এখন সময়:সন্ধ্যা ৬:৫২- আজ: সোমবার-২৮শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-১৫ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-গ্রীষ্মকাল

এখন সময়:সন্ধ্যা ৬:৫২- আজ: সোমবার
২৮শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-১৫ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-গ্রীষ্মকাল

বাঁশি: চিরন্তন বাংলার গৌরব ও  ঐতিহ্যের নিজস্ব সুর- নবম পর্ব

নাজমুল টিটো

 

প্রান্তিক (১৯৩৮) রবীন্দ্রনাথের কাব্য রচনার “অন্ত্যপর্ব”-র অন্তর্গত এক অনন্য সৃষ্টি। এই কাব্যের কবিতায় মৃত্যুচেতনা প্রাধান্য পেয়েছে এবং অধিকাংশ কবিতা অন্তমিলবর্জিত মহাপয়ারে লেখা। ৫, ৭ ও ৯ সংখ্যক কবিতায় কবি তাঁর বিচিত্র বেদনা ও আজন্মের স্মৃতি মন্থনে সুর তুলেছেন চিরসঙ্গী বাঁশিতে।

 

(২৩৬)

“পশ্চাতের সহচর, ছিন্ন করো স্বপ্নের বন্ধন; রেখেছ হরণ করি মরণের অধিকার হতে

বেদনার ধন যত, কামনার রঙিন ব্যর্থতা-

মৃত্যুরে ফিরায়ে দাও। আজি মেঘমুক্ত শরতের দূরে-চাওয়া আকাশেতে ভারমুক্ত চিরপথিকের বাঁশিতে বেজেছে ধ্বনি, আমি তারি হব অনুগামী।”

 

 

এখানে কবি অতীত ‘পশ্চাতের সহচর’কে মিনতি করছেন এই বন্ধন ছিন্ন করার জন্য, কারণ তা তাঁর মরণের অধিকারকে হরণ করে রেখেছে ফেলে আসা জীবনের না পাওয়ার বেদনা। কবির কাছে মৃত্যু মানে চিরপথিকের ভার মুক্তি আর সেই পথে কবি হবেন অনুগামী।

 

[৫, প্রান্তিক]

(২৩৭)

“ধন্য এ জীবন মোর- এই বাণী গাব আমি, প্রভাতে প্রথম-জাগা পাখি যে সুরে ঘোষণা করে আপনাতে আনন্দ আপন। দুঃখ দেখা দিয়েছিল, খেলায়েছি দুঃখনাগিনীরে ব্যথার বাঁশির সুরে।

নানা রন্ধ্রে প্রাণের ফোয়ারা করিয়াছি উৎসারিত অন্তরের নানা বেদনায়।”

 

কবি এই জীবনে যা কিছু পেয়েছেন সবকিছু তাঁর কাছে গৌরব ও ঐশ্বর্যের। জীবন দেবতার অপার মহিমায় প্রাপ্ত নিজের যত আনন্দ, যত দুঃখ, সবকিছু তাঁর একান্ত আপনার ধন। এই ধনকে খেলিয়েছেন তিনি আপন বাঁশির সুরে।

“আজি বিদায়ের বেলা

স্বীকার করিব তারে, সে আমার বিপুল বিস্ময়।”

 

[৭, প্রান্তিক]

(২৩৮)

“দেখিলাম- অবসন্ন চেতনার গোধূলিবেলায়-

দেহ মোর ভেসে যায় কালো কালিন্দীর স্রোত বাহি

নিয়ে অনুভূতিপুঞ্জ, নিয়ে তার বিচিত্র বেদনা,

চিত্র করা আচ্ছাদনে আজন্মের স্মৃতির সঞ্চয়, নিয়ে তার বাঁশিখানি। দূর হতে দূরে যেতে যেতে

ম্লান হয়ে আসে তার রূপ, পরিচিত তীরে তীরে তরুচ্ছায়া-আলিঙ্গিত লোকালয়ে

ক্ষীণ হয়ে আসে সন্ধ্যা-আরতির ধ্বনি,

ঘরে ঘরে রুদ্ধ হয় দ্বার, ঢাকা পড়ে দীপশিখা, খেয়া নৌকা বাঁধা পড়ে ঘাটে।”

 

