নাওজিশ মাহমুদ
রোজার মাস চলছে। আাবার মুক্তিযুদ্ধের মাস। সামনে ঈদ। বাঙালি মুসলমানদের জীবনে প্রধান উৎসব ঈদ। ঈদ নিয়ে আমাদের জীবনে যে রকম উৎসাহ উদ্দীপনা ছিল, এবার ঈদকে সামনে রেখে উৎসাহ উদ্দীপনার রেশ মাত্র নাই। কারণ দেশের ভবিষ্যত ও জাতির ভবিষ্যত নিয়ে উৎকন্ঠায় আছি আমরা। আমাদের ভবিষ্যত অনিশ্চয়তার মুখোমুখি। এই অনিশ্চয়তা থেকে আমরা কিভাবে মুক্তি পাবো। একটি গণ-অভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে সরকারের পতনের পর আমরা এখন কি করবো? এটাই এখন বড় প্রশ্ন হিসেবে দেখা দিয়েছে।
হাজার বছরে গড়ে ওঠা একটি জাতি ১৯৭১ সালে সশস্ত্র লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে একটি স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠার পর আবার প্রকৃত স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ১৯৭১ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এই ৫৪ বছরে আমরা কি স্বাধীনতা হারিয়ে বসে আছি? নাকি ১৯৭১ সালে আমরা প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জন করতে পারি নি? এই প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে এবারের গণ-অভ্যুত্থানের পর। ১৯৭১ সাল ধেকে ২০২৪ পর্যন্ত ৫৪ বছরে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি সমাজনীতি এবং সংস্কৃতি কি ভুল পথে পরিচালিত হয়েছে। না হলে বর্তমান প্রজন্ম ২৪ সালে গণ-অভ্যুত্থানের পর এই প্রশ্ন করে কিভাবে? তবে হা এটা সত্য যে আমাদের দেশে সত্যিকারে জনগণের শাসন কায়েম হয় নি। গণতন্ত্র চর্চা ব্যাপকতা লাভ করতে পারে নি। শাসকেরা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। আমাদের নির্বাচন প্রক্রিয়া ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। আমাদের দেশের গণতন্ত্র সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনা গণবিরোধী এবং দুর্নীতিতে আকন্ঠ নিমজ্জিত। আমাদের রাজনীতির প্রধান অংশ রাজনৈতিক ধারা থেকে সরে এসেছে। রাজনীতি হয়ে পড়েছে অর্থ আয় এবং মানুষের উপর অনৈতিক আধিপত্যের হাতিয়ার। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ তার আবেদন হারিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীরা রাষ্ট্রীয় সুবিধার বিনিময়ে মুক্তিযুদ্ধের নীতি থেকে বিচ্যুত হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় অধিকাংশই ভুয়া।
প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের বিরাট অংশ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হতে পারে নি। কারণ একটায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং বিশ্বাস অমুক্তিযোদ্ধাদের হাতে জিম্মি। আমাদের অর্থনীতি অসৎ ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কাছে বন্দি। এই পরিস্থিতিতে দেশের রাজনৈতিক কাঠামো ফ্যাসিবাদের খপ্পরে চলে গিয়েছে। আমাদের রাজনীতি ফ্যাসিবাদেরর প্রবণতা জন্ম থেকেই আছে। উত্তারাধিকার সূত্রে ফ্যসিবাদ আামাদের রাষ্ট্রব্যবস্থাপনা বহন করছে। আমাদের সমাজেও ফ্যাসিবাদেরর প্রবণতা বিদ্যমান। সুতরাং রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিকশিত না হয়ে ক্রমাগত ফ্যাসিবাদের দিকে ঝুঁকেছে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য। আমাদের ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলসমূহের মধ্যে কমবেশি ফ্যাসিবাদী সংস্কৃতি দ্বারা আচ্ছন্ন। বিগত হাসিনা আমলে এসে এর প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে।
