হানিফ ওয়াহিদ : আমার ঘরে একজন জাঁদরেল মহিলা বাস করেন। তার ভয়াবহ রকমের একটা গুন আছে। সেই গুনটা হচ্ছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমার ভুল ধরা।
আমি যেভাবে যেখানেই থাকি, আমার একটা খুঁত খুঁজে বের করবেই। খুঁত ধরা বিষয়ে মোটামুটি তাকে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন বলা যায়।
এই তুমি এখনও বিছানায় কেন? সোফায় ঠ্যাং তুলে বস কেন? নাক ডাক কেন? এমন বোকার মতো হাসো কেন, দেখতে তো পাগল ছাগলের মতো লাগে!
আমি বলি, আমি তো এমনই।
ইস্ত্রি ছাড়া জামা পরছো কেন,তুমি কি ফকির? মেয়েদের মতো সারাক্ষণ ঘরে কী কর, মুখে লিপিস্টিক লাগাও?
ইস্ত্রি করা জামা পরার পর,
এই, ঘটনা কী? একেবারে নতুন বরের বেশে কই যাও? নায়ক শাকিব খান সেজে কারে খুঁজতে যাও, বুবলি না অপুরে ? আয়নায় নিজের খোমা দেখছো? এখনও বাইরে কেন, ঘরে মন বসে না? বাজারে যাও নাই কেন? গরুর পিছনের ঠ্যাংয়ের
মাংস আনছো কেন, যেই গরু কিনছো সেই গরুর ঠ্যাং কি দুইটাই ছিল? তিন ঠ্যাংওয়ালা মুরগি আনছো কেন, মোরগ কই?
শুধু কেন, আর কেন?
মনে হয় মহিলা বিয়ের আগে ভুলধরা বিষয়ে পিএইচডি করে এসেছে। এখন আমার উপর এক্সপেরিমেন্ট করছে। আগামীতে এই বিষয়ে গবেষনা করে সে নোবেল পুরস্কার পাইলেও পাইতে পারে!
সেই মহিলা কে জানেন? আমার দুই বাচ্চার মা।
তার ধারনা, তার জীবনটা আমি একেবারেই ছ্যাঁড়াব্যাড়া কইরা দিছি। সে বলেই আমার সংসারে এখনো ঠিক আছে। অন্য মহিলা হলে কবেই আমার মাথায় গোবরের রস ঢেলে চইলা যাইতো!
তাকে বলেছি, দেখ, তুমি কিন্তু আমার বউ, প্রেমিকা না। প্রেমিকার মাইর খাইতেও ভাল্লাগে, বউয়ের মিষ্টি কথাও তিতা লাগে। বেশি ফালাফালি কইরো না। চিল্লাইয়া মার্কেট পাওন যাইবো না,,
সে বলে, প্রেমিকা সম্পর্কে ভালো জ্ঞান রাখ দেখছি, তা বিয়ের আগে কয়টা প্রেম করছিলা?
আমি বললাম, একটাও না।
বউ তাচ্ছিল্য করে বলল, তোমার বেবাক কথা অবিশ্বাস করলেও এই কথাটা বিশ্বাস করলাম। কারণ, প্রেম করতেও বুদ্ধি লাগে, যা তোমার নাই। প্রেম করতে মুরোদ লাগে।
বউরে কীভাবে বলি, আমি প্রেম করতে চাইছি কিন্তু প্রেম আমারে চায় নাই। কারন, প্রেম করতে হলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ফটকাবাজ, চাপাবাজ হতে হয়,মিথ্যুক হতে হয়। ইনিয়েবিনিয়ে পেতœীকেও পরি বলতে হয়, যা ছিল আমার স্বভাব বিরুদ্ধ!
তোমাদের মতো পুরুষ মানুষ আমি রগে রগে চিনি। এদের মতো খাইষ্টা প্রাণি পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টা নাই। তোমাদের হাঁটুর গোড়ায় গোড়ায় শয়তানি বুদ্ধি। তোমরা প্রেমিকার রঙঢঙও খুবই পছন্দ কর, বউয়ের ভালোবাসার কথা শুনেও পাতলা পায়খানা শুরু কর।
আমি উৎসাহ দিয়ে বলি, এইটা অবশ্য বউ একটা খাঁটি কথা বলছো। একেবারে গোল্ডেন এ প্লাস পাইছো। অন্য সময় যা বল সবই মাইনাস। এটা তোমার গ্রেট আবিষ্কার। বুঝা যাচ্ছে তোমার মাথা বোঝাই কিডনি!
