রুদ্র সুশান্ত:
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর মতো কবি শতকে বোধহয় একজনই জন্মান। তিনি কবিতাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছিলেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘শুধু কবিতার জন্য আরও দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে লোভ হয়।’ আর নীরেন্দ্রনাথ শিখিয়েছিলেন কীভাবে কবিতাকে ভালোবাসতে হয়। তাই তো তাঁর সময় থেকে বর্তমান কালের তরুণ কবি, সবার কাছেই তিনি আরধ্য। (৩)
তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘কলকাতার যিশু’ থেকে কয়েক চরণ পড়লেই বুঝা যায় কতোটা সহজ এবং মেধাবী কবি ছিলেন তিনি –
“লালবাতির নিষেধ ছিল না,
তবুও ঝড়ের-বেগে-ধাবমান কলকাতা শহর
অতর্কিতে থেমে গেল ;
ভয়ংকরভাবে টাল সামলে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল
ট্যাক্সি ও প্রাইভেট, টেমপো, বাঘমার্কা ডবলডেকার ।
‘গেল গেল’ আর্তনাদে রাস্তার দু’-দিক থেকে যারা
ছুটে এসেছিল-
ঝাঁকামুটে, ফিরিওয়ালা, দোকানি ও খরিদ্দার-
এখন তারাও যেন স্থির চিত্রটির মতো শিল্পীর ইজেলে
লগ্ন হয়ে আছে ।
স্তব্ধ হয়ে সবাই দেখছে,
টালমাটাল পায়ে
রাস্তার এক-পার থেকে অন্য-পারে হেঁটে চলে যায়
সম্পূর্ণ উলঙ্গ একটি শিশু ।
খানিক আগেই বৃষ্টি হয়ে গেছে চৌরঙ্গিপাড়ায় ।
এখন রোদ্দুর ফের অতিদীর্ঘ বল্লমের মতো
মেঘের হৃদপিন্ড ফুঁড়ে
নেমে আসছে ;
মায়াবী আলোয় ভাসছে কলকাতা শহর ।… ” (২)
‘কলকাতা যিশু’ কবিতা লেখা নিয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করলে এ প্রসঙ্গেই তিনি লিখেছিলেন-‘এক বার আনন্দবাজার অফিস থেকে বিকেল বেলায় দোতলা বাসে উঠে বাড়ি ফিরছি। হঠাৎ বাসটা প্রচ- ব্রেক কষে থেমে গেল। তাকিয়ে দেখি, একটা বছর চার-পাঁচের সম্পূর্ণ উলঙ্গ শিশু চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ে রাস্তার উলটো দিকের ফুটপাথে ছুটে চলে যাচ্ছে। কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই তার। বাস, ট্যাক্সির মধ্য দিয়েই সে দুরন্ত দৌড়ে রাস্তাটা পার হচ্ছে। সেই রাতেই লিখি কলকাতার যিশু।’ (৪)
তিনি বলতেন- ‘কবিতা লেখায় আমার কল্পনার জোর তত নেই। আমি চার পাশে যা দেখি, যা শুনি, যে ধরনের অভিজ্ঞতা হয় এ শহরটার মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে, তাই নিয়েই আমার কবিতা। একেবারে চোখের সামনে যা ঘটতে দেখলুম, তার ভিত্তিতে তক্ষুনি লেখা। যেমন কলকাতার যিশু, উলঙ্গ রাজা, বাতাসি।’