ফ্যাসিবাদ উৎপত্তি হয় ক্ষমতার প্রতি লোভ ও নৈতিকতার ঘাটতি থেকে। ক্ষমতা ও দুর্নীতি পরস্পরের হাত ধরে চলে। বর্তমান প্রজন্ম কি এই নৈতিকতার ঘাটতি পুরণ করে সুস্থ ধারার রাজনীতি চালু করতে পারবে? আমরা গভীর মনোযোগ সহকারে তাদের গতিবিধি লক্ষ্য করছি। তাঁদের অধিকাংশের ঝোঁক মুসলিম জাতীয়তাবাদের দিকে। তাদের সখ্যতাও বেশি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের প্রতি। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের দুর্বলতা মাজার ও পীর মুর্শিদের দিকে। এই দেশের অধিকাংশ মুসলমান এই পীর মুর্শিদের হাত ধরেই ধর্মান্তরিত হয়েছে। পীর মুর্শিদের মাজার আক্রমণের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদের একটি ধরণও আমরা দেখাতে পাচ্ছি।
বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে। যার প্রধান ভিত্তি ছিল বাঙালি জাতীয়তবাদ। মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে জন্ম লাভ করা বাংলদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থাপনা মুক্তিযুদ্ধের মূলনীতি সাম্য, সামাজিক ন্যয়িবিচার এবং মানবিক মর্যাদার প্রতি কখনও দায়বদ্ধ ছিল না। যার পরিণতিতে রাষ্ট্র প্রথম দিনে থেকে ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থি।
২০০৮ সালে নির্বাচিত হয়ে পরবর্তীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে ভোটারবিহীন নির্বাচনের মধ্যদিয়ে গণতন্ত্র ও জনমতকে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে হাসিনা সরকার ক্ষমতায় থাকার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে ফ্যাসিবাদের আশ্রয় নেয়। আমাদের সমাজে ফ্যাসিবাদের প্রবণতা সমভাবে বিরাজ করায় রাষ্ট্রব্যবস্থাপনা বাড়তে বাড়তে ফ্যাসিবাদি চরিত্র ধারণ করে বসে আছে। ৫৪ বছর ধরে ক্ষমতাসীন সামরিক সরকার এবং রাজনৈতিক সরকার কেউ এর দায় থেকে মুক্তি পেতে পারে না। প্রতিক্রিয়ায় বর্তমান প্রজন্ম সরকার উৎখাতে জীবন বাজি ধরে এগিয়ে আসে । হাজারের উপর প্রাণ উৎসর্গ করে এবং হাজার দশেক পঙ্গুত্বকে বরণ করে সরকারের পতন ঘটায়। সরকার পতনে নেতৃত্বের ভূমিকা সরকারি বিশ্ববিধ্যালয়সমূহ। মূল স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে ভূমিকা রাখে বেসরবকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মাদ্রাসার ছাত্ররা। নেপথ্যে জামাতসহ ইসলামি শক্তি ও বিএনপির ইন্ধন থাকলেও সরাসরি সামনে আসে নি। তাই সরকার পতনের পর ড. ইউনুচ ছাড়া কোন গত্যন্তর ছিল না। কারণ আর্ন্তজাতিক গ্রহণযোগ্যতা এবং আওয়ামী লীগ বিরোধী সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য আর কাউকে পাওয়া না যাওয়ায়। সরকারপতনের পর কোন সরাসরি রাজনৈতিক শক্তি ক্ষমতায় না এসে এনজিও প্রাধান্য একটি সরকার গঠিত হয়। বর্তমান সরকার ফ্যাসিবাদি চরিত্রের রাষ্ট্রব্যবস্থাপনাকে জনবান্ধব হিসেবে কিভাবে গড়ে তুলে এটাই এখন দেখার বিষয়। কিন্তু সরকারে মধ্যে কিছুটা দ্বিধাও রযেছে। কি করবে এটা নিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে সরাসরি আক্রমণ না করলেও মুক্তিযুদ্ধের আইকন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ফ্যাসিবাদের জনক হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীরা কৌশলে সক্রিয় মুক্তিযুদ্ধকে জাতির মনোজগত থেকে মুছে দিতে। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তির দ্বন্দ্ব; গণতন্ত্র ও ফাসিবাদের দ্বন্দ্ব; জনবান্ধব ও গণবিরোধী রাষ্ট্রব্যবস্থাপনার দ্বন্দ্ব কিভাবে মীমাংসিত হয় তা দেখার জন্য আমরা অপেক্ষায় আছি।
