আনোয়ারুল হক
সদ্য শেষ করা গল্পের কপিটা বুক পকেটে নিয়ে ঘরের বাইরে বের হয়ে ঘরের দরজায় তালা দিল জাহিদ।
রাস্তায় বের হতেই শীতের সকালের মিস্টি রোদে মনের ভিতর গুনগুনিয়ে উঠলো পছন্দের গান।
আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে কোনরকম দাঁত-ব্রাশ মুখ ধোয়া সেরে টেবিলে বসে গেছে। এখন একটানে গল্পটা লেখা শেষ করার তৃপ্তি আর সকালের নরম রোদ, কপোতের ওম সব মিলিয়ে একটা শান্তি শান্তি ভাব তার মনে। সিঁড়ি ভেঙে তিনতলা থেকে রাস্তায় নেমে সামনে একটা খালি রিক্সা পেয়েই উঠে বসলো। বললো, মামা চলেন।
প্যাডেল রিক্সা চলতে শুরু করতেই হুঁশ হলো, কোথায় যাবে সে?
রিক্সাওয়ালা ঘাড় বাঁকিয়ে পিছনে তাকাতেই বলে ফেললো, লালমাটিয়া যাও।
বলেই ভাবলো, লালমাটিয়া যাবো? রেনুদের বাসায়! তবে কি রেনুদের বাসায় যাবো বলেই আমার সব তোড়জোর! এমন তো একটু আগেও ভাবিনি! না ভেবেছি, মনই জানতো না!
রিক্সাওয়ালাকে দিক ফেরাতে গিয়েও কী মনে করে আবার ওর পিঠের ওপর থেকে জাহিদ হাত গুটিয়ে নিল। কালো পিচ রাস্তায় রিক্সার চাকা ঘুরতে লাগল একটানা। সেইসঙ্গে বেঁধে রাখা গেল না নবীন লেখকের মনের চাকা। সেও ঘুরতে লাগল।
গতরাতে জাহিদের ঘুমে ঘুমের চেয়ে স্বপ্ন ছিল বেশি। স্বপ্নে তার গল্পের নায়িকার কমনীয় মুখটা সারারাত মনের জানালায় জেগে ছিল। ভোরে ঘুম ভেঙেই অর্ধসমাপ্ত লেখাটা শেষ করার তগিদ তাকে থির হতে দেয়নি। মধুর ভাললাগায় একটানে গল্পটা শেষ করেই মনে হয়েছিল একবার, লেখাটা প্রিয়জন কাউকে যদি দেখানো যেতো! ক্যাম্পাসের সবগুলি চেনা মুখ ছাপিয়ে এক ঝলক তার অবচেতনেই ভেসে উঠেছিল রেনুর মুখ। আর সে কারণেই বুঝি মুখ ফসকে রেনুর বাড়ির ঠিকানাটাই রিক্সাওয়ালাকে বলে ফেললো জাহিদ।
যদিও জাহিদ রেনুদের লালমাটিয়ার বাসায় যাওয়া ছেড়ে দিয়েছে প্রায় বছর খানেক হয়ে এলো। এক সময়ের প্রিয় নামটা ভুলতেই তো বসেছিল সে। আজ আবার এমন করে কেন যে মনে পড়ল ভেবে অবাক হচ্ছে সে। শুনেছে, আজকাল নাকি তার নাম শুনলে রেনু অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। তো সেই রেনুকেই ভাললাগার গল্পটা পড়ে শোনানোর জন্যে জাহিদ যাচ্ছে ওর বাসায়! তাহলে এ কথাই ঠিক যে, মানুষ নিজেকেই চিনতে পারে না ঠিকঠিক। সেই মানুষ আবার কথায় কথায় অন্যকে বিচার করে। সম্পর্ক ভাঙে। মুখ ফিরিয়ে নেয় অথবা ভুল মানুষকে ভালবাসে।
এইসব ভেবে ভেবে আর একবার চাইল রিক্সাটাকে ফেরাতে। হাত উঠল না।
এদিকে রিক্সাটা যতই লালমাটিয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ততই তার মনটা ভাললাগার বদলে সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। ভাবনাটা থেমে থাকলো না, রেনুর বাসায় যাওয়া কি ঠিক হচ্ছে ? এত এতদিন পর আচম্কা ওর বাসায় হাজির হয়ে যদি বলে, সে একটা গল্প পড়ে শোনাতে চায়, তাহলে কথাটা রেনু কি খুব সহজভাবে নেবে ?
বন্ধুরা, সে নিজেও তো জানে, তাদের সম্পর্ক তো আর আগের মত নেই!
