এখন সময়:রাত ৩:৩৪- আজ: বৃহস্পতিবার-২২শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-৮ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-গ্রীষ্মকাল

এখন সময়:রাত ৩:৩৪- আজ: বৃহস্পতিবার
২২শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-৮ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-গ্রীষ্মকাল

সমরেশ বসু : ‘কালকূট’ থেকে ‘অমৃত’ জীবন সন্ধানের শিল্পী

আহমেদ মাওলা

সমরেশ বসুর জন্ম ১৯২৪ সালের ১১ ডিসেম্বর। সেই হিসেবে গতবছর ডিসেম্বর এই মহান কথাশিল্পীর জন্মশতবার্ষিকী ছিলো। ব্যতিক্রম শব্দটি অভিধানে যে অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, সমরেশ বসু (১৯২৪-১৯৮৮) ঠিক সেই রকমই একজন সর্বার্থে ব্যতিক্রমধর্মী কথাশিল্পী। ‘কালকূট’ তাঁর ছদ্ম নাম। কালকূট মানে তীব্র বিষ। লোভ-লালসা, প্রেম-কাম, হিংসা, বিদ্বেষ, দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র-এসবের বেড়াজালে বন্দি যে দুর্বিসহ মানব জীবন, সেখান থেকে বেরিয়ে এসে তিনি অমৃতের সন্ধান করেছেন। শুভ্রতুষার শৃঙ্গের পদতলে খুঁজেছেন ‘শাম্ব’। লেখক হিসেবে তাঁর অভিযাত্রা ছিল বরাবরই প্রথাবিরোধী, অদেখা, অচেনা, রস-রহস্যময় ভিন্ন এক ভুবন অবিস্কারের দিকে। হয়ত সেই জন্যই তাঁকে বার বার ছদ্ম নাম, ছদ্মাবেশের আশ্রয় নিতে হয়েছে। তবুও লেখা নিয়ে বিতর্ক তাঁর পিছু ছাড়েনি। তাঁর লেখা একাধিক বই নিষিদ্ধ হয়েছে, অশ্লীলতার আভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছে। জীবন এবং যৌনতাকে সমরেশ বসু অভিজ্ঞতার নিরিখে রূপদক্ষ শিল্পীর     মতো ব্যবহার করেছেন। শ্রমজীবী, প্রান্তিক জনমানুষের, বিস্রস্ত, বিপন্ন মন মেরামতের সযত্ন প্রয়াস অবলোকন করা যায় সমরেশ বসুর উপন্যাসেই। এ জন্যই বলতে হয় ‘কোথায় পাবো তারে’?

লেখক হিসেবে তিনি বার বার স্থান বদল করেছেন, এক জায়গায় দাঁড়িয়ে সমাজ ও মানুষকে দেখেন নি। এই জন্য বাংলা কথাসাহিত্যে তাঁর কোনো অনুসারী বা উত্তরাধিকারী নেই। জীবনকে উল্টেপাল্টে দেখার এই চোখ, এই দৃষ্টির কারণেই সমরেশ বসুকে আমি ব্যতিক্রমধর্মী লেখক হিসেবে চিহ্নিত করতে চাই। নিছক কল্পনা বিলাস, মধ্যবিত্তের বানানো দুঃখ-কষ্ট, মিষ্টিভাবনা দিয়ে তিনি জীবনকে আড়াল করতে চাননি। প্রান্তিক মানুষের প্রবল জীবনলিপ্সা,অসহ্য যন্ত্রণাময় জীবন, সত্যপ্রকাশের দুরন্ত সাহস নিয়েই সমরেশ বসু লেখালেখিতে এসেছিলেন। কোনো প্রশংসা বা নিন্দার তোয়াক্কা তিনি করেন নি। ক্রমাগত ভাঙা-গড়া, তীব্র স্রোতের বিপরীতে যাওয়াই তাঁর লেখক চৈতন্যে স্বভাব ছিল, বলা যায়।

 