দেশ ও জাতি এখন বাঁক বদলের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। সামনে তার অনেকগুলি পথের নিশানা। জাতি এখন দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে আছে কোন পথ খুঁজে নিবে। ফ্যাসিবাদ থেকে রাষ্ট্রব্যবস্থাপনাকে পরিবর্তন করে জনগণবান্ধব উত্তরণ ঘটানোই হচ্ছে বড় চ্যালেঞ্জ। চ্যালেঞ্জের প্রধান প্রতিপক্ষ জামাতে ইসলাম, হেফাজতে ইসলাম ও ইসলামি আন্দোলন এবং আলেম ওলামারা। মুক্তিযুদ্ধের বিচ্যুত ধারা ক্ষমতার জন্য মুক্তিযুদ্ধকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে। মুক্তিযুদ্ধ এবং ইসলামের মধ্যে যেমন বিরোধ সৃষ্টি করানো হয়েছে। তেমনি শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ সরকার মুক্তিযুদ্ধকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করায় খোদ মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নের সম্মুখীন। ফ্যাসিবাদের ভাবাদর্শ হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে কাজে লাগানোর কারণে মুক্তিযুদ্ধ হয়ে উঠেছে ফ্যাসিবাদের উত্থানের উৎস। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সাম্য, সামাজিক ন্যায় বিচার ও মানবিক মর্যাদাকে ধারণ না করে মুক্তিযোদ্ধারা হয়ে উঠেছে ব্যক্তিবন্দনা ভিত্তিক ফাসিবাদি চেতনার ধারক।
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। মুক্তিযুদ্ধে যখন অংশ গ্রহণ করি তখন আমার বয়স ছিল মাত্র ১৫ বছর। একজন কিশোর। মুক্তিযুদ্ধোত্তর সমাজ পরিবর্তনের লড়াইয়ে যখন নিজেদের প্রস্তুত করছি, তখন মুক্তিযুদ্ধকে খুব একটি বড় বা গুরুত্বপুর্ণ কাজ বলে মনে হয়নি। রাষ্ট্র পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ সৃষ্টি শুধু শাসকের পরিবর্তন ও পতাকার পরিবর্তন বলে মনে হয়েছে। এর চেয়ে বড় পরিবর্তন মনে হয়েছে অর্থনৈতিক মুক্তি, চিন্তার স্বাধীনতা , সাংস্কৃতিক চর্চার স্বাধীনতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা। যা একমাত্র সমাজ পরিরবর্তনের মধ্যদিয়ে সম্ভব। রাষ্ট্র পরিবর্তনের চেয়ে সমাজ পরিবর্তন অনেক অনেক কঠিন কাজ। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান কাঠামোতে জোর করে আমাদেরকে কেউ নেয় নি। আমরা স্বেচ্ছায় ভোট দিয়ে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠার জন্য ভোট দিয়েছি। ২৩ বছরে আমাদের মোহভক্সগ ঘটে। মোহভক্সেগর পর পাকিস্তানে যোগদানের খেসারত হিসেবে আমদেরকে ৩০ লক্ষ লোককে হারাতে হয়েছে। ৫ লক্ষ মা-বোনদের ইজ্জত বিসর্জন দিতে হয়েছে। ১৯৪৭ সালে পূর্বপুরুষদের দায়ভার ১৯৭১ সালের প্রজন্ম অনেক দাম দিয়ে পরিশোধ করতে হয়েছে। ৫৪ বছরের শাসকদের ভুলের ও অন্যায়ের দায়ভার ২০২৪ সালে জাতি ও প্রজন্মকে নিতে হচ্ছে। বর্তমান প্রজন্ম এখন প্রশ্নবিদ্ধ করেছে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে। প্রশ্ন তুলেছে ১৯৭১ সালের অর্জন নিয়ে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও অনেক প্রশ্ন উঠেছে।
কিন্তু হাজার বছরে গড়ে ওঠা সমাজ পরিবর্তনের জন্য দেশ, জাতি ও সমাজ এবং জনগণ মোটেও প্রস্তুত ছিল না। তবু পাকিস্তান কাঠামো থেকে বের হয়ে আসতে এই ২৩ বছর বয়সী পাকিস্তান থেকে বের হয়ে আসা যত সহজ হয়েছে , হাজার বছরে গড়ে ওঠা সমাজ পরিবর্তন অনেক অনেক কঠিন কাজ। তাই মুক্তিযুদ্ধে আমাদের অংশ্রগহণ মনে হয় নি জীবনে অনেক বড় কাজ করেছি। আরও বড় কিছুর জন্য উৎসর্গ করতে হবে ভাবনা নিয়ে আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।
