ড. আহমেদ মাওলা
বাংলা কবিতার পাঠক মাত্রেই জানেন,রবীন্দ্রনাথের নিস্তরঙ্গ কাব্যপ্রবাহ, তিরিশি কবিদের নিষ্প্রভ,অলস শব্দগুচ্ছের বিপরীতে নজরুলের ‘বিদ্রোহী’কে শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ কবিতা বলা যায়। সচকিত ভাষাভঙ্গি,সরাট কণ্ঠস্বর এবং উপনিবেশ বিরোধী কাব্যপ্রকল্প হিসেবে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা উপস্থাাপিত হলেও এর প্রাসঙ্গিকতা ও প্রয়োজনীয়তা কোনো কালে ম্লান হবার নয়। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লেখা হয় ১৯২১ সালে ডিসেম্বর মাসের শেষে কোনো এক রাতে। কবিতার-ঘোর লাগা আবেগের আলো-আঁধারে নজরুল কাঠপেন্সিলে, আলাদা আলাদা কাগজে একটানা লিখেছেন ১৪৭ পংক্তির কবিতা। তখন নজরুল এবং কমরেড মুজাফফর আহমদ একই ঘরে বাস করতেন। মুজাফফর আহমদ ছিলেন এই কবিতার প্রথম শ্রোতা। ‘সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখ ধু’য়ে এসে আমি বসেছি, এমন সময়ে নজরুল বলল, সে একটি কবিতা লিখেছে। পুরো কবিতাটি সে আমায় পড়ে শোনাল। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার আমিই প্রথম শ্রোতা।…১৯২২ সালে ৬ জানুয়ারি ‘বিদ্রোহী’ বিজলী’তেই প্রথম ছাপা হয়েছিল।’১ মুজাফফর আহমদের তথ্য থেকে জানা যায়, পাঠক চাহিদার কারণে বিজলী দু’বার ছাপা হয় উনত্রিশ হাজার কপি। পরে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা পুনর্মুদ্রিত হয় প্রবাসী, সাধনা, ধূমকেতু এবং বসুমতি পত্রিকায়। বাংলা কবিতার ইতিহাসে এরকম অভূতপূর্ব ঘটনা আজ অবধি দেখা যায়নি। এই কবিতা নজরুলের কাব্য-মানসের মূর্তপ্রতীক হয়ে উঠে এবং উত্তরকালে ‘বিদ্রোহী কবি’ নামাঙ্কিত জয়-তিলক নজরুলের ললাট লিখন হিসেবে অক্ষয় হয়ে যায়।
এই কবিতায় ‘বিদ্রোহী-সত্তার’ বহুমাত্রিকতা শনাক্ত করা যায় এভাবে-১.ইংরেজ কলোনিয়াল শাসনের বিরুদ্ধে দ্রোহ ২.জাতি-ধর্ম ভেদ,অন্যায়-অবিচার,অমানবিকতা-অসুন্দর-অমঙ্গলের বিরুদ্ধে দ্রোহ ৩. শোষণ-নির্যাতন, অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে দ্রোহ ৪.ভাষাগত বিদ্রোহ ইত্যাদি চেতনা স্বাক্ষরিত হয়েছে। নজরুল নিজেই লিখেছেন-‘আমি বিদ্রোহ করেছি-বিদ্রোহের গান গেয়েছি অন্যায়ের বিরুদ্ধে,অত্যাচারের বিরুদ্ধে-যা মিথ্যা, কুলষিত, পুরাতন-পচা, সে মিথ্যা সনাতনের বিরুদ্ধে,ধর্মের নামে ভ-ামি ও কুসস্কারের বিরুদ্ধে…গড়ে তুলতে হলে একটা শৃঙ্খলার দরকার কিন্তু ভাঙ্গার কোনো শৃঙ্খলা বা সাবধানতার প্রয়োজন আছে মনে করিনে। নতুন করে গড়তে চাই বলেই তো ভাঙ্গি- আঘাতের পর আঘাত হেনে পচা-পুরাতনকে পাতিত করি।’২ কবিতাটির প্রথম স্তবকের পংক্তি-
‘বল বীর
বল উন্নত মম শির
শির নেহারি আমারি নত শির ওই শিখর হিমাদ্রির!
এখানে বিদ্রোহী-সত্তার সদম্ভ আত্মপ্রকাশ ঘোষিত হয়েছে। তার মস্তক বা শির এতো উর্ধে যে হিমালয় পর্বতের শিখর নত করে রেখেছে। এটা এমন একটা মেটাফোর, যেখানে দু’টি বস্তু‘র মধ্যে কোনো মিল নেই কিন্তু কাল্পনিকভাবে উচ্চতাগুণের মিল আছে। যে গুণটিকে এখানে অনুমান করে নেয়া হয়েছে, তা হচ্ছে বিশালতা। সদায় নত, দুর্বল, শক্তিহীন বাঙালিকে হিমালয়ের উচ্চতা এবং বিশালতার সঙ্গে তুলনা করে এক ধরনের শক্তি সঞ্চয় করা হয়েছে। উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ভয়ার্ত মূর্তি হিসেবে ‘বিদ্রোহী-সত্তা’র এই উত্থান সত্যি বিস্ময়কর। সকল অন্যায়,অনিয়ম, অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে গিয়ে হিন্দু-মুসলমান ধর্মীয় মিথ-ঐতিহ্য, পুরাণের শক্তিধর উপাদানকে একত্রিত করে ‘বিদ্রোহী-সত্তা’র অবয়ব রচনা করেছেন নজরুল। যেমন-
‘আমি চিরদুর্দম,দুর্বিনীত নৃশংস
মহা প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস
…আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল
আমি দ’লে যাই যত বন্ধন,যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল !
আমি মানি না কো কোন আইন’
‘দুর্বিনীত’ অর্থৎ নত নন, ‘নৃশংস’ দয়ামায়াহীন-যিনি দুঃসাহসিকভাবে দমন করেন অন্যায়কারীকে। ‘আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল’ দ্বারা বুঝিয়েছেন-ব্রিটিশদের প্রণীত আইন তিনি মানেন না। ‘আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস’ এটা হচ্ছে বিদ্রোহী-সত্তা’র ভয়াবহ রূপ। ‘আমি বেদুঈন’ অর্থৎ যাযাবর বেদুঈন জাতির বৈশিষ্ট্য-যাদের পিছুটান নেই। ‘আমি চেঙ্গিস’ দ্বারা বুঝিয়েছেন, তিনি দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। ‘আমি অর্ফিয়াসের বাঁশরী’ দেবতা অর্ফিয়াস যেমন বাঁশির সুরের মায়াজালে সকলের মন জয় করেছিলেন, তিনিও তেমন। ‘আমি ই¯্রফিলের শিঙ্গার মহা-হুঙ্কার’ ইসলমি ধর্ম বিশ্বাস মতে, রোজ কেয়ামতের দিন ই¯্রাফিল ফেরেস্তা শিঙ্গা ফুক দিলেই পৃথিবীর সমস্ত কিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। ‘বিদ্রোহী-সত্তা’ নিজেকে সেই ই¯্রাফিল ফেরেস্তার শিঙ্গার ধ্বংস ধ্বনির সঙ্গে তুলনা করে বুঝাতে চেয়েছেন যে, তাঁর বাঁশির সুরেও তেমনি ব্রিটিশ উনিবেশের শাসনকাঠামো ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে। তিনি যেন সেই শিঙ্গা হাতে নিয়ে বসে আছেন। এখানে উল্লেখ্য যে,তৎকালীন মুসলমানদের একটা অংশ এই কবিতার অষ্টম-নবম পঙ্ক্তির কারণে নজরুলকে খোদাদ্রোহী, কাফের বলে অভিযুক্ত করেছিলেন-
ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া
খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া
উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাত্রীর!
এই অমূলক প্রচারণা একসময় থেমে যায়, যখন নজরুল ইসলামি গান, হামদ-নাত লেখা শুরু করেন। হুমায়ুন কবির তাঁর বাঙলার কাব্য (১৯২৯) গ্রন্থে’ লিখেছেন, ‘অসহযোগ আন্দেলনের আলোড়ন বাঙলা কাব্যে বোধ হয় নজরুল ইসলামের মধ্যেই জেগেছিল এবং সেইজন্যই শতাব্দীর তৃতীয় দশকে তাঁর এত প্রতিষ্ঠা।…বঙ্গভঙ্গ উপলক্ষ হলেও স্বাধীন স্বজাতিক রাষ্ট্রস্থাপনই ছিল স্বদেশী আন্দোলনের প্রকৃত লক্ষ্য।… নজরুল ইসলামের প্রতিশ্রুতির মূল সমাজ জীবনের এই ঐক্যে প্রতিষ্ঠিত এবং সেইজন্যই দেখি যে নিপীড়িত জনমানসের আশাÑআকাক্সক্ষাকে রূপ দেবার সাধনা তাঁর রচনায় সবল কণ্ঠে ফুটে উঠেছিল।’