মূল : হারুকি মুরাকামির
ভাষান্তর : জ্যোতির্ময় নন্দী
[প্রখ্যাত জাপানি লেখক হারুকি মুরাকামি (জন্ম: ১২ জানুয়ারি, ১৯৪৯)’র পরিচয় বিশ্ব সাহিত্যের পাঠকদের নতুন করে দেয়ার কিছু নেই । তাঁর উপন্যাস, প্রবন্ধ, এবং ছোট গল্প জাপানে এবং আন্তর্জাতিকভাবে বহুবার বেস্ট সেলার হয়েছে, তাঁর কাজ পঞ্চাশটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং জাপানের বাইরে লক্ষ লক্ষ কপি বিক্রি হয়েছে। বহুপ্রজ লেখক মুরাকামির অসংখ্য গ্রন্থের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বা বহুলপঠিত ও পরিচিত কয়েকটির মূল জাপানি নাম প্রকাশনার কালানুক্রমে নিচে দেয়া হলো (পাঠকের বোধগম্যতার স্বার্থে বইগুলোর ইংরেজি অনুবাদের নামগুলোও এখানে দেয়া হলো, যদিও সেগুলোর প্রকাশকাল মূল বইগুলোর সমসাময়িক নয়):
‘কাজে নো উতা ও কিকে’ (হিয়ার দা উইন্ড সিং, ১৯৭৯), ‘১৯৭৩—নেন নো পিনবরু’ (‘পিনবল—১৯৭৩, ১৯৮০), ‘হিৎসুজি ও মেগুরু বকেন’ (এ ওয়াইল্ড শিপ চেজ, ১৯৮২), ‘সেকাই নো অওয়ারি তো হাদো—বইরুদো ওয়ান্ডারালান্ডো’ (হার্ড বয়েল্ড ওয়ান্ডারল্যান্ড অ্যান্ড দা এন্ড অব দা ওয়ার্ল্ড, ১৯৮৫), ‘নরউওয়েই নো মোরি’ (নরওয়েজিয়ান উড, ১৯৮৭), ‘দান্সু দান্সু দান্সু’ (ড্যান্স ড্যন্স ড্যান্স, ১৯৮৮), ‘নেজিমাকি—দোরি কুরোনিকুরু’ (দা ওয়াইন্ড—আপ বার্ড ক্রনিকল, ১৯৯৪—৯৫), ‘উমিবে নো কাফুকা’ (কাফকা অন দা শোর, ২০০২), ‘ইচি—কিয়ু—হাচি—ইয়ন’ (ওয়ানকিউএইট্টিফোর, ২০০৯—১০), ‘শিকিসাই ও মোতানাই তাজাকি ৎসুকুরু তো, কারে নো জুনরেই নো তোশি’ (কালারলেস ৎসুকুরু তাজাকি অ্যান্ড হিজ ইয়ার্স অব পিলগ্রিমেজ, ২০১৩) প্রভৃতি। চিন্তাধারা ও রচনাশৈলীর দিকে দিয়ে মুরাকামি যাঁদের প্রভাব স্বীকার করেছেন, তাঁরা হলেন: নাৎসুমে সোসেকি, কেনজাবুরু ওয়ে, ইমানুয়েল কান্ট, সিগমুন্ড ফ্রয়েড, কার্ল ইয়ুং, লুডভিগ ভিডগেনস্টেইন প্রমুখ। মুরাকামি কেন এখনও পর্যৗল্প সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান নি, সেটা অনেক সাহিত্যামোদির ও সমালোচকের বিস্ময়মিশ্রিত প্রশ্ন বটে। তবে নিজের সাহিত্যকর্মের জন্য অন্যান্য অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন তিনি, যেগুলোর মধ্যে রয়েছে গুনজো পুরস্কার (১৯৭৯), নর্মা সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮২), তানিজাকি পুরস্কার (১৯৮৫), ইয়োমিউরি পুরস্কার (১৯৯৫), কুওয়াবারা তাকিও পুরস্কার (১৯৯৯), ওয়ার্ল্ড ফ্যান্টাসি পুরস্কার (২০০৬), ফ্রান্জ্ কাফকা পুরস্কার (২০০৬), ফ্রাঙ্ক ও’কনর আন্তর্জাতিক ছোটগল্প পুরস্কার (২০০৬), হ্যান্স