রিজোয়ান মাহমুদ
বেশ ক’বছর যাবৎ শোয়েব নাঈম লক্ষ্য হয়ে উঠেছে দেশের সৃজনশীল কবি সাহিত্যিক শিল্প রসিকদের কাছে। তিনি সরগরমে একেবারে নিজস্ব অভিরুচিতে কবিতা ডিসেকশন্ করে চলেছেন গত কয়েক বছর ধরে। প্রথাগত বাংলা সাহিত্য সমালোচনার ধারা থেকে বেরিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক ধারা উন্মোচন করে শোয়েব নাঈম- ই সম্ভবত প্রথম এ কাজে হাত লাগান বাংলাদেশের সাহিত্যে বিশেষ করে কবিতায়। এতে কেউ কেউ তার প্রবর্তিত নতুনত্ব কে সাধুবাদ জানালেও অগোচরে কিংবা প্রকাশ্যে অনেকের গাত্রদাহ হয়ে ওঠেন। এমন কি গ্রন্থের শিরোনাম নিয়েও নাঈমের আগবাড়ানো চিন্তাকে গোঁড়ামি ও ল্যাভেন্ডিশ ভেবেছে অনেকেই। নাঈম হয়েছে স্পষ্টতর লক্ষ্য ও প্রতিপক্ষ।
শুদ্ধ শিল্প সমালোচনা আমাদের সাহিত্যে নেই বল্লেই চলে। ভারতবর্ষে হাতেগোনা কয়েকজনকে দেখি যাদের দুর্দান্ত মেধা ও মনন সমানভাবে চলেছে। তৎপরবর্তী ব্যক্তিপর্যায়ে কিংবা দলগতভাবে গঠনমূলক সমালোচনা নিয়ে কাউকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি। হতে পারে লেখকের অরুচি, অনীহা সমালোচনা সহ্য করবার মানসিকতা গড়ে না উঠার কারণে কেউ তেমন উৎসাহবোধ করেনি, কিংবা সাহসও করেনি। অথচ প্রত্যেক দেশে সৃজনশীল সাহিত্যের বিপরীতে একটি গঠনমূলক সুস্থধারার সাহিত্য সমালোচনা শাখা থাকা জরুরি। এতে লেখকরা সতর্ক ও সচেতন থাকতে পারে। লেখকদের সৃজনক্ষমতা প্রতিদিনের সমালোচনার তলোয়ারে কাটা পড়ে নতুন চর্চার জ্ঞানে ও গুণে বাড়তে পারে। মূলতঃ সমালোচনা না
থাকার কারণে সবল সাহিত্য ও দুর্বল সাহিত্য বাজারে একসাথে বাস করে। পাঠক ভালো ও সুস্থধারার সাহিত্য বেছে নিতে পারেনা জনপ্রিয় দুর্বল সাহিত্যের কারণে। নামেমাত্র সমালোচনা বলতে যা আছে আমাদের উপমহাদেশে তা দোষগুণে সমালোচনা নয়,পরস্পরের পিঠ চুলকানি মাত্র।
এখানে এই কথাটি বলা সঙ্গত হবে যে শিল্প সমালোচনা গঠনমূলক না হলে কোনো শিল্প-সাহিত্য আন্দোলনই সফল হবে না। অনর্থক চাটুকারিতা তোষামোদ নয়, সমালোচনা হবে নির্ভরযোগ্য, জ্ঞানবিজ্ঞানে যুক্তিতে বুদ্ধিবৃত্তিক। প্রখ্যাত ইংরেজি ভাষার কবি টি এস এলিয়ট তাঁর ট্রেডিশন এন্ড ইন্ডিভিজুয়াল টেলেন্ট প্রবন্ধে বেশ কিছু দরকারি কথা বলেছেন, এরই মধ্যে সাহিত্য সমালোচনা বিষয়ে তাঁর বক্তব্য অত্যন্ত ক্ষুরধার ও বিবেচনা প্রত্যাশা করে। তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেন; আমাদের অবশ্যই মনে রাখা দরকার যে, সমালোচনা শ্বাস- প্রশ্বাসের মতোই