আছে, কাব্যকৃতিতে কবিগোত্রীয় হলেও তাঁর ডিএনএ ভিন্ন বা আলাদা। কবিতার চলনে গঠনে আলাদা ডিএনএ কবিকে নিয়ে যায় অনালোকিত অনিশ্চয়তাময় ভবিষ্যতের দিকে। এই চালচলন অনেকটাই উদ্ধত, উগ্র আর হিপনোটিক। এই ঔদ্ধত্য, এই তীব্রতা পাঠককে সম্মোহনের এক অমোঘ টানে কবিতার নিউক্লিয়াসের দিকেই ধাবিত করে। আত্মকে দর্শন করার পর, কবিতা সৃজনের পথে বৈচিত্র্যের ঐশ্বর্য সঞ্চার করেছেন। কবির সৃজনের সার্থকতা এটাই যে, নানান বিপরীতমুখী বিষয়কে পরস্পরের সঙ্গে সংঘাতে না জড়িয়ে দারুণ শান্তিপূর্ণ অবস্থানে মথিত হতে হতে ছড়িয়ে দিচ্ছেন কবিতাকে এভাবে
“ভেবেছিলাম তোমার জন্য
গিনিসোনার চেইন কিনে নিয়ে যাব
ভরিতে স্বর্ণের দাম লাখ টাকা
পেরিয়েছে শুনে পিছপা হলাম।
সুগন্ধি ফুলের তোড়া সব
বিক্রি হয়ে গেছে
দ-খাটা কুখ্যাত নেতার
সংবর্ধনা আয়োজনে।
হাতে কিছু নেয়া পুরোনো অভ্যাস
কী নেব কী নেব
শেষমেষ একমুঠো রোদ হাতে
রওনা হলাম কাক্সিক্ষত গন্তব্যে।
ক্রয়ক্ষমতার ঊর্ধ্বে
সোনা পণ্য ফুল পণ্য
রৌদ্র যদি কোনদিন পণ্য হয়
কী নিয়ে তোমার কাছে যাব!
যত আমি হৃদয়ের
সমান বিশাল হতে চাই
বাস্তবতার শাসনে পীড়িত হৃদয়
উল্টো তত খাটো হয়ে যায়। ”
(কবিতা : বাজার যখন ঊর্ধ্বমুখী, পৃষ্ঠা : ১০)
এই কবিতাটি হাবিব আহসানের অবিরল আত্মদর্শন ও আত্মবোধে অনুরক্ত তাঁর চেতনার সম্প্রচার। এই কবিতায় তিনি শুধু তাঁর বোধকেই অন্তর্ভুক্ত করেননি, পাঠককে বিষয়টি অবলোকনের জন্য ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য’ও করে তুলেছেন। কবিতার উৎপ্রেক্ষায় আছে কবির সেই মারাত্মক অক্ষমতা, সেই কর্কশ কন্ঠ এবং ইচ্ছের প্রীতি প্রদর্শন। কিন্তু হাবিব আহসানের কথনের ভঙ্গিতে আছে বাস্তববাদের যে চেনা ছক আছে তা থেকে অনেক বাইরের। তিনি নিজেকে বাস্তব থেকে বিচ্ছিন্ন করে জনপদের অভ্যস্ততাকে নিরীক্ষণ করেছেন।
কবিকে নিয়ে যায় অনালোকিত অনিশ্চয়তাময় এক ভবিষ্যতের দিকে, যা নিচের কবিতায় সম্প্রসারিত
“কবিতা দেয় না
ভাতকাপড়ের নিশ্চয়তা
বরং অনিশ্চয়তার ক্ষতচিহ্ন আঁকে
হৃদয়ের নরম পলিতে
কবিতা চাগিয়ে তোলে কষ্ট
মনোজগতের নিরীহ প্রকোষ্ঠে
ঝড় ওঠে আচম্বিতে;
শিল্পের চাবুক বিদ্যুচ্চমকিত!
