আহমেদ মাওলা
ষাটের দশকের অন্যতম কথাসাহিত্যিক রিজিয়া রহমান (১৯৩৯-২০১৯) সম্প্রতি আশি বছর বয়সে প্রয়াত হলেন। পেছনে রেখে গেছেন প্রায় পাঁচ দশকের সাহিত্য কীর্তি। সমাকালীন সাহিত্যিক মহলে তাঁর নাম অনেকটা অনু”চারিতই ছিল। কোনো সাহিত্য মঞ্চে তাঁর উপস্থিতি চোখে পড়েনি। অনেকটা নিভৃতচারী হয়ে বসাবাস করেছিলেন এই ঢাকা শহরে। যদিও সাতচল্লিশ পরবর্তী বাংলাদেশের স্বতন্ত্র সাহিত্যিক অভিযাত্রায় রিজিয়া রহমানের অবদান খুব সামান্য নয়। তাঁর লেখা ঘর ভাঙ্গা ঘর (১৯৭৪) উত্তর পুরুষ (১৯৭৭) রক্তের অক্ষর (১৯৭৮) বং থেকে বাংলা (১৯৭৮) অলিখিত উপাখ্যান (১৯৮০) শিলায় শিলায় আগুন (১৯৮৪) একটি ফুলের জন্য (১৯৮৬) হারুন ফেরেনি (১৯৯৪) ইত্যাদি উপন্যাস ভিন্ন এক উপলখণ্ডের মতো সাহিত্যের ইতিহাসে অম্লান হয়ে থাকবে। রিজিয়া রহমানের উপন্যাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য তাঁর বিষয় নির্বাচন এবং নির্মাণ কৌশলের স্বাতন্ত্র্য। এক্ষেত্রে তিনি নৃতাত্ত্বিক, সামাজিক, ইতিহাস ঐতিহ্যকে গুরুত্ব দিয়েছেন এবং কাহিনি ও চরিত্র সৃষ্টিতে তাঁর প্রযত্ন প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়।
বাংলাদেশে কথাসাহিত্যে দু’টি ধারা লক্ষকরা যায়। ক. পপুলার রাইটিং বা জনপ্রিয় ধারা, খ. সিরিয়াস বা মূলধারা। রিজিয়া রহমান দ্বিতীয় ধারার অভিযাত্রী। তাঁর উপন্যাস বিনোদনের সামগ্রী হয়ে উঠতে পারেনি বলেই আজকের প্রজন্মের কাছে রিজিয়া রহমান অপরিচিত, অপঠিতই থেকে গেছে।
একসময় তিনি রাঙ্গামাটি, চট্টগ্রাম শহরে বসবাস করেছিলেন, একথাও অনেকে জানেনা। এক সাক্ষাৎকারে তিনি চট্টগ্রাম থাকার স্মৃতি চারণ করেছেন এভাবে-
চট্টগ্রাম সেই ষাটের দশকে ছিল ছিমছাম ফাঁকা পাহাড় সমুদ্রঘেরা চমৎকার একটি আধুনিক শহর। প্রায় ঘরে বেড়াতাম শহরের এখানে সেখানে। প্রায় চার’শ বছরের পুরানো সেন্ট প্লাসিড গির্জা, ফিরিঙ্গি বাজার, পাথরঘাটা ও শহরের অন্যান্য প্রাচীন স্থানগুলো আমাকে কৌতুহলী করতো।
প্রায় যেতাম কর্ণফুলী নদীর পাড়ে, পতেঙ্গা সমুদ্রের ধারে। নদী সমুদ্র, আউটার অ্যাংকরে থেমে থাকা জাহাজের সারি, কর্ণফুলী নদীর বুকে আলোড়ণ তুলে বন্দরে বিদেশি জাহাজের আসা যাওয়া আর পতেঙ্গা সীমেন্স হোস্টেলের সামনে বিভিন্ন দেশি বিভিন্ন ভাষি নাবিকদের আনাগোনা ভীষণ আকৃষ্ট করত আমাকে। চট্টগ্রামের প্রাচীন সমুদ্র বন্দর সাড়ে চার’শ বছর আগে এদেশে আসা পুর্তগিজরা যার নাম দিয়েছিল ‘পোর্ট গ্র্যান্ডী’ তাকে ঘিরেই বাংলাদেশের ইতিহাসে সংযোজিত হয়েছিল কলঙ্কিত পুর্তগিজ অধ্যায়। সেই দুর্ধর্ষ জলদস্যু আর পুর্তগিজদের প্রেক্ষাপটে লিখলাম দ্বিতীয় উপন্যাস ‘উত্তর পুরুষ’। (গল্পকথা, সম্পাদক চন্দন আনোয়ার, রিজিয়া রহমান সংখ্যা, ২০১৭) চট্টগ্রাম শহরের দক্ষিণ-পূর্বকোণে, কর্ণফুলীর কূলঘেঁষা একটা প্রাচীন এলাকা ফিরিঙ্গিবাজার। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের ফিরিঙ্গিবাজারের সঙ্গে আজকের ফিরিঙ্গিবাজারের মিল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। রিজিয়া রহমান ষাটের দশকে দেখা ফিরিঙ্গিবাজার এবং পুর্তগিজদের পরবর্তী প্রজন্মের সামাজিক, পারিবারিক জীবনকে পটভূমি করে লিখেছিলেন তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘উত্তর পুরুষ’ (১৯৭৭)। এখানকার অধিবাসীরা কালাফিরিঙ্গি, মাটিয়াফিরিঙ্গি নামে পরিচিত। সবাই রোমান ক্যাথলিক খ্রিস্টান। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র ফিরিঙ্গিবাজারের বুড়ো অ্যান্টনি ডিক্রুজ। একসময় রেলওয়ের ক্লার্ক ছিল, এখন অবসর, নিঃস্ব, অক্ষম বৃদ্ধ। গলির মোড়ে দর্জি আজাহার আলীর দোকানে প্রায় বসে থাকে, চা বিস্কুট খায়। মাঝে মাঝে কখনও ইংরেজি বুলিতে বলে— ‘জানো আজহার, তোমাদের ইতিহাস ভুল লিখেছে,
উইওয়ার নট হার্মাদ পাইরেটস বাট উইওয়ার কনকারার ডু ইউ ফলো।’ দর্জি আজহার আলীর এসব পুরানো ইতিহাসের প্রতি কোনো আগ্রহ দেখায় না। তবু ডিক্রুজ পূর্বপুরুষ পুর্তগিজদের অতীত উজ্জ্বল গৌরবের কথা বর্ণনা করে। বুড়ো ডিক্রুজ একাই বকবক করে। দোকানের ছেলেটা চা এনে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে তাকেও দেয়। ‘উত্তর পুরুষ’ উপন্যাসের মোট এগারোটি অধ্যায় জুড়ে ফিরিঙ্গি সমাজের মানুষগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক তাদের জীবনযাপন, বিপন্নতা, হতাশা, বৃহত্তর বাঙালি সমাজের সঙ্গে খাপখাওয়াতে না পারা, এই অ্যাংলো ইন্ডিয়ান জাতিসত্তার অস্তিত্ব সংকটকে তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন। পুর্তগিজ ঐতিহ্য বিচ্ছিন্ন অথচ এদেশীয় সমাজে বেমানান অস্তিত্বের টানাপোড়েনের ছবি ফুটে উঠে অ্যান্টনি ডিক্রজের মেয়ে লিসি ডিক্রজের মধ্যে। বন্দরে অ্যাংকর করা জাহাজের পুর্তগিজ সিম্যান জেরি ফার্দিনান্দের সঙ্গে লিসি হোটেলে নিশিযাপন করে সে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে। বর্তমান অবস্থা থেকে সে পালাতে চায়। ফার্দিনান্দ লিসিকে বিয়ে করে লিসবনে নিয়ে যাবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়। একসময় জাহাজ বন্দর ত্যাগ করে চলে যায়। জেরি ফার্দিনান্দ আর কখনো ফিরে আসেনা। লিসি ডিক্রুজ প্রতারিত হয়। লিসির ভাই বনি ডিক্রুজ গিটার বাজিয়ে গান গায়। গির্জা তাকে আকৃষ্ট করেনা, ‘ধর্মে তার আস্থা নেই। মারিয়া, এলিজা, মনিকা প্রমুখ প্রাক্তন প্রেমিকাদের প্রতি অনুকম্পা ছাড়া কিছুই তার নেই। বার্মিজ কালোবাজারি ধনী ব্যবসায়ীর মংপুর দলে ভিড়ে যায় সে। অনেক টাকা উপার্জনের নেশায় তাকে পেয়ে বসে। একসময় বার্মিজ ধনী ব্যবসায়ীর মেয়ে মাশোয়ের প্রেমে পড়ে বনি ডিক্রুজ। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়না, পুলিশের হাতে ধরা পড়ে সে।