৩ বলা যায় বাংলার বিপুল কৃষক সম্প্রদায়ের সঙ্গে নজরুলের ছিল সহজ সম্পর্ক। নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ পাঠের ক্ষেত্রে এবং বাংলা কবিতার ইতিহাসে নজরুলের স্থাান বিচার করতে গিয়ে সুকুমার সেন, অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়,দীপ্তি ত্রিপাঠী, অশ্রুকুমার সিকদার প্রমুখ সমালোচক সংকীর্ণতার পরিচয় দিয়েছেন। তার এটি উদাহরণ হচ্ছে, তাঁরা নজরুলকে স্থাাপন করেছেন রবীন্দ্রনাথ এবং তিরিশি কবিদের মাঝখানে। কিন্তু নজরুলের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, একের পর এক বই বাজেয়াপ্ত হওয়া, কবিতা লেখার কারণে জেলখাটার সংগ্রামকে প্রথাগত সমালোচকগণ গৌণভাবে উপস্থাাপন করলেও আজকের উত্তর-উপনিবেশিক চিন্তাচর্চায় নজরুলের অবস্থাান প্রধান হয়ে উঠছে। নজরুলের কণ্ঠস্বরই হয়ে উঠছে ব্রিটিশ উপনিবেশিত ভারতবর্ষের নিপীড়িত মানুষের প্রতিবাদী চেতনার জনস্বর। নজরুল লিখেছেন-‘আজ ভারত পরাধীন।তার অধিবাসীবৃন্দ দাস। এটা নির্জলা সত্য। কিন্তু দাসকে দাস বললে, আন্যায়কে অন্যায় বললে, রাজত্বে তা হবে রাজদ্রোহ। এ তো ন্যায়ের শাসন হতে পারে না।’৪ এখানে নজরুলের দৃঢ় অবস্থাান এবং ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মূল বক্তব্য পরিষ্কার। আরেকটি জায়গায় নজরুল বলছেন-‘পূর্ণ স্বাধীনতা পেতে হলে সকলের আগে আমাদের বিদ্রোহ করতে হবে,সকল-কিছু নিয়ম-কানুন বাঁধন-শৃঙ্খল মানা নিষেধের বিরুদ্ধে বুক ফুলিয়ে বলতে হবেÑ‘আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্নিশ! অর্থৎ নজরুল তার ‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্রতিটি শব্দকে উপনিবেশিক শাসকদের বিরুদ্ধে ‘অস্ত্র’ হিসেবে, কামানের ‘গোলা’ রাইফেলের ‘বুলেট’ হিসেবে ছুঁড়ে মেরেছেন। তা যথাযর্থ জায়গায় আঘাত করতে পেরেছে বলেই নজরুলই একমাত্র কবি হিসেবে জেল খেটেছেন,দ-িত হয়েছিলেন। ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটির আন্তিমে যখন পৌঁছাচ্ছেন, বিদ্রোহী তার সমস্ত কর্তব্য শেষে একটি শর্তযুক্ত করেন। গভীর, গাঢ় কণ্ঠে বলেন-
‘মহা বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না
অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না’
ধীরোদাত্ত স্বর, কিন্তু সেই স্বরের মধ্যে রণ-ক্লান্তির সুষমা আছে। একেবারে শেষে এসে ‘বিদ্রোহী-সত্তা’ মর্মমূলে প্রোথিত হয়। কোনো উন্মূল বাসনা নয়,হৃদয় থেকে উৎসারিত, বোধ-উপলব্ধি থেকে উঠে এসে সামষ্টিক মুক্তির আকাক্সক্ষা বজ্র কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে ‘বিদ্রোহী’ কাব্যভাষ্যে। নজরুল হয়ে ওঠেছেন ‘মহা প্রলয়ের নটরাজ’। শিব. মহাদেব যেমন তা-ব নৃত্যে নেচেছিলেন, ঠিক তেমনি বিদ্রোহী-সত্তা কবি নজরুল নিজেকে কল্পনা করেছেন। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা মূলত উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে নজরুলের রুদ্র-রাগী চোখের বি-উপনিবেশিক দৃষ্টি।
প্রাসঙ্গিক উল্লেখ:
১.মুজাফফর আহমদ (পঞ্চদশ মুদ্রণ ২০১২) কাজী নজরুল ইসলাম:
স্মৃতিকথা ,ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রা. লি. কলকাতা,পৃ.১২২-২৩
২. নজরুলের পত্রাবলি,২০১৩,প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁকে লিখিত পত্র,
নজরুল ইন্সটিটিউট,ঢাকা
৩. হুমাযুন কবির ,১৯২৯,আহমদ পাবলিশিং হাউস,ঢাকা,পৃ.৬৬-৬৭
৪. নজরুলের প্রবন্ধ সমগ্র,২০১৫, ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’নজরুল
ইন্সটিটিউট,ঢাকা
৫. নজরুলের প্রবন্ধ সমগ্র,২০১৫, ‘ক্ষুদিরামের মা’নজরুল ইন্সটিটিউট,ঢাকা
ড. আহমেদ মাওলা, প্রফেসর, বাংলা বিভাগ,
ডিন, কলা ও মানবিক অনুষদ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়