চল্লিশের দশকে ভারতবর্ষের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক অবস্থা ছিল সবচেয়ে বিপর্যস্ত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৩৯-১৯৪৫) গান্ধীজীর নেতৃত্বে আগস্ট আন্দোলন (১৯৪২) পঞ্চাশের মন্বন্তর (১৯৪৩) দাঙ্গা (১৯৪৬) দেশভাগ (১৯৪৭) ইত্যাদি ঘটনায় উত্তাল ছিল এই সময়খণ্ড। সমরেশ বসুর জন্ম মুন্সিগঞ্জ জেলার রাজানগর, শৈশব কাটে বিক্রমপুরে, কৈশোর কাটে নৈহাটিতে। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন বন্ধনহীন, চঞ্চল প্রকৃতির। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায় তাঁর মন বসতো না, বাঁধাধরা জীবন তাঁর ভালো লাগতো না। কিছু দিন ‘ঢাকেশ্বরী কটন মিলে’ কাজ করেন। আবার চলে আসেন বড়দাদা মন্মথনাথের কাছে নৈহাটিতে। আক্রান্ত হন জন্ডিস ও ম্যালেরিয়ায়, গৌরীদেবীর সেবায় সুস্থ হয়ে উঠেন। গৌরীদেবী ছিলেন সমরেশের চেয়ে চার বছরের বড় এবং ব্রাক্ষ্মণ মেয়ে, তবু সমাজের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে গৌরীকে বিয়ে করে চলে আসেন আটপুরের বস্তিতে। অভাব-অনটনের মধ্য দিয়ে তাদের দাম্পত্য জীবন শুরু হয়। সম্পূর্ণ বেকার, পেটের ভাত জোটানোর জন্য এসময়ে তিনি মাথায় বোঝা নিয়ে সব্জী বিক্রি করেন, সাহেবদের কোয়ার্টারে ডিম ফেরি করে বিক্রি করেন। ১৯৪২ সালে পরিচয় হয় কমিনিস্ট নেতা সত্যপ্রসন্ন দাশগুপ্তের সঙ্গে, তিনিই সমরেশ বসুকে চটকল এলাকায় শ্রমিকদের সাথে কাজ করতে বলেন। সত্যপ্রসন্ন বাবুর সংস্পর্শে অসার পর তিনি কমিউনিস্ট ভাবধারার প্রতি আকৃষ্ট হন। ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত ইছাপুর গান ফ্যাক্টরিতে চাকরি করেন। ট্রেড ইউনিয়ন ও কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হওয়ার করণে ১৯৪৯ সালে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হলে সমরেশ বসু গ্রেপ্তর হন এবং ১৯৪৯-৫০ সাল তাঁকে জেলে কাটাতে হয়েছিল। জেলে বসেই লেখেন প্রথম উপন্যাস উত্তরঙ্গ (১৯৫১)। এরপূর্বে ১৯৪৬ সালে ‘পরিচয়’ পত্রিকায় তাঁর লেখা  প্রথম গল্প ‘আদাব’ ছাপা হয়েছিল। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে বেছে নেন। বলতে গেলে সমরেশ বসুর পুরো জীবনটা একটা লড়াই, বিচিত্র পেশা ও অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে গেছে। সেই লড়াইকে চিরসখা নামে  স্মরণীয় করে রেখেছেন, তার পুত্র নবকুমার বসু।

 

অভিজ্ঞতাই সমরেশ বসুর সাহিত্যের ভিত্তি এবং পুঁজি। জীবন-অভিজ্ঞতাকেই তিনি জীবন-দর্শনে রূপান্তরিত করেছেন। এই জন্য তাঁর উপন্যাসে বিচিত্র পেশা ও শ্রেণির মানুষ ভিড় করেছে, মৃৎ শিল্পী, কৃষক,-শ্রমিক, বধূ-বেশ্যা, দালাল, লুচ্চা ও লম্পট, মোট কথা চরিত্র চিত্রণে সমরেশ বসুর কুশলী দৃষ্টি ও পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা বিস্ময়কর। উপন্যাসের বিষয়, ভাষার ক্ষেত্রেও তাঁর নিরীক্ষা কম নয়। উপন্যাসের বিষয় অনুযায়ী ভাষা নির্মাণ করেছেন, প্রেম-কাম, যৌনতা, মানুষের ভেতরকার চালাকি-বদমায়েশী আঁকার প্রয়োজনেই উপন্যাসের নব আঙ্গিক উদ্ভাবন করেছেন। চলমান সময়ের কামার্ত ঠোঁট, লোভাতুর স্তন, দেহ, বেঁচে থাকার অফুরন্ত ইচ্ছা নিয়ে সংগ্রাম করা সেই বাস্তবকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন কলমের ডগায়। সহজ, গতিময়, নিরাভরণ তাঁর উপন্যাসের ভাষা কিন্তু সেই স্বচ্ছন্দ ভাষার মধ্যে রয়েছে গভীর ব্যঞ্জনা ও সংকেতময়তা।

 

সমরেশ বসুর উপন্যাসের বিষয় ও রূপগত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী কয়েকটি পর্বে ভাগ করা যায়-

 

