জ্যোতির্ময় নন্দী
আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার ২০২৪ পেয়েছে জার্মান কথাসাহিত্যিক জেনি এর্পেনবেকের লেখা উপন্যাস কায়রস। জার্মান ভাষায় লেখা মূল বইটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন মাইকেল হফম্যান। পুরস্কারের পঞ্চাশ হাজার পাউন্ড লেখক আর অনুবাদক সমানভাবে ভাগাভাগি করে নিয়েছেন।
উল্লেখ্য, বুকার পুরস্কার দেয়া হয় শুধুমাত্র ইংরেজি ভাষায় লিখিত বা অনূদিত সাহিত্যের জন্যে। অনুবাদ হলে পুরস্কারটা মূল লেখক ও অনুবাদককে যৌথভাবে দেয়া হয়ে থাকে।
কায়রস উপন্যাসটির আখ্যানভাগ গড়ে উঠেছে অসমবয়সী দুই নর-নারীর প্রেমকে কেন্দ্র করে। ১৯৮০’র দশকের পূর্ব বার্লিনের প্রেক্ষাপটে এক প্রৌঢ় আর এক তরুণীর গভীর অন্তরঙ্গ সম্পর্কের ক্রমশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়ার হৃদয়বিদারক কাহিনী এটি।
পঞ্চাশোর্ধ বয়সের হান্স তখন একজন লেখক, বিবাহিত, এবং একটা তরুণ পুত্রের বাবা। ১৯৮৬’র ১১ জুলাই একটা বাসের মধ্যে তার সঙ্গে দেখা হয় উনিশ বছরের তরুণী ক্যাথারিনার। প্রথম পরিচয়েই তারা পরস্পরের প্রতি এক আকস্মিক আর তীব্র আকর্ষণ অনুভব করে। আকর্ষণের এ আগুন ইন্ধন পায় সঙ্গীত ও শিল্পের প্রতি দুজনের সম-অনুরাগ থেকে, আর তা তীব্রতর হয়ে ওঠে তাদের এ সম্পর্কের সম্পূর্ণ গোপনীয়তা রক্ষা করার অঙ্গীকার থেকে। কিন্তু শুধু একটা রাতের জন্যে মেয়েটা একটু বিপথগামী হওয়ায় লোকটা তাকে ক্ষমা করতে পারল না আর তাদের মধ্যেকার সম্পর্কে একটা বিপজ্জনক ফাটলের সৃষ্টি হল। খুলে গেল নিষ্ঠুরতা, নির্যাতন আর শক্তি প্রয়োগের পথ।
তাদের চারপাশের জগৎটাও তখন দ্রুত পাল্টে যাচ্ছিল। ভেঙে পড়ছিল জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র বা পূর্ব জার্মানি, আর সেইসাথে অবসান ঘটছিল পুরোনো সব নিশ্চয়তা আর আনুগত্যের। উদয় হচ্ছিল পুনরেকত্রিত বার্লিন তথা জার্মানির এক অনন্ত সম্ভাবনাময় নবযুগের।
হান্স বড় হয়ে উঠেছে হিটলারের কব্জায় থাকা জার্মানিতে। সে চোখের সামনে দেখেছে, কিভাবে হান্সের বাবার সমস্ত সত্তাকে হিটলারের ফ্যাসিবাদ গ্রাস করে নিল। হান্স তার নিজের কাছে আর মানবজাতির কাছে প্রমাণ করতে চেয়েছিল যে, সে ফ্যাসিবাদী নয়। ফ্যাসিবাদী বাবার ছেলে হিসেবে গভীর অপরাধবোধে আক্রান্ত সে তার আঠারো বছর বয়সে সাবালকত্ব অর্জনের পরপরই পশ্চিম বার্লিন থেকে পূর্ব বার্লিনে চলে আসে।
