মনি হায়দার
বিশ্বাস করুন, এক মুহূর্তের জন্যও আপনার অমর্যাদা করবো না, আমার সকল অনুরাগ একত্র করে আপনাকে ভালোবাসবো, সুখি করবো… সোনালি এ´প্রেস ব্যাংক পিএলসি র ডিএমডি মিস জুলেখা জুঁই হাত ধরে অফিসের চতুর্থ গ্রেডের কমীর্ শোভন রায়হানের প্রবল আকুতির সঙ্গে।
শোভন রায়হানের শরীরের সকল শক্তি বোধ বুদ্ধি হারিয়ে গেছে। বসে আছে অনিন্দ্য সুন্দরী জুলেখা জুঁইয়ের সামনে, খুব কাছাকাছি। জুলেখা জুঁই সাধারনত শাড়ি পরেন না কিন্ত আজ পরেছেন। শরীরের রং হালকা সাদা কিন্ত লাল রক্তাভ। মাথার উপর থেকে একরাশ বব কালোজামের চুল ঘাড়ের উপর পড়েছে। সবুজ কালারের জমিনে লাল পাড়ের শাড়ির সঙ্গে ম্যাচ করে পরেছে ব্লাউজ। ব্লাউজের বিপরীত রংয়ের ব্রা শরীরের কোমল সুন্দরকে প্রকাশ করছে সুন্দরের ছন্দে। কানে সবুজ রংয়ের গোল দুটি ঝুমকো দুলছে থির থির…। চোখ দুটি প্রজাপতির পাখনায় পিটপিট করছে টলোমলো আনন্দে।
সাত বছর আগে শোভন রায়হান সোনালী এক্সপ্রেস ব্যাংকে এসএস সি পরীক্ষার পর ঢুকেছিল পিয়ন হিসেবে। সমাজে বেঁচে থাকলে হলে পড়াশুনা দরকার, বুঝতে পেরেছিল শুরুতেই। গ্রামে পিতা কৃষক। নিজেদের জমি খুবই কম। নিজের এক বিঘা জমির সঙ্গে অন্যর জমি বরগা চাষ করে সাহেব আলী সংসার চালান। দুটি মেয়ে দুটি ছেলে সংসারে। শোভন বড় সন্তান। সাহেব আলী শত অভাবের মধ্যে চাইতেন ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করুক। সেই সূত্রে শোভন খেয়ে না খেয়ে স্থানীয় উজানগাও হাই স্কুল থেকে মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে দূর সম্পর্কের এক মামার সূত্রে ঢাকায় আসে। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে চাকরির আবেদন করে এবং সফল শোভন। পিয়নের চাকরিটা মন দিয়ে করতে শুরু করে। সকাল নটায় অফিস শুরু হয়ে কখনো কখনো বড় স্যারদের জন্য রাত নটা পর্যন্তও থাকতে হয়েছে। থেকেছে এবং নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করায় অফিসে একটা অবস্থান তৈরি করে নিতে সময় লাগেনি। মেসে গিয়ে রাতে পড়াশুনা করেছে। দু’ বছর পর ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে পাস করলে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ প্রমোশন দিয়ে ডেক্সের বসায়। বেতনও বাড়ে। বাড়িতে নিয়মিত বাবাকে টাকা পাঠায়। সাহেব আলী আরও গরু কিনেছেন। কয়েক কাঠা জমি কবলা করে আয় বাড়িয়েছেন। সাহেব আলীর সংসারে ধীরে ধীরে সুখের ডানা মেলতে শুরু করে পুত্র শোভনের কল্যাণে। পরের দুবছর পর শোভন রায়হান ডিগ্রি পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে যায়। কর্তৃপক্ষ শোভনের সাধনায় মুগ্ধ। ওকে প্রমোশন দিয়ে ডিএমডি জুলেখা জুঁইয়ের ব্যক্তিগত সহকারী পদে নিয়োগ দেয়।