জানালার শিক ছুঁয়ে হাত পাতি
ঝমঝম বৃষ্টির কয়েক ফোঁটা
যদি পড়ে তৃষিত তালুতে
মিললেও মিলে যেতে পারে
খরবেলা শেষে অনির্বচনীয় সুখ
সুখের প্রপঞ্চ দূর নীলিমায়
ভেসে থাকে একখ- মেঘ হয়ে
বৃষ্টি কি প্রত্যহ ঝরে! ”
( কবিতা: শিল্পের প্রহার; পৃষ্ঠা : ১৪)
অনিশ্চয়তাময় এক ভবিষ্যত সংযুক্তির তত্ত্ব হিসাবে এই
কবিতাটি পাঠককে স্পর্শ করছে। এই কবিতায় কবি ভবিষ্যতের তাঁর একটি আবেগীয় চিন্তা খুঁজে পেয়েছেন এবং সেই চিন্তাকে সংযুক্তি করে ভবিষ্যতের শব্দ খুঁজে পেয়েছেন।
এই কাব্যগ্রন্থের অনেক কবিতায় যখন পাঠের চোখ পড়ে, অনুসন্ধিৎসায় ভরপুর পাঠকের আটকে যায় অনুভূতির দৃষ্টি। অনুষঙ্গপ্রধান অদৃশ্যভাবে কিন্তু স্পর্শগ্রাহ্য কোনো এক নারীর অস্তিত্ব উপলব্ধির উপত্যকায় পাঠক অনুভব করে। অসম্ভব নিবিড়তায় জড়িয়ে ধরে এসব সম্পর্ক থেকে কবি পেয়েছেন নির্বাসনের অনুভূতি। জীবনবৃত্তান্তের মতো খন্ড-বিচ্ছিন্ন সেসব মুহূর্তগুলি তুলে ধরেছেন পাঠকবর্গের সামনেÑ
” অরন্ধনে রাঁধবো তোমায়
কালের রাধিকা-
আমলকী পাতা চুয়ে
ঝরছে শিশির
জল ধরে রাখি
চীনামাটি পাত্রে
কনকনে উত্তুরে হাওয়া
অম্লজান ভরে রাখি
কাচের বোতলে।
আগুন কোথায় পাবো?
আগুনে পোড়াবো না তোমায়
মাঝ গগনের
সূর্য থেকে চুরি করে আনা
গনগনে রোদে রাঁধবো বঁধুয়া।
চলবে জীবনভর
রন্ধনে ইতি নাই
একূল ওকূল দুইকূলে ভাসি
কুলবধূ কূল নাই। ”
( কবিতা: বঁধুয়া, পৃষ্ঠা : ৯)
আত্মধ্বংসের খেলায় কবি অনেক ভার্সকে পোয়েট্রিতে নিঃসৃত হওয়ার ঘোর আর্তিতে সৃজন করেছেন। এসব অন্তর্ঘাতময় সংবেদনশীলতার সন্ধিগুলি তখন ফরফর করে তাঁর চারপাশে শব্দ করতে থাকে। এসব পঙক্তিতে কবির দিশেহারাবোধ থাকে। মনোভাবনার এসব সন্ধিগুলিকে ব্যাপক অর্থে সাদামাটা করে রাখতে কবি সচেষ্ট হন এভাবে এবং গভীরতার বিচিত্র বিন্যাসে
” অন্ধগলি ডাক পাঠালো মন্দ হতে
আকাশপাতাল না ভেবে আজ চেপে বসি ছন্দ-রথে একটুখানি টলোমলো
আমি কিন্তু মানুষ ভালো।
রাত্রিবেলায় কে যেন আজ ফেঁদেছে ফাঁদ
ফুল ফুটেছে গাছের ডগায় তার ওপরে ঘোলাটে চাঁদ ফুলের গায়ে হুল ফোটাতে ভ্রমর এলো মনের দ্বারে
মাঘ আকাশের চন্দ্রদেবী চক্ষু মারে।
পুলিশ এবং বেশ্যা এখন বন্ধু আমার
রেতে শয়তান মন্ত্রণা দেয় রাস্তা ছেড়ে ঝোপে নামার।
আধবোজা দুই চক্ষু মেলি
আগড়বাগড় না বলে আজ আসল কথা বলেই ফেলি একার রাজ্যে আমিই হলাম রাজার রাজা
কব্জি তুলে স্যালুট হাঁকি দেখতে পেলে সরল প্রজা।