সাহিত্য জগতের নক্ষত্র ছিলেন তিনি, তিনি একমাত্র বলতেন- কবিতা তাঁর মাতৃভাষা। কবিতার কথা বললে তাঁর আরেকটি বিখ্যাত কবিতার কথা মনে পড়ে যায়, ‘অমলকান্তি’ সেই বিখ্যাত কবিতা। ‘অমলকান্তি’ কবিতা নিয়ে বলতে গিয়ে বাঙলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী বলেছেন- “তাঁর কবিতা তাঁর মতোই ঋজু, তাঁর মতোই হৃদয়-সারল্য নিয়ে পাঠককে বৃত্তটি পূর্ণ করতে সহায়তা করে। সন্মুখের চালচিত্রটি পরিস্ফুটিত হয় মনোজানালায় এবং একসময় তা আলো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে দিগি¦দিক। বিস্মৃতির এই কালে একজন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী যেমন হরণপ্রত্যাশী, তেমনি আবার সংযোগ সাধকও।” (৭)
সেই বিখ্যাত ‘আমলকান্তি’ কবিতার কয়েকটি লাইন –
“…রোজ দেরি করে ক্লাসে আসত,
পড়া পারত না,শব্দরূপ জিজ্ঞেস করলে এমন অবাক হয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে থাকতো যে,
দেখে ভারী কষ্ট হত আমাদের।
আমরা কেউ মাষ্টার হতে চেয়েছিলাম,
কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল। অমলকান্তি সে সব কিছু হতে চায়নি। সে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল!…”
এই বিখ্যাত কবিতা ‘অমলকান্তি।’ নিয়ে কবির সম্বন্ধে নাট্যকার, সাহিত্যিক ও অনুবাদক শিশিরকুমার দাস তাঁর ‘সাহিত্য সঙ্গী’তে লিখেছেন, ‘‘তাঁর ছন্দনৈপুণ্য প্রতিমা নির্মাণ কুশলতা, শব্দব্যবহারে নিজস্বতা তাঁর কবিতার জনপ্রিয়তার মূলে। প্রকৃতি ও প্রেম, সমকালীন জীবনের ছোট ছোট ঘটনার মধ্যে নাটকীয় সম্ভাবনা এবং গভীর জীবনচেতনার উপলব্ধি তাঁর কবিতার জগত।’’
রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দ যুগ-উত্তর সময়ের সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী ও জনপ্রিয় কবি ছিলেন তিনি। বাংলা কবিতা যে নতুন আদল, প্রকরণ ও আধুনিকতা ও হিরের দ্যুতির মতো ঝলমল ও ছন্দের নবীন নিরীক্ষায় সিদ্ধি অর্জন করেছে, তাতে তাঁর কৃতিত্ব কম নয়। ছন্দ ছিল তাঁর কবিতার প্রাণ। তিনি কতভাবে যে ছন্দ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন তা বলে শেষ করা যায় না। যেকোনো নবীন কবির জন্য তাঁর রচিত কবিতার ক্লাশ গ্রন্থটি হয়ে উঠেছিল অবশ্যপাঠ্য। ছন্দে তিনি যতœ ও মনোযোগের জন্য বহু তরুণকে দীপিত করেছেন। তিরিশ, চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশক থেকে বাংলা কবিতা নানাজনের প্রতিভার স্পর্শে শিখরস্পর্শী, লোকপ্রিয় ও জীবনের নানা দিক উন্মোচনে আশ্চর্য দক্ষতা অর্জন করলেও এই কবির এ ক্ষেত্রে ভিন্ন দায় বহন করেছিল তাঁর সাহিত্যবোধ। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কথায়, ‘কবির কাজ তাঁর নিজস্ব হৃদয়কে উন্মোচিত করে দেখানো। কিন্তু তার মানে কি এই যে শুধু ব্যক্তিগত কিছু দুঃখ-সুখের কথাই তিনি বলবেন? আমার তা মনে হয় না।…সন্ন্যাসী তিনি নন। তিনিও সামাজিক মানুষই। উপরন্তু, ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক তাঁকেও একটি রাজনৈতিক বিন্যাসের মধ্যেই নিশ্বাস নিতে হয়। ফলত, তাঁর চতুষ্পার্শে¦র সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনাবলি, প্রায় অনিবার্যভাবেই তাঁর ওপর ছায়া ফেলতে থাকে।’(৮)