আড়াই তিন মাস অসুস্থতা থেকে আরোগ্য লাভের পর এই কবিতা লেখা বলে কবির উপলব্ধি এখানে অনেক শান্ত ও সংহত। জীবনীশক্তির গোধূলিবেলায় অবসন্ন চেতনা নিয়ে ভেসে চলেছেন কালিন্দীর স্রোতে। ভেসে চলেছে কবির এতদিনের অনুভূতিপুঞ্জ, এতদিনের সঞ্চিত বেদনা, আজন্মকালের স্মৃতির সঞ্চয় আর তাঁর প্রিয় বাঁশি। এই বাঁশি কবির কাছে এক ঘনিষ্ঠ প্রতীক। কারণ তাঁর সকল গোপন কথা শুধু এই বাঁশিই জানে।

 

[৯, প্রান্তিক]

সেঁজুতি (১৯৩৮) কাব্য রচনায় জীবনের শেষ প্রান্তে এসে কবি মৃত্যুচিন্তাকে নতুন করে উপলব্ধি করেছেন। পার্থিব জীবনের সকল মায়া ফেলে সকলকেই একসময় মৃত্যুর স্বাদ নিতে হয়। তাই অনিবার্য মৃত্যুর কথা ভেবে তিনি আর মৃত্যুকে ভয়  না করে মৃত্যু ভয়কে জয় করার চেষ্টা করেন এবং সেই উপলব্ধির আবেশ ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন দিগন্তের পানে তাঁর আপন বাঁশির সুরে।

 

(২৩৯)

“দায়-ভোলা মোর মন

মন্দে-ভালোয় সাদায়-কালোয় অঙ্কিত প্রাঙ্গণ

ছাড়িয়ে গেছে দূর দিগন্ত-পানে

আপন বাঁশির পথ-ভোলানো তানে।”

[অমর্ত, সেঁজুতি]

 

#প্রহাসিনী (১৯৩৯) ধরিত্রী ছেড়ে কবি চলে যাবেন কিন্তু তাঁর বাঁশি ফেলে যাবেন ধূলিতে। তাঁর বিশ্বাস বাঁশির মধ্য দিয়ে তিনি বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল। কারণ এই বাঁশিই হচ্ছে তাঁর কাব্য ও শিল্প সৃজনের প্রধান হাতিয়ার।

 

(২৪০)

“এর পর বাঁশি যবে ফেলে যাব ধূলিতে

তখন আমারে ভুলো পার যদি ভুলিতে।”

[আধুনিকা, প্রহাসিনী]

(২৪১)

“নাহি গান, নাহি বাঁশি,

দিনরাত্রি শুধু কাশি,

ছন্দ তাল কিছু নাহি তাহে;

নবরস কবিত্বের

চিত্তে জমা ছিল ঢের,

বহে গেল সর্দির প্রবাহে।”

[পত্র, প্রহাসিনী]

(২৪২)

“বাঁশি নেই, কাঁসি নেই, নাহি দেয় হাঁক সে, পিঠেতে কাঁপাতে থাকে এক-জোড়া পাখ সে-”

[লিখি কিছু সাধ্য কী, প্রহাসিনী]

 

# আকাশ প্রদীপ (১৯৩৯)

“আকাশ প্রদীপ” কাব্যগ্রন্থে কবি মানুষের জীবনের আনন্দ-বেদনা ও হতাশার কথা ব্যক্ত করতে গিয়ে বাঁশিকে ব্যবহার করেছেন প্রাসঙ্গিকভাবে।

 

(২৪৩)

“রন্ধ্রে রন্ধ্রে হাওয়া যেমন সুরে বাজায় বাঁশি,

কালের বাঁশির মৃত্যুরন্ধ্রে সেই মতো উচ্ছ্বাসি উৎসারিছে প্রাণের ধারা।”

[পাখির ভোজ, আকাশ প্রদীপ]

(২৪৪)

“গভীর রাত্রি; বাতাস লেগে কাঁপে ঘরের সাসি,

রেলের গাড়ি অনেক দূরে বাজিয়ে গেল বাঁশি।”

[যাত্রা, আকাশ প্রদীপ]

(২৪৫)

“বাঁশি থামল, বাণী থামল না-

আমাদের বধূ রইল

বিস্ময়ের অদৃশ্য রশ্মি দিয়ে ঘেরা।”

[কাঁচা আম, আকাশ প্রদীপ]