গত বছরের তেইশ সেপ্টেম্বর। তারিখটা মনে থাকবে তার আজীবন। সেদিনের পর থেকে রেনুর সঙ্গে ওর আর দেখা হয়নি। রেনু চায়না বলেই নিরবে সেও সরে এসেছে। এরপর মাস ছয়েকের মতো জাহিদের প্রায়ই মনে হয়েছে, যাই। সংকোচে, লজ্জ¦ায় আবার নিজেকে ফিরিয়ে নিয়েছে। শুনেছে, ওর বন্ধু রূপকের কাছে, রেনু বলেছে, জাহিদের সাথে তার সম্পর্কটা নাকি এখন অতীতই। সেইসব স্মৃতি রেনু আর মনে করে না। ভুলে গেছে।
সত্যিই ভুলে গেছে সে! জাহিদ মন খারাপ করেছে, বিষাদে আচ্ছন্ন হয়ে ছিল কিছুদিন। নিজেকে ভুলে থাকার জন্যে রাত বিরাতে বন্ধুদের প্ররোচনায়ও ভুল পথে পা বাড়িয়েছে। কষ্ট পেয়েছে, চেষ্টা করেছে কিন্তু রেনুকে সে ভুলে যেতে পারেনি। আর যদি পারতোই তাহলে সে আজ হুট করে লালমাটিয়া যাচ্ছে কেন ? অবচেতন মন ভুলে থাকেনি ? বাহানা পেয়েই উঁকি মেরেছে!
রেনুও তো তাকে বলেছিল, কোনদিন সে ভুলে যাবে না। বলেছিল, ভালবাসি। সেই রেনু নাকি আজকাল তার নাম মুখেও আনতে চায় না। ওসব অতীত রঙ তামাশা! সত্যিই!
আবারও ভাবলো, তাহলে ফিরে যাওয়া উচিত। ফিরে যাই।
কিন্তু জাহিদ ফিরল না। ফিরতে পারল না। রিক্সাওয়ালাকে বলতে পারলো না,
-মামা, ঘুরো। শংকর যাবো। বাবলু ওর বন্ধু। নামকরা পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক। তাকেই তো দেবে সে গল্পটা। রেনুকে শোনানোর দরকার কি! সেদিকেই যাই। মন শোনে না মনের কথা। জাহিদের মন এখন একমুখি। সে মনে মনে তার প্রিয় শের আওরায়,
‘রোশনি চাঁন্দনী সে হোতা হ্যায়, সুরজ সে নেহি
মুহব্বত এক হি সে হোতা হ্যায় হাজারোসে নেহি‘।
দুই.
দ্বিপদী এই শের একদিন রেনুকে শুনিয়েছিল জাহিদ। তার রেনু, ফুলের রেনু, শতদলের পরাগ রেনু. আর সে কিনা একদিন বদলে গেল। জাহিদ কখনো ভাবেনি, রেনু অমন খামখেয়ালি। ভেবেছিল, অন্যরকম। সব বোকা প্রেমিক যেমন ভাবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আনেক বন্ধুর মতো, যারা অহরহ ভালবাসার নামে রুচি বদলায় রেনু তাদেরই মতো একজন হবে। সে কি আজ জানতে চাইবে, কেন রেনু তাকে ছেড়ে গেল ?
এই যে এতগুলি দিন পার হয়ে গেল বিনা খ কারণ জানতে না চাওয়ার নাম কি ব্যক্তিত্বহীনতা ? ? সে কি একটু জোর করতে পারলো না! ভেবে মনে মনে হাসে জাহিদ, ভালবাসা কি কারো দিক থেকে জোর করে হয়!
ভালোবাসা হয়ে যায়। কারো হয়, কারো হয় না। সারাজীবনে অনেকে টেরও পায় না। জানেও না, ভালবাসা করে কয়।
মোবাইল বাজতে স্ক্রিনে দেখলো অদিতির ফোন। এই সময়ে অদিতির ফোন জাহিদ আশা করেনি। মেয়েটার কি কোন সময় জ্ঞান নেই না কি! ধরবো কি ধরবো না করতে করতে প্রায় শেষ রিং টোনে চাপ দিল জাহিদ। এসময় এক ঝলক্ ভাবনাটা মনের ওপর দিয়ে উড়ে গেল, অদিতি কি তাকে ভালবাসে! পাত্তা দিল না ভাবনাটাকে। ঝরা পাতার মতো ওটাকে পড়ে যেতে দিল পাতার মর্মরে। বললো,
-অদিতি, এত সকালে তোমার ফোন, কেন ?