খ্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসেন সাহিত্য পুরস্কার (২০১৬), আমেরিকা সাহিত্য পুরস্কার (২০১৮), জেরুজালেম পুরস্কার ইত্যাদি। এখানে ধারাবাহিকভাবে দেয়া হচ্ছে তাঁর লেখা ‘শেহেরাজাদে’ নামের বিখ্যাত গল্পটি। “আলিফ লায়লা’ বা ‘হাজার এক রজনী’র গল্পকথক কেন্দ্রীয় চরিত্র শেহেরাজাদের নামানুসারে এ গল্পের নাম রাখা হয়েছে, যেহেতু এ বইয়ের অন্যতম প্রধান চরিত্র মেয়েটিও উপকথার শেহেরাজাদের মতো গল্প বলে। আলিফ লায়লার শেহেরাজাদে যেমন প্রতি রাতের শেষে একটা গল্প অসমাপ্ত রেখে দিতো পরের রাতে বলার জন্যে, এ গল্পের শেহেরাজাদেও তেমনটাই করেছে। গল্পের কোথাও লেখক মেয়েটার আসল নাম লেখেন নি, সবসময় তাকে শেহেরাজাদে নামেই উল্লেখ করা হয়েছে। গল্পটার বাংলা ভাষান্তর করা হয়েছে মূল জাপানি থেকে টেড গাসেনের করা ইংরেজি অনুবাদ অনুসরণে।]
“কোনো পূর্বজন্মের কথা ঠিক সেভাবে মনে করতে পারা যায় না,” শেহেরাজাদে বললো। “তোমার ভাগ্য খুব ভালো হলে ওটার কথা একঝলক মনে পড়ে যেতে পারে। এটা একটা দেয়ালে ছোট্ট একটা ফুটোর মধ্যে দিয়ে একঝলক দেখার মতো। তুমি কি তোমার আগের জন্মগুলোর কোনোটার কথা মনে করতে পারো?”
“না, পারি না,” হাবারা বললো। সত্যি কথা বলতে গেলে, কোনো পূর্বজন্মে পুনর্গমনের কোনো তাগিদই সে কখনো অনুভব করে নি। এ জীবনটা দিয়েই তার জীবন ভরপুর ছিলো।
“তো, হ্রদের তলাটা ছিলো বেশ পরিচ্ছন্ন। মাথাটা নিচের দিকে করে একটা পাথরে মুখ আটকে দিয়ে আমি দেখতাম আমার ওপর দিয়ে ভেসে যাওয়া মাছগুলোকে। একটা সত্যিকারের বিরাট আর বদমেজাজি কচ্ছপকেও দেখেছিলাম, প্রকাণ্ড একটা কালো চেহারা, ‘স্টার ওয়ার’ ছবির শয়তান জাহাজগুলোর মতো। আর লম্বা, ধারালো ঠোঁটের সাদা পাখিগুলো, যাদেরকে দেখাতো যেন আকাশে ভেসে যাওয়া সাদা মেঘ।”
“এসব জিনিস তুমি এখনো দেখো?”
“একেবারে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার,” শেহেরাজাদে বললো। “সূর্যের আলো, স্রোতের টান, সবকিছু। কখনো কখনো এমনকি মনে মনেও আমি সেখানে চলে যেতে পারি।”
“যখন তুমি সেখানে যাওয়ার কথা ভাবো তখন?”
“হ্যাঁ।”
“ল্যাম্প্রেরা কী নিয়ে ভাবে?”
“ল্যাম্প্রেরা ল্যাম্প্রেদের ভাবনা ভাবে। খুবই ল্যাম্প্রেসুলভ বিষয় সব। এসব ভাবনা প্রকাশের জন্যে কোনো শব্দ নেই। এটা যেন আমাদের মাতৃগর্ভে থাকার সময়ের মতো। সেখানে আমরা অনেক জিনিস ভেবেছি, কিন্তু এখানে আমরা যে—ভাষা ব্যবহার করি তাতে সেগুলোকে প্রকাশ করতে পারি না। তাই তো?”
“এক সেকেন্ড দাঁড়াও! মায়ের গর্ভে থাকার সময়টার কথাও তুমি মনে করতে পারো?”
“নিশ্চয়,” শেহেরাজাদে বললো, হাবারার বুকের ওপর দিয়ে মাথা তুলে। “তুমি পারো না?”