নিজের প্রতি পাভেল রায়হান খুবই কৃতজ্ঞ। বলা যায়, আজ যেখানে এসে পৌঁছেছে, সেই পোছানোর পিছনে নিজের লড়াই, সাধনা আর একাগ্রতার কোনো তুলনা নেই। মেসের বন্ধুরা যখর সিনেমা হলে, কিংবা স্টেডিয়ামে ক্রিকেট খেলয় তুমুল আনন্দমুখর সময় কাচাচ্ছে, সেই সময়ে রুমের মধ্যে মুখ পড়েছে শোভন। প্রতিজ্ঞা ছিল, পিতাকে মুক্তি দেবে,নিজেও মুক্তি গ্রহণ করবে।
চমৎকার সময় যাচ্ছে শোভন রায়হানের। খুবই ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ জুলেখা জুঁই। সবকিছু আপডেট চান, নিখুঁত থাকতে পছন্দ করেন। আবার ব্যক্তিগত কোনো সমস্যা হলে খুব মানবিক জায়গা থেকে অনুভব করার চেষ্টা করেন। এইতো মাস তিনেক আগে শোভনের মা ও বাবা ঢাকায় এসেছিলেন, প্রথমত বেড়াতে। দ্বিতীয়ত সামান্য চিকিৎসার জন্য। তৃতীয়ত ছেলে এখন রাজপুত্র, টুকটুকে একটা বৌ দরকার— সে বিষয়ে কথা বলতে চান পুত্রের সঙ্গে। ডিএমডিকে বলতেই বিনাবাক্য ব্যয়ে তিন দিনের ছুটি দিয়ে দিলেন। এমন বসের সঙ্গে কাজ করেও আনন্দ আছে। অফিসে জুলেখা জুঁইয়ের বিশাল রুমের পাশেই ছোট রুম শোভনের। খুবই সাজানো। মাঝে মধ্যে দুপুরের খাবার একসঙ্গেই খান জুলেখা জুঁই। নিজেই ডাকেন, এসো আমরা একসঙ্গে খাই।
যদিও ডিএমডির সঙ্গে খানা খাওয়ায় এক ধরনের আনন্দ আছে কিন্ত ভয়ও আছে। ভয় এবং আনন্দ নিয়ে দুটো বছর কাটিয়ে দেয় শোভন রায়হান সোনালী এক্সপ্রেস ব্যাংক পিএলসির ডিএমডির সঙ্গে। কিন্ত গতকালই বিকেলের দিকে জুঁই ডাকলেন রুমে। সামনে দাঁড়াইতেই বললেন, বসো।
সামনের চেয়ারে বসলেও জুলেখা জুঁই হাতের কাগজ দেখছেন, সই করছেন, কম্পিউটারে মেইল চেক করছেন। এ রকমতো করেন না ডিএমডি। রুমে ঢুকলেই চটপট আদেশ দেন, ওটা করা। এটা কর। ফাইল নিয়ে যাও। এই ফাইল দিয়ে দাও এমডির ডেক্সে। কিন্ত এখন….
কম্পিউটারে মেইল চেক করতে করতে তাকান শোভনের দিকে, ম্যাম ডেকেছিলেন আমাকে!
চেয়ারে রাখলেন শরীর জুলেখা জুঁই, ডেকেছিলাম?
মাথা ঝাকায় শোভন, জি ম্যাম।
আগামীকাল সন্ধ্যার পরে আপনার কোনো কাজ আছে?
এক মুহূর্ত চিন্তা করে শোভন, না ম্যাম। কোনো কাজ নেই আমার।
গুড। ড্রয়ার খুলে একটা কার্ড বের করে বাড়িয়ে ধরে, এটা একটা রেস্টুরেন্ট। ধানমন্ডির শেখ কামাল রোডের মাঝ বরাবর। দশ তলা বিল্ডিংয়ের ছয় তলায়। সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ চলে আসবে।
ম্যাম, কোনো অনুষ্ঠান?
হাসেন ডিএমডি জুলেখা জুঁই মিষ্টি করে লাল লিপস্টিক চর্চিত দুই ঠোট ফাক করে, না না, কোনো অনুষ্ঠান নয়। আসলে বুঝতে পারবে।
কিন্ত শেখ কামাল রোড!
ধানমণ্ডির সাতাশ নাম্বার রোডটার নামই শেখ কামাল রোড।
দাঁড়ায় শোভন রায়হান, জানে কাজ শেষ হয়ে যাবার পর এক মুহূর্তও থাকা উচিৎ নয় বসের সামনে, আমি ম্যাম?
