মহান মুক্তিযুদ্ধের ৫৩তম বার্ষিকী এবং শিল্প—সাহিত্য—সংস্কৃতি ও সমাজভাবনামূলক কাগজ আন্দরকিল্লা’র ২৭তম বর্ষে পদার্পন কালপ্রবাহে দু’টি অনন্য উপলক্ষ।
হাজার বছরের বাঙালির ইতিহাসে মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয় একটি ঐতিহাসিক ফলক। এক সাগর রক্তমূল্যে অর্জিত এই বিজয় একটি গৌরবদীপ্ত জাতির পৃথক স্বাধীনসত্তাকে উন্মোচিত করেছে। বাঙালির এই স্বাধীন পরিচয় একটি জাতির স্বপ্ন ও প্রত্যাশার অমূল্য প্রাপ্তিযোগ। সমগ্র জাতির কাছে বিজয়ের এই দিনটি বহুমাত্রিক অভিধায় অভিষিক্ত। বিজয়ের এই আনন্দের মধ্যেও স্বজনহননের বিষাদের ছায়াও আছে। খুব কম বাঙালি পরিবারই আছে এই বিজয় অর্জনের জন্য কোন আপনজন, স্বজন ও প্রিয় মানুষকে হারায়নি; প্রায় সকল পরিবারকেই নানাভাবে মূল্যাদিতে হয়েছে।
প্রশ্ন আসে এত মূল্য দিয়ে অর্জিত এই বিজয় কতটা অর্থপূর্ণ তাৎপর্য নিয়ে প্রতিবছর আসে। আমাদের স্বপ্ন ও প্রত্যাশার প্রাপ্তির হিসেব—নিকেষ না করেও বলা যায়, বাংলাদেশ নামক এই স্বাধীন ভূখণ্ডে সাম্য, মৈত্রী ও মুক্তি এখনও অধরা। স্বাধীনতা প্রাপ্তির অর্ধশতাব্দীকাল পেরিয়ে গেলেও এ জাতির জীবনধারা ও যাপিত জীবনে অসঙ্গতি, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা প্রতিক্ষণ লেগেই থাকে। প্রতিটি স্তরেই বৈষম্য মানুষে মানুষে ব্যবধান ও দূরত্ব বাড়িয়েছে। ধনী যে হারে বেড়েছে ততোধিক বেশি হারে বেড়ে চলেছে গরীবের মিছিল। সম্পদের সুষম বণ্টনের পরিবর্তে লুণ্ঠন প্রবৃত্তির কুৎসিত প্রতিযোগিতায় মনুষ্যত্ব বিলুপ্ত প্রায়। সামাজিক অস্থিরতা বারবার আর্থ—সামাজিক ভিত্তিকে নড়বড়ে করে দেয়। এভাবে চলতে চলতে শুভ, শান্তি, কল্যাণ, স্বস্তি নানা অনিশ্চয়তাতার দোলাচলে দুলতে দুলতে একসময় নিশ্চল হবার উপক্রম। তবুও এই নিশ্চল স্থবিরতার মধ্যেও বাংলাদেশ যে এগিয়ে যায়নি তা বলা যাবে না। কিন্তু আরও এগুনো যেতো মানুষে মানুষে বৈষম্য ও বিভাজনের সীমারেখার দেয়ালটি ভাঙতে পারলে। এই দায় যাদের তারা তা কতটুকু পালন করেছেন সেই প্রশ্নের উত্তর কখনও তারা দিতে অভ্যস্থ নয়। দায় মোচনের উপায় জবাবদিহিতা। এই জবাবদিহিতার সংস্কৃতি রাষ্ট্র, সমমাজে এমনকি পরিবারেও প্রচলিত না হওয়া পর্যন্ত স্বপ্ন ও প্রত্যাশার প্রাপ্তিযোগ পূর্ণ হবে না। বিজয় দিবস উদযাপন শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকতা না হয়ে শুদ্ধতা অর্জনের অগ্নিশিখার বর্তিকা হোক এই প্রত্যাশা করি।
মহান বিজয়ের এই মাস অনেক প্রতিকূলতা এবং বিরামহীন পথ চলার কণ্টক জ্বালা সয়ে আন্দরকিল্লা প্রকাশনার ২৭তম বর্ষে পদার্পন করলো। শিল্প—সাহিত্য—সংষ্কৃতি ও সমাজভাবনামূলক এই কাগজটি লেখক, পাঠক, শুভানুধ্যায়ী ও অনুরাগীর সহযোগে বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়েছে শিকড় মাটির গভীরে পেঁৗছেছে বলে ঝড়—ঝাপটা ঠেকিয়ে সটান দাঁড়িয়ে আছে। এই প্রকাশনায় যারা মন মননের সৃজন শিখা জ্বালিয়ে রেখেছেন তাঁরা আন্দরকিল্লার নাতিদীর্ঘ পথ চলার স্বার্থক সারথী। এই সারথীরা সাহিত্য, শিল্প, সংষ্কৃতির নানান শাখা ও সমাজ ভাবনায় তাঁদের মুক্ত চিন্তার প্রকাশ ঘটিয়ে আন্দরকিল্লাকে ঋদ্ধ করেছেনÑএটাই এই প্রকাশনার পরম প্রাপ্তি।
আন্দরকিল্লা চিন্তা—চেতনায় গন্ডিবদ্ধ নয় এবং মুক্ত চিন্তা স্ফূরনের খোলা জানালা। মুক্ত আলো বাতাস প্রবাহের সহজ—সরল গতিপথ। তাই উচ্চ কণ্ঠে উচ্চারণ করি: ‘এই আকাশে, এই বাতাসে, আমার মুক্তি আলোয় আলোয়।’
২৭ বছর পদার্পনে লেখক, পাঠক, বিজ্ঞাপনদাতা, শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি প্রীতি ও শুভচ্ছা রইলো।