ক্যাথারিনার সঙ্গে প্রথম যখন দেখা হল, হান্সকে ভীষণভাবে টানল মেয়েটার তারুণ্যের উজ্জ্বলতা আর ঐশ^র্য। তবে তাদের সম্পর্কটা চলমান থাকবে নাকি শেষ করে দেবে সেটা শুধু মেয়েটাই স্থির করবে বলে সে সিদ্ধান্ত নিল। এদিকে সম্পর্কটা যতই ঘনিষ্ট হচ্ছিল, হান্স তত বেশি আক্রমণাত্মক হয়ে উঠছিল আর ক্যাথারিনার ওপর এক জবরদস্তিমূলক নিয়ন্ত্রণ গড়ে তুলেছিল। হান্সের ফ্যাসিবাদী পিতার রক্ত যেন গোপনে কাজ করছিল তার মধ্যে। এবং আশ্চর্যের কথা, ক্যাথারিনাও এসব অত্যাচার-অপমানকে তার প্রাপ্য বলে ধরে নিয়েছিল।
বইটি সম্পর্কে লেখক নিজে যা বলেছেন:
এটা এক বৃহৎ প্রেম আর তার বিনষ্টির একটি ব্যক্তিগত গল্প, তবে সেইসাথে এটা একটা রাজনৈতিক ব্যবস্থার সম্পূর্ণ বিলুপ্তির গল্পও। সহজ কথায়: শুরুতে যেটা সঠিক মনে হয়, সেটা ভুল কিছুতে পরিণত হয় কিভাবে? এ পরিবর্তনই আমার কৌতূহল জাগিয়ে তুলেছে। ভাষা নিয়ে এটাতে অনেককিছু করার আছে। ভাষার সাথে এর অনেক সম্পর্ক রয়েছে– যেহেতু ভাষা তৈরি করা হয় যতটা অনুভূতি আর দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশের জন্যে, ততটাই গোপন করার বা বিশ্বাসঘাতকতার জন্যেও। এটা ভেতরকার কিছু প্রকাশ করতে পারে, অথচ তারপরও মানুষকে বিভ্রান্তও করতে পারে, অথবা এটা কেবল একটা ফাঁকা পৃষ্ঠাও হতে পারে। এখানে কী বলা হয়েছে আর তার বদলে কোথায় কোথায় রয়েছে নীরবতা, সেটা যদি খুঁটিয়ে দেখেন, আপনিও পারবেন অদৃশ্য স্রোতধারা, প্রজন্মান্তরে স্থানান্তরিত ক্ষমতা, কাজে লাগানো আর অপব্যবহারের কৌশলগুলি অনুসরণ করতে।
লেখকের পরিচয়
জেনি এর্পেনবেকের জন্ম ১৯৬৭-তে পূর্ব বার্লিনে। তিনি একাধারে একজন পুরস্কৃত ঔপন্যাসিক, নাট্যকার এবং অপেরা পরিচালক। প্রথম জীবনে তিনি প্রশিক্ষণ নিয়েছেন বই বাঁধাইয়ের কাজের, তারপর কাজ করেছেন থিয়েটার প্রপ্সের ম্যানেজার হিসেবে। এর পর গীতিনাট্য পরিচালনা নিয়ে পড়াশোনা করে ১৯৯০-এর দশকের শেষদিক থেকে একজন সফল অপেরা পরিচালক হিসেবে ক্যারিয়ার গড়ে তোলেন।
১৯৯৯-এ তাঁর প্রথম উপন্যাসিকা বা ছোট আকারের উপন্যাস গেশিস্টে ফম্ আইটেন কিন্ড্ প্রকাশিত হয়। দা ওল্ড চাইল্ড
