জাহাঙ্গীর আজাদ:
একফোঁটা মেঘের চিহ্ন ছিলো না আকাশে, ঝড়বৃষ্টির কথাও ছিলো না তাই, দু’এক মোচড় দমকা বাতাসের ধাক্কাও গতরে লাগলো না কারও।
তামাম রাইতভর আলগা পলকা মরচে খাওয়া টিনের চালেও কোন ক্যাচক্যাচানির আওয়াজ শুনলো না কেউ। অথচ খুব সক্কালে রাফিজার জামাই, ঈশিতা নিশিথা অর্ণবের বাপ শুক্কুর রঙমিস্ত্রি তার শাদা হলুদ আর নীল রঙে থ্যাবড়ানো জিনসের উপর সেই রকমেরই দাগ ছোপঅলা খয়েরি জামাটায় বোতাম লাগাতে লাগাতে ঘরের দরজাটা খুলে বাইরে আসার সাথে সাথেই দৃশ্যটি তার চোখে পড়লো।
একঘর পরে এই বস্তির কেয়ারটেকার মোছেনার মা’র দুয়ারে দাঁড়ানো নধর কচি সজনে গাছটি, চার হাত উপর থেকে যেখানে তিনটি ডাল ত্রিশুলের মতো তিনদিকে ছড়ানো ছিলো, সেখানটায় ভেঙে দুমড়ে পড়ে আছে মাটিতে।
শুক্কুর মিস্ত্রি কোন ফাঁকে দিনের পয়লা আকিজ বিড়িটা ধরিয়ে ফেলেছে। বিড়ির ধোঁয়ালাগা লাল চোখে সে এবার দেখলো, ভেঙেপড়া সজনে ডালের একটা ভারী অংশ পাশের ঘরের নান্টু মিয়ার চালের নিচের কবুতরের খোপগুলোকে চাপা দিয়েছে।
নান্টুর বেশ ক’জোড়া কবুতরের বাস এই খোপে, এর মধ্যে ভাঙা ডালের চাপায় পড়ে ক’টা কবুতর মরেছে ডিম বাচ্চা সহ, ক’টা বেঁচে আছে, এই জরুরি বিষয়টি দেখার সময় নেই শুক্কুরের হাতে।
মোছেনার মা আর নান্টু মিয়ার ঘুম ভাঙিয়ে খবরটা যে দেবে, সেই ফুরসুতই বা কোথায়? সাতটার মধ্যে কাজ শুরু করতে না পারলে সোলেমান কন্ট্রাকটার, যে নিজেও তুখোড় রঙমিস্ত্রি, মা-বাপ-চৌদ্দগুষ্টিকে গালাগালির তোড়ে কবর থেকে টেনে উঠাবে।
শুক্কুর মিস্ত্রি দ্রুত জিইসি মোড়ের দিকে হাঁটা ধরলো। ডেবার
পাড়ের এই কালু হাজির বস্তিতে, যেখানে সে বউ বাচ্চা নিয়ে সাত বছর পার করে দিচ্ছে, সেই বস্তির প্রতিটি ঘরে তখনো কার্তিক মাসের শেষপক্ষে রাত্রিশেষের ঠান্ডায় টানা ঘুমের আমেজ।
শুক্কুর চলার গতি বাড়িয়ে দেয় আরও। জিইসি মোড় থেকে দুইবার বাস বদলিয়ে আবার দশ মিনিট পায়ে হেঁটে পৌঁছতে হবে বিশ্ব কলোনিতে, যেখানে আটতলা নতুন এক ফ্ল্যাটবাড়ির দেয়ালে রঙের কাজ করছে ওরা তিনজন মিস্ত্রি আর চারজন হেলপার গেলো এক হপ্তা ধরে।
সাতটা বাজার কিছু আগেই সে পৌঁছতে পারলো কাজকামের জায়গায়, অন্যরা পৌঁছে গেছে ইতিমধ্যে। দেরি না করে হেলপার বাদলকে নিয়ে শুক্কুর মিস্ত্রি ছাদে উঠতে থাকে সিড়ি ভেঙে ভেঙে। ছাদ থেকে টাঙানো মোটা দড়ি আর শক্ত পাকা বাঁশের টুকরো দিয়ে বানানো ঝুল সিড়িটি যেখানটায় ছিলো, তা আরও চারহাত বাঁয়ে সরিয়ে মজবুত করে আটকালো প্রথমে। পরখ করে দেখলো ঠিক মতো আটকেছে কী না।
ঝুল বেয়ে পাঁচতলা বরাবর যখন সে নেমে এসেছে, ঠিক সেই সময়ে কালু হাজির বস্তিতে শুক্কুর মিস্ত্রির বউ রাফিজার চিলের মতো চিৎকারে একসাথে ঘুম ভেঙে ধরমর করে উঠে বসে প্রতিটি প্রাণি।
‘অরে! মোছেনার মার গাছ পড়ি নান্টুইয়ার হকলডি কইতর মরি গেছেগৈ রে!’
