রুহু রুহেল
সময়ের সাহসী উচ্চারণ খুব কম সংখ্যক মানুষই করতে পারেন। প্রতিবাদী মানসিকতা সবার থাকে না; থাকলেও সেখানে সংখ্যা স্বল্পই। এই স্বল্পসংখ্যক মানুষের মাঝে সৌম্যদীপ্র প্রিয় নাম কবি মিনার মনসুর। তাঁর তারুণ্য ও যৌবনকে ঘিরে মনে পড়ে বাংলা সাহিত্যে “যৌবনে দাও রাজটীকা”র লেখক প্রমথ চৌধুরীর কথা। দ্বিতীয় যার কথা সবচেয়ে প্রোজ্জ্বল কাজী নজরুল ইসলাম এর কথা, “তরুণের সাধনা” এবং “বার্ধক্য ও যৌবন” প্রবন্ধের কথা। তৃতীয়ত সুকান্ত ভট্টাচার্যের “আঠারো বছর বয়স” কবিতার কথা। কাজী নজরুল ইসলাম তারুণ্যের দীপ্তময় অনুভবকে বোঝাবার জন্যে বললেন-
“আমার একমাত্র সম্বল, আপনাদের –তরুণদের প্রতি আমার অপরিসীম ভালোবাসা, প্রাণের টান। তারুণ্যকে– যৌবনকে– আমি যেদিন হইতে গান গাহিতে শিখিয়াছি সেই দিন হইতেই বারে বারে সালাম করিয়াছি, তাজিম করিয়াছি, সশ্রদ্ধ নমস্কার নিবেদন করিয়াছি-” —
“তরুণের সাধনা”
পৃষ্ঠা: ৭ নজরুল রচনাবলী অষ্টম খ- আমার প্রথম জাগরণ প্রভাতে তেমনি সশ্রদ্ধবিস্বয় লইয়া যৌবনকে অন্তরের শ্রদ্ধা নিবেদন করিয়াছি তার স্তব গান গাহিয়াছি তরুণ “অরুণের মতোই যে তারুণ্য তিমিরবিদারী সে আলোর দেবতা।”
এ রকম অনুভবের উচ্চকণ্ঠ প্রিয় জন কবি মিনার মনসুর।
বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহৎ সম্মানের পদক একুশে পদক। দেশ বরেণ্য খ্যাতকীর্তি এ কবি ২০২৪ এ পদক প্রাপ্তিতে সংবর্ধিত হলেন। ৬ মে সন্ধ্যায় বিরূপ আবহাওয়ার মধ্যে দিয়েও চট্টগ্রাম থিয়েটার ইনস্টিটিউট এর হল ভর্তি উপস্থিতি মুগ্ধতা ছড়ালো সকলকে।
বিগত পাঁচ বছর ধরে তিনি জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের মহাপরিচালকের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। স্বদেশের বহু মান্যজন তাঁকে অভিনন্দিত করলেন তাঁর কর্মময়জীবন, কবিজীবন আরো ধন্য হয়ে উঠুক।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন শিল্পী শাহরিয়ার খালেদ।
একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি মিনার মনসুরকে চট্টগ্রামে নাগরিক সংবর্ধনায় অসহায়-দুস্থ মানুষের কথা ভেবে তরুণদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন ড. অনুপম সেন। তিনি বলেন, ‘মানুষের কথা ভাবতে হবে, তাদের নিয়ে তরুণদের ভাবতে হবে, এগিয়ে আসতে হবে।’
ওই দিন সোমবার থিয়েটার ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে আয়োজিত নাগরিক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ আহ্বান জানান।
কবি ও প্রাবন্ধিক মিনার মনসুরের একুশে পদক প্রাপ্তি উপলক্ষে চট্টগ্রাম নাগরিক সমাজের উদ্যোগে নাগরিক সংবর্ধনার এ আয়োজনে সভাপতিত্ব করেন নাগরিক সমাজ চট্টগ্রামের আহ্বায়ক ও চসিকের সাবেক প্রশাসক গণমানুষের নেতা আলহাজ্ব খোরশেদ আলম সুজন।
শুরুতে কবি মিনার মনসুরের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি ও প্রবন্ধ পাঠ করেন প্রমা আবৃত্তি সংগঠনের সভাপতি আবৃত্তি শিল্পী রাশেদ হাসান।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. অনুপম সেন আরো বলেন, ছোটবেলা থেকে বিক্ষুব্ধ বিশ্বকে দেখেছি, অত্যাচারের বিশ্বকে দেখেছি, অত্যাচারিত মানুষকে দেখেছি, আজও দেখছি। ১৯৭২ সালের সংবিধান দেওয়ার সময় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- বিশ্ব দুই ভাগে বিভক্ত, একটি হলো শোষিতের আরেকটি শোষকের। তিনি যে গণতন্ত্রের কথা বলেছিলেন তা হলো শোষিতের গণতন্ত্র, শোষকের নয়। তিনি ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেছিলেন- ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়, প্রত্যেকের তার ধর্ম পালন করবে কিন্তু ধর্মকে রাজনীতির জন্য ব্যবহার করবে না। ‘মিনার মনসুরের লেখা পড়ে মুগ্ধ হয়েছি। তিনি তাঁর লেখায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। নারী ও শিশু হত্যা নিয়ে বারবার লিখেছেন। কিছু মানুষ আছে, যারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, এভাবে আপনারা অনেকে দাঁড়িয়েছেন। যুগে যুগে মানুষ দাঁড়ায়, মারাও যায়।’