উযধশধ টহরাবৎংরঃু খরঃবৎধঃঁৎব ঝড়পরবঃু – উটখঝ এর প্রতিবেদক এক সাক্ষাৎকারে জিজ্ঞেস করলেন ‘আমার মনে হয় কবিতাই আমার মাতৃভাষা।’ আপনি একথা বললেও তবুও সারা জীবনে তো গদ্যও লিখেছেন প্রচুর। এ নিয়ে নীরেন্দ্রনাথের অভিমত জানতে চায়লে তিনি বলেন- “আমি মনেই করি কবিতা আমার মাতৃভাষা, গদ্য নয়। গদ্য আমি বাধ্য হয়ে লিখি। খবরের কাগজে কাজ করার কারণে লিখতে হয়েছেও প্রচুর। কিন্তু কেবলই মনে হয়, কবিতাকে ফাঁকি দিয়ে, তার থেকে সময় চুরি করে নিয়ে আমি গদ্যকে দিচ্ছি। গদ্য লিখতে আমার ভালো লাগে না।”(১)
‘উলঙ্গ রাজা’ কবিতায় সমান্ততান্ত্রিক জমিদার জোতদার সমাজ ব্যবস্থাকে তীব্র কটাক্ষের বাণে বিদ্ধ করেছিলেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। কবিতার শেষ লাইনে লেখা ‘রাজা তোর কাপড় কোথায়’ লাইনটি আজও ঘোরাফেরা করে লোকমুখে। লাইনটি একসময় প্রবাদবাক্যে পরিণত হয়েছিলো। দেখে নিই ‘উলঙ্গ রাজা’ কবিতার কয়েকটি চরণ-
“সবাই দেখছে যে, রাজা উলঙ্গ,তবুও
সবাই হাততালি দিচ্ছে।
সবাই চেঁচিয়ে বলছে শাবাস, শাবাস।
কারো মনে সংস্কার, কারও ভয়-
কেউ বা নিজের বুদ্ধি অন্য মানুষের কাছে বন্ধক দিয়েছে
কেউ বা পরান্নভোজী, কেউ
কৃপাপ্রার্থী, উমেদার, প্রবঞ্চক;
কেউ ভাবছে, রাজবস্ত্র সত্যিই অতীব সূক্ষ্ম,
চোখে পড়ছে না যদিও, তবুও আছে
অন্তত থাকাটা কিছু অসম্ভব নয়।…”
আর কবিতাটির শেষ লাইন হলো-
‘রাজা, তোর কাপড় কোথায়? ‘
১৯৫৪ সালে প্রকাশ পায় তার প্রথম কবিতার বই ‘নীল নির্জন’। তখন তাঁর বয়স ছিলো ৩০। তার পর একে একে প্রকাশ পায় ‘অন্ধকার বারান্দা’, ‘নিরক্ত করবী’, ‘নক্ষত্র জয়ের জন্য’, ‘আজ সকালে’… অজস্র কবিতার বই। ১৯৯০-এ বিশ্ব কবি সম্মেলনে ভারতের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন তিনি। একটা সময়ে ‘দেশ’ পত্রিকায় বেশ কিছু ছোটগল্প লিখেছেন। সেই লেখাও পাঠক মহলে সাড়া ফেলে দিয়েছিল।
রোমান্টিকতা, প্রেম, প্রকৃতি, মধ্যবিত্ত জীবনের সুখ-দুঃখ, আশা-বেদনা, স্পষ্টবাদী ও স্বদেশপ্রেমের কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ১৯২৪ সালের ১৯ অক্টোবর অবিভক্ত ভারতের ফরিদপুরে চান্দ্রা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর শৈশবরের পুরোটাই প্রায় কেটেছে তৎকালীন পূর্ববঙ্গে ঠাকুরদা, ঠাকুমার কাছে।