বউ আমার দিকে তেরচা চোখে তাকিয়ে বলল, স্বীকার করলা, আমার মাথায় কিছু একটা আছে, তোমার মাথার মতো একেবারেই খালি নাই!
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, তোমরা বউরা আসলেই একটা প্যারা। সবকিছুতেই ভুল ধর। প্রেম করলেও কোনো পুরুষের বিয়ে করা উচিত না। বউয়ের চেয়ে প্রেমিকা হাজার গুন ভালো।
প্রেমিকা নিয়ে প্যারা নাই?
মোটেই না। প্রেমিকা তেড়িবেড়ি করলে সোজা ব্রেকআপ। বউ তেড়িবেড়ি করলে ব্রেকআপ তো দূর কী বাত, সেভেন আপও করা যায় না। দুনিয়ার সব মেয়ে গৃহপালিত জামাই পছন্দ করে। জামাই যত বলদ হয়,বউ তত খুশি হয়। জ্ঞানী জামাই কেউ পছন্দ করে না।
তুমি বোকা, না জ্ঞানী?
অবশ্যই জ্ঞানী। জ্ঞানী না হইলে তোমাকে নিয়ে এতো বছর সংসার করলাম কেমনে? বলদ হইলে এতোদিনে আমাকে দিয়ে হালচাষ করাইতা। তবে আমাকে নিয়ে তোমার গর্ব করা উচিত।
বউ তিড়িংবিড়িং করে লাফিয়ে উঠে বলল, কেন? তোমার মতো ইবলিশকে নিয়ে গর্ব করার মতো কী আছে?
আমি শার্টের কলারে টোকা মেরে বলি, তোমার চৌদ্দগোষ্ঠীর ভাগ্য আমার মতো নিরীহ, অব্যবহৃত, ইনটেক, জ্ঞানী একটা জামাই পাইছো,,,
বউ তাচ্ছিল্য করে বলল, তুমি নিরীহ? হাউ ফানি, জরিনার নানি! তুমি একটা মিচকে ইনটেক শয়তান। তুমি ভালো মানুষ হইলে শয়তানও ফেরেস্তা।
বাচ্চারা বিরক্ত করলেই বউ তেজ দেখিয়ে বলে, তোমার বাচ্চারা তোমার মতোই ফাজিল হইছে। এইসব ফাজিদের একা সামলানো যায়? আমি বলেই তোমার সংসার করছি,,,অন্য কেউ হলে কবে,,, জীবন আমার ভাজাভাজা, তেজপাতা কইরা ফালাইলো!
আমি বলি, তাহলে কি ওদেরকে সামলানোর জন্য ওদেরকে আরেকটা নতুন ইনটেক মা এনে দিবো?
বউ তখন আমার দিকে কটমট করে তাকায়, তারপর বিড়বিড় করে বলে, বিড়াল পালতে জানে না, তার আবার সিংহ পালার শখ! আমি বলি, চেষ্টা করতে দোষ কী? চেষ্টায় মিলায় বস্তু আলসেমিতে বহুদুর!
এই মহিলাকে আমি একেবারেই বুঝতে পারি না। যখন মেজাজ মর্জি ভালো থাকে, তখন একেবারে পানির মতো সরল। সেসময় এমন মধুর করে কথা বলে, মনে হয় ঢাকা শহরের সব মিষ্টির দোকান তার মুখের ভিতরে। কথায় রস একেবারে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ে। এমন চোখে তাকায় যেন আমরা প্রেমিক প্রেমিকা। আমেরিকা আর ইসরাইলের যে সম্পর্ক, আমাদের সম্পর্ক তার চেয়েও মধুর। তখন তার কথাবার্তা শুনে মনে হয়, এই দুনিয়ায় একটাও যদি ভালো স্বামী থাকে, সে হচ্ছে আমি!!
তখন কী যে ভালো লাগে! মনে হয় এমন বউ একটা কেন পাঁচটা থাকলেও সমস্যা নাই!
আর যখন মেজাজ গরম থাকে?
চিড়তার রস যেন তার মুখ থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ে। মনে হয় তার মা সারাজীবন তাকে শুধু করলার রস খাইয়েছে, ভুল করেও একফোঁটা মধু খাওয়ায় নাই। আমাকে একেবারে বারবিকিউ বানিয়ে ফেলে। আমাদের সম্পর্ক হয়ে যায় ইসরাইল ফিলিস্তিনের মতো। সারাক্ষণ ধমকের উপর রাখে। কথায় কথায় ভারত পাকিস্তানের মতো আচরণ করে। আমি যে আস্ত একটা মিচকে শয়তান তা প্রতি মিনিটে মিনিটে মনে করিয়ে দেয়।
বউয়ের ধারণা সংসারে আমি ভারত সে বাংলাদেশ, সব সময় তার সাথে বড়ভাই সূলভ আচরণ করি। আমি মনে করি উল্টোটা। সে ভারত, আমি বাংলাদেশ!