ওকে! প্রশ্রয়ের হাসি ডিএমডি জুলেখা জুঁইয়ের মুখে। রুমের বাইরে এসে নিজের রুমে ঢোকে শোভন। বসে নিজের চেয়ারে। কেনো এই তিলোত্তমা রেস্টুরেন্টে ডেকেছেন ম্যাম? নিজের মনে চিন্তা করে শোভন কিন্ত কোনো ক্লু আবিষ্কার করতে সমর্থ হয় না। মনে মনে হাসে, উচু তলার মানুষদের নানা ধরনের উদ্ভট পরিকল্পনা থাকে, অফিসের বড় বড় স্যারদের সহকারীদের কাছ থেকে জেনেছে।
পরের দিন যথাসময়ের দশ মিনিট আগেই উপস্থিত হয় শোভন রায়হান হোটেল তিলোত্তমায়। পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে প্যান্ট শার্ট জুতো পরেছে। লম্বায় একহারা গড়নের শোভন রায়হানকে সুপুরুষ মনে হয়। কিন্ত শোভনের আগেই হাজির জুঁই। শোভন বুঝতে পারে, আমার জন্য ম্যাম অপেক্ষা করছেন। ইতিমধ্যে রেস্টুরেন্টে লোকজন আসতে শুরু করেছে। ওকে দেখে এগিয়ে আসেন জুলেখা জুঁই, তুমি এসেছো?
জ্বি ম্যাম, শোভন আসায় জুঁই ম্যাম কেনো এতো আনন্দমুখর, বুঝতে পারে না শোভন রায়হান।
চলো, কনার্রের ওই টেবিলটায় বসি।
জুঁই ম্যারে পেছনে পেছনে কয়েকটা টেবিল পার হয়ে লেকের ধার ঘেষে একটা টেবিলে বসেন জুলেখা জুঁই। সামনে বসে শোভন। জুলেখা জুঁই শাড়ি পরেছেন। অথচ অফিসে কখনোই শাড়ি পরেন না। স্যালোয়ার কামিজই তিনি পরিধান করেন। মাথার চুল সাজিয়েছেন দারুণ খেঁাপায়। চোখে দিয়েছেন কাজল। ঠোটে লাল লিপিস্টিক। দারুণ লাগছে কিন্ত সরাসরি তাকাতে লজ্জা পাচ্ছে শোভন।
টেবিলে রাখা শোভনের ডান হাত হঠাৎ স্পর্শ করেন জুঁই ম্যাম, তোমাকে নার্ভাস লাগছে কেনো? আমি কি বাঘ, তোমাকে খেয়ে ফেলবো? ইজি হয়ে বসো।
বসছিতো ম্যাম! এদিক ও দিক তাকিয়ে প্রশ্ন করে শোভন, ম্যাম আর কেউ নেই আপনার অতিথি?
হাসেন জুলেখা, আজকে তুমিই আমার অতিথি।
অবিশ্বাস্য লাগে শোভন রায়হানের, আমি আপনার অতিথি?
হ্যাঁ, তুমিই আমার আজকের অতিথি, মিষ্টি হাসেন জুঁই।
শোভনের মাথায় ধরছে না, আজকের এই মুহূর্তের দৃশ্য। এই দৃশ্য বাস্তব? ঘটছে আমার জীবনে? আমার বস বিশিষ্ট সুন্দরী, ঢাকা শহরের কয়েকটা ফ্ল্যাটের মালিক, সোনালী এক্সপ্রেস ব্যাংকের ডিএমডির অতিথি আমি? নিশ্চয়ই আমি কোনো অপরাধ করেছি…
শোভন! কোমল কণ্ঠে ডাকেন জুলেখা জুঁই।
জ্বি ম্যাম!
ম্যাম ম্যাম করছো কেনো? এটাতো অফিস না। এখানে এসেছি তোমার সঙ্গে গল্প করতে। তুমিই তো জানো, আমার কোনো বন্ধু নেই। আমি একা একজন মানুষ।
কিন্ত আমিতো আপনার বন্ধু না ম্যা…
ঠিক আছে, আমরা একে অপরের বন্ধু না, কিন্ত বন্ধু হতে কতোক্ষণ, তিনি শোভনের ডান হাতটাকে আরও জড়িয়ে ধরেন, শোনো তোমার সঙ্গে এই মুহূর্তটা তৈরি করবার জন্য আমি এক বছর ধরে মনে মনে প্রস্তুতি নিয়েছি। কতোভাবে মনে মনে তোমার সঙ্গে গল্প করেছি, কথা বলেছি, তুমি জানো না।
শোভন চিনতে পারছে না, সামনে হাত ধরে বসে থাকা এই অনিন্দ্য সুন্দরীকে। সোনালী এক্সপ্রেস ব্যাংক পিএলসির ডিএমডি জুলেখা জুঁই কী সত্যি আমার সামনে? আমার ডান হাত ধরে আছেন কোমলের মোহনীয়তায়? কিন্তু কেনো?
