এখন সময়:বিকাল ৫:২১- আজ: সোমবার-২৮শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-১৫ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-গ্রীষ্মকাল

এখন সময়:বিকাল ৫:২১- আজ: সোমবার
২৮শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-১৫ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-গ্রীষ্মকাল

লাশকাটাঘরে যুগলবন্দী

মোহিত কামাল

জীবনে প্রথম লাশকাটা ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ফরমালিনের ঝাঁজে নাক জ্বলে উঠলেও নিঃশ্বাস—প্রশ্বাসে অসুবিধে হলো না লাবণীর। চোখও জ্বলছে- পিটপিট করে চোখের পাতা বন্ধ করছে আর খুলছে। জলে ভরে যাচ্ছে চোখ। পঁচিশ জনের ব্যাচের সদস্য হিসেবে দলবদ্ধভাবে ভেতরে এগোতে মোটেও ভয় পেল না সে। বোঝা যাচ্ছে মেঝেতেও ফরমালিনের ওয়াশ দেওয়া হয়েছে। ফরমালিনের ঝাঁজে ভরা লাশকাটা ঘরের চার কোণে চারটা টেবিলে শোয়ানো আছে চারটি ডেড—বডি। হলঘরের মতো বিশাল এ রুমের সেন্টারেও রয়েছে আরেকটি টেবিল। ওই টেবিল ঘিরে রয়েছে একদল শিক্ষার্থী। লাবণীদের দল এগিয়ে গেল উত্তর—পূর্ব কোণের ডেড—বডির দিকে। সবার গায়ে ধবধবে সাদা অ্যাপ্রন। অ্যাপ্রনের দু পাশে লম্বা পকেটে রয়েছে জ্যামিতি বক্সের আকৃতির ডিসেক্টিং বক্স। বক্সে আছে স্কালপেল, ডিসেক্টিং ব্লেড, ফরসেপ, সিজার. এসব ডিসেকশন টুলস। যতই লাশটির দিকে এগোতে লাগল, টের পেল, গ্রুপের অনেকের পায়ের গতি শ্লথ হয়ে গেছে, সামনে থেকে সরে পেছনে চলে যাচ্ছে একে একে সবাই। থমকালো না লাবণী, পায়ের গতিও কমাল না। দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে গেল টেবিলের দিকে। টেবিলের পাশে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে কাঁপন উঠল বুকে।

ব্যাচ—টিচার জামিল চৌধুরী প্রশ্ন করলেন, কে আছো সাহসী? ডেড—বডির বুকে কে প্রথম ছুরি চালাবে?

স্যারের প্রশ্ন শুনে নীরব হয়ে গেল সবাই। প্রায় শ্বাস—প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে পঁচিশ জন ছাত্রছাত্রীর। বেঁচে থাকা অবস্থায় মানুষের এক রূপ, মরে গেলে আরেক রূপ, এ কোন সংস্করণ মানবদেহের! ভেবে লাবণী বলল, স্যার আপনি শুরু করুন। আমরা দেখি।

না, সেটা হবে না। হাতে—কলমে শেখার কাজ; নিজ হাতে করবে তোমরা। এটা অ্যানাটমি ডিসেকশন রুম, ভুলে গেলে চলবে না। আমি দেখিয়ে দিতে পারি। বলেই লাবণীর উদ্দেশে বললেন, তুমি সাহস দেখিয়েছো। তোমার স্কালপেলে ব্লেড ফিট করে নাও। চেস্ট—কার্ড অর্থাৎ বুক কাটার মধ্য দিয়ে শুরু করব আমরা। ইনসিশন বা পোচ বসাতে হবে এখান থেকে এ পর্যন্ত। আঙুল দিয়ে বুকের মধ্যবর্তী অংশ দেখিয়ে দিলেন জামিল চৌধুরী।