অনিবার্য। সমালোচনা সাহিত্যকে বোঝা ও অনুধাবনের ক্ষেত্রে পরবর্তী কার্যকর ভুমিকা লেখক গ্রহণ করতে পারেন। ভালো ও মন্দ মিলিয়ে সমালোচনা সাহিত্য এগুতে পারে। সমালোচনার পূর্বশর্ত সহনশীলতা। সমালোচনাকে সর্বদা নেতিবাচক অর্থে সংজ্ঞায়িত করা হলে শিল্পের বিকাশ ও সম্ভাবনার মৃত্যু ঘটে। কোনো কিছুই চূড়ান্ত নয়, সম্ভাবনার দ্বারকে খোলা রাখা শিল্প সাহিত্যের কাজ। সমালোচনা সাহিত্য সম্ভাবনার কথা বলে, অন্য কিছু নয়।
শোয়েব নাঈম, ইউরোপীয় কাঠামোর নানান অনুষঙ্গে
টেক্সট ভাঙেন মনে হলো। একটা টেক্সট সিলেকশনে থাকতে পারে নব উত্থিত বিষয় কিংবা লেখার অন্তর্গত কাঠামো। একটা টেক্সটের মেশিনারিজ ফিনিস গুডস্ একজন লেখক তার লেখার ঘোরে এড়িয়ে যেতে পারেন কিন্তু যিনি সমালোচক তিনি তার অধীত বিদ্যাগুণে কিংবা তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণে খুব সহজে মস্তিষ্কে নিতে পারেন। শোয়েব নাঈম এর সাহিত্য সমালোচনা যতটা বিষয় নির্ভর ঠিক ততটা কাঠামো নির্ভর নয়, মনে হয়েছে। একজন লেখক বেড়ে উঠেন সামাজিক রাজনৈতিক ও মনস্তত্ত্বের নিগূঢ় টানাপোড়েনে। একটি সমাজ মানসের অবস্থা যতই অবজ্ঞাসূচক ও অবক্ষয়িত হবে একজন সংবেদনশীল লেখক উন্নত দৃষ্টি সহযোগে তা তুলে ধরবার চেষ্টা করবেন। একজন সমালোচক সে-ই লেখায় মেশিনারিজ নিখুঁত ফিনিস গুডস্ খুঁজে বের করবেন; এটাই সমালোচনা। আমাদের দেশে লেখকদের নাক সিটকানির কারণে সমালোচনা সাহিত্য গড়ে উঠতে পারছে না। অথচ সমালোচক যথার্থভাবে সকল সৃজনযজ্ঞের পুরোহিত। তান্ত্রিকরা যেমন দেবতার আচার ইচ্ছা ও কঠোর নির্দেশনা সাধারণ পূজারীর কাছে পরম নির্ভরতায় পৌঁছে দেন, একজন ধীমান সমালোচকও তাই করে থাকেন। সমালোচকগণ সাধারণত তিনটি ধারায় সাহিত্যের মূল্যায়নে এগিয়ে আসেন। এই ত্রিধারা হচ্ছে, ব্যাখ্যান, বিচার ও উপভোগ। সমালোচনা প্রতিষ্ঠিত সত্যের আলোকে এগিয়ে এলে সর্বজনগ্রাহ্য হয়ে ওঠে। সমালোচকের ভাষা ব্যবহার বড় একটা দায় থাকে লেখক ও পাঠক শ্রেণির কাছে। সমালোচনা শব্দটি যদি কুঝ্জটিকায় আচ্ছন্ন থাকে তাকে ভাষা দিয়ে নিরাবরণ ও সহজ করা সমালোচকের কাজ। দেবতার ভাষা হয়তো সবাই বুঝবে না। বুঝ – ব্যবস্থার কাজটি পুরোহিত-ই করবে।