তাঁর ঠাকুরদার কর্মজীবন কেটেছে কলকাতায়। তবে কর্মজীবনের শেষে ৫০ বছর বয়সে কলকাতা ছেড়ে তিনি চলে আসেন ফরিদপুরের চান্দ্রা গ্রামে। কলকাতার একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহ-উপাচার্য হিসেবে কাজ করতেন কবির বাবা। কিন্তু কবির মন পড়েছিল বাংলাদেশেই। মা, বাবা কলকাতায় থাকলেও কবির ছেলেবেলা কেটেছে তাই বাংলাদেশেই। ঠাকুরদার মৃত্যুর পর তিনি পাকাপাকি ভাবে চলে আসেন কলকাতায়। প্রাথমিক পড়াশোনা সেখানকার পাঠশালায়। ছোটবেলা থেকেই ছড়া লিখতে ভালোবাসতেন কবি নীরেন্দ্রনাথ। কবিগানের কথা একনাগাড়ে মুখস্থ আওড়ে যেতেন। চার বছর বয়সে কবির কাকিমা বলছিলেন- “তুই তো দেখছি কবিদের মতো কথা বলছিস!”(৬) মাত্র ৫ বছর বয়সে তিনি প্রথম কবিতা লেখেন। কিন্তু সেটা কোনো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি। ১৬ বছর বয়স থেকে বিভিন্ন পত্রিকায় তিনি কবিতা লিখে এসেছেন। ১৬ বছর বয়সেই “শ্রীহর্ষ” পত্রিকায় কবিতা লেখার মধ্যে দিয়েই সাহিত্যজগতে তাঁর প্রথম আত্মপ্রকাশ হয়। পরে ১৯৩০-এ কলকাতায় চলে আসা। শহরের মিত্র ইনস্টিটিউশন, বঙ্গবাসী এবং সেন্ট পলস কলেজে পড়াশোনা।গ্রামের পাঠশালায় প্রথমে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। তারপর কলকাতা এসে প্রথমে কলকাতার বঙ্গবাসী স্কুলে এবং পরে মিত্র ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হন। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে “প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গবাসী কলেজ থেকে আই. এ পাশ করেন। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে সেন্টপলস্ কলেজ থেকে ইতিহাসে অনার্স নিয়ে বি. এ পাশ করেন। ছাত্রাবস্থায় “শ্রীহর্ষ” পত্রিকার সম্পাদনা করে সংবাদপত্রের প্রতি তার নিবিড় ও গভীর অনুরাগের সূত্রপাত হয়। (৫) দৈনিক প্রত্যহ” পত্রিকায় তার সাংবাদিকতার হাতে খড়ি। “সত্যযুগ” পত্রিকার সাংবাদিক রূপে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর তিনি একে একে “মাতৃভূমি”, “স্বরাজ”, “ভারত”, “ইউনাইটেড প্রেস অফ্ ইন্ডিয়া” প্রভৃতি পত্রিকায় কাজ করা শুরু করেন।
১৯৫১ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় কাজে যোগ দেন। একটা দীর্ঘ সময় তিনি ‘আনন্দমেলা’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। কবিতা লেখার পাশাপাশি নীরেন্দ্রনাথ ছিলেন ছড়াকার, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, গদ্যকার, গোয়েন্দা-গল্পকার, শিশুসাহিত্যিক, ভ্রমণ-কাহিনির লেখক, সম্পাদক এবং বানান-বিশেষজ্ঞ। সাংবাদিক, শিশু সাহিত্যিক, রহস্য রোমাঞ্চকার, গল্পকার হিসেবেও তিনি পরিচিত, কিন্তু সব পরিচয় চাপিয়ে কবি-ই তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয়। অভিজ্ঞতার