স্যারের নির্দেশনা অনুসরণ করার পর পুরো ডেড—বডি একবার দেখে নিল লাবণী। কালচে রঙের ত্বক সেঁটে আছে পেশি আর হাড়ের সঙ্গে। চক্ষু—কোটরে চোখ নেই। দৃশ্যমান মুখের হাড়ের সঙ্গে ত্বক লেগে থাকার কারণে ফ্যাসিয়াললুকে ফুটে উঠেছে কঙ্কাল—মূর্তি। অবয়বটি দেখার সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড ঝাঁকি খেল লাবণী। পরিচিত আপন কারও মরদেহ কি এটি? ঝড়ের বেগে প্রশ্ন হানা দিল মনে। তা উপেক্ষা করে ডেড—বডির কাছাকাছি ঘেঁষার পর ফরমালিনের ঝাঁজ আরও বেশি টের পেতে লাগল। আগের চেয়ে বেশি জ্বলতে শুরু করল চোখ। তবু স্কালপেলে ব্লেড লাগিয়ে নিল। বেড়ে গেল হাতের কাঁপুনি। নিজেকে ব্যর্থ হতে দিতে চায় না সে। মনোবল বাড়ানোর জন্য কথা বলে সময়ক্ষেপণের প্রয়োজনে জিজ্ঞেস করল, স্যার, মরার পর তো পচন ধরে শরীরে। অথচ এ রকম তাজা দেহ কীভাবে সংরক্ষণ করা হলো?

জামিল চৌধুরী জবাব দিলেন, গুড কোয়েশ্চন। সবার জানা উচিতÑধমনীর মধ্য দিয়ে প্রথমে ফরমালিন ঢোকানো হয় দেহে। গোটা দেহে ছড়িয়ে যাওয়া এই ফরমালিন মেরে ফেলে দেহের ভেতরের ব্যাকটেরিয়া ও মাইক্রোঅর্গানিজম। ফলে থেমে যায় শরীরের কোষগুলোর ‘ডিকম্পোজিশন’ বা দ্রুত পচন প্রক্রিয়া। এছাড়া শরীরে থাকা পানি ও চর্বি সরিয়ে প্রথমে অ্যাসিটোন নামক দ্রাবক ও পরবর্তীসময়ে পলিমার ব্যবহার করা হয়। ফলে শরীর আর পচার সুযোগ পায় না। বুঝেছো?

কোনও জবাব পেলেন না জামিল চৌধুরী।

সবাই নিশ্চুপ কেন? কিছুই কি বোঝাতে পারিনি?

দ্বিতীয় প্রশ্নেও মুখ খুলল না কেউ।

জামিল চৌধুরী বললেন, ধরে নিলাম আর কারও প্রশ্ন নেই। এবার শুরু করা যাক। লাবণীর উদ্দেশে বললেন, এমনভাবে ব্লেড চালাবে যেন ত্বকের পুরো স্তর জুড়ে পোচ বসে। এরপর ফরসেপ দিয়ে কাটা অংশ চেপে ধরে ত্বক আলগা করে নেবে ভেতরের আবরণী থেকে। ধীরে ধীরে বিভিন্ন স্তর পেরিয়ে দেহের ভেতরে ঢুকবে তোমার ছুরি।

মাথা নাড়িয়ে লাবণী সায় দিল, জি স্যার।

ডেড—বডির বুকের ত্বকের ওপর ব্লেড বসানোর সঙ্গে সঙ্গে ব্লেড বেয়ে শব্দহীন এক তরঙ্গ ধেয়ে এল লাবণীর দেহের ভেতর। তীব্র নাড়া খেয়ে পেছনে ছিটকে পড়ল, ডেড—বডির অবিশ্বাস্য অনুস্পন্দন জাগিয়ে দিল নিজ দেহের কম্পন। স্তব্ধ হয়ে গেল লাবণী।

জামিল চৌধুরী বললেন, ভয় পেলে চলবে? সাহসী হতে হবে। ডেড—বডি কেটে—কুটে ভালো করে শিখতে হবে অ্যানাটমি। লাশ কাটতে কাটতে হাত পাকাতে হবে। তাহলে পরবর্তী জীবনে ভালো সার্জন হওয়ার পথে কোনও বাধা থাকবে না।

নির্মম কথা কত সহজভাবে বলে গেলেন স্যার! অথচ পঁচিশ জন ছাত্রছাত্রীর বুকের স্পন্দন আরেক দফা থেমে গেল। লাবণীর শরীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা ঘনিষ্ঠ ফ্রেন্ড মঞ্জুলিকার দেহের ভেতরে ফুঁসে ওঠা উথালপাতাল ভয়—তরঙ্গ আক্রান্ত করল লাবণীকে। দুম করে পতনের শব্দ হলো। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল ফ্লোরে পড়ে গেছে মঞ্জুলিকা। কয়েকজন তার শুশ্রƒষায় লেগে গেলেও একবার পেছনে তাকিয়ে লাবণী আবার তাকাল ডেড—বডির দিকে। সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেল চিন্তার জট। সামনে যেন শুয়ে আছে পরাজিত ক্লান্ত এক যুবক! কে এ যুবক? কোথায় তার বাড়ি? তার স্বজনরা কি জানে যুবকের বুকে ব্লেড বসিয়েছে সে! ধারালো টুল্সের ফলায় চিকচিক করে উঠল প্রাণের স্পন্দন। অনুচ্চ স্বরের সঙ্গে শুরু হয়ে গেল অদৃশ্য সংলাপ। বুকের হু হু বাতাসের সঙ্গে বেরিয়ে এল সহস্র শব্দের তুমুল বিস্ফোরণ। যুবকের গহিনে জমে থাকা নিমগ্ন অঁাধার নিমেষে জ্বালিয়ে দিল নিজের দু চোখের মণি। ডেড—বডি কথা বলছে, চালাও ছুরি! থেমে গেলে কেন, লাবণী?

সে কী! আমার নাম জানো তুমি? গনগনে কয়লার লালচে উনুনের অঁাচে ঝলসে ওঠা লাবণী প্রশ্ন করে থেমে গেল আবার।

যুবক বলল, জানি। জানি। তুমিই তো সেই টান টান পুষ্পডাঁটা, কৈশোরের সজীব বুকে পেঁচিয়ে থাকা মাধবীলতার মতো এখনও জড়িয়ে আছো দেহ—মনে।

কী বলছো? তুমিই কি সেই হিল্লোল? কৈশোরে হারিয়ে যাওয়া হিল্লোল?

প্রশ্নের উত্তর কানে শুনতে পেল না লাবণী। তবে একটা চিৎকার অনুভব করল ডেড—বডির বুকের ভেতর; গলায় আটকে গেছে সেই চিৎকার। কানে নয়, চিৎকারটি নাড়া দিয়েছে লাবণীর বুক। বুকের ভেতরে বইছে মেঘমালা। সেই মেঘের ভেতর ডানাহীন ক্লান্ত এক পাখি উড়াল দিয়ে এগিয়ে যেতে চাচ্ছে শূন্যলোকে। উড়তে পারছে না। মুখ থুবড়ে পড়ে আছে সামনে, লাশকাটা ঘরে।

আমি হিল্লোল কি না দেখো। ছুরি চালাও। বুক কেটে খুঁজে দেখো।

না। ছুরি চালাব না। তোমাকে ব্যথা দিতে পারব না আমি।

ভুল করছো তুমি। ব্যথার জগতে নেই আমি। মন আমার কঠিন বরফের মতো জমে আছে বুকের ঘরে। কুড়াল দিয়ে কেটেও জমানো বরফ ভাঙা যাবে না আর। উষ্ণতা পেলেও গলবে না এ বরফখণ্ড। বসাও ছুরির ফলা। ফলার পোচেই কেবল অনুভব করতে পারবে আমাকে। খুঁড়ে দেখো। অনুভব করো, সাহসী হও।

গোপন অনুভব উপেক্ষা করতে পারল না লাবণী। শক্ত হাতে ছুরি চালাল ডেড—বডির বুকে। সরাসরি উন্মুক্ত হয়ে গেছে বুকের ঘরÑএখানে হৃৎপিণ্ড থাকার কথা, ফুসফুস থাকার কথা। নেই। খাঁখাঁ করছে শূন্য বুক। অদৃশ্য আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরতে চেয়েছিল হিল্লোলকে! মরীচিকার মতো লাগছে সব। শূন্যতার উন্মত্ত ফণা ছোবল বসাল বুকে।

চিৎকার করে উঠল লাবণীর অন্তর্লোক। কোথায় তুমি? কথা বলছো না কেন! তোমার হার্ট কোথায়, ফুসফুস কোথায়?

আমার হার্ট ও ফুসফুস আছে ভিসেরা রাখার কোনও জারে, ভিসেরা রুমে। আর শূন্যতায় বিলীন হয়ে আছি আমি। বাতাসে মিশে গেছি। বাতাসে মিশে অক্সিজেন দিচ্ছি তোমার বুকে। তাপ হয়ে উষ্ণতা দিচ্ছি তোমাকে। আলো—বাতাস প্রতিনিয়তই অনুভব করতে হচ্ছে তোমাকে। সেই অনুভবে পাবে আমাকেও।

মিথ্যা মায়ার ছলনায় ভুলতে চাই না আমি। জানতে চাই কেন হারিয়ে গেলে তুমি?

জানতে চাচ্ছ? সেটাও মায়ার ছলনায় ভরা। মিথ্যা। মায়াটাও মিথ্যা। জগৎটাও মিথ্যা। সত্য হলো মরতে হবে সবাইকে। কেউ আমার মতো শুয়ে থাকবে টেবিলে। কেউ কেটে—কুটে শিখবে মানবদেহ কাঠামো। আবার জীবিত কেউ তোমাকে শোনাবে মায়ার কথা। ভালোবাসায় পূর্ণ করবে তোমাকে। একদিন মিথ্যা হয়ে উড়াল দেবে সব। মিথ্যার জন্য এত অধীর হলে কি মানায়, লাবণী?

আমি তো ভুলিনি কৈশোরের হিল্লোলকে। মিথ্যা হবে কেন মায়ার জগৎ?

তোমার বুকের মধ্যে ঘুরে মরছে দীর্ঘ হাহাকার। ঘোলা আবেগের ঢেউ জেগেছে তোমার বুকে। স্বচ্ছ আবেগের ঊর্মিমালায় হিল্লোল নেই, আছে অয়ন। অয়নের ছায়ায় হিল্লোলকে খেঁাজা কি মিথ্যা মায়ার ছলনা নয়?

চমকে উঠে লাবণী প্রশ্ন করল, অয়নকেও চেনো তুমি?

তোমার অন্তরে যে আছে তাকে তো চেনো তুমি। তোমার চেনাশোনার তোমাকে চিনে ফেলি আমিও। তুমি কি লুকাতে পারবে তোমাকে তোমার অনুভব থেকে?

লুকানোর প্রশ্নই আসে না। এজন্যই লুকিয়ে রাখিনি তোমাকেও। অয়নকে বলেছি তোমার কথা।

ভুল করেছো। অয়ন সবসময় তোমার বুকের মধ্যে খুঁজবে হিল্লোলকে, মানে আমাকে। নিজেকে সে খুঁজে পাবে না তোমার মধ্যে। অসুখী হবে তুমি। অয়নও।

মায়ার জগৎটাকে মিথ্যা বলছো কেন? তোমার কথার মধ্যে থেকেও সত্য বেরোচ্ছেÑমায়াটাকে অলীক মনে হচ্ছে না। সত্য মনে হচ্ছে, সত্য অনুভূতি ধারণ করে অসুখী হব কেন?

অনুভবের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। অনুচ্চ—গোপন কথোপকথন থেমে গেল। শিক্ষক জামিল চৌধুরী বললেন, লাবণী ভুল করেছো তুমি। তোমার ডিসেকটিং ব্লেডের ধার এত তীক্ষè! এত শক্তি রয়েছে তোমার হাতে! এক পোচেই উন্মুক্ত করে ফেললে পুরোটা বুক? ধাপে ধাপে এগোনো উচিত ছিল। ধাপ খুঁজে পাওনি। এক ধাপ ডিঙিয়ে আর এক ধাপে গেলে তল খুঁজে পাবে না সত্যের। বুঝেছো?

স্যারের কথায় মন খারাপ করল না লাবণী। বরং সত্যের বদ্ধ তালাটা সে দেখতে পেল। বুঝতে পারল, জীবনের স্বাভাবিক ধাপ টপকানো উচিত নয়। এগোতে হবে প্রতিটি ধাপে পা রেখে। সত্য উন্মোচনের চাবিও পেয়ে গেল হাতে। নতমুখে দাঁড়িয়ে রইল ডেড—বডির সামনে …

 

দুই

অয়নের কল পেয়ে লাবণী বললÑকী বলছো এসব?

সত্যি বলছি, ট্রেনে আসার সময় একজন লোক কথা প্রসঙ্গে বলল, আখাউড়া জংশনে একটা ছেলে আত্মহত্যা করেছিল। তার বুকপকেটে একটা ছবি ও চিরকুট ছিল। ছবির মেয়েটার নাম লাবণী। ছেলেটা চিরকুটে লিখে গেছে, ‘আমার ডেড—বডিটা কেটে দেখো। আমার বুকে লেখা আছে কার নাম, খুঁজে দেখো। হিল্লোল।’

তোমার ছোটবেলার হারানো কিশোর বন্ধুর নাম হিল্লোল না?

শরীর থেকে পেখম খুলে গেল। বুকের পাখিটা হঠাৎ করে নিঃশব্দে পড়ে গেল মাটিতে। তীব্র কাঁপুনি টের পেল লাবণী। লাইন কাটার আগে আতঙ্কিত কণ্ঠে বলল, পরে কথা বলব তোমার সঙ্গে। এখন রাখি। লাইন কাটার পরও দীর্ঘক্ষণ কাঁপতে থাকল সে।

 

তিন

দরজা খুলে হিল্লোলকে দেখে চমকে উঠল লাবণী। সন্ত্রস্ত কণ্ঠে বলল, তুমি এসেছো?

কখনও কি বারণ করেছো আমাকে? আমার আসা—যাওয়া কি নিষিদ্ধ তোমার ঘরে? আমি এলে অয়ন কি মাইন্ড করবে? টানা তিনটি প্রশ্ন করার পর হিল্লোল আবার জিজ্ঞেস করল, আমি বাসায় ঢুকব, নাকি চলে যাব?

না। না। যাবে কেন? এসো। বারণ করব কেন? তোমার আসা—যাওয়া কি নিষিদ্ধ করা যায়? তুমি তো থাকই সবসময় আমার মনে।

ওঃ! এটা বড় প্রাপ্তি আমার। আমার প্রাপ্তি ক্ষতি করবে না তোমার? সন্দেহ ঢুকিয়ে দেবে না অয়নের মনে?

 

 

 

 

লক্ষ্যভেদী শকুনের মতোও ছোবল বসাতে পারে অনিবার্য অবিশ্বাস। তবে অয়নকে ক্ষুদ্র ভাবতে পারি না। আমার চোখে অয়ন অনেক বড়। মায়া, আবদার, ভালোবাসা আলাদা করে চিনে নেওয়ার ক্ষমতা আছে তার। হিমালয়ের মতো উঁচু তার মন!

তাহলে ছুঁয়ে দেখি তোমার হাত? হিমালয়ের ছায়ার আড়ালে একবার আলিঙ্গন করি তোমাকে? শর্ত দিচ্ছি এই আলিঙ্গনের খবর জানাব না কাউকে।

তোমার—আমার মাঝে কোনও শর্ত নেই। দ্বিধাহীন হাতে ছুঁতে পারো তুমি। মায়ার ওই হাত যেন সন্দেহের ডানা মেলে দিতে না পারে অয়নের বুকে, সেটাও খেয়াল রাখতে হবে তোমাকে।

বাহ্! শর্ত নেই বলেও শর্ত আরোপ করছো! তুমি কি আসলেই তোমাকে চেনো? আসলেই কি অয়নের মন পাহাড়সমান উঁচু? নাকি উঁচু পাহাড়ের বুক কেটেও নেমে আসতে পারে গোপন সরু জলধারা, সন্দেহের বিষবাষ্প কি বয়ে আসতে পারে না সেই সরু—স্রোতে?

এত ‘সন্দেহ’ ‘সন্দেহ’ করছো কেন? তুমি কি লুণ্ঠন করতে এসেছো আমাকে? নাকি এসেছো মায়ার পরশ দিতে?

মায়া হলো ভালোবাসার ভিত। ভিত শক্ত না হলে ভালোবাসার স্তম্ভ শক্ত হয় না, নড়বড়ে হয়ে যায় শেকড়। আমিই যদি মায়ার ভিত তৈরি করে দেই, দুর্বল হয়ে যাবে না অয়নের জন্য তোমার ভালোবাসার ইমারত?

না। দুর্বল হবে না। অয়নের স্থানে আছে অয়ন। তোমার স্থানে তুমি। একজন আছে বাস্তব—মেরুতে। আর একজন অতীত—মেরুতে। দুজনকে নিয়ে সংঘাতের প্রশ্নই ওঠে না। তোমার জন্য মায়া থাকলেও অয়নের জন্য ভালোবাসার কোনও ঘাটতি নেই।

তুমি কি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছ তোমাকে? নাকি ছায়ার আড়ালে থেকে ভুল দেখ, ভুলছো ভাবছোÑনিজেকে প্রশ্ন করে দেখো তো আর একবার।

চোখ বন্ধ করে কিছুটা সময় চুপ থাকল লাবণী। তারপর উদ্বিগ্ন হয়ে চোখ খুলে বলল, আমার পায়ের কাছে লুটিয়ে থাকা ওই রোদ্দুর তোমার। অয়নের কোনও রোদ নেই কেন? কেন অন্ধকারে ছেয়ে আছে অয়নের মুখ? অঁাধারের আড়ালে কি তবে সে লুকিয়ে রেখেছে গোপন কোনও অঁাধার—ছুরি?

হো হো করে হেসে উঠল হিল্লোল। নির্ভীক হাতে জড়িয়ে ধরতে চাইল লাবণীকে। চিৎকার করে সামনে থেকে সরে গেল লাবণী। উচ্চৈঃস্বরে ডাকতে লাগলÑঅয়ন! অয়ন! দেখো, হিল্লোল এসেছে। অঁাধার থেকে বেরিয়ে এসো তুমি। রোদ নিয়ে এসেছে হিল্লোল। তার রোদটা গ্রহণ করো। তার মায়া নাও। তাকে বসতে বলো। তাড়িয়ে দিও না।

লাবণীর গায়ে ধাক্কা দিতে দিতে রুমমেট মঞ্জুলিকা বলল, এই লাবণী! চিৎকার করছিস কেন? দুঃস্বপ্ন দেখছিস? ওঠ। পানি খেয়ে নে। এখনও ভোর হয়নি। এখন প্রায় রাত তিনটা। আর একটু ঘুমিয়ে নে। আজ সকাল নটায় কার্ড সমাপনী পরীক্ষা। ভালো ঘুম না হলে পরীক্ষা খারাপ করবি। ঘুমা।

চোখ খুলে মঞ্জুলিকার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকাল লাবণী। বুকের ভেতর থেকে প্রশ্ন বেরিয়ে এলÑহিল্লোল আসেনি? প্রশ্নটি বুঝতে পারল না মঞ্জুলিকা। আর মাথায় প্রশ্ন নিয়ে আবার শুয়ে পড়ল লাবণী।

 