ম্যাম!
শোনো শোভন, একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করেন জুঁই, আমি বড় অভাগা একজন মানুষ। তুমি বা চারপাশের লোকেরা দেখে আমার কতো শান শওকত ক্ষমতা প্রভাব প্রতিপত্তি, ভাবে আমি সুখের ে¯্রাতে ভেসে চলা এক নারী। কিন্ত আমি নি:স্ব এক মানুষ। কেউ নেই আমার। ইউনিভারসিটিতে পড়বার সময়ে মেধাবী ক্লাসমেট মাহজার মুকুলের সঙ্গে আমার সম্পর্ক তৈরি হয়। আমরা দুজনে এক সঙ্গে থাকি, আডডা দিই, গল্প করি, ক্লাশ করি। সুখে, দারুণ সুখে সময় কেটে যায়। দুজনেই পড়ি অর্থনীতিতে। ফাইনাল পরীক্ষা শেষ করেই ঢুকে গেলাম একটা প্রাইভেট কলেজে। মুকুল দুই বছরের একটা স্কলারশিপ নিয়ে চলে গেলো অস্ট্রেলিয়ায়। দুই পরিবারে কথা হলো, এক বছর পর এক মাসের ছুটি পাবে, সেই সময়ে দেশে এসে বিয়ে করে নিয়ে যাবে আমাকে। কিন্ত মুকুল আর কোনোদিন আসেনি। জেনেছি, অস্ট্রেলিয়ার এক মেয়েকে বিয়ে করে সেখানেই সেটেল্ড। না, আমি কাঁদিনি, কিন্ত শোভন, অসম্ভব কষ্ট পেয়েছি। একা একা কষ্ট কাটিয়ে ওঠার পর অনুভব করলাম, তীব্র অপমান। আমাদের বন্ধুরা পরিচিতজনেরা দূর থেকে অকারণে শ্লেষের তীর ছুড়তে থাকে। বাবা, তুমি জানো শোভন ছিলেন সরকারের বড় আমলা। দাদার আমলেই ঢাকার ধানমণ্ডিতে আমাদের বিশাল জায়গা। কোনোদিন অভাব কি বুঝিনি অর্থ ও প্রাচুয্যের্র। কিন্ত …
সামনে এসে দাঁড়ায় ওয়েটার।
নিজেকে সামলে নিয়ে তাকান শোভন রায়হানের দিকে, কী খাবে?
ম্যাম আমি তেমন কিছু খাবো না।
কেনো?
এমনিই। ইচ্ছে করছে না।
সেটা কী হয়? তুমি আমার প্রিয় মেহমান। আমন্ত্রন করে এনেছি, না খেলে আমি কষ্ট পাবো।
ঠিক আছে, বার্গার আর কোল ড্রিংকস দিন, ওয়েটারকে বলে শোভন।
ওকে স্যার, ওয়েটার অর্ডার নিয়ে চলে যায়।
শোভন রায়হানের ডিএমডি সৌন্দর্যের কুসুম জুলেখা জুঁই কাঁদছেন! জীবনে অনেক নাটক দেখেছে শোভন, অনেক গল্প উপন্যাস পড়েছে কিন্ত আজ নিজেই উপন্যাসের একটা অধ্যায়ের সাক্ষী হতে চলেছে। কী করবে, কী বলবে, বুঝে উঠতে পাছে না ও। ভাবছে, ম্যাম আরও কিছু বলবেন আমাকে? কী বলবেন? আমি কী ম্যামকে রেখে চলে যাবো? পরিচিত কেউ যদি দেখে ফেলে? বিশেষ করে অফিসের কেউ দেখলে… সামনে এক অনিন্দ্য সুন্দরীকে রেখে শোভন রায়হান চাকরির জন্য প্রার্থনা করছে। সব ধ্বংস হোক কিন্তু চাকরি…
শোভন! মা মারা গেছেন আট বছর আগে, বাবা একলা এখন। বয়স হয়েছে, হাঁটতে পারেন না। সারাদিন রুমে থাকেন। বাবাকে দেখে, আমি ভয় পাচ্ছি। অনেক বিয়ের প্রস্তাব এসেছে, মন্ত্রীর ছেলে, রাষ্ট্রদূত, দেশের বিশাল ব্যবসায়ীর ছেলে, ব্যবসায়ী এসেছে কিন্তু আমি ফিরিয়ে দিয়েছি। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, জীবনে বিয়ে করবো না। কিন্ত আমি সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছি। একলা জীবনকে আমি ভীষণ ভয় পাই।
ম্যাম, কাকে বিয়ে করবেন?