প্রথম পর্ব : এপর্বে গ্রাম, বস্তি অঞ্চল, শ্রমিক জীবনকে মূলত উপস্থাপন করেছেন। গোষ্ঠিজীবন, ,নীচুতলার মানুষের সংগ্রামকে নিয়ে রচিত- উত্তরঙ্গ, সওদাগর, বাঘিনী, নয়নপুরের মাটি, টানাপোড়েন, সুচাঁদের স্বদেশযাত্রা, শেকল ছেঁড়া হাতের খোঁজে, প্রভৃতি।

দ্বিতীয় পর্বে কলকাতা নাগরিক জীবনের সংকট, মধ্যবিত্ত শ্রেণির শঠতা, ভন্ডামী, মূল্যবোধহীন জীবনের ফাঁক-ফাঁকি তুলে ধরেছেন। বিবর, প্রজাপতি, পাতক, স্বীকারোক্তি, বিশ্বাস উপন্যাসের মধ্য দিয়ে মধ্যবিত্তশ্রেণির অন্তঃসারশূন্য জীবন চিত্র এঁকেছেন। সমাজের মধ্যবিত্তশ্রেণি ক্রমাগত কম্প্রোমাইজ করে চলতে গিয়ে সমস্ত মূল্যবোধ হারিয়েছে, নীতিহীন, আত্ম-উন্নতি, স্বার্থপরতা এই শ্রেণির প্রধান আদর্শ হয়ে ওঠায়, তাদের মধ্যে অবক্ষয়, অনিশ্চয়তা, অস্থিরতা, সুবিধাবাদি মানসিকতার মধ্যে ডুবে আছে। তাই এই শ্রেণির দাম্পত্য জীবনে অসুখি, মিথ্যাচার, নর-নারীদের অবৈধ প্রেম, পরকীয়া বিরাজমান।

 

সমরেশ বসু মার্কসীয় দর্শনে বিশ্বাসী হয়ে সাহিত্যে আবির্ভূত হয়েছিলেন। পরবর্তীতে তাঁর সাহিত্যে বার বার গান্ধীজী উঠে এসেছেন। ছিন্নবাধা, মহাকালের রথের ঘোড়া, তিনপরুষ, শেকল ছেঁড়া হাতে খোঁজে, ইত্যাদি উপন্যাসে বুর্জোয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণি চরিত্র যেমন এসেছে, তেমনি প্রান্তিকবাসী অসহায়, দারিদ্র্য-পীড়িত মানুষের জীবন রিয়ালিটি নিয়ে হাজির হয়েছে। সমরেশ বসু প্রথম পর্বের উপন্যাসে ভায়োলেন্স দ্বারা মানুষের সংগ্রামী জীবনকে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন, দ্বিতীয় পর্বের উপন্যাসে ভায়োলেন্সের মাধ্যমে সমাজের ক্ষত ও ক্ষতিকে চিত্রিত করেছেন।

 

তৃতীয় পর্বের উপন্যাসে দেখানো হয়েছে ভায়োলেন্সের মাধ্যমে একটি বিশেষ শ্রেণির অভিসন্ধি এবং স্বার্থের দিকটিকে উন্মেচিত করেছেন।

 

উত্তরঙ্গ, জগদ্দল উপন্যাসে ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের ফলে গ্রামবাংলার রূপ-রস, প্রকৃতি কীভাবে ধ্বংস হয়েছে, তার চিত্র তুলে ধরেছেন। বি.টি. রোডের ধারে, উপন্যাসের নায়ক গোবিন্দ কারখানার মালিকের অন্যায়-অত্যাচারে ভিটেমাটি ছেড়ে দেশান্তরি হয়ে কর্মের সন্ধানে পথে পথে ঘুরে।

 

গঙ্গা সমরেশ বসুর উপন্যাসের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। আর্থসামাজিক কাহিনির সঙ্গে উপকথা, মিথের ব্যবহার এই উপন্যাসটিকে বিশিষ্টতা দান করেছে। কেন্দ্রীয় চরিত্র তেঁতলে  (তেঁতুতলার বিলাস)। তার বাবা নিবারণ সাঁইদার দুঃসাহসী সমূদ্রের মাছ শিকারি মালো। সমূদ্রে মাছ ধরতে গিয়েই তার মৃত্যু হয়। তেঁতলে তখন মায়ের গর্ভে। বড় হয়ে তেঁতলে বাপের মতো কালো কুচকুচে, পেটানো শরীর, স্বভাবে গোঁয়ার। কলকাতা থেকে হুগলি নদীর তীরে মাছ ধরে। এখানে এসে পাইকার দামিনীর সাথে পরিচয় হয় বিলাসের। প্রেম হয় দামিনীর নাতনী হিমির সাথে। উভয়ের সম্পর্কের টানাপোড়েন, সুখ-দুঃখ নিয়ে কাহিনি বিস্তার। নদীবক্ষেই পাঁচুর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পূর্বে সে হিমি ও বিলাসের মিলনের সম্মতি জানিয়ে যায়। সেবারই নদীতে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরা পড়ে। মালোদের কপাল খুলে যায়। হিমি আর বিলাসের মিলন হলেও,  বিলাসকে  হিমি ধরে রাখতে পারে না। বিলাস বেরিয়ে পড়ে সমূদ্রের দিকে। উপন্যাসটি সমাপ্ত হয় এভাবে-