চার

পরীক্ষা শেষে এবার অনেক বছর পর ছোটবেলার শহরে বেড়াতে এসেছে লাবণী। একই পাড়ায় থাকত হিল্লোলদের পরিবার। এখানেই ওদের পৈতৃক বাড়ি। শৈশবের শহরে এসে আশ্চর্য এক নীরব টানে হিল্লোলদের দেয়ালঘেরা বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল সে। ওই বাড়িটির পশ্চিমে ছিল একটা বড় আমগাছ। আগেও ছিল নাম না জানা বিশাল আরেকটি বৃক্ষ। পাশেই ছিল একটি পেয়ারা গাছ। বারোমাস পেয়ারা ধরত ওই গাছে। বাড়ির দশা জরাজীর্ণ হলেও গাছগুলো বুড়ো হয়নি। এখনও রয়েছে সতেজ, সজীব। খোলা গেইট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকেই অন্যমনস্ক হয়ে গেল লাবণী। এভাবে একদিন গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে পেয়ারা গাছ থেকে ঢিল ছোড়ার মতো চার—পাঁচটা টসটসে পেয়ারা তার পায়ের কাছে ছুড়ে মেরেছিল হিল্লোল। হাসতে হাসতে বলেছিল, পেয়ারা পছন্দ তোমার? মুখ ফুটে কোনও জবাব দেয়নি লাবণী। মনে মনে বলেছিল, পেয়ারা নয়, তোমাকেই পছন্দ আমার। ঝমঝম বৃষ্টিপাতের মতো স্মৃতির বৃষ্টিধারা মুহূর্তে ভিজিয়ে দিল তাকে। অন্তর্লোকে ফুটে উঠল বৃষ্টিস্নাত শ্রাবণের আকাশ। মুগ্ধ আবেশে ভেতরে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই দেখতে পেল হিল্লোলের মাকে। অবাক হয়ে তিনি তাকিয়ে আছেন তার দিকে। দেখে মনে হলো বয়স বেড়ে গেছে অনেক, শরীর—মন ভেঙে গেছে আন্টির। কদমবুসি করে লাবণী বলল, আমাকে চিনতে পারছেন না, আন্টি?

কণ্ঠস্বর চেনা চেনা লাগছে। তবে চিনতে পারছি না। নিশ্চয় ছোটবেলায় আসতে আমাদের বাড়িতে! বসে যাওয়া গলায় বললেন হিল্লোলের মা রুবিনা আকতার।

হঁ্যা, অ্যান্টি। আমি লাবণী। হিল্লোলের সঙ্গে পড়তাম ওই স্কুলে একই ক্লাসে। বলতে বলতে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল স্কুলটি। হঠাৎ লাবণী খেয়াল করল আন্টি আর এ জগতে নেই। তার কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেছেন। শত বছরের পুরোনো পাথরের মতো কালের সাক্ষী হয়ে স্থবির হয়ে গেছেন তিনি।

আচমকা পাথরের বুক ফেটে বেরিয়ে এল অশ্রম্নধারা। চোখের নীরব জলপতনের কারণ না বুঝে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল লাবণীও।

আকস্মিক থেমে গেল অশ্রম্নপাত। নি®প্রাণ স্বরে রুবিনা আকতার বললেন, শুনেছি মেডিকেলে ভর্তি হয়েছো তুমি। বুয়েটপড়–য়া এক ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে তোমার। হিল্লোলই বলেছিল।

এত কিছু জেনেছে হিল্লোল! সে তো কোনও খবরই রাখেনি ছোটবেলার বন্ধুর! অবাক হয়ে লাবণী প্রশ্ন করল, হিল্লোল কোথায় এখন, আন্টি?

শূন্য চোখ তুলে লাবণীর দিকে তাকালেন রুবিনা আকতার। প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললেন, এসো। বাসার ভেতরে এসো। তার রুমে বসো।

এলোমেলো অপরিচ্ছন্ন ছোট্ট রুমটিতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে অদ্ভুত এক গন্ধ ঢুকল নাকে। কীসের গন্ধ? বুঝে ওঠার আগেই চোখ গেল দেয়ালে বাঁধানো একটি ছবির দিকে- লাবণী ও হিল্লোলের স্কুল—জীবনের ছবি। ব্যাডমিন্টন খেলায় মিক্সড ডাবলসে জুনিয়র গ্রুপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ওরা। পুরস্কার গ্রহণের সময়কার ছবিটি সুন্দর করে বাঁধিয়ে রেখেছে হিল্লোল। দেখে অনেক উঁচু থেকে বুকের মধ্য দিয়ে আকস্মিক ছুটে এল স্বচ্ছজলের ধারা। মায়াবি হাত বাড়িয়ে ছবিটি ছুঁতে গিয়েও থেমে গেল লাবণী।

রুবিনা আকতার বললেন, গত তিন মাস ধরে কোনও খবর নেই হিল্লোলের। কোথায় গেছে কেউ বলতে পারছে না।