তাই মুক্তিযুদ্ধ সময়কালে অংশগ্রহণ নিয়ে কোন দিন গর্ব করার বিষয় মনে হয় নি। অথচ সুদূর সন্দ্বীপ থেকে জেলে নৌকা করে সমুদ্র পার হয়েছি। সেখান পিচ্ছিল বারিয়ার ঢালা দিয়ে পাহাড় ডিঙ্গিয়ে হাটহাজারি থেকে বাসে নাজির হাট নেমে সেখান থেকে পায়ে হেঁটে ফটিকছড়ি মাইজভান্ডারের দরবার শরীফ হাজির হই একদিন কাটিয়ে। রাতের বেলা মাইজভান্ডার থেকে বের হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড় ডিঙ্গিয়ে বৈষ্ণবপুর দিয়ে ভারতে প্রবেশ করি। সেখান থেকে হরিনা ক্যাম্পে কয়েকদিন থেকে বিমান ও ট্রাকে করে ভারতের দেরাদুনের টান্ডুয়া ক্যাম্পে প্রশিক্ষণের জন্য যাই। প্রশিক্ষণ শেষে আগরতলার ট্রানজিট ক্যাম্প গ্লাস ফ্যাক্টরিতে কয়েকদিন থেকে দীর্ঘ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে উদয়পুরের সন্নিকট তেপানিয়া ক্যাম্পে স্থানান্তরিত হই। তেপানিয়া ক্যাম্পে আমরা দীর্ঘদিন অপেক্ষায় ছিলাম। চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে বিশেষ পরিকল্পনা থাকায় অবশেষে অক্টোবর মাসে আমাদের কয়েকটি গ্রুপে ভাগ করে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে হয়। সেই প্রবেশও বৈষ্ণপুর দিয়ে। বৃহৎ অংশ চলে যায় মিজোরামের দেমাগিরিতে। ফজলুল হক মনির সরাসরি কমান্ডে। রাঙ্গুনিয়া ও দক্ষিণ চট্টগ্রাম স্বপন চৌধুরীর কমান্ডে এবং হাটহাজারী রাউজান এবং ফটিকছড়ি নিয়ে এস এম ইউসুফের কমান্ডে। সন্দ্বীপ মিরেরশ্বরাই এবং সিতাকুন্ড সাবের আহমদ আসগরির কমান্ডে। মহানগর ব্যতিরেকে জেলার কমান্ডে ইঞ্জিনিয়ার ইব্রাহিম। তার সাথে সংযুক্ত হয়ে পড়ি আমরা কয়েকজন। আমাকে প্রথমে পাঠনোর কথা ছিল সন্দ্বীপ একটি গ্রুপের কমান্ডার হিসেবে কিন্তু সন্দ্বীপে সরাসরি যুদ্ধ না থাকায় আমি যেতে অস্বীকার করি। তখন জেলা সদর দপ্তরে সংযুক্ত থাকি। আমরা একসাথে প্রবেশ করি ওয়ারলেসসহ পাহাড় ডিক্সিগয়ে কয়েকদিন হেঁটে স্থিত হই বকয়িতুল্লাহ খামারে। জায়গটা সম্ভবত রাউজান থানা, ফটিকছড়ি এবং রামগড় মহকুমার মধ্যখানে। সেখানে কয়েকদিন অবস্থান করি। দুদিন পর স্বপন চৌধুরী চলে যায় রাঙ্গুনিয়ার উেেদ্দশ্যে। তার আগে রাউজান থানার কমান্ডার নাজিম উদ্দিনের কমান্ডে একটি গ্রুপ চলে যায় রাউজানের উদ্দেশ্যে। স্বপন চৌধুরীর গ্রুপের সাথে নুরুনবী ও সুব্রত বড়ুয়া ওয়ারলেস সহ পরিবহন করতো। একদিন তাদের সাথে ক্যাম্প থেকে দূরবর্তী স্থানে গিয়ে ওয়ারল্যাসের মেসেজ পাঠাবার জন্য সঙ্গ দেই। স্বপন চৌধুরী যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী হাতে ধরা পড়ে, তখন নুরুনবী ও সুব্রতও ধরা পড়ে এবং নিহত হয়। সুনীলের অসাবধানবশত গুলিতে রাউজানের নাজিম মারা যায়। ১৯৭১ সালের নভেম্বরের ২০ তারিখ সকালে জানতে পারলাম ঈদ। পাশে ছোট একটি মসজিদ ছিল। ছড়াতে গোসল করে সার্ট পেন্ট পড়ে ঈদের নামাজ পড়তে গেলাম। এই সময় মসজিদে ঢুকার পূর্বে রাস্তায় কয়েকজনসহ আগ্রবাদ কলোনীর আমাদের জুনিয়র মাহবুবের সাথে দেখা। ভারতে যাচ্ছে। দেখলাম সে ক্ষুধায় কাতর। তখন আমি আমার পকেটে ১০০ টাকা ছিল । আমি টাকা দিয়ে বলেছিলাম পাশেই দোকান আছে তুমি সেমাই খেয়ে বাকি যা থাকে টাকা আমাকে ফেরত দিও। আমার কাছে আর টাকা নেই। আমি ঈদের জামাত শেষ বের হয়ে দেখলাম মাহবুব দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে টাকা ফেরত দেয়ার জন্য। অর্থাৎ যুদ্ধের সময় আমাদের নৈতিকতা এতো বেশি উচ্চে ছিল, সে টাকা নিয়ে চলে যেতে পারতো। আমি জানি তাঁর কাছে টাকা নেই সে টাকা নিয়ে চলে গেলে আমার সামান্য হয়তো অসুবিধা হতো কিন্তু সে যদি নিয়ে যেত আমার আফসোস করা ছাড়া কোন উপায় থাকতো না। সে ভারতে যাচ্ছে তার টাকার বড় প্রয়োজন ছিল। এরপর দীর্ঘ ৫৪ বছর তার সাথে আমার আর দেখা হয় নি। বেঁচে আছে কিনা জানি না। বারবার তার কথা মনে পড়ে।
নাওজিশ মাহমুদ : গবেষক ও প্রাবন্ধিক, ঢাকা