যার ধারণা, যিনি সাহিত্য সমালোচনা লিখবেন ডানেবামে না তাকিয়ে, অদরকারী পক্ষপাতিত্ব না করে তাঁর সে-ই কাজটি পরম যত্নে করা। শোয়েব নাঈম, অনেক দূর এগিয়েছেন অনেক অম্লমধুর অভিজ্ঞতা নিয়ে। লেখকরা খুশিমনে মেনে নিলে তাঁর পৌরোহিত্যে সহজ সাবলীল হবে। তবে তাকেও মৌখিক মন্তব্য ও যা-তা লেখা থেকে সরে আসতে হবে। ইদানিং তিনিও মৌলিক কবিতা রচনার দিকে হাত বাড়িয়েছেন। এরইমধ্যে কিছু কবিতা পড়ার সুযোগও হয়েছে। পৌরোহিত্যে ছেড়ে টলটলায়মান দেবতাদের আসনে তিনি অভিষিক্ত হতে চাইছেন। এটি আশার কথা। পুরোহিতের পুজো সর্বাংশে সঠিক হতেই হবে। কারণ কোন দেবতাকে কোন ফুল দিয়ে তুষ্ট করতে হবে একজন পুরোহিত ই ভালো জানবে অভিজ্ঞতার আলোকে। যদি সে দেবতা ফুলের গুণাগুণবোধ নিয়ে আবির্ভূত থাকেন। তবে, সমালোচকরা শিল্প সাহিত্যের মৌলিক কাজ খুব বেশি কেউ করেননি। সমালোচনার তুলনামূলক রীতিতে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিক্ষা সংস্কৃতির সংমিশ্রণে প্রথম বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ই বাংলা সাহিত্যে সমালোচনা প্রচলন করেন। ঐতিহাসিক রীতিতে, বিনয় ঘোষ, শৈলী বিশ্লেষণ করে আরম্ভ করেন, শিশিরকুমার দাশ ও কুমার রায়। জীবনানন্দ দাশের কবিতা সমালোচনা করেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বুদ্ধদেব বসু, গিরিজাপতি ভট্টাচার্য, শনিবারের চিঠির সম্পাদক সজনীকান্ত দাস, এমন কি জীবনানন্দ হেইট – ক্লাব সংঘও তৈরি করেছিল অনেকেই। কবিকে নিয়ে হাসি ঠাট্টাও কম হতো না। শেষ পর্যন্ত জীবনানন্দ টিকে আছে মাথা উঁচু করে আধুনিক বাঙালি কবির মুকুট মাথায় নিয়ে।
শোয়েব নাঈম, বাংলা সমালোচনা সাহিত্যের অনেক দিনের জং ধরা গিঁট খুলে দিতে চায়। সমালোচনার প্রচলিত কাঠামোকে ভেঙেচুরে নতুন একগতির নির্মিতি নিয়ে এগুতে চান নাঈম। পথ খুব মসৃণ না হলেও সমালোচকের অলিতে-গলিতে তার হেঁটে যাবার আভিজাত্য আমাদের মনে আশার সঞ্চার করে। খুব সাধারণভাবে বললে, সাহিত্য সমালোচনার মূল হলো, বুদ্ধিদীপ্ত সংবেদী মূল্যায়ন ও ব্যাখ্যা। সেই সূত্রে বলা যায় আমাদের উপমহাদেশের সাহিত্যে উত্তর ঔপনিনিবেশবাদী টেক্সট জনপ্রিয় সমকালীন দৃষ্টিতে। কারণ একচ্ছত্র আধিপত্যবাদ ও দুর্বিনীত ক্ষমতা-কে ছাড়িয়ে সাহিত্য যখন লেখকের নিজ ভূখ-ের জাতিগোষ্ঠীর অস্তিত্ব মানস প্রবণতাসহ ইতিহাসকে উন্মোচন করে তখন সাহিত্য হয়ে ওঠে স্বপ্ন পূরণের অঙ্গীকার। উত্তর ঔপনিবেশিক সাহিত্য চিনিয়ে দেয় মূলের দর্শন ও মনস্তত্ত্ব, সাথে থাকে প্রগাঢ় রাজনৈতিক বাস্তবতা। নাঈম গভীর হাঁটেন এই পথ ধরে। আবার উপরোক্ত টেক্সটের বাইরে গিয়ে সমালোচনার বিশ্লেষণাত্মক পদ্ধতিও গ্রহণ করেন।