ঝগড়া করে মাঝে মাঝে যখন আমাকে ছেড়ে বাপের বাড়ি চলে যাওয়ার হুমকি দেয়, তখন আমি সরলমনে মানিব্যাগ খুলে ভাড়ার টাকা এগিয়ে দেই। এতে সে আমাকে আরও সন্দেহ করে, নাক দিয়ে শার্টের ঘ্রাণ শুকে দেখে বাইরে পরকীয়া করছি কিনা!
আমি প্রায়ই বলি, আমার বুদ্ধি হাঁটুর নিচে হলে তোমার বুদ্ধি পায়ের পাতায়। এই বুদ্ধি নিয়া ঘরসংসার কর কেমনে? তোমার বিয়া করা উচিত হয় নাই। তোমার উচিত ছিল রসের বাইদানী হয়ে সাপের খেলা দেখানো।
সে বলে, এই পায়ের পাতায় বুদ্ধি দিয়েই তো তোমার মাথা চিবিয়ে খাচ্ছি। কোন মশলাপাতিরও দরকার হয় না। বুদ্ধি আরেকটু উপরে হলে কী হইতো ভেবে দেখ। পায়ের পাতায় হলেও তো বুদ্ধি আছে। তোমার মাথায় আছে শুধুই গোবর!
আমি বলি, আর বিয়ের পর থেকেই সেই গোবর মাথা তুমি মসলা ছাড়াই চিবিয়ে খাচ্ছ? ওয়াক থু!
কথা শুনে বউ আমার দিকে এমন কঠিন দৃষ্টিতে তাকায়, নায়িকা মৌসুমীও ভিলেন মিশা সওদাগরের দিকে এমন করে তাকায় না। আমি অবশ্য কথা বলার সময় খেয়াল রাখি, তার হাতের কাছে ছুঁড়ে মারার মতো কিছু আছে কিনা!
হাতের কাছে কিছু থাকলে একটু দুরে গিয়ে বলি, তোমাকে ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করছি, জীবনেও আর পুলিশের মেয়ে বিয়ে করবো
না। নেভার এভার! তুমি নিজে শত অনুরোধ করলেও না। পুলিশ বাইরে মাস্তানি করে। তোমরা কর ঘরে।
আমার কথা শুনে এমন লুক মারে, হিমালয় পর্বত পর্যন্ত পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ার কথা!
বলাবাহুল্য, বউ পুলিশের মেয়ে।
মাঝে মাঝে বউকে বলি, দেখ বউ, নায়িকা শাবানার মতো হতে পার না? গরিব ঠেলাওয়ালা জসিম শাবানাকে সেলাই মেশিন কিনে দেয়, দুই বছরের মাথায় জসিমকে শাবানা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির মালিক বানিয়ে দেয়। আর তুমি? বিয়ের আগে ছিলাম লাখপতি, এখন হইছি হাজারপতি। দুইদিন পর তো ফকিরপতি হয়ে যাবো। রিনা খানের মতো আচরণ কর কেন?
বউ রওশন জামিলের মতো মুখ ঝামটা দিয়ে বলে, ভুঁড়ির দিকে তাকাইলে তো মনে হয় তুমি প্রেগন্যান্ট। পেট বোঝাই শয়তানি বুদ্ধি। তোমার আচরণ হইলো ডিপজল, মিশা সওদাগরদের মতো, আর বউ চাও শাবানা! তুমি শাহরুখ খান, সালমান খান হইতে পারো না?
বউ রে কেমনে বুঝাই, ডিপজল মিশা সওদাগররা ভিলেন হইলেও কোনদিন মৌসুমী, শাবনুরদের পিছনে লাইন মারে না। শাহরুখ খান সালমান খানরা পিয়াংকা চোপড়া কাটরিনা কাইফদের পিছনে তো ছোঁক ছোঁক করে!
বউ অবশ্য কখনোই আমার সাথে তর্কে পারে না। সবসময় তর্কে আমি জয়লাভ করি। বউকে হারিয়ে দেই। জয়ী হবার টেকনিক আমি ভালো করেই জানি। বেশি রেগে গেলে শুধু কাছে গিয়ে হাত ধরে বলি, ক্ষমা দেও বউ, আমার ভুল হইছে!