দীর্ঘপথ হেঁটে কবি নিজেও অন্ধকার ঠেলে আলোর দিকে যাবার কথা বলেছেন। এই দীপ্ত বিশ্বাসেই আত্মসচেতন কবি নীরেন্দ্রনাথ বাংলা কাব্যভূমিতে এখনও অনুভূতির পুষ্পবৃষ্টি করে তুলেছেন। কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীই প্রথম “টিনটিন” চরিত্রের বঙ্গানুবাদ করেছেন। একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, ছোটো গল্পকার ও সম্পাদক ছিলেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী।
কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ছিলেন রোমান্টিকতা, প্রেম, প্রকৃতি, মধ্যবিত্ত জীবনের সুখ-দুঃখ, আশা-বেদনা, স্পষ্টবাদী ও স্বদেশপ্রেমিক কবি। কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ঘৃণা করতেন মেকি দেশপ্রেমকে। কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতার ভাষা আধুনিক কবিদের মতো দুর্বোধ্য নয়। বিশ শতকে চল্লিশের দশকে রাজনৈতিক উত্তাপ যখন ঘনীভূত কবি তার কবিতায় তখন আশার গান শুনিয়েছেন। কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার সমালোচনা করেছেন। কবিতার মাঝে মাঝে তাঁর গল্প বলার প্রবণতা দেখা যায়। বিষয় উপস্থাপনার মাধ্যমে কবিতাকে অন্যমাত্রা দেয়া, ভাবগত ব্যঞ্জনাকে অক্ষুণ্ণ রেখে কবিতায় বর্ণিত চরিত্রকে উচ্চারণের দ্যোতনায় অর্থময় করে তোলেন।
তিনি প্রায়ই গল্প বলার ছলে কবিতা লিখতেন। উযধশধ টহরাবৎংরঃু খরঃবৎধঃঁৎব ঝড়পরবঃু – উটখঝ এর প্রতিবেদক এক সাক্ষাৎকারে জিজ্ঞেস করলেন- “আপনার প্রায় সব কবিতাই একটা না একটা গল্প বলে। অথচ যখন শুরু করেছিলেন, বাংলা ভাষায় তখনো সেভাবে কবিতায় গল্প বলার প্রচলন ছিল না। যদি না আমরা রবিঠাকুরের ‘দুই বিঘে জমি’ কিংবা ‘ক্যামেলিয়া’র মতো কিছু কবিতাকে আলাদা রাখি।”
নীরেন্দ্রনাথ বলেছেন- “সুন্দর প্রশ্ন করেছো। তবে কবিতায় গল্প বলার বিষয়ে কি জানো, সম্পূর্ণ গল্পটা তো আর আমি কবিতায় ধরে দিতে পারবো না। গল্পের একটা আভাস আছে, একটা ইঙ্গিত আছে আমার কবিতায়। একটা আন্দাজ দিতে পারবো। এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলি, আমাদের বাংলা সাহিত্যের কবিতা সেই গোড়া থেকেই গল্প বলে। ‘মহাভারত’ পুরোটা জুড়েই গল্প আর গল্প। একগাদা গল্পের সমষ্টি। আমাদের মঙ্গলকাব্য গল্প ছাড়া আর কী! আর সেগুলো তো পদ্যেই লেখা। ছন্দে লেখা গল্প।”(১) কবিতা নিয়ে ভাবনার আর আবিষ্কারের শেষ ছিলো না তাঁর, তিনি শব্দের গায়ে হাতুড়ি মেরে নতুন শব্দ তৈরী করতেন আর সে শব্দ বুনন করতেন কাব্যের পাতায়, তিনি নিয়মিত সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন আপন মেধায়। তিনি কবিতা প্রাণের সুরে ও গলার স্বরে গেঁথে রাখতাম। স্পষ্টবাদী কবি আত্মসমীক্ষায় ব্রতী হয়ে “কলকাতার কড়চা” কবিতায় লিখেছেন, “তুমি তিলোত্তমা হওনি, আমরাই তিলে তিলে ছোট হয়ে গেছি।” তাঁর কবিতা নিয়ে লেখিকা ‘সংগীতা বন্দ্যোপাধ্যায়’ বলেছেন, কীভাবে বাংলা লিখতে হয়, তা কবির থেকেই শিখেছিলেন তিনি। বাংলা বানানকে তিনি নতুন এক দিশা দেখিয়েছেন।(৩) শীতল চৌধুরী তাঁর “আধুনিক বাংলা কবিতার নিবিড় পাঠ” গ্রন্থে বলেছেন, “কবি নীরেন্দ্রনাথের কবিতার বিশেষত্ব হল সহজ সরল জলের মতন পাঠকের অন্তরগহনে তিরতির করে ঢেউ তোলে। তিনি গদ্যের কথ্যভাষায় স্পষ্ট ছবি গেঁথে গেঁথে আপন মনের একতারাতে সুর তুলে কবিতাকে তরতর করে নদীর স্রোতের মতন এঁকে নিয়ে
যান।”
ড. বাসন্তীকুমার মুখোপাধ্যায় তার “আধুনিক বাংলা কবিতার রূপরেখা” গ্রন্থে বলেছেন, “নীরেন্দ্র চক্রবর্তীর সুতাংশুকে জীবনানন্দ দাশের ‘আট বছর একদিন আগের কবিতা’য় নায়কের উত্তর পুরুষ বলে মনে হবে। জীবনানন্দের নায়কের মৃত্যুটাকেই যেন অনুজ কবি বিশ্লেষণ করে অনুভব করতে পারছেন।
তিনি আজন্ম একজন প্রেমিক, তিনি আজন্ম একজন কবি। তেমনি একটা প্রমের কবিতা- “প্রিয়তমাসু”
“তুমি বলেছিলে ক্ষমা নেই, ক্ষমা নেই।
অথচ ক্ষমাই আছে।
প্রসন্ন হাতে কে ঢালে জীবন শীতের শীর্ণ গাছে।
অন্তরে তার কোনো ক্ষোভ জমা নেই।
তুমি বলেছিলে, তমিস্রা জয়ী হবে।
তমিস্রা জয়ী হলো না।
দিনের দেবতা ছিন্ন করেছে অমারাত্রির ছলনা;
ভরেছে হৃদয় শিশিরের সৌরভে।
তুমি বলেছিলে, বিচ্ছেদই শেষ কথা।
শেষ কথা কেউ জানে?
কথা যে ছড়িয়ে আছে হৃদয়ের সব গানে, সবখানে;
তারও পরে আছে বাঙময় নীরবতা।
এবং তুষার মৌলি পাহাড়ে কুয়াশা গিয়েছে টুটে,
এবং নীলাভ রৌদ্রকিরণে ঝরে প্রশান্ত ক্ষমা,
এবং পৃথিবী রৌদ্রকে ধরে প্রসন্ন করপুটে।
দ্যাখো, কোনোখানে কোন বিচ্ছেদ নেই।
আছে অনন্ত মিলনে অমেয় আনন্দ, প্রিয়তমা।” (৯) কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ভাবনা – “মানুষের মধ্যেই ঈশ্বরকে খোঁজা ও মানুষের সারল্যের মধ্যেই ঈশ্বরের প্রকাশ উপলব্ধি।” এমন মধুর ভাবনার একজন লোক হারালো বাঙলা সাহিত্য আর পৃথিবীকে চিরবিদায় জানিয়ে তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে। অনেক দিন ধরেই বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন তিনি। ৯ ডিসেম্বর ২০১৮ ইং তারিখে তাঁকে বাইপাস লাগোয়া একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিডনি ও ফুসফুসের সংক্রমণে ভুগছিলেন তিনি। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, গত কয়েক দিন ধরেই তাঁর শরীর খারাপ হতে শুরু করেছিল। পা ফুলে গিয়েছিল। তবে লেখা থামাননি। অসুস্থ অবস্থাতেও কবিতা লিখতেন, সকলের সঙ্গে কথাও বলতেন। সোমবার হঠাৎই হৃদরোগে আক্রান্ত হন কবি। সেই ধাক্কা আর সামলাতে পারেননি। বাংলা সাহিত্যের একটা যুগের অবসান হল। চলে গেলেন কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। ২০১৮ সালের ২৫ ডিসেম্বর, মঙ্গলবার বেলা ১২টা ২৫ মিনিট নাগাদ দক্ষিণ কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে বড়দিনেই চলে গেলেন ‘কলকাতার যিশু’র স্রষ্টা কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। বয়স হয়েছিল ৯৪ বছর। আমি কবির আত্মার শান্তি প্রার্থনা করছি।
তিনি জীবনে মোট ২৯ টি কাব্যগ্রন্থ, ১ টি উপন্যাস, ১ টি আত্মস্মৃতি, ১ টি কাব্যনাট্য, কয়েকটি আলোচনা গ্রন্থ, ভ্রমণকাহিনি, রহস্যকাহিনি, ছোটদের ছড়া ও কবিতা, কবিতাসমগ্র (১-৫) খন্ড ও নির্বাসিত কবিতা ১ টি এবং ৩ টি রহস্যকাহিনি সমগ্র রচনা করেন। তাঁর রচিত গ্রন্থগুলোর তালিকা দেয়া হলো-
কাব্যগ্রন্থ :
“নীল নির্জনে” (১৯৫৪) “অন্ধকার বারান্দা” (১৯৬১) “প্রথম নায়ক” (১৯৬১) “নিরক্ত করবী” (১৯৬৫)”নক্ষত্র জয়ের জন্য” (১৯৬৯) “কলকাতার যীশু” (১৯৬৯) “উলঙ্গ রাজা” (১৯৭১) “খোলা মুঠি” (১৯৭৪) “কবিতার বদলে কবিতা” (১৯৭৬) “আজ সকালে” (১৯৭৮) “পাগলা ঘন্টি” (১৯৮১) “ঘর-দুয়ার” (১৯৮৩) “সময় বড় কম” (১৯৮৪) “রূপ-কাহিনী” (১৯৮৪ ) “যাবতীয় ভালবাসাবাসি” (১৯৮৬) “ঘুমিয়ে পড়ার আগে” (১৯৮৭)
“জঙ্গলে এক উন্মাদিনী” (১৯৮৯) “আয় রঙ্গ” (১৯৯১) “চল্লিশের দিনগুলি” (১৯৯৪) “সত্য সেলুকাস” (১৯৯৫) “সন্ধ্যারাতের কবিতা” (১৯৯৭) “অন্য গোপাল” (১৯৯৯) “জলের জেলখানা থেকে” (২০০০ “সাকুল্যে তিনজন” (২০০০) “কবি চেনে সম্পূর্ণ চেনেনা” (২০০১) “দেখা হবে” (২০০২) “ভালবাসা মন্দবাসা” (২০০৩) “মায়াবী বন্ধন” (২০০৪) “জ্যোৎস্নায় একেলা” (২০০৬)
উপন্যাস :
“পিতৃপুরুষ” (১৯৭৩)
আত্মস্মৃতি (আত্মজীবনী মূলক গ্রন্থ)
“নীরবিন্দু ১” (১৯৯৩)
কাব্যনাট্য :
“প্রথম নায়ক” (১৯৬১)
আলোচনা গ্রন্থ :
১. “কবিতার ক্লাস” (১৯৭০) ২. “কবিতার দিকে ও অন্যান্য রচনা” (প্রথম সংস্করণ – ১৯৭৬ , দ্বিতীয় সংস্করণ – ১৯৯২) ৩. “কবিতা কী ও কেন” (১৯৮২) ৪. “সমাজ সংসার” (১৯৮৮) ৫. “বাংলা কী লিখবেন, কেন লিখবেন” (১৯৯১)
৬. “রবীন্দ্রনাথ ও আমরা এবং অন্যান্য রচনা” (২০০১)
ভ্রমণকাহিনি:
“গঙ্গাযমুনা” (১৯৮২) “বাইরে দূরে” (১৯৯২) “আট ঘাটের জল” (১৯৯৩)
রহস্যকাহিনি:
“শ্যামনিবাস রহস্য” (১৯৯০) “মুকুন্দপুরের মনসা” (১৯৯১) “বিষাণগড়ের সোনা” (১৯৯২) “চশমার আড়ালে” (১৯৯৩) “রাত তখন তিনটে” (১৯৯৪) “লকারের চাবি” (১৯৯৫) “বরফ যখন গলে” (১৯৯৫) “একটি হত্যার অন্তরালে” (১৯৯৭) “আড়ালে আছে কালীচরণ” (১৯৯৮) “পাহাড়ি দিছে” (১৯৯৮)
“আংটি রহস্য” (২০০০) “জোড়া ভাদুড়ি” (২০০১) “শান্তিলতার অশান্তি” (২০০২) “কামিনীর কণ্ঠহার” (২০০৩)