মাঝে মধ্যে এমন উৎকট দুর্গন্ধযুক্ত কথা বলেন বা ফেসসবুকে লেখেন তা একদম অরুচিকর এবং বদহজমী বড়ি। আজ থেকে বছর চারেক আগে নাঈম ফেসবুকে লিখেন চট্টগ্রামে মানসম্মত কবিতা লেখেন মাত্র ৭ জন কবি। তিনি এই থিসিস কোথায় করলেন কিংবা পরিসংখ্যান -ই বা পেলেন কোথায়!? কিছু কবিকে নাঈম আগাছা কবি ও পচা দুর্গন্ধযুক্ত ধুলোবালি বলেন। কিছু কবি বিলো এভারজ বা নিম্নমানের। উমুকের স্বনির্বাচিত কবিতার পঞ্চাশ শতাংশ নারী স্তনের কবিতা। নারী দেহের কবিতা। উত্তর আধুনিক দর্শন উড়নচন্ডী ও অপরিনামদর্শী – এমন কি কবিতার বইয়ের শিরোনাম নিয়ে অনেক কটুবাক্য এবং নিম্ন রুচির কথাও বলা হয়েছে। উপরোক্ত বিষয়ে যা বলা হলো সে সবের বিশদ ব্যাখ্যা দরকার। তাছাড়া আদি সাহিত্যে নারীদেহ ও যৌনতার অনুষঙ্গ নিয়ে সফল কাব্য করা হয়েছে। চর্যাপদেও নারী প্রসঙ্গ এসেছে বিবিধভাবে।আদিরসাত্মক কবিতার ধারা শুরু হয়েছে সাহিত্যের সুপ্রাচীন কাল থেকে। আধুনিক কাব্যধারায় নারী শরীর কে বাঙময় করা হয়েছে নানা মাত্রিক ব্যঞ্জনায়। যেমন, কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের “হিমযুগ” কবিতা, হুমায়ুন আজাদের সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে ” আবুল হাসানের “সেই সুখ, “ভ্রমণ যাত্রা” মিতুল দত্তের কবিতা, সৈয়দ আলী আহসান এর “উচ্চারণ” কবিতা। আল মাহমুদ এর অনেক কবিতায় যৌনতা নারীদেহের সৌন্দর্য বর্ণনা শৈল্পিক সীমানা উত্তীর্ণ করেছে। এরকম আরও কবির সহস্র উদাহরণ দেওয়া যায়। সমকালের অনেক তরুণ কবিদের মধ্যে নারীদেহের সৌন্দর্যবোধ ও যৌনতা দুস্প্রাপ্য নয়। নারীদেহ কিংবা যৌনতা নিয়ে কবিতা লেখেনি এমন কবির সংখ্যা মারাত্মকভাবে কম। পাঠের সীমানা সীমাবদ্ধ হলে এ ধরনের মন্তব্য সহজপাচ্য হয়। অর্বাচীন মন্তব্য নিশ্চয় সুস্থ সমালোচনার পরিবেশ তৈরি করবে না। লেখার টেক্সট নিয়ে ফরম্যাট করে সমালোচনায় এগিয়ে এলে লেখক ও সমালোচক উভয়ের জন্য মঙ্গল। মোদ্দাকথা, লেখা পাঠকের বোধগম্য ভাষায় হতে হবে। বুঝতে হবে সমালোচনা মানে একটা লেখাকে সর্ব দিক থেকে খুলে দেওয়া। আবার সমালোচনার ভাষা কোষ্ঠকাঠিন্য রোগে আক্রান্ত হলে পাঠকের পাঠশ্রম বৃথা যাবে। লেখকের আবিষ্কারও কোথাও গিয়ে ঠেকে যাবে। টেক্সটের বাইরে গিয়ে অনর্থক টানাহেঁচড়া করে লেখকের মর্যাদাহানিকর কিছু করা যাবে না। মহাকালের যাত্রায় সমালোচনা সাহিত্য হোক লেখকের কশেরুকা।
শোয়েব নাঈম এর ক্ষমতা সৎ নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গিতে এগিয়ে এলে দেশে সমালোচনা সাহিত্যের একটা কাঠামো দাঁড়াবে, আমার বিশ্বাস।
রিজোয়ান মাহমুদ, কবি ও প্রাবন্ধিক