ভদ্রবেশী ভদ্রলোকের ভদ্রখানা সয়না প্রাণে আর রাতবিরেতে সত্যবাদী গুঁড়িখানার সঙ্গ চমৎকার
আমি কিন্তু মানুষ ভালো
এই যা একটু টলোমলো। ”
(কবিতা : রাত্রি যখন টলোমলো, পৃষ্ঠা : ৪৭)
কবিতায় কবি চোখ দিয়ে যা কিছু দেখেছেন তা দৃষ্টিগত, ত্বক দিয়ে যা কিছুই ছুঁয়েছেন তা স্পর্শগত। দীর্ঘশ্বাস ও অশ্রুর মাঝখানে যা কিছু চলে গেছে সবই কবির হারাকিরি বিস্ময়বোধ। কবির চিন্তা ও অনুশীলনের মাঝখানে যা কিছু আছে সবই ছন্দগত সমগ্রতাবোধ। এ যেন কাব্যবোধের ছদ্মবাস্তবতা। অভিজাত বেদনারা খুঁজে পায় ছন্দের সমর্পণে সরল ছান্দিক রীতিমুগ্ধতা
“মুখোমুখি দু’জন পথিক
নির্বাক দু’টি শিল্প গথিক
হয়তো মনে ফুর্তি ছিল
কিন্তু নীরব মূর্তি ছিল।
ভেতরে ঢেউ জোয়ারভাটা
ঠোঁটের আগায় কুলুপ আঁটা
বললো না কেউ একটি কথা
বইলো সময় ঠাঁই অযথা।
ধৈর্য্যহারা বাক্যহারা
অভিমানে সওয়ার তারা
যে যার পথে পা বাড়ালো
ঠান্ডা মাথায় হিসেব কষে
জানলো পরে জেদের বশে
যাবার পথে যা হারালো
সুযোগ ছিল কথা বলার
দু’জনে এক পথে চলার
স্মৃতির জাবর কাটছে শেষে
ভগ্ন হৃদয় হাপিত্যেশে।”
( কবিতা : মাশুল ; পৃষ্ঠা : ১৬)
‘পাড়ভাঙা জলের চৌকাঠ’-এ কবি হাবিব আহসান জলের ক্যানভাসে পাড়ের কাছে যে কাঠ বিছিয়েছেন, সেখানে অনেক না-বলা কথায় এপার-ওপার জুড়িয়েছেন হৃদয়-সংবাদী সাঁকো। কবিতার আত্মভারে গ্রন্থটি হয়েছে যেভাবে সময়ের মোহনিয়া, কবির অন্তর্গত নান্দনিকতায় পাঠক বিমুগ্ধ হয়েছে পরিশুদ্ধ আনন্দিতায়। হাবিব আহসানের অনুভূতিতে আছে বৈচিত্র্যের নানামুখিতা, কাব্যিক সম্ভাষণে সেসব দিয়েছে কবিকে উৎসপাঠের সম্মোহিত প্রতিভাস। কবি হাবিব আহসানের সেই সম্মোহিত প্রতিভাসের নাম ‘পাড়ভাঙা জলের চৌকাঠ’। এই কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি নিবিড়ভাবে পাঠ করলে দৃঢ়ভাবে উপলব্ধি হয় ক্ষমতা যখন মানুষকে দাম্ভিকতার দিকে নিয়ে যায়, তখন হাবিব আহসানের কবিতা মানুষের আচরণের সীমাবদ্ধতার কথা মনে করিয়ে দেয়। ক্ষমতা যখন মানুষের চিন্তার ক্ষেত্রকে সংকুচিত করে, তাঁর কবিতা মনে করিয়ে দেয় মানুষের অস্তিত্বের ঐশ্বর্য ও বৈচিত্র্যের কথা। ক্ষমতার কলুষিতাকে এই কাব্যগ্রন্থের পাঠ দিয়ে পাঠককে নির্মল করা যায়। তেমন মননের এবং সৃজনের মৈথুনে তাঁর কাব্যবাসনা ভাসিয়ে দিয়েছেন ‘পাড়ভাঙা জলের চৌকাঠ’-এ।
লেখক : শোয়েব নাঈম, সাহিত্য সমালোচক