তিনি আরও বলেন, আজকের বিশ্ব বঞ্চিতের বিশ্ব। আমরাতো অত্যন্ত সুবিধাভোগী, আরামে থাকি কিন্তু যখন রাস্তা দিয়ে যাই, দেখি- অনেক মানুষ ফুটপাতে শুয়ে আছে। মিনার মনসুররা একদিন তাদের জন্যই সংগ্রাম করেছেন, এখনো করছে। এসব মানুষের কথা ভাবতে হবে, তাদের নিয়ে তরুণদের ভাবতে হবে, এগিয়ে আসতে হবে।
একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি ও প্রাবন্ধিক মিনার মনসুর সংবর্ধনার জবাবে বলেন, আমি একুশে পদক পেতে চাইনি, কবি হতে চাইনি, বিপ্লবীও হতে চাইনি; আমাদের চোখের সামনে যে অন্যায় হয়েছিল, শিশু হত্যা হয়েছিল, নারী হত্যা হয়েছিল- তার প্রতিবাদ করেছি মাত্র। এই বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের যিনি প্রতিষ্ঠাতা, যাঁর জন্ম না হলে এই রাষ্ট্রের জন্মই হতো না- সেই মানুষটিকে যখন হত্যা করাই হলো, আমি চেয়েছিলাম তার প্রতিবাদ করতে, প্রতিশোধ নিতে। বঙ্গবন্ধু শব্দটি যখন নিষিদ্ধ ছিল তখনই আমি বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করেছি।
আমি একুশে পদক পাওয়ার পর যখন জিজ্ঞেস করা হয়- আমার প্রতিক্রিয়া কি? আমি বলেছিলাম, প্রধানমন্ত্রী আমাকে যে পদকটি দিয়েছিলেন সেটি আসলে আমাকে দেননি, পঁচাত্তরের পরে আমার মতো অখ্যাত, অজ্ঞাত হাজার হাজার তরুণ লড়াই করেছে মাঠে আমি তাদের পক্ষ থেকে পদকটি গ্রহণ করেছি মাত্র।
চসিকের সাবেক প্রশাসক ও নাগরিক সমাজ চট্টগ্রামের আহ্বায়ক খোরশেদ আলম সুজন বলেন, পঁচাত্তরের ধ্বংসস্তূপ থেকে কিভাবে আওয়ামী লীগ উঠে এসেছে- আজ যারা রঙিন চশমা চোখে দিয়ে বিভোর জীবন কাটাচ্ছেন, তারা জানেন না, দেখেন না। পৃথিবীতে এমন নেতা নেই, যিনি স্বপ্নের বীজ বপন করে সেই বৃক্ষের ফল জনগণের জন্য দিয়ে গেছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এদেশের মানুষের জন্য স্বপ্ন দেখেছেন, স্বপ্নের বীজ বপন করেছেন এবং সেই বৃক্ষের ফল আমাদের জন্য দিয়ে গেছেন।
জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এটিএম পেয়ারুল ইসলাম বলেন, এক দারুণ দুঃসময়ে মিনার মনসুর ও আমরা বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করেছিলাম। যখন বঙ্গবন্ধু শব্দটি নিষিদ্ধ ছিল, বঙ্গবন্ধু কন্যা আজ মিনার মনসুরকে রাষ্ট্রের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মর্যাদায় একুশে পদক দিয়ে সম্মানিত করায় আমি নিজেকে গৌরবান্বিত বোধ করছি। কারণ আমিও তঁাঁর সহযোদ্ধা ছিলাম।
নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব শাহরিয়ার খালেদের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন কোডেক এর উপনির্বাহী পরিচালক কমল সেনগুপ্ত, ড. আবদুল্লাহ আল মামুন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. সেকান্দর চৌধুরী, বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু তৈয়ব, অধ্যাপক মাইনুল হাসান চৌধুরী, অনুবাদক ও গবেষক আলম খোরশেদ, কবি ও সাংবাদিক রাশেদ রউফ, রাশেদ মনোয়ার, অ্যাডভোকেট এ টি এম আফতাবউদ্দীন, কবি দিলওয়ার চৌধুরী, কবি ইউসুফ মোহাম্মদ কামরুল হাসান হারুন, জামশেদুল আলম চৌধুরী, অ্যাডভোকেট মুজিবুল হক, সাইফুদ্দিন সাকী, মশিউর রহমান চৌধুরী, যুবনেতা মাহবুবুল আলম সুমন প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি করেন, কাজী সিরাজুল ইসলাম, দিলরুবা খানম, মিশফাক রাশেল, মারওয়া আনজুমানে জান্নাত, সৈয়দ হোসেন বাবু ।
রুহু রুহেল, কবি