ইফতেখার মারুফ
ধরা যাক আপনি একজনকে ভালবেসে বিয়ে করলেন।সুখে সংসার জীবন পার করছেন। হঠাৎ একদিন সকালে উঠে দেখলেন আপনার স্ত্রী আপনার নানি হয়ে গেছে আপনি বনে গেলেন তার নাতি। এমন যদি হয়ে যায় কারো মাথা কি ঠিক থাকবে!এমন অবস্থায় পাবনার মানসিক হাসপাতালে স্থান হবে এটাইতো স্বাভাবিক। ড. আজমতেরও তেমন অবস্থা হয়ে গেল।ড. আজমত একজন বিশ্ববিখ্যাত গণিত বিশারদ। যত জটিল অংকই হোক ড. আজমতের কাছে তা নস্যি। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তিনি সমাধান করে ফেলতে পারেন। পিএইচ ডি করার জন্য তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গেলে সে দেশের সরকার তাকে আসতে দেননি। সে বিশ্ববিদ্যালয়ে তার চাকুরি হয়ে গেল। তাকে সে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের কথা বললে তিনি প্রথমে রাজি হননি। পরে ভেবে দেখলেন দেশে কাজ করার সুযোগ তেমন নেই। তিনি সেখানে থাকলে বরং ভাল করতে পারবেন।তবে তার ইচ্ছে বড় কোন কাজ করে সে কাজের বড় কোন স্বীকৃতি নিয়ে তিনি দেশে স্থায়ীভাবে ফিরে আসবেন। ড. আজমত দেশে ফিরলেন ঠিকই তবে অন্যভাবে।
আমাদের দেশের কৃতি সন্তান ড. আজমত। বিশ্বের যে কোন প্রান্তে জটিল সমস্যায় তার
ডাক পড়লে তিনি ছুটে যান। তিনি খুব সহজেই সূত্র মিলিয়ে সহজ করে দেন। তাই তার নামডাক ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বব্যাপী। অংকশাস্ত্রে তার অসামান্য অবদানকে স্বীকৃতি দিতে গণিতবিদদের জন্য সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার “ফিল্ডস মেডেল” পদক কমিটির কাছে তার নাম প্রস্তাব করা হয়েছে।এ খবরে সারা দেশে খুশির বন্যা বয়ে যাচ্ছে। ঠিক এমন সময় তিনি দেশে ফিরে এলেন।তার স্থান হল পাবনার মানসিক হাসপাতালে। গোটা বিশ্বের মতো দেশবাসিও হতভম্ভ।মনে হল দেশের আকাশে বিষাদের কালোছায়া নেমে এসেছে। দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী তার বাল্য বন্ধু। বন্ধুর এমন অবস্থায় তিনি সবচেয়ে বেশি মর্মাহত হলেন। তাকে যখন “ফিল্ডস মেডেল” পুরস্কার দেয়ার জন্য আলোচনা হচ্ছে তখন স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজেই ফোন করলেন ড. আজমতকে। ড. আজমত স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে জানালেন তিনি “ফিল্ডস মেডেল”পুরস্কার নিয়ে এবার দেশে স্থায়ীভাবে ফিরতে চান, দেশের জন্য কিছু করতে চান। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানালেন “ফিল্ডস মেডেল”পাওয়ার পর রাষ্ট্রীয়ভাবে তাকে সংবর্ধনা দেয়া হবে।তার সব কাজে সরকার পাশে থাকবে।তারপর দুই বন্ধুর মধ্যে কত আলাপ আলোচনা হল। হঠাৎ এমন দু:সংবাদে স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিদারুণ বিমর্ষ হয়ে গেলেন।স্বাস্থ্যমন্ত্রী তার সরকারি কার্যক্রমের অংশ হিসাবে সেদিন পরিদর্শনে গেলেন পাবনা মানসিক হাপাতালে। পরিদর্শনটা আরো পরে হত তিনি বন্ধু ড. আজমতকে দেখতে এ সময়ে পরিদর্শনের সময় নির্ধারণ করলেন।
ওয়ার্ডে ঢুকে তিনি থমকে দাঁড়ালেন, বুকের ভেতর কেমন যেন হু হু করে উঠল। তার বন্ধু এত বড় মাপের মানুষ, নিয়তির কি নির্মম পরিহাস মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে পাগলে মত আচরণ করছে। চুল তার উস্কোখুস্কো। কেতাদুরস্থ যার চলাফেরা ছিল, মলিন কাপড় চোপড়ে তাকে কেমন যেন পাগলের মতো লাগছে। তার বুকের ভেতর থেকে হাহাকারের দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে গেল। তিনি নিজেকে সামলে নিয়ে বন্ধুর দিকে এগিয়ে গেলেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী ভাবলেন বন্ধু তাকে চিনতে পারবেন না।কিন্তু দেখা গেল ঠিকই চিনতে পারলেন। তিনি হাত মেলালেন এটা সেটা নানা কথা হল।
এবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী তাকে জিজ্ঞেস করলেন,বন্ধু তোমারতো এখানে থাকার কথা না তুমি এখানে কেন?
প্রশ্ন শুনে ড. আজমত কেমন যেন অস্থির হয়ে গেলেন।তিনি যে মানসিক ভারসাম্যহীন সেটা বুঝা গেল।একটু পর ড. আজমত সুস্থির হলেন।তারপর একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলেন, সে সব কথা থাক বন্ধু।শুনলে তোমার মাথা গুলিয়ে যাবে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বললেন, আমার মাথা গুলিয়ে গেলে যাক তবু আমি তোমার কথা শুনব।
ড.আজমত বললেন,না বন্ধু এ সব বলে আমি তোমার মাথা গুলিয়ে দিতে চাই না।আমি চাই না আমার বন্ধুর দশা আমার মতো হোক। তোমর ঠিকানাও এখানে হোক।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী নাছোড়বান্দা, বন্ধু আমার দশা তোমার মত হলে হোক। তবু আমি শুনতে চাই।
ড. আজমত বলেন, না বন্ধু আমি জেনে শুনে তোমার ক্ষতি করতে চাই না।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবার বলেন, বন্ধু তোমার কথা আমি শুনবই শুনব। তোমাকে কি কাহিনী বলতে হবে।একবার চিন্তা করে দেখ আমার অবস্থাও তোমার মত হলে তো হলে ভালই হবে।দু’বন্ধু একসাথে সময় কাটাতে পারব। ছোটবেলার মতো দু’বন্ধু মিলে নিজেদের মতো থাকব। আনন্দে সময় কাটাতে পারব।কী মজাই না হবে ভেবে দেখ একবার।
এ কথা শুনে ড. আজমত ভাবে, ছোটবেলার বন্ধুকে কাছে পেলেতো ভালই হয়। দু’বন্ধু মিলে গল্পগুজব করে সময়টা আনন্দে কাটাতে পারব। এবার তিনি মাথার চুল হালকা করে টানতে টানতে বলেন, দু:খের নাকি সুখের কথা বুঝতে পারছি না। জীবনে কত জটিল জটিল অংকের হিসাব নিমিষেই মিলিয়ে ফেলেছি। এই অংকের হিসাবতো কিছুতেই আমি মিলাতে পারছি না।এই বলেই তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে উদাস হয়ে পড়েন। তার দু’চোখ বন্ধ হয়ে গেল।
একটু পরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী তাড়া দিলেন, বল বন্ধু বল,আমি অস্থির হয়ে আছি শোনার জন্য, কি অংক তুমি মিলাতে পারছ না।
এবার ড. আজমত চোখ খুলেন, জটিল অংক বন্ধু জটিল অংক।
যত জটিল হোক তুমি বল আমি শুনব।
এবার ড. আজমত বলতে শুরু করেন,তুমিতো জান চাকুরি হওয়ার পর আমি বাবা মাকে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে গিয়েছিলাম। এক সময় আমার বিয়ে হয়। বাবা মা স্ত্রীকে নিয়ে আমাদের সুখের সংসার ছিল। জানতো বিশ্বে করোনা হল। আমার মাও স্ত্রী দুজনই আক্রান্ত হল। প্রথমে মা এরপর আমার স্ত্রী মারা গেল। ইচ্ছে ছিল না বিয়ে করি। কারণ আমি স্ত্রীকে খুব ভালবাসতাম। তাই বাবাকে বললাম আমি বিয়ে করব না তুমি বিয়ে করো। বাবা বলেন আমার বয়েস হয়েছে। কোন সময় পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে হয় জানি না। তুই আমার একমাত্র সন্তান। তোকে সংসারি দেখে যেতে না পারলে আমি মরেও শান্তি পাব না। শেষে বাবার পীড়াপীড়িতে একজন মার্কিন বিধবাকে বিয়ে করলাম।আমার সে স্ত্রীর একটি মেয়ে আছে। বিয়ে করলাম একটি মেয়েও পেলাম। মেয়েটাকে আমি নিজের মেয়ের মতোই স্ন্হে করতাম।আমাদের সংসার জীবন বেশ আনন্দে কাটতে লাগল।ড. আজমত চুপ করে রইলেন।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী তাগাদা দিলেন,বন্ধু বলো বলো,আমি শোনার জন্য অস্থির হয়ে আছি।
ড.আজমত আবার বলতে শুরু করেন,বাবা স্ত্রী, মেয়েকে নিয়ে সুখে আমাদের জীবন কাটতে লাগল। এদিকে আমার বাবা আর মেয়ে একে অপরকে ভালবেসে বিয়ে করে ফেলে। তা হলে কি হল? আমার মেয়ে আমার মা হয়ে গেল, আমি আমার বাবার শ্বশুর হয়ে গেলাম। মেয়েতো মা-ই।তাই তাতে কোন সমস্যা হল না।
এদিকে আমার একটি ছেলে সন্তান হল।আমরা সবাই খুশি।আমার ছেলে আবার আমার নতুন মা’র ভাই সে হিসাবে সে আমার বাবার শালা। বাবার শালা মানে আমার ছেলে আমার মামা।তাতে কোন সমস্যা হল না।আমার বাবা,স্ত্রী,সন্তান আমার মেয়ে যে আবার মাও,সবাইকে নিয়ে আমাদের জীবন সুখেই কাটছিল।
এদিকে আমার বাবার একটি পুত্র সন্তান হল।বাবার পুত্র সন্তান মানে আমি একটি ভাই পেলাম। খুবই আনন্দিত হলাম। তবে তখন থেকেই জট পাকাতে শুরু করে। বাবা, স্ত্রী, সন্তান, মা, ভাইকে নিয়ে আমাদের সুখের সংসারে সুখ যেন ষোলকলা পূর্ণ হল। আমাদের জীবন বেশ আনন্দেই কাটছিল।হঠাৎ সেদিন সবকিছু গোলমাল পাকিয়ে গেল। আমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাসায় ফিরে দেখি আমার স্ত্রী আমার ভাইকে কোলে নিয়ে আদর করতে করতে বলছে, ওলে লে লে আমার আদরের নাতি ,তুমি আমাকে চেন? আমি তোমার নানি তুমি আমার নাতি। এ কথা কানে আসতেই আমার মাথায় তালগোল পাকাতে লাগল। মনে হল,আরে আমার ভাইতো আসলেই আমার স্ত্রীর নাতি আর আমার স্ত্রী তার নানি। আমার ভাইয়ের নানি মানে আমারও নানি,আমার ভাই আমার স্ত্রীর নাতি মানে আমিও আমার স্ত্রীর নাতি। ব্যাস এ কথা মনে হতেই আমার মাথায় মারাত্মক ঝট পাকিয়ে গেল। মাথা আউলা ঝাউলা হয়ে গেল। জীবনে অনেক জটিল অংকের সমাধান করেছি। কিন্ত আমার বউ আমার নানি আমি আমার বউয়ের নাতি এই অংকের হিসাতো আর মেলাতে পারছি না। ব্যাস তখন থেকেই যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমি সরাসরি এখানে।
ইফতেখার মারুফ, গল্পকার ও শিশুসাহিত্যিক