-একটু দরকার ছিল। তোমার সঙ্গে কি আজ ক্যাম্পাসে দেখা হতে পারে একটু। আসবে ?
অদিতিকে এড়িয়ে গেল জাহিদ। বললো,
-আজ পারবো না অদিতি। ভীষণ ব্যস্ত। পরে কথা হবে।
মোবাইলের সুইচ অফ করে দিয়ে মনটা খারাপ হলো ওর। কেন অদিতেকে না করলো সে! কেন ব্যস্ততার অজুহাত দিল! মনে পড়লো, কেউ একজন তাকে একদিন বলেছিল, যে তোমাকে ভালবাসে, তাকে ভালবাসো। যে ভালবাসে না তাকে কেন শুধু শুধু! তবে, কেউ কি জানে, মন কেন ঠিক তার উল্টোটাই করে!
ফিজিক্যাল কলেজের সামনে এসে জাহিদের নির্দেশে রিকসাটা ডানে মোড় নিলে সে ভুলে গেল অদিতিকে। লালমাটিয়া ব্লক ডি। এই রোডের শেষ মাথার বাড়িটাই রেনুদের।
তিন.
বিশাল ফ্লাট বাড়িটার গেইটের দুইপাশে দুটি বকুল গাছ। একটা মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে আছে আশেপাশে। ভেতরে ঢুকেই লনের দুইদিকে নানা রকম ফুল গাছের সমারোহ। জাহিদ আকাশমুখি বাড়িটার উপরের দিকে তাকাল। রেনু কি বাসায় আছে ?
এমনও ভাবলো, রেনু যদি কথা না বলে ওকে ফিরিয়ে দেয়! তাকে অপমান করে!
তবুও ফিরলো না জাহিদ, লিফটের বোতামে হাত রাখলো সে।
ন‘তলায় লিফটের দরজা খুলতেই জাহিদ অবাক! দেখলো, লিফটের সোজা ওর ফ্লাটের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে রেনু।
যেন তারই অপেক্ষায়, না কি কোথাও যাচ্ছে সে!
রেনুর অবাক চোখেমুখে অপ্রত্যাশিতের আলোছায়া। জাহিদই মুখ খুললো,
-আমি তোমার কাছেই এসেছিলাম রেনু।
-আমার কাছে ? কেন ?
ওটা যেন রেনুর প্রশ্ন ছিল না। ছিল ঝড়ো বাতাসের ঝাপটা। বিব্রত জাহিদের বুক পকেটে খসখস করে উঠলো গল্পের খসড়াটা। বললো, ও সরি, থাক তাহলে। যাই..
জাহিদকে চলে যেতে উদ্যত হতে দেখে দ্রুত কথা বললো রেনু,
-এলেই বা কেন, আবার চলে যাচ্ছো যে..
রেনুর কণ্ঠে জিজ্ঞাসা থাকলেও তেমন কম্পন নেই। সরল ঠাণ্ডা। আবার বললো,
-কেন এসেছো, বলো। তোমার তো আসার কথা না!
জাহিদ রাখ-ঢাক করলো না। বললো,
-যে কথা ভেবে এসেছিলাম, সেই ইচ্ছেটা এখন আর নেই। মরে গেছে। তোমার মতোন।
রেনু এমন কথায় একটু রাঙা হলো। তবে মুখে কিছু বললো না। স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে রইল।
জাহিদ রেনুর ঘরের দরজার গোড়া থেকেই ফিরলো। এবার লিফটে নয়। সিঁড়িতে।
পিছনে রেনু তাকে ফিরে যেতে ডাকলো না। জাহিদের চোখ দুটো জ্বালা করে ওঠে। দীর্ঘশ্বাস গোপন করে আস্তে আস্তে সিঁড়ি ভাঙে সে। তারপর একসময় আড়ালে চলে এলে উপর তলার সিঁড়ির মুখে পিছনে পড়ে রইল রেনু।
ভাবলো, জীবন তো কোন সেলুলয়েডের ফিতে নয়।
শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পথ বুঝি এমনই, একা চলার। উপরে উঠার কিংবা নিচে নামার।
পিছনে যারা থাকে তাদের জন্যেও বুঝি।
দীর্ঘ সিঁড়ি ভেঙে জাহিদ নিচে নেমে এলো একা। কিন্তু কিছুতেই রেনুকে তার মনের আড়াল করা গেল না। কেউ জানবে না। জানবে শুধু সে। একা।
আনোয়ারুল হক, গল্পকার, কুমিল্লা