অতঃপর সেই চিৎকারে গর্ত থেকে যেমন পিপড়ে বেরোয়, পোকা বেরোয়, তেমনি পিলপিল করে বেরিয়ে আসে পোকা মানুষগুলো তাদের তিনটা চারটা আন্ডাবাচ্চা সহ। এমন চেঁচামেচি শুরু হয়ে যায়, আশপাশের ঘুমন্ত ফ্ল্যাটবাড়িগুলোও যেন কেঁপে ওঠে।
নান্টু মিয়ার দশ জোড়া কবুতরের আট জোড়াই মারা পড়েছে চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে, মরেছে বাচ্চা ক’টাও। ভাঙা আন্ডার রসে চ্যাটচ্যাটে হয়ে আছে মাটি। একটা মাদী শুধু টিনের চালায় বসে থিরথির করে কাঁপে আর বাকি যে ক’টার লাশ পাওয়া যায় নি, তাদের কোন হদিস পাওয়া গেলো না চারদিক খুঁজেও।
অনেকদিন ধরে রাফিজা সকাল আটটা থেকে বিকাল চারটা, এই আটঘণ্টায় চারটা বাসায় বুয়ার কাজ করে। মাঝখানে চার ফুটি চিকন একটা উঠোনের দুইপাশ থেকে দুই সারিতে ছ’দুগুণে বারোটা সামনাসামনি ঘর নিয়ে কালু হাজির বস্তির সবচেয়ে পুরানো বাসিন্দা রাফিজা। এই বস্তির কোন মেয়েছেলে গার্মেন্টসে কাম করে না। সবাই আশেপাশের ফ্ল্যাটবাড়ির বুয়া। আর ব্যাটাছেলেরা রিকশা চালায়, ভ্যান গাড়িতে সবজি, জাম্বুরা, টুকরো করা আঁখ, আর লইট্যা মাছ বেচে। উঠতি কিশোর পোলাপানগুলা করে চায়ের দোকানে বয়ের কাজ আর টেম্পোর হেলপারি। শুধু রাফিজার জামাই রংমিস্ত্রির কাজের ফাঁকে ফাঁকে বাসাবাড়ির অলিগলিতে কাঁথা ফেরি করে বেচে শীতকালের দিনগুলোতে। রাফিজা এইসব কাঁথার কোত্থেকে যে যোগান দেয় তার হদিস শুক্কুর পায় না কখনো। তবে শুক্কুরের ধারণা, আশেপাশের বুয়াদের কাজ পাইয়ে দিয়ে যেমন কমিশন খায় রাফিজা, তেমনি কাঁথার কেনাদামের ভিতরেও কিছু একটা দুনম্বরি করে সে, কমিশন খায় শুক্কুরের থেকেও। নইলে কোত্থেকে এই কাঁথার গাট্টি আসে তার মধ্যে এতো গোপন রাখঢাক কেন রাফিজার?