ছোটদের ছড়া ও কবিতা :
“সাদা বাঘ” (প্রথম সংস্করণ – ১৯৭৯ , প্রথম সৃষ্টি সংস্করণ – ২০০১)
“বিবির ছড়া” (১৯৮২) “বারো মাসের ছড়া” (১৯৮৮) “ও কলকাতা” (১৯৯১)”ডাইনোসর” (১৯৯১)”ভোরের পাখি” (২০০০)
“নদীনালা গাছপালা” (২০০১)
“ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি” (২০০২)
“বারো পাখির ছড়া” (২০০৩) “খোকনের খাতা” (২০০৩) “ছোটদের ছড়া” (২০০৩) “বারো পুতুলের ছড়া” (২০০৪) “মায়ের কাঁথা” (২০০৫)”পাঁচ বছরের আমি” (২০০৫) “ছেলেবেলা” (২০০৬) “দাশুর কথা” (২০০৬) “রাত-পাহাড়া” (২০০৬)
কবিতাসমগ্র ও নির্বাচিত কবিতা :
“শ্রেষ্ঠ কবিতা” (১৯৭০) “কবিতাসমগ্র ১ম” (১৯৮২) “কবিতাসমগ্র ২য়” (১৯৮৫) “নির্বাচিত কবিতা” (১৯৯২) “কবিতাসমগ্র ৩য়” (১৯৯৪) “কবিতাসমগ্র ৪থ” (২০০০) “কবিতাসমগ্র ৫ম” (২০০০)
রহস্যকাহিনি সমগ্র-
“ভাদুড়ি সমগ্র ১ম” (২০০৬)”ভাদুড়ি সমগ্র ২য়” (২০০৬) “ভাদুড়ি সমগ্র ৩য়” (২০০৬)
সৃষ্ট গোয়েন্দা চরিত্র :
প্রাপ্তবয়স্কদের জন্যে কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সৃষ্ট গোয়েন্দা চরিত্রের নাম হল “ভাদুড়ী মশাই”।
তথ্য সূত্র:
১.কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সাক্ষাৎকার, সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন, উযধশধ টহরাবৎংরঃু খরঃবৎধঃঁৎব ঝড়পরবঃু – উটখঝ.
২.কাব্যগ্রন্থ : কলকাতার যীশু, প্রকাশকাল- ডিসেম্বর, ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দ।
৩.মেঘের হৃদপি- ফুঁড়ে রোদ্দুর হয়ে গেলেন ‘কলকাতার যিশু’
সংবাদ প্রতিদিন, ডিজিটাল ডেস্ক, প্রকাশক-বিশাখা পাল, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৮ ইং।
৪.রোদ্দুর হয়ে গেলেন অমলকান্তির কবি নীরেন্দ্রনাথ (১৯২৪-২০১৮)
আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা
২৫ ডিসেম্বর, ২০১৮ইং।
৫.”কবিতার যিশু” নীরেন্দ্রনাথ রোদ্দুর হয়ে চলে গেলেন” – অমিত গোস্বামী, ডেইলি বাংলাদেশ ডটকম, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৮ইং।
৬.বড়দিনেই চলে গেলেন ‘কলকাতার যিশু’র স্রষ্টা কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, দ্য ওয়াল ব্যুরো, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৮ইং।
৭. প্রথম আলো’র সাহিত্য ক্রোড়পত্র- অন্য আলো, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৮ ইং।
৮.নীরেন্দ্রনাথের প্রয়াণে- আবুল হাসনাত, প্রথম আলো’র সাহিত্য ক্রোড়পত্র-অন্য আলো, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৮ ইং।
৯. কাব্যগ্রন্থ: অন্ধকার বারান্দা- নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, বাংলা ১৩৬৭ সনে প্রকাশিত।
রুদ্র সুশান্ত, কবি ও প্রাবন্ধিক