তোমাকে, জুলেখা জুঁই দুহাতে অঁাকড়ে ধরে শোভনের দুই হাত, আমি তোমাকে কখনো ছোট করবো না। অপমান করবো না। শুধু তুমি গত দুই বছরে যেভাবে অফিসের নানা ঝড় জাপটা থেকে সামলে নিয়েছো, অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তুমিই আমার উপযুক্ত স্বামী, মুখের দিকে আকুতি ভরা দৃষ্টি রাখেন জুলেখা জুঁই, আমাকে ফিরিয়ে দিও না শোভন।
আ আ আমি কী বলবো, বুঝতে পারছি না ম্যাম!
আমি তোমার জুলেখা, আমি তোমার জুঁই, ম্যাম না। আমি তোমাকে আমার মতো আগলে রাখবো। তোমার যাতে অমর্যদা না হয়, আমি…
মরিয়া হয়ে বলে শোভন রায়হান, এটা হয় না ম্যাম!
কেনো?
আমার চেয়ে আপনার বদনাম হবে অনেক বেশি। অফিসে বিশ্রী তিক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হবে আপনার জন্য।
আমি সব ভেবেছি, ভেবেই তোমাকে বিয়ে করতে চাই। যদি বলো তোমার বাবা মায়ের কাছে যেতে হবে, আমি যাবো। ওনারা আমার মুরব্বি, আমি পায়ে ধরে তোমাকে চাইবো।
কিন্ত আমাকে নিবার্চন করলেন কেনো আপনি? বিস্ময় কেঁপে ওঠে শোভন রায়হান? কেনো আমাকে…
তুমিই তোমার শ্রম নিষ্ঠা আর মর্যাদায় আমাকে জয় করেছো শোভন। বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়ার পর আমি অনেক খঁুজেছি, হঠাৎই একদিন মনে হলো, তুমি হতে পারো আমার যোগ্য পাত্র। যেদিন আমি অফিসে অসুস্থ হয়েছিলাম, তুমি কি যত্নটা যে করলে, হাসপাতালে নিয়ে গেলে, আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোর করে ভর্তি করালে, দুই দিন হাসপাতালে প্রায় সার্বক্ষণ আমাকে পাহারায় রাখলে, আমি সেদিনই সিদ্ধান্তি নিয়েছি… তুমিই আমার যোগ্য পাত্র। তুমি আমার বন্ধু।
আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি মাত্র!
সেই দায়টুকু সুচারুভাবে কে আজকাল পালন করে? তোমার ওপর অফিসের কোটি কোটি টাকায় কাজ দিয়ে আমি নিভার্র থাকতে পারি, জানি শোভন যথা সময়ে কাজটা করবে। আমি কখনো তোমার ওপর রাগ করবো না, আমি তোমাকে ভালোবাসায় ভরিয়ে রাখবো। তুমি ছাড়া আমার সামনে কেউ নেই, তীব্র আকুতি ঝরে জুলেখা জুঁইয়ের কণ্ঠে।
আমি আপনার অধীনে একজন কর্মচারী মাত্র। আপনার সঙ্গে আমার বিয়ে হলে আপনার বন্ধুরা উপহাসে অশ্রদ্ধায় বিষাক্ত করে তুলবে আপনার জীবন, মরিয়া হয়ে প্রতিরোধের চেষ্টা করে শোভন রায়হান।
হাসেন জুলেখা জুঁই, আমার বন্ধুদের কথা বলছো? ওরা এক একটা মাকাল ফল। ফোনে, ইনবক্সে আমার সঙ্গে দূরে নির্জনে সময় কাটানোর প্রস্তাব করে। বুঝতে পারছো, ওরা কতোটা কীট নরকের? আর তোমাকে বিয়ে করে একটা প্রতিশোধও নিতে চাই।
জুলেখা জুঁইয়ের কমনীয় কিন্ত নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে শোভন রায়হান, কিসের প্রতিশোধ নিতে চায় আমার ম্যাম আমাকে বিয়ে করে?