নামে সুসান বের্নোফস্কির করা বইটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয় ২০০৫-এ। ইংরেজিতে অনূদিত এর্পেনবেকের অন্যান্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে: দা বুক অব ওয়ার্ডস (২০০৮), ভিজিটেশান (২০১০), স্বতন্ত্র বিদেশী উপন্যাস পুরস্কার বিজয়ী দা এন্ড অব ডেজ (২০১৪), বুকার পুরস্কার ২০১৮’র জন্যে দীর্ঘতালিকাভুক্ত উপন্যাস গো, ওয়েন্ট, গন (২০১৭), নট এ নভেল: কলেক্টেড রাইটিংস অ্যান্ড রিফ্লেকশানস (২০২০) প্রভৃতি। তাঁর কাজ অন্ততপক্ষে তিরিশটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে, এবং বলা হয়ে থাকে যে, স্বদেশ জার্মানির চেয়েও বিদেশেই তিনি বেশি পরিচিত একজন সুলেখক হিসেবে। ২০১৯-এ গার্ডিয়ান পত্রিকা তাঁর ভিজিটেশান উপন্যাসটিকে একুশ শতকের সেরা একশটি বইয়ের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে।
যুক্তরাষ্ট্রে মাইকেল হফম্যান অনূদিত এর্পেনবেকের কায়রস উপন্যাসটি ২০২৩-এ বুকার পুরস্কারের অনূদিত সাহিত্য বিভাগে দীর্ঘতালিকাভুক্ত করা হয়েছিল। শেষপর্যন্ত ২০২৪-এ বইটি অর্জন করে এই মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার, গুরুত্বের দিক থেকে যেটার স্থান নোবেল পুরস্কারের ঠিক পরে বলেই মনে করা হয়।
অনুবাদকের পরিচয়
কায়রস উপন্যাসটির ইংরেজি অনুবাদক মাইকেল হফম্যান একাধারে একজন কবি, সাহিত্য পর্যালোচক ও অনুবাদক। এ পর্যন্ত তাঁর কবিতার চারটি বই , এবং একটি পর্যালোচনা গ্রন্থ বিহাইন্ড দা লাইনস: পিসেস অন রাইটিংস অ্যান্ড পিকচারস প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া ফেবার অ্যান্ড ফেবার ২০১৫ সালে তাঁর প্রবন্ধ সংগ্রহ হোয়্যার হ্যাভ ইউ বিন? প্রকাশ করে। এ ছাড়া তিনি রবার্ট লাওয়েল ও জন বেরিম্যানের নির্বাচিত কবিতা প্রকাশ করেন, এবং জেমস ল্যাসডানের মঙ্গে যৌথভাবে সম্পাদনা করেন আফটার ওভিড নামে একটি প্রভাবশালী কবিতা সঙ্কলন।
জেনি এর্পেনবেক ছাড়া বহু ধ্রুপদী জার্মান সাহিত্যিকের কাজেরও ইংরেজি ভাষান্তর করেছেন হফম্যান, যাঁদের মধ্যে রয়েছেন ফ্রাঞ্জ্ কাফ্কা, জোসেফ রথ আর হান্স ফালাদা। তাঁর অনুবাদ করা কাফ্কার মেটামরফসিস অ্যান্ড আদার স্টোরিজ প্রকাশিত হয়েছে পেঙ্গুইন থেকে। বর্তমানে তিনি কাজ করছেন আরেক জার্মান লেখক আলফ্রেড ডবলিনের বার্লিন আলেকজান্ডারপ্লাট্জ্ বইটির অনুবাদ নিয়ে। তাঁর করা ফালাদার ইতোপূর্বে অননূদিত একটি উপন্যাসের হফম্যান-কৃত অনুবাদ ২০১২-তে প্রকাশিত হয় এ স্মল সার্কাস নামে।