১৪৯৮ সালের দিকে ভাস্কো-দা-গামা আসার পর পুর্তগিজরা ভারতবর্ষের নানা জায়গায় উনিবেশ গড়ে তোলে। গোয়া, কলকাতা, হুগলি, বরিশাল, সবুজ ডানামেলা রঙিন নারীর মতো জনপদ চট্টগ্রামে। গৌরাঙ্গ, দীর্ঘদেহী, সোনালীচুল, নীল চোখের পুর্তগিজদের স্বভাব ছিল হিংস্র। বন্দুক, গোলাবারুদ তাদের সঙ্গে ছিল। আরব বণিক, আরাকান দস্যুদের সঙ্গে পুর্তগিজদের সংঘর্ষ লেগেই থাকতো। ১৪৯৮ থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত প্রায় সাড়ে চারশো বছরের ইতিহাস অ্যান্টনি ডিক্রজের চোখে ভাসে। পাহাড়, নদী, সাগর, অরণ্য সবুজ সম্পদশালী নগরী চট্টগ্রাম হাতছানি দিয়ে আকৃষ্ট করেছিল অনেককে। হার্মাদ পুর্তগিজ, আরব বণিক, ফরাসি, ওলন্দাজ আর্মেনিয় সবাই সম্পদ লুণ্ঠনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। একসময় বাংলার স্বাধীন নবাব হুসেন শাহ তাঁর সেনাপতি পরাগল খাঁকে পাঠিয়ে ছিলেন এই সন্ত্রাসের জনপদ চট্টগ্রামের শান্তির জন্য। রিজিয়া রহমান কাহিনির কাঠামোতে ইতিহাসকে এভাবে গেঁথে দেন , যেন সময়ের স্বরুপ পাঠকের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠে। ডিক্রুজ তার স্বপ্নিল দৃষ্টি থেকে তুলে আনে ১৯৩০ সালে চট্টগ্রমের অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের নায়িকা প্রীতিলতা ওয়াদ্দারের কথা। পাহাড়তলীর ‘ইউরোপীয়ান ক্লাব’কে তীর্থস্থানের মতোই পবিত্র মনে হয়। ইতিহাস যেন সমান্তরালভাবে ডানা মেলতে থাকে ‘উত্তর পুরুষ’ উপন্যাসে। ১৬৫৯ সালে দিল্লির সম্রাট শাহজাহানের চার পুত্র দারা-সুজা-আত্তরঙ্গজেব-মুরাদ- এর মধ্যে চরম ভ্রাতৃদ্বন্দ্ব শুরু হয়। সেসময় বাংলার শাসনকর্তা ছিলেন শাহ সুজা। আত্তরঙ্গজেব তার সেনাপতি মীর জুমলাকে পাঠান সুজাকে হত্যা করতে। মীর জুমলার ধাওয়া খেয়ে সুজা আরাকানে গিয়ে আশ্রয় নেয়। আরাকানরাজ সন্দসুধর্মা সুজার স্ত্রী পরীবানুর প্রণয়াসক্ত হলে যুদ্ধে সুজা নিহত হয়। পরীবানু নিজের বুকে ছুরিকাঘাত করে আত্মঘাতি হন। রাজা সন্দসুধর্মা সুজার কন্যা আমেনাকে জোরপূর্বক বিয়ে করলেও আমেনা অন্তঃসত্ত্বা হয়ে মারা যায়।
অ্যান্টনি ডিক্রুজ পাষন্ড, লুটেরা পুর্তগিজ দস্যু গঞ্জালেসের বংশধর। যে প্রেমময়ী স্বামীকে হত্যা করে তার সুন্দরী স্ত্রীকে শয্যাসঙ্গিনী করেছে। মায়ের বুক থেকে শিশু ছিনিয়ে নিয়ে বিক্রি করে দিয়েছিল আরাকানের মেয়াংয়ে। বৃদ্ধ মার একমাত্র ছেলেকে ধরে নিয়ে দাস হিসেবে বিক্রি করে দিয়েছিল। মেয়েদেরকে নগ্ন করে কক্সবাজারে গরুছাগলের মতো দামাদামি করে বিদেশি বণিকদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল। সেই নিষ্ঠুর, লুটেরা, নৃশংস পুর্তগিজ গঞ্জালেসেরই উত্তর পুরুষ অ্যান্টনি ডিক্রুজ, বনি ডিক্রুজ এবং লিসি ডিক্রুজ। অ্যান্টনির বুকভরা স্বপ্ন ছিলো লিসি মাদাম কুরি, হেলেন কেলার হবে। ফিরিঙ্গিবাজারের সাধারণ মেয়ে হবার জন্য লিসির জন্ম হয়নি। সে লিসি বন্দরের নাবিকদের মনোরঞ্জনে পটিয়সী, ‘সি গালর্স’ হয়েছে। বাসায় কখন ফিরে কখনো ফেরেনা। মায়ের হাতে পাউন্ড ডলার ভাঙ্গিয়ে মুঠোভর্তি টাকা দেয়। কিন্তু লিসি কী কাজ করে এত কাঁচা টাকা উপার্জন করে কেউ বুঝতে পারেনা। বিস্ময় একদিন ঘুচলো, লিসিকে পাওয়া যায় আদিম দেহ ব্যবসায়। বাদামিত্বক, সোনালি চুল, সুঠাম দেহ জেরি ফার্দিনান্দের অদ্ভুত সম্ভোগ সুখে ডুবে গিয়ে লিসি সন্তান সম্ভাবনা হয়ে পড়ে। পঁচিশ বছরের যুবতী লিসির যৌবন লুটপুটে পালিয়ে যায় ফার্দিনান্দ। লিসির শরীরে নিক্ষেপ করে যায় পুর্তগিজ বীজ। তাঁর পূর্বপুরুষ গঞ্জালেস যেমন বাঙালির নারীর সবকিছু লুঠ করেছিল, ঠিক তেমনি। এ যেন পূর্বপুরুষের প্রায়শ্চিত্য। ওদিকে অ্যান্টনির ছেলে বনি ডিক্রুজ, ছিপছিপে শরীরে আঁটোসাঁটো বার্মিজ লুঙ্গি, লাল টকটকে কাটা শার্ট, পারফিউমে সুরভিত মাশোয়া প্রেমে উন্মাদ হয়। মাশোয়া হোটেলে গিয়ে বিদেশিদের কাছে ব্যাগ খুলে মালে স্যাম্পল দেখায়, বলে- ‘টেল মি ইয়োর চয়েস, হুইচ ওয়ান ইউ লাই।’ মাশোয়া ছলনা বনি ডিক্রুজ বুঝতে পারে না। বনির ক্লিয়ারিং ফরোয়াডিং ব্যবসার আড়ালে স্মাগলিংয়ের কথা মাশোয়া পুলিশকে জানিয়ে দিয়ে দেশ ত্যাগ করে বার্মামুল্লকে চলে যায়। জেরি ফার্দিনান্দ যেমন লিসিকে বলেছিল – ‘আমরা সিম্যানরা সিরিয়াসলি কিছু ভাবিনা। সারা বছর সিগালের মতো সাগরে ভেসে বেড়াই। আর বন্দরে এসে যতটুকু পারি জীবনের আসঙ্গকে লুটে নিই।’ ঠিক তেমনি বনি ডিক্রুজের সবকিছু লুঠ করে নিয়ে যায় আরাকানের মেয়ে মাশোয়া। একসময় যাদের পূর্বপুরুষ গঞ্জালেস যেমন হার্মাদের নিষ্ঠুরভাবে এদেশের সম্পদ, নারীদের সর্বস্ব লুট করেছে, আজ তাদের উত্তর পুরুষ সেভাবে প্রতারিত, লুণ্ঠিত হচ্ছে। অত্যাচারী, হার্মাদ, লুন্ঠেরা গঞ্জালেসের উত্তরপুরুষ অ্যান্টনি ডিক্রজের এ যেন চরম শাস্তি, গঞ্জালেসের পাপের প্রায়শ্চিত্য? ‘উত্তর পুুরুষ’উপন্যাসের নাটকীয় সমাপ্তিতে সেটাই যেন প্রমাণিত হয়- অ্যান্টনি ডিক্রুজ বিদেশি নাবিকের দিকে ভিক্ষার হাত বাড়ায় আর তখনই থমকে দাঁড়ায়। একি বিদেশির পাশে তার মেয়ে লিসি। কি মর্মান্তিক দৃশ্য্ বাবা ভিখারি, মেয়ে দেহ পসারিনি। পকেটে হাত দিয়ে একটি কয়েন অ্যান্টনি ক্রুজের হাতে দিতে দিতে বিদেশি নাবিক লিসিকে বলে – ‘তোমাদের পোর্ট চিটাগাং- এ এক পা হাঁটতে গেলে দশটা বেগার হাত পাতে।’ লিসির মুখ তখন বিবর্ণ, রক্তশূন্য হয়ে যায়। রিজিয়া রহমান পুর্তগিজ হার্মাদের উত্তর পুরুষের প্রায়শ্চিত্যকে এভাবে রুপায়িত করেছেন এ উপন্যাসে।
আহমেদ মাওলা, ডীন, বাংলা বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়