আমি বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, অষ্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাহজার মুকুলতে দেখাতে চাই, তথাকথিক শিক্ষিত মানুষদের চাইতে সাধারণ মানুষ, কম লেখাপড়া জানা মানুষ অনেক মানবিক, অনেক বেশী দায়িত্বশীল। তুমি আমার জীবনে প্রতিবাদের একটি মহাবৃক্ষ হয়ে বেঁচে থাকো। আমি তোমাকে আমার জীবনের ধ্রুব করে রাখবো শোভন! আকুল আকুতিতে ভেঙে পড়েন জুলেখা জুঁই।
সঙ্গে সঙ্গে বিশিষ্ট কৃষক সাহেব আলী আর বৈরভী খাতুনের পুত্র শোভন রায়হান সিদ্ধান্ত নেয়, আর যা হোক— সামনে লোভনীয় জীবনের হাতছানি। সোনালী এক্সপ্রেস ব্যাংকের ডিএমডিকে বিয়ে করলে হয়তো আর্থিকভাবে ভালো থাকবো, এক ধরনের সাজানো গোছানো পালিশ জীবন যাপন করবো কিন্তু আমি আমাকে হারিয়ে ফেলবো। জীবনে এতো লড়াই করলাম কেনো? আমার আমির জন্যতো! আমি ম্যামের মনবাসনার গিনিপিগ হবো না কখনোই…।
ম্যাম জুলেখা, আপনি তো আপনার চিন্তা এবং প্রকল্প আমাকে বললেন। এবং এই প্রকল্প নিয়ে আপনি অনেক দিন ভেবেছেন. আমাকেও তো আপনি ভাবনার সুযোগ দেবেন, জীবনতো ফোলানো বেলুন নয়, জীবন এক মস্ত রেলগাড়ি।
মিষ্টি হাসেন জুঁই, অবশ্যই ভাববে। বিয়ে তো ছেলেখেলা নয়, সারা জীবনের সিদ্ধান্ত। কিন্ত আমি জানি, আজকের এই সময়ের পর আমাকে ছাড়া তুমি বিকল্প কিছুই ভাবতে পারবে না।
হাসে শোভন, দেখা যাক ম্যাম ভাবনার ফল কী আসে। উঠুন, অনেক রাত হয়েছে, প্রায় সাড়ে নটা। চলুন, আপনাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি।
হাসেন জুঁই, দেখো তুমিই তোমার দায়িত্ব তুলে নিয়েছো।
চলুন বাসায়, দুজনে ধানমণ্ডির তিলোত্তমা রেস্টুরেন্টের লিফট বেয়ে নিচে নেমে আসে। ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে এসে দরজা খুলে দাঁড়ালে, জুলেখা জুঁই গাড়িতে ওঠার আগে গভীর আয়াত চোখের প্রেম আর অনুরাগে তাকান শোভন রায়হানের দিকে, আসি!
জি ম্যাম! গাড়ির দরজা বন্ধ করে দেয় শোভন রায়হান।
কালো রঙের বিশাল মাসিডিজ গাড়িটি রেস্টুরেন্টের পাকিং এরিয়া থেকে বের হয়ে প্রধান সড়কে পেরোবার সঙ্গে সঙ্গে শোভন রায়হান,সোনালী এক্সপ্রেস ব্যাংকের ডিএমডির অফিস সহকারী শরীর দুলিয়ে আকাশ বাতাস মাটি প্রকম্পিত করে বিকট হাসিতে ফেটে পড়ে। চারপাশের লোকজন ওকে হাসতে দেখে বিস্ময়ে বিপন্নবোধে আক্রান্ত হতে থাকে।
যেতে যেতে কেউ একজন মন্তব্য করে, আহারে লোকটা বুঝি পাগল হয়ে গেলো!
মনি হায়দার, কথাসাহিত্যিক