 

# নবজাতক (১৯৪০) এর ভূমিকা লিখতে গিয়ে কবি নিজেই বলেছেন তাঁর “কাব্যের ঋতু পরিবর্তন ঘটেছে বারে বারে। প্রায়ই সেটা ঘটে নিজের অলক্ষ্যে। কালে কালে ফুলের ফসল বদল হয়ে থাকে তখন মৌমাছির মধু জোগান নতুন পথ নেয়। ফুল চোখে দেখবার পূর্বেই মৌমাছি ফুলগন্ধের সূক্ষ্ম নির্দেশ পায়, সেটা পায় চারদিকের হাওয়ায়। যারা ভোগ করে এই মধু তারা এই বিশিষ্টতা টের পায় স্বাদে। কোনো কোনো বনের মধু বিগলিত তার মাধুর্যে, তার রং হয় রাঙা, কোনো পাহাড়ি মধু দেখি ঘন, আর তাতে রঙের আবেদন নেই, সে শুভ্র, আবার কোনো আরণ্য সঞ্চয়ে একটু তিক্ত স্বাদেরও আভাস থাকে।”

এই কাব্যের ছত্রে ছত্রে কবি নীতিহীন মানবসভ্যতা, অধর্মের প্রবাহমানতা ও বিদেশী শক্তির ক্রূরতার প্রতি বিক্ষোভ প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে প্রতিবাদী সুর তুলেছেন তার বাঁশিতে।

 

(২৪৬)

“যে অতিথিদেহে ভোরবেলাকার

রূপ নিল ভৈরবী,

অস্তরবির দেহলিদুয়ারে

বাঁশিতে আজিকে আঁকিল উহারে

মূলতান রাগে সুরের প্রতিমা

গেরুয়া রঙের ছবি।”

[শেষদৃষ্টি, নবজাতক]

(২৪৭)

“সময়ের ঘড়িধরা অঙ্কেতে

ভোঁ ভোঁ ক’রে বাঁশি বাজে সংকেতে।

দেরি নাহি সয় কারো কিছুতেই-

কেহ যায়, কেহ থাকে পিছুতেই।”

[ইস্টেশন, নবজাতক]

(২৪৮)

“নেশা লাগে তোমার হাসিতে।

আমার বাঁশিতে

যখন আলাপ করি মূলতান

মনের রহস্য নিজ রাগিণীর পায় যে সন্ধান।”

[রোম্যান্টিক, নবজাতক]

 

# সানাই (১৯৪০) রবীন্দ্র কাব্য রচনার “অন্ত্যপর্ব”-এর অন্তর্গত একটি উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি। সানাই বাঁশি গোত্রের একটি সুরযন্ত্র। এটি এসেছে ফারসি শব্দ ‘শাহ্নাই’ থেকে, যার অর্থ বড় নল। যে শুষিরযন্ত্রের নলটি বড়, সেটিই সানাই। পারস্য থেকে যন্ত্রটি এই উপমহাদেশে আসে। রবীন্দ্রনাথ সুরশিল্পী ছিলেন বলে তাঁর লেখা কবিতা ও গানে বাঁশি, বীণা, সানাই প্রভৃতি সুরযন্ত্রের পাশাপাশি অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রের ব্যাপক ব্যবহার ও প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। সানাই কাব্যেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।

(২৪৯)

“ওগো দূরবাসী,

কে শুনিতে চাও মোর চিরপ্রবাসের এই বাঁশি-

অকারণ বেদনার ভৈরবীর সুরে

চেনার সীমানা হতে দূরে

যার গান কক্ষচ্যুত তারা

চিররাত্রি আকাশেতে খুঁজিছে কিনারা।

এ বাঁশি দিবে সে মন্ত্র যে মন্ত্রের গুণে

আজি এ ফাল্গুনে

কুসুমিত অরণ্যের গভীর রহস্যখানি

তোমার সর্বাঙ্গে মনে দিবে আনি

সৃষ্টির প্রথম গূঢ়বাণী।”

[দূরের গান, সানাই]

(২৫০)

“কম্পিত প্রদীপশিখা-‘পরে

তার চিহ্ন পদপাতে লুপ্ত করি দিলে চিরতরে;

প্রান্তে তার ব্যর্থ বাঁশিরবে

প্রতীক্ষিত প্রত্যাশার বেদনা যে উপেক্ষিত হবে।

[বিপ্লব, সানাই]