রুবিনা আকতারের এ মুহূর্তের অশ্রম্নহীন চোখ, শুকনো মুখ থেকে বেরিয়ে আসা খবরটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে লাবণীর বুকের ভেতর জেগে উঠল গোপন গোঙানির স্বর। কিছুক্ষণ পূর্বে নাকে ঢোকা গন্ধটা এখন শনাক্ত করতে পারল সে। মনে হলো, নাকের ভেতর দিয়ে গোটা শরীরে ছড়িয়ে যাচ্ছে ফরমালিন, পলিমার ও অ্যাসিটোন দ্রাবকের স্রোত। এই স্রোতে মরে যাচ্ছে নিজ দেহের শত—সহস্র ব্যাকটেরিয়া, মাইক্রোঅর্গানিজম। জামিল চৌধুরী স্যার ডিসেকটিং ক্লাসে পড়ানোর সময় বলেছিলেন, মানুষ মরে গেলে দেহের পচন ঘটে। এই জীবাণুগুলো মরে যাওয়ার কারণে দেহে আর পচন ধরবে না। দেহ থাকবে সতেজ। নিজেকে মনে হলো পচনহীন সজীব মরদেহ। দেহটি এখন শুয়ে আছে লাশকাটা ঘরে। লাবণীর আরও মনে হলো, সামনে ডিসেকটিং ব্লেড হাতে দাঁড়িয়ে আছে হিল্লোল। নিজ দেহে ব্লেডের শক্ত পোচ অনুভব করল লাবণী। দু ভাগ হয়ে গেছে বুক। বুকের ঘরে ঢুকে গেছে হিল্লোল। যুগলবন্দি তারা এখন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল লাশকাটা ঘরে। ঘরের আলো নিভে গেছে। গভীর অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে চারপাশ। দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে ওদের নিভৃত যাত্রাপথ।

 

 

মোহিত কামাল, কথাসাহিত্যিক ও মনোবিজ্ঞানী

সম্পাদক— শব্দঘর

অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ হয় না

শোয়েব নাঈম শব্দের মধ্যেই থাকে জীবনের আসল দর্শন। শব্দের কারণেই মানুষ হয় নির্বাসিত। এখন মঙ্গলের অমরতায় ঘামছে গ্রীষ্মের বৈশাখ মাস। মঙ্গল এই শব্দবোধে যতটা কল্যাণ

চীনের মতো আমাদেরও ভাবা উচিত

আমির হোসেন চীনে ফেসবুক, ই’নস্টাগ্রা’ম, ইউটিউব, গুগল, গুগল ম্যাপ, হোয়াটসঅ্যাপ, এমনকি ক্রোম ব্রাউজারও ব্যান! শুরুতে শুনে বিরক্ত লাগলেও এখন বুঝতে পারছি- ওরা আসলে অনেক আগেই

গল্পশূন্য জীবনের ইতিকথা

আন্দরকিল্লা ডেক্স : আমাদের পূর্বপুরুষরা কৃষক ছিলেন, শ্রমিক ছিলেন। থাকতেন মাটির কাঁচা ঘরে। অর্থাভাবে-অন্নাভাবে কখনও-সখনও উপোসও করতেন। পরতেন মলিন পোশাকপরিচ্ছদ। আমাদের বাবারা চাইলেন আমরাও যেন

সংস্কার চাই : চট্টগ্রামের ক্রীড়াঙ্গন

নিখিল রঞ্জন দাশ সম্প্রতি চট্টগ্রাম এম.এ. আজিজ স্টেডিয়ামকে আগামী ২৫ বছরের জন্য বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারশনকে দেয়া হবে। তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচের আয়োজনে চট্টগ্রাম স্টেডিয়ামের ৬০

চল্লিশ বছর পর জীবনের প্রথম প্রেম আবার ঝড় তুলল মৈত্রেয়ীর জীবনে “মির্চা, মির্চা আই হ্যাভ টোল্ড মাই মাদার দ্যাট ইউ হ্যাভ কিসড মাই ফোরহেড'”

নহন্যতে উপন্যাসে মৈত্রেয়ী দেবীর এই উক্তি টি অবশ্যই পাঠকদের মনে আছে? মির্চা এলিয়াদ আর মৈত্রেয়ী দেবীর প্রেম কি শুধুই প্রেম ছিল নাকি সেই সাথে কিছু