সাথে সাথে আগুন গলে বরফ হয়ে যায়!
যেদিন আমার উপর বেশি রেগে থাকে, কাছে গেলে ধমক দিয়ে বলে, এই সাবধান! কাছে আসবে না, তোমাকে দেখলেই আমার বমি আসে। একদম কাছে আসবে না। কাছে আসলে ডাইরেক্ট খুন করে ফেলবো। আমার সাপ বিচ্ছু দেখলেও আদর করতে ইচ্ছা করে। তোমাকে দেখলেই মনে হয় খুন করি!!
তখন সুন্দর একটা চিকন বুদ্ধির টেকনিক কাজে লাগাই। পায়ের পাতায় বুদ্ধি তো তাই বুঝতে পারে না।
আমার মাথাধরা রোগ আছে। প্রায়ই মাথা ধরে। বউ নরম হাতের পরম ছোঁয়ায় কিছুক্ষণ মাথা টিপে দিলেই সেরে যায়।
ঔষধের দরকার হয় না।
সে আমার উপর রাগ করলেই আমি মাথা ধরার ভান করে শুয়ে পড়ি। যত রাগই থাকুক বউ তক্ষুনি দৌড়ে এসে টিপাটিপি শুরু করে। আমি তখন রাগ করে উঠে যেতে চাই। সে ধমক দিয়ে বলে, এই সাবধান, একদম উঠবে না, খুন করে ফেলবো। নট নড়নচড়ন!
আমি ভয় পাওয়ার ভান করে শুয়ে থাকি।
একদিন বউ মাথা টিপছে, আমি বললাম, যদি সাহস দেও, তাইলে একটা কথা বলি?
বউ বলল, কী কথা?
ভয়ে বলবো, নাকি নির্ভয়ে?
সে চোখ গরম করে বলল, তোমার মতো ফাজিলের নির্ভয়ে বলার দরকার নাই। ভয়ে ভয়ে বল।
আমি খুবই নিরীহ গলায় বললাম, আচ্ছা, বল তো, তোমার মতো এতো পাঁজী একটা মহিলার সাথে আমি এতো বছর কাটালাম কেমন করে!
বউ পারে তো তক্ষুনি আমাকে খুন করে!
আমি বললাম, পারলে না তো! আসলে তোমাকে জড়িয়ে ধরে না শুইলে, তোমার গায়ে ঠ্যাং তুলে না দিলে আমার ঘুম আসে না। শুধু এই একটা কারনেই তোমাকে আমার সারাজীবন সহ্য করে যেতে হবে। গায়ের উপর ঠ্যাং রাখার জন্য হলেও প্রতিটি পুরুষের একটা করে বউ থাকা উচিত!!
সে মাথা টিপতে টিপতে বলল, আর কিছু?
আশেপাশে ঝগড়া করার জন্যও একটা মানুষ থাকা চাই। ঝগড়া করার জন্য আদর্শ প্রতিপক্ষ হচ্ছে বউ। কেউ কাউরে নাহি ছাড়ে সমান সমান!
আমার কথা শুনে বউ মিটিমিটি হাসে। তখন কী যে ভালো লাগে!
বউটা আসলেই পাঁজি।
আমার সুগারের সমস্যা আছে। সে আমাকে ঠিক সময়ে ঔষধ খেতে বাধ্য করে। ঠিক সময়ে নাস্তা খেতে, ঘুমাতে বাধ্য করে। সকালে আলসেমিতে ধরলে জোর করে তুলে ফজর নামাজ পড়তে বাধ্য করে।
সে আমাকে সময়ের কাজ সময়েই করতে বাধ্য করে।
এমন পাঁজী বউয়ের পাল্লায় পড়ে মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে উঠি।
তবে এই হাঁপিয়ে উঠায় সুখ আছে।
আমার মনে হয়, মাঝে মাঝে হাঁপাতে হয়, নইলে জীবন একঘেয়ে হয়ে যায়। একঘেয়ে জীবন কার ভালো লাগে?
দাম্পত্য জীবন হতে হয় টক ঝাল মিষ্টি। সেখানে ভালবাসা থাকবে। সুখ, দুঃখ হাসিকান্না সবই থাকবে। থাকবে খুনসুটিও। একঘেয়ে সুখও বিরক্তিকর। অতি সুখও একধরণের অসুখ।
অতিরিক্ত কোন কিছুই ভালো নয়। হউক সেটা ভালোবাসা অথবা ঘৃণা।
হানিফ ওয়াহিদ, গল্পকার