(২৫১)

“অরূপের মর্ম হতে সমুচ্ছ্বাসি

উৎসবের মধুচ্ছন্দ বিস্তারিছে বাঁশি।

সন্ধ্যাতারা-জ্বালা অন্ধকারে

অনন্তের বিরাট পরশ যথা অন্তর-মাঝারে,”

[সানাই, সানাই]

(২৫২)

“দেখতে পেলেম ছবি,

এই বিশ্বের হৃদয়মাঝে

বসে আছেন অনির্বচনীয়া, তুমি তাঁরি পায়ের কাছে

বাজাও তোমার বাঁশি।”

[পরিচয়, সানাই]

(২৫৩)

“সেদিন তুমি দূরের ছিলে মম,

তাই ছিলে সেই আসন-‘পরে যা অন্তরতম।

অগোচরে সেদিন তোমার লীলা

বইত অন্তঃশীলা।

থমকে যেতে যখন কাছে আসি,

তখন তোমার ত্রস্ত চোখে বাজত দূরের বাঁশি।”

[দূরবর্তিনী, সানাই]

(২৫৪)

“বহুদূরে বাজে তব বাঁশি,

সকরুণ সুর আসে ভাসি

বিহ্বল বায়ে

নিদ্রাসমুদ্র পারায়ে।”

[বাণীহারা, সানাই]

 

কবি’র চির প্রবাসের বাঁশি কিংবা দূরের বাঁশির সুর সঞ্চারিত করে দেয় দেহ ও মনে সৃষ্টির প্রথম গূঢ়বাণীর গভীর রহস্যখানি। এই বাঁশি বেজে ওঠে কখনো উৎসবের মধুচ্ছন্দে আবার কখনোবা সকরুণ সুরে।

(চলবে-)

 

 

নাজমুল টিটো, গবেষক ও প্রাবন্ধিক, ঢাকা

অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ হয় না

শোয়েব নাঈম শব্দের মধ্যেই থাকে জীবনের আসল দর্শন। শব্দের কারণেই মানুষ হয় নির্বাসিত। এখন মঙ্গলের অমরতায় ঘামছে গ্রীষ্মের বৈশাখ মাস। মঙ্গল এই শব্দবোধে যতটা কল্যাণ

চীনের মতো আমাদেরও ভাবা উচিত

আমির হোসেন চীনে ফেসবুক, ই’নস্টাগ্রা’ম, ইউটিউব, গুগল, গুগল ম্যাপ, হোয়াটসঅ্যাপ, এমনকি ক্রোম ব্রাউজারও ব্যান! শুরুতে শুনে বিরক্ত লাগলেও এখন বুঝতে পারছি- ওরা আসলে অনেক আগেই

গল্পশূন্য জীবনের ইতিকথা

আন্দরকিল্লা ডেক্স : আমাদের পূর্বপুরুষরা কৃষক ছিলেন, শ্রমিক ছিলেন। থাকতেন মাটির কাঁচা ঘরে। অর্থাভাবে-অন্নাভাবে কখনও-সখনও উপোসও করতেন। পরতেন মলিন পোশাকপরিচ্ছদ। আমাদের বাবারা চাইলেন আমরাও যেন

সংস্কার চাই : চট্টগ্রামের ক্রীড়াঙ্গন

নিখিল রঞ্জন দাশ সম্প্রতি চট্টগ্রাম এম.এ. আজিজ স্টেডিয়ামকে আগামী ২৫ বছরের জন্য বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারশনকে দেয়া হবে। তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচের আয়োজনে চট্টগ্রাম স্টেডিয়ামের ৬০

চল্লিশ বছর পর জীবনের প্রথম প্রেম আবার ঝড় তুলল মৈত্রেয়ীর জীবনে “মির্চা, মির্চা আই হ্যাভ টোল্ড মাই মাদার দ্যাট ইউ হ্যাভ কিসড মাই ফোরহেড'”

নহন্যতে উপন্যাসে মৈত্রেয়ী দেবীর এই উক্তি টি অবশ্যই পাঠকদের মনে আছে? মির্চা এলিয়াদ আর মৈত্রেয়ী দেবীর প্রেম কি শুধুই প্রেম ছিল নাকি সেই সাথে কিছু