শুক্কুর মিস্ত্রি কাজের শেষে নেশাভাঙ করে প্রায় প্রতিদিন ঘরে ফেরে। ঘরে এসে ভাত খায় কখনো সখনো, কোনদিন খায়ই না। শরীরটা হাড্ডিসার বলেই চোখ দুটো গর্তে। ওদিকে রাফিজার কালো তেলচুপচুপে গতর থেকে চেকনাই যেন টসটস করে ঝরে।
ইতিমধ্যেই বস্তির খিস্তিখেউড় স্পষ্ট দুইভাগে মারমুখি হয়ে পড়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যে দুই একটা মাথাটাথা ফাটবে। কিন্তু রাফিজার টাইম নাই। টাইম থাকলে সে নান্টুর পক্ষেই কোমর বেঁধে দাঁড়াতো। মোছেনার মাকে দুইচক্ষে দেখতে পারে না রাফিজা। বস্তির মালিক কালু হাজি মাসকাবারি ভাড়া তোলার জন্যে বুড়ি মোছেনার মাকে কেয়ারটেকার বানাবার পর থেকে ভাবখানা যেন সে-ই বস্তির মালিক!
আজ মাসের ছয় তারিখ। প্রায় নতুন ছিটের ম্যাক্সিটার ভিতর শরীরটা গলিয়ে রাফিজা একটু ফিটফাট হয়ে নেয়। মুখে একটু পাউডার ঘষে, শেষ হয়ে যাওয়া লিপস্টিকের গর্তে কড়ে আঙুল ঢুকিয়ে তলানিটুকু বের করে নিয়ে ঘষে মোটা মোটা ঠোঁট দুটোয়। বগলের কাছে নাক নামিয়ে শ্বাস টেনে একটু অস্বস্তি হলেও পরমুহূর্তে ঝেড়ে ফেলে মন থেকে। বেগম সাহেবার সাজগোজের টেবিল থেকে একটু সেন্ট মেরে দিলেই হবে।
তা আজ মাসের ছয় তারিখ। হয়তো আর একটা বিশেষ দিনও। সেরকমই ইশারা দিয়েছিলেন আশফাক স্যার। আজ হয়তো বকশিসের পরিমাণটা হতে পারে দ্বিগুণ। হতে পারে সাথে একটা শাড়িও। আচ্ছা শাড়িই যদি হয়, রঙটা কেমন হবে? স্যাররা বড়লোক মানুষ, ইচ্ছা করলে কী-ই না পারেন।
আমেনা হাইটসের চারতলার আশফাক স্যারের ফ্ল্যাটে দু’মাস আগে নুতন কাজ নিয়েছিলো রাফেজা। অন্য বস্তির মরিয়ম মানে মরিখালাও এই বাসায় কাজ নিয়েছে ক’দিন আগে। মরি খালা খুব ভোরে এসে ঘর ঝাড়ু দিয়ে, সাবান মাখা ন্যাকড়ায় ফ্লোর মুছে, বাথরুম পরিস্কার করে চলে যাবার পরপরই রাফেজা আসে। ওর কাম ময়লা কাপড় ধুয়ে ছাদে শুকোতে দেয়া, তারপর হাঁড়িপাতিল বাসনকোসন মেজে রান্নার শাক সবজি, মাছ মুরগি কাটাকুটি করে ধুয়ে রেখে যাওয়া। বেগম সাহেবা নিজেই রান্নাটি করেন।
রাফিজার চেয়ে অন্তত পনের বছরের বড় মরি খালা। দুই ছেলেই তার সিটি করপোরেশনের সুইপারের কাম করে, তাদের বিয়েশাদির কথাবার্তাও উঠছে আজকাল।