হফম্যান থাকেন লন্ডন আর জার্মানিতে ভাগাভাগি করে। ১৯৯৩ থেকে তিনি গেইনসভিলের ফ্লোরিডা বিশ^বিদ্যালয়ে খ-কালীন শিক্ষক হিসেবেও কাজ করে আসছেন। তাঁর সাম্প্রতিক অনুবাদকর্মের মধ্যে রয়েছে কাফকার দা বারো (পেঙ্গুইন, ২০১৭)। এ ছাড়া তিনি এখন পেঙ্গুইনের জন্যে ফালাদা’র ক্লেইনার মান্, ওয়াস নুন? উপন্যাসটির ইংরেজি তর্জমা করছেন লিটল ম্যান, হোয়াট নাউ? নামে।
২০১৬-তে হফম্যানের চারটি কাব্যগ্রন্থ নাইটস ইন দা আয়রন হোটেল, অ্যাক্রিমনি, করোনা এবং অ্যাপ্রক্সিমেটলি নোহোয়্যার ফেবার থেকে পুনঃপ্রকাশ করা হয়। তাঁর সাম্প্রতিকতম কাব্যগ্রন্থ ওয়ান লার্ক, ওয়ান হর্স ফেবার থেকে প্রকাশিত হয়েছে ২০১৮-তে।
বুকার পুরস্কার ২০২৪-এর বিচারকদের মন্তব্য
আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার ২০২৪-এর বিচারকরা ছিলেন: উইলিয়াম কেন্টরিজ, নাতালি ডায়াজ, এলেনর ওয়াচটেল, রমেশ গুণসেকেরা এবং অ্যারন রবার্টসন। কায়রস সম্পর্কে তাঁদের অভিমতগুলো নিচে তুলে ধরা হল প্রশ্নোত্তর আকারে:
পাঠকদের উৎসাহিত করার জন্যে একটা বাক্যে বইটার সারমর্ম তুলে ধরতে চাইলে কী বলবেন?
কায়রস হল পূর্ব জার্মানির ক্রমশ মরে যেতে থাকার বছরগুলোর প্রেক্ষাপটে এক বেদনাদীর্ণ ভালোবাসার সমৃদ্ধ বয়নের উদ্দীপনা। উজ্জ্বল গদ্যভাষায় এর্পেনবেক উন্মোচিত করেছেন এক ১৯ বজরের তরুণী আর অনেক বেশি বয়সের লেখকের মধ্যেকার কামার্ত আবেগপূর্ণ সম্পর্কের যাবতীয় জটিলতা।
বইটাতে ব্যতিক্রমী কিছু আছে, যেমনটা আগে কোনো উপন্যাসে দেখেন নি?
কায়রস অস্বস্তিকর আর জটিল একটা উপন্যাস। এটা লেখা হয়েছে সময়ের ভার আর কিভাবে সেটা আমাদের জীবনে চেপে বসে তা নিয়ে। এটা শুরু হয় ভালোবাসা আর কামাবেগ নিয়ে, কিন্তু সবকিছুর পরেও এটা ক্ষমতা, শিল্প, সংস্কৃতি, আর একটা ভিন্ন ধরনের অবসেশানের ইতিবৃত্তও বটে।
এই বইটা সম্পর্কে কী মনে করেন? পাঠকরা এটাকে শুধুমাত্র প্রশংসা করবে, নাকি সত্যিই ভালোবাসবে?
তরল, বাদ্যযন্ত্রের বাক্যে, এরপেনবেক পাঠককে তার চরিত্রের কাছাকাছি নিয়ে আসে এবং তারা যে পূর্ণ চাহিদার মুখোমুখি হয়। এগুলো একইসাথে যত শারীরিক নাটক এবং নৈতিক আর রাজনৈতিক দ্বিধাদ্বন্দ্ব সবগুলোকে নিয়ে যায় এক সঙ্কটবিন্দুর দিকে।
প্রবহমান, সাঙ্গীতিক বাক্যে এর্পেনবেক পাঠকদেরকে তাঁর চরিত্রগুলোর আর তারা যেসব বিপজ্জনক দাবিদাওয়ার মুখোমুখি হয় সেগুলোর কাছাকাছি নিয়ে আসেন।
আপনি কি আমাদের এমন কোনো বিশেষ চরিত্র সম্পর্কে বলতে পারেন যার সাথে পাঠকরা সংযুক্ত হতে পারে এবং কেন?