না, হাবারা বললো। সে পারে না।
“তা হলে আমি তোমাকে কোনোসময়ে বলবো মায়ের গর্ভে থাকার সময়ের জীবনের কথা।”
“শেহেরাজাদে, ল্যাম্প্রে, পূর্বজন্ম” —— এ কথাগুলো সেদিন হাবারা তার ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করেছিলো। সে ধরে নিয়েছিলো, কেউ এটা পড়লে শব্দগুলোর অর্থ অনুমান করতে পারবে না।
শেহেরাজাদের সঙ্গে হাবারার প্রথম দেখা হয়েছিলো মাস চারেক আগে। টোকিয়োর উত্তরে এক প্রাদেশিক শহরে হাবারাকে স্থানান্তরিত করা হয়েছিলো, এবং শেহেরাজাদেকে নিয়োগ করা হয়েছিলো তার ‘সহায়ক সংযোগকারী’ হিসেবে। যেহেতু হাবারা বাইরে যেতে পারতো না, শেহেরাজাদের কাজ ছিলো তার খাবার দাবার আর অন্যান্য দরকারি জিনিস কিনে তার বাড়িতে পৌঁছে দেয়া। হাবারা যে বই—ই পড়তে বা যে সিডি—ই শুনতে চাক না কেন, শেহেরাজাদে সেগুলোও খুঁজে বের করে এনে দিতো। এর বাড়তি সে নিজে বাছাই করে কিছু ডিভিডিও এনে দিতো, যদিও এক্ষেত্রে শেহেরাজাদের পছন্দের মানদণ্ড মেনে নিতে হাবারার বেশ অসুবিধেই হতো।
হাবারা এখানে এসে পৌঁছার এক সপ্তাহ পর শেহেরাজাদে তাকে বিছানায় নিয়ে গেলো, যেন এই পরবর্তী পদক্ষেপটা স্বতঃসিদ্ধই ছিলো। শোয়ার ঘরে দিয়ে হাবারা দেখতে পেলো, বিছানার পাশের টেবিলে কনডম রাখা আছে। সে অনুমান করলো, তার সঙ্গে শোয়াটাও শেহেরাজাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব, অথবা হয়তো ওরা যাকে বলে ‘আনুষঙ্গিক কর্মকাণ্ড’, তার মধ্যে পড়ে। শব্দটা যা—ই হোক, আর শেহেরাজাদের উদ্দেশ্যও যেটাই হোক না কেন, হাবারা নির্দ্বিধায় তার প্রস্তাবটা মেনে নিয়ে গ্রোতে গা ভাসিয়ে দিল।
তাদের যৌনমিলন ঠিক বাধ্যতামূলক ছিলো না, আবার এটাতে পুরোপুরি তাদের মন ছিলো সেটাও বলা যাবে না। শেহেরাজাদে পাহারায় থাকতো, পাছে তারা খুব বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়ে —— ঠিক যেভাবে একজন ড্রাইভিং ইনস্ট্রাক্টর হয়তো চায় না তার ছাত্রেরা গাড়ি চালানোর সময় খুব বেশি উত্তেজিত হোক। তারপরও আপনারা যাকে আবেগদীপ্ত বলে থাকেন, তাদের এই দৈহিক মিলন ঠিক সেরকমটা না হলেও, পুরোপুরি কাজ সারা গোছেরও ছিলো না। এটা হয়তো শুরু হয়েছিলো শেহেরাজাদের ওপর অর্পিত দায়িত্বের একটা অংশ হিসেবে (অথবা অন্তত এমন কিছু একটা হিসেবে, যেটাকে খুব জোরালোভাবে উৎসাহিত করার কথা ছিলো), কিন্তু এক পর্যায়ে গিয়ে মনে হলো, শেহেরাজাদে —— সামান্য পরিমাণে হলেও —— এতে একধরনের আনন্দ খুঁজে পাচ্ছে। তার শরীরের এই সাড়া দেয়াটার বিশেষ কিছু সূক্ষ্ম লক্ষণ থেকে হাবারা সেটা বুঝতে পারতো, আর এটা তাকেও বেশ খুশি করে তুলতো। যতই হোক, সে তো আর খাঁচায় বন্দী করে রাখা জন্তু নয়, বরং একজন মানুষ যার আবেগের একটা পরিসীমা আছে, এবং শুধুমাত্র দৈহিক রেচনের জন্যে যৌনসঙ্গম সে—পরিধি পূর্ণ করতে পারে না। তারপরও তাদের এই যৌন সম্পর্ককে শেহেরাজাদে তার কাজের অংশ হিসেবে কতটুকু পর্যন্ত দেখতো, এবং এর কতটুকু তার ব্যক্তিগত জীবনের পরিধির মধ্যে ছিলো? হাবারা সেটা বুঝতে পারতো না।
অন্যান্যে জিনিসের ব্যাপারেও কথাটা সত্য ছিলো। শেহেরাজাদের অনুভব আর অভিপ্রায়গুলো হাবারা সবসময় বুঝে উঠতে পারতো না। যেমন ধরুন, শেহেরাজাদে সবসময় সাদামাটা সুতির প্যান্টি পরতো। এ ধরনের প্যান্টি মধ্য—তিরিশের মহিলারা পরে বলে হাবারা কল্পনা করতো —— যদিও সেটা ছিলো পুরো একটা অনুমান, যেহেতু সে—বয়সের মহিলাদের ব্যাপারে তার কোনো অভিজ্ঞতাই ছিলো না। কয়েকদিনের মধ্যেই শেহেরাজাদে রঙিন, কুচি দেয়া প্যান্টি পরে দেখা দিলো। কেন সে একটা থেকে আরেকটায় গেলো, সে—ব্যাপারে হাবারার কোনো ধারণা ছিলো না।
আরো একটা জিনিস হাবারাকে বেশ ধাঁধায় ফেলে দিয়েছিলো, যেটা হলো, তাদের দেহমিলন আর শেহেরাজাদের গল্প বলাটা এত ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত ছিলো যে, কোথায় একটার শেষ আর আরেকটার শুরু হচ্ছে সেটা বলা কঠিন ছিলো। তার এরকম কোনো অভিজ্ঞতা আগে কখনো হয় নি। শেহেরাজাদেকে যদিও সে ভালোবাসতো না, এবং তাদের যৌনমিলনটাও ছিলো মোটামুটি রকমের, তবুও কিন্তু সে দৈহিকভাবে তার সাথে জড়িয়ে পড়েছিলো খুব দৃঢ়ভাবে। পুরো ব্যাপারটাই ছিলো কেমন যেন বিভ্রান্তিকর।
একদিন সঙ্গমের পর তারা দুজন যখন বিছানায় শুয়ে আছে, শেহেরাজাদে বললো, “আমি যখন থেকে অন্যদের ফাঁকা বাড়িতে চুরি করে ঢুকে পড়তে শুরু করেছিলোম, তখন আমার বয়স ছিলো সতেরো বছর।”
হাবারা কোনো কথা খুঁজে পেলো না, শেহেরাজাদের গল্প শুনে যেমনটা তার প্রায়ই হতো।
“তুমি কখনো গোপনে কারো বাড়িতে ঢুকেছো?” শেহেরাজাদে জিজ্ঞেস করলো।
“মনে পড়ছে না,” শুকনো গলায় জবাব দিলো হাবারা।
“একবার ঢুকে দেখো। তোমার নেশা হয়ে যাবে।”
“কিন্তু কাজটা তো বেআইনি!”
“বাজি রাখতে পার। এটা বিপজ্জনক, কিন্তু তারপরও তুমি আসক্ত হয়ে পড়বে।”
হাবারা চুপচাপ অপেক্ষা করতে লাগলো শেহেরাজাদের গল্পটা বলা ফের কখন শুরু হবে।
“কারো বাড়িতে ঢুকে পড়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে মজার সময়টা হলো যখন সেখানে কেউ নেই, বাড়িটা একদম চুপচাপ, ফাঁকা,” শেহেরাজাদে বলে চললো। “কোথাও একটা শব্দ নেই। যেন সেটা পৃথিবীর সবচেয়ে শান্ত জায়গা। আমার অবশ্য তেমনটাই মনে হয়েছিলো। যখন আমি একদম স্থির হয়ে মেঝেতে বসে ছিলাম, আমার ল্যাম্প্রে—জীবনের স্মৃতি আমার মনে ফিরে এসেছিলো। আমি যে আগের জন্মে একটা ল্যাম্প্রে ছিলাম, সেটা তো তোমাকে আগেই বলেছি, তাই না?”
“হ্যাঁ, তুমি বলেছিলে।”
“ওটা ছিলো ঠিক ওরকমই। আমার চোষকগুলো জলের তলায় একটা পাথরে আটকানো আর আমার শরীরটা ওপরদিকে আগুপিছু দুলতো, আমার চারপাশের অন্য শ্যওলাগুলোর মতো। সবকিছু এত শান্ত, চুপচাপ। সেটা হয়তো আমার কোনো কান না থাকার কারণেও হতে পারে। পরিষ্কার দিনগুলোতে জলের মধ্যে দিয়ে সূর্যের আলো ঢুকে পড়তো তিরের মতো। আমার মাথার ওপর দিয়ে ভেসে যেতো সব রঙের আর আকার—আকৃতির মাছেরা। আমার মন ছিলো একেবারে ফাঁকা, ভাবনাহীন। তার মানে, ল্যাম্প্রেসুলভ ভাবনাগুলো বাদে। ওগুলো ছিলো অস্পষ্ট, কিন্তু খুব খাঁটি। একটা চমৎকার অবস্থা ছিলো ওটা।”
শেহেরাজাদে বুঝিয়ে বললো, প্রথমবার লুকিয়ে কারো বাড়িতে ঢুকে পড়ার সময় সে ছিলো জুনিয়র হাই স্কুলের ছাত্রী এবং তখন সে প্রচণ্ডভাবে তার ক্লাসের একটা ছেলের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলো। যদিও সুদর্শন বলতে যা বোঝায় ছেলেটাকে তা ঠিক বলা যেতো না, তবে সে ছিলো লম্বা আর পরিষ্কার কাটছাঁটের, পড়াশোনায় ভালো এবং স্কুলের ফুটবল টিমের খেলোয়াড়। শেহেরাজাদে তীব্রভাবে তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলো। কিন্তু ছেলেটা স্পষ্টতই তাদের ক্লাসের আরেকটা মেয়েকে পছন্দ করতো এবং শেহেরাজাদেকে সে লক্ষ্যই করতো না। সত্যি বলতে কি, শেহেরাজাদের অস্তিত্বের ব্যাপারেই সম্ভবত সে আদৌ সচেতন ছিলো না। তারপরও শেহেরাজাদে কিন্তু তাকে মাথার মধ্যে থেকে সরাতে পারলো না। ছেলেটাকে দেখলেই তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যেতো। মাঝে মাঝে মনে হতো, সে বোধহয় হাল ছেড়ে দেবে। তার মনে হত, এ ব্যাপারে সে নিজে কিছু একটা করে না ফেললে সে হয়তো পাগল হয়ে যাবে। তবে কিন্তু ছেলেটার কাছে গিয়ে সরাসরি প্রেম নিবেদন করার কথাও সে ভাবতে পারতো না।
একদিন শেহেরাজাদে স্কুলে না গিয়ে সোজা ছেলেটার বাড়িতে চলে গিয়েছিলো। সে যেখানে থাকতো, সেখান থেকে ছেলেটার বাড়ি মিনিট পনেরোর পথ। তার পারিবারিক অবস্থার ব্যাপারে শেহেরাজাদে আগেই খোঁজখবর নিয়ে রেখেছিলো। তার মা পাশের একটা শহরে জাপানি ভাষা শেখাতো। বাবা ছিলো একটা সিমেন্ট কোম্পানির কর্মচারী, যে কয়েক বছর আগে এক গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গেছে। তার বোন ছিলো একটা জুনিয়র হাই স্কুলের ছাত্রী। তার মানে, দিনের বেলায় বেশির ভাগ সময়ে বাড়িটা পুরোপুরি খালিই থাকার কথা ছিলো।
প্রত্যাশিতভাবেই, বাড়িটার সামনের দরজা ছিলো তালাবদ্ধ। শেহেরাজাদে দরজার সামনে রাখা পাপোষটা উল্টিয়ে দেখলো, ওটার নিচে চাবি রাখা আছে কিনা। সত্যি সত্যিই ওখানে একটা চাবি ছিলো। এরকম প্রাদেশিক শহরগুলোর শান্ত আবাসিক এলাকাগুলোতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড তেমন একটা হয় না বললেই চলে, আর তাই ঘরের একটা বাড়তি চাবি প্রায়শ পাপোষের নিচে বা ফুলগাছের টবে রেখে দেয়া হয়।
নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যে শেহেরাজাদে দরজার ঘণ্টি চাপল, একটু অপেক্ষা করে দেখলো কোনো জবাব পাওয়া যায় কিনা, পাশের রাস্তায় চোখ বুলিয়ে দেখলো কেউ তার ওপর নজর রাখছে কিনা, আর তারপর দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো। ঢোকার পর দরজাটাকে আবার সে লক করে দিল। তারপর জুতোগুলো খুলে একটা প্ল্যাস্টিকের ব্যাগে নিয়ে সেটাকে তার পিঠের ঝোলায় আটকে নিলো। তারপর সে পা টিপে টিপে উঠে গেলো উপরের তলায়। (ক্রমশ)
জ্যোতির্ময় নন্দী, কবি ও অনুবাদক