গত মাসের ছয় তারিখে এই আশফাক স্যার রাফিজাকে বেতন দিয়েছিলেন বারোশো টাকা আর হাতের মুঠোয় লুকোনো নোটটি তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন, তোমার বকশিশ। কৃত্রিম লজ্জায় রাফেজা যতোই না না করে, স্যার ততোই কাছে এগিয়ে আসেন, অবশেষে উপায় না দেখে স্যার বকশিসের হাজার টাকার নোটটা জোর করেই গুঁজে দেন রাফিজার হাতে। সুন্দরী বেগম সাব একটু আগেই ছেলেকে নিয়ে ইশকুলের জন্যে তড়িঘড়ি বেরিয়ে পড়েছেন।
রাফিজার তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে কারো নামই বস্তির অন্য ছেলেমেয়ের মতো ছলিম কলিম ছকিনা জরিনা নয়। যেসব ফ্ল্যাটে সে রোজ কাজ করতে যেতো, ওখান থেকে যেমন পেয়াজ রসুন আলুটার হাতসাফাই করতো, তেমনি তাঁদের ছেলেমেয়েদের নাম থেকে চুরি করেই রাফেজার দুই মেয়ের নাম হয় ঈশিতা নিশিথা আর ছেলের নাম অর্ণব।
আজকের এই বিশেষ সকাল বেলায় আমিনা হাইটসের যতোই কাছাকাছি যেতে থাকে রাফিজা, ততোই কেমন এক উত্তেজনা আর আনন্দ বুকের ভেতরটা দুরুদুরু কাঁপায়। আজ এই বাসায় তার বেতনের দিন। স্যার বেতনের সাথে হাতের ভেতর গুঁজে দেবেন বাড়তি কিছুও। আর সেটা নিশ্চয়ই এক হাজার টাকার কম হবার কথা নয়। কিছু কিছু ভালোমানুষ এতো ভালো কেন হয়!
গেটের মুখে মরি খালার সাথে দেখা হয়ে গেলো, কেমন আলুথালু দিশেহারা ভাবসাব। রাফিজাকে দেখে থমকে দাঁড়ায় মরি খালা। কাছে আসতেই হ্যাঁচকা টান দিয়ে ড্রেনের ধারে নিরিবিলিতে নিয়ে যায় রাফিজাকে।
‘অই কুত্তার বাইচ্চা আশফাইক্যার মুখত থু দিয়া আইছি। খবদ্দার রাফিনি। উপাস থাকিস, তারপরেও অই কুত্তার ঘরত কামে যাইস না কইলাম।’
রাফিজা স্পষ্ট দেখতে পায়, মরিখালার উপরের ঠোঁটের বাম দিকে রক্তের কালশিটে দাগ, কণ্ঠার হাড়ের নীচেও নখের আঁচড়টি ব্লাউজের ভেতর হারিয়ে গেছে। রাফিজার পেটের নাড়িভুড়ি মোচড়ে একদলা বমি উঠে আসে গলার কাছে।
রাতে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে ঘরে ফিরে শুক্কুর মিস্ত্রি। হড়কে পড়ে গিয়ে ঠ্যাং মচকে গেছে তার। সকালবেলায় এতো বড় হাঙ্গামাটা হয়ে গেল, তার কোন চিহ্ন বস্তিতে নেই। ভেঙে পড়া গাছটাও উধাও, সেই সাথে নান্টু মিয়ার কবুতরের খোপও।
রাফিজা শূন্য চোখ মেলে শুক্কুরের দিকে তাকায়। তার এখন গরম রসুন তেলে সোয়ামীর মচকানো পায়ে মালিশ দেয়ার কথা। সে কিছুই করে না, কিছুই দেখে না। বড়সড় দুইটা গাট্টি পড়ে আছে ঘরের কোণে। সংসারের তামাম জিনিস ধরে গেছে দুই বোঁচকায়। কাল ভোর হবার আগেই সে এই শহর ছেড়ে যাবে। শুকুইজ্যা আর পোলাপান যদি যেতে চায় যাবে। নইলে রাফিজা একাই। এই মরার শহরে আর একটা সকালও দেখতে চায় না সে।
জাহাঙ্গীর আজাদ, কবি ও গল্পকার