যদিও উপন্যাসটি জুড়ে দুটো চেতনাকে অনুসরণ করা হয়, সর্বোপরি এটি ক্যাথারিনার গল্প। ১৯৮০’র দশকের শেষ তিন বছরে পূর্ব জার্মানির বৃহত্তর ইতিহাসের সাথে যুক্ত থাকা অবস্থায় আমরা তাকে অনুসরণ করি, যখন সে একটি আত্ম-ধ্বংসাত্মক ঘূর্ণিতে নেমে যায় আর তারপর একসময় ফের উঠে আসে।
যদিও এটা একটা কল্পিত কাহিনি, তারপরও এটাতে কি এমন কিছু আছে যেটা বিশেষ করে আজকের বিশ্বে আমরা যেসব সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছি সেগুলোর সাথে প্রাসঙ্গিক?
উপন্যাসটি পাঠককে বার্লিন প্রাচীরের পতনের ঠিক আগেকার পূর্ব বার্লিনে বাসাবাড়ি, ক্যাফে, রাস্তাঘাট, কর্মক্ষেত্র এবং খাদ্য-পানীয়ের সাথে পাঠককে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচয় করিয়ে দেয়, যেগুলোর অস্তিত্ব এখন আর নেই। এটি সেই সময়কার কঠিন নীতিগত বাছাইগুলো এবং ভূমিকম্পের মতো রাজনৈতিক রূপান্তরণ-জনিত ক্ষয়ক্ষতিগুলোকেও তুলে ধরে।
বইটিতে কি এমন কোনো নির্দিষ্ট মুহূর্ত আছে, যা আপনার মনে দাগ কেটে আছে, আর যদি তাই হয়, কেন?
মুহূর্ত নয়, তবে একটি সংবেদনশীলতা: ক্যাথারিনা শিল্পকে যতটা ভালোবাসে, ততটাই হান্সকেও। সঙ্গীত, কবিতা এবং নাটক নিয়ে ঋদ্ধ আলোচনা সারা বইটিকে আলোকিত করে রেখেছে।
আলোচকদের মন্তব্য
লস অ্যানজেলেস টাইমস-এ চার্লস ফিঞ্চ লিখেছেন:
জার্মান উপন্যাস সংখ্যায় যত বেশি হোক না কেন, আমেরিকায় এ মুহূর্তে অবিসম্বাদিত তারকা হলেন জেনি এর্পেনবেক। তিনি হলেন একজন সদাভ্রাম্যমাণ, ক্রুদ্ধ, উদ্দীপ্ত হৃদয়ের লেখক, এবং একজন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপকের শরণার্থী সংকটের সময়কার জীবন নিয়ে লেখা গো, ওয়েন্ট, গন-সহ তাঁর সবচেয়ে বেশি পরিচিত বইগুলোতে তিনি আবেগ আর ইতিহাসকে এমনভাবে মিলিয়ে দিয়েছেন, যা বলা যায় জার্মান উপন্যাসের জন্যে এক নতুন পথ খুলে দিয়েছে। এখন তাঁর প্রখর অথচ পুরস্কারযোগ্য ‘কায়রস’-এ এর্পেনবেক আবার এই একই কাজটা করেছেন, খুব সাবধানে ১৯৯০-এ জার্মানি পুনরেকত্রিত হওয়ার ঠিক আগেকার সময়টাতে পূর্ব জার্মানির এক প্রেমের সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার মানচিত্রটি আঁকার মধ্যে দিয়ে। বইটা আপনাকে কিছু অস্তিত্বগত প্রশ্নের চরম গুরুত্বের সামনে দাঁড় করিয়ে এমনভাবে চমকে দেয়, যেটা বোধ হয় খুব কম উপন্যাসই করতে পারে। এসব প্রশ্ন বার্লিন প্রাচীরের পতন এবং ধর্ষ-মর্ষকামের উত্থান দুটোকে নিয়েই।
গার্ডিয়ানে নাতাশা ওয়াল্টার লিখেছেন:
জেনি এর্পেনবেকের কায়রস আমার এযাবৎ পড়া সবচেয়ে তমসাচ্ছন্ন অথচ সবচেয়ে সুন্দর উপন্যাসগুলোর একটি। একটা স্তরে এটা একটা প্রেমের উপন্যাস, কিংবা বলা যায় প্রেম হারানোর উপন্যাস। এটা শুরু হয় ক্যাথারিনা নামের একটা মেয়ের তার প্রাক্তন প্রেমিকের মৃত্যু সংবাদ শোনার মধ্যে দিয়ে। প্রেমিকের কাগজপত্রের বাক্সগুলো তার অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছে দেয়া হয়, এবং শেষপর্যন্ত সে যখন ওগুলো খুলে পড়তে বসে, অতীত তার সামনে এসে হাজির হয় হাওয়ায় ছড়িয়ে দেয়া একগোছা তাসের মতো।…….. এসব ব্যাক্তিগত আর রাজনৈতিক পরিব্রাজনের আগাগোড়া কখনোই এর্পেনবেক গৎ বাঁধা বুলি বা চেনাজানা প্রতিক্রিয়ার দিকে হাত বাড়ান নি। প্রেম আর রাজনীতির ব্যাপারে মতামত বা দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে উপন্যাসটা অবশ্যই তমসাচ্ছন্ন, কিন্তু তারপরও এর্পেনবেকের শ্রমসাধ্য আর আপোষহীন কল্পনা বইটির শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত পাঠককে উজ্জীবিত করে রাখে।
স্পেকটেটরের অ্যাডাম বেগলি লিখেছেন:
কায়রসকে রূপক হিসাবে পড়া সহজ– বিনষ্ট এক প্রেম এবং পূর্ব জার্মানির নিয়তি, তার সমাজতান্ত্রিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর
তার নাগরিকদের কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে তার আদর্শের বিকৃতির কাহিনি এ বইয়ে সমান্তরাল এগিয়ে গেছে। কিন্তু একনিঃশ্বাসে উচ্চারিত দুটি প্রশ্ন আলাদা উত্তরের দাবি রাখে। কেবল রূপক হিসেবে পাঠ করলে সেটা এর্পেনবেকের সূক্ষ্ম, বিভিন্ন স্তরসমৃদ্ধ, গভীর ইঙ্গিতপূর্ণ এবং অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী উপন্যাসটির প্রতি সুবিচার হতে পারে না।
নিউ ইয়র্ক টাইমসে ডুইট গার্নার লিখেছেন:
কায়রস যদি শুধু একটা আবেগের বা শোক-দুঃখের গল্প হতো, তবে এটা সম্পর্কে আর বেশি কিছু বলার থাকত না। কিন্তু ১৯৬৭-তে জন্ম নেয়া জার্মান লেখক এর্পেনবেক, যাঁর কাজ গত এক দশকে ইংরেজি ভাষাভাষী পাঠকদের মনোযোগী নজরে এসেছে, তিনি আমাদের সবচেয়ে পরিশীলিত এবং শক্তিশালী ঔপন্যাসিকদের একজন।
…. এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, ইতিমধ্যেই একজন ভবিষ্যত নোবেলজয়ী হিসেবে তাঁর নাম উচ্চারিত হচ্ছে। তাঁর কাজ প্রথমে সুসান বার্নোফস্কি এবং তারপর এখন কবি ও সমালোচক মাইকেল হফম্যানের মতো তারকা অনুবাদকের আকৃষ্ট করেছে।
জ্যোতির্ময় নন্দী, কবি ও অনুবাদক