 

‘ঢেউ লেগেছে রাইমঙ্গল আর ঝিল্লির মোহনায়। কালীনগর গঞ্জ থেকে চাল ডাল নুন তেল যোগাড়যন্ত্র হয়েছে। সাঁইদারের অপেক্ষা।

-সাঁইদার কে?

—বিলাস। তেঁতলে বিলাস।

তেঁতলে বিলাস সমূদ্রে যায়।’

গঙ্গা উপন্যাসে মৃত্যু হয়েছে নিবারণ সাঁইদার ও তার ভাই পাঁচুর। মাছ ও জলের সঙ্গে যাদের জীবন বাঁধা. নিবারণ সাঁইদার ও ভাই পাঁচুর মৃত্যু হয় মাছ ধরতে এসেই। এটাই যেন নিয়তি, প্রকৃতির আমোঘ খেয়াল।

 

মহাকালের রথের ঘোড়া উপন্যাসের নায়ক রুহিতন বিপ্লবে ব্যর্থ হয় এবং পরিবার থেকে বিছিন্ন, হতাশ হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। যুগ যুগ জীয়ে উপন্যাসের মৃগেন্দ্রেরও মৃত্যু হয়। প্রজাপতি, পাতক, স্বীকারোক্তি উপন্যাসেও নানাভাবে আকরিত হয়েছে মৃত্যু চেতনা। প্রজাপতি’র নায়ক সুখেনের মৃত্যু ঘটেছে। স্বীকারোক্তি’র রাজনৈতিক নেতা টোটদা ও কোম্পানির মালিক লালশাহকে হত্যা করেছে। পাতক উপন্যাসের নায়ক যৌনাচারি মা ও ভন্ড, প্রতারক ছাত্রনেতা রুদ্ধকে হত্যা করেছে। কিš‘ তাদের কারোরই সংগ্রাম শেষ হয় না। জীবন যুদ্ধ, বেঁচে থাকার লড়াই প্রবহমান সময়ের সাথে চলমান থাকে। বিবর, প্রজাপতি, পাতক, স্বীকারোক্তি -এগুলোতে নতুন এক রীতির প্রবর্তনই শুধু নয়, দুর্বার, দৃঃসাহসী, অপ্রিয়সত্যভাষী হয়ে উঠেছেন সমরেশ বসু। যেন নিজের বোধ-বিশ্বাসকে ভেঙেচুরে নতুন করে গড়ে তুলেছেন। জীবন আর সাহিত্য যেন অভিন্ন, মিলেমিশে একাকার। বিতর্ক, অশ্লীলতা, শারীরিক রিরংসা, যৌনতা, হত্যা, খুন, মৃত্যু আর জীবনকে যেন এক অভিনতুন শিল্পভাষ্য দিয়েছেন সমরেশ বসু তাঁর উপন্যাসে।  এসবের জন্যই হয়তো তিনি নিজের নামের আড়াল খুঁজেন ‘কালকূট’ (তীব্র বিষ), আকিষ্কার করেন জীবনের ভিন্ন এক পৃষ্ঠা, মগ্ন পাঠকের কাছে খুলেমেলে ধরেন জীবনের আলাদা এক রূপ। বোধ ও চৈতন্যের অপর ভূগোল। যার নাম ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধান’। অর্থাৎ নয়নপুরের মাটি উপন্যাসে মৃৎশিল্পী মহিম মাটির তাল দিয়ে পরম মমতায় জীঅবনের নানা রূপ ফুটিয়ে তোলে। ফরমায়েশি কাজে উপার্যন বেশি হলেও  সে কাজে মহিম স্বাচ্ছন্দ্য বোধ কওে না। শিক্ষিত পাগল-শিল্পী গৌরাঙ্গ মহিমকে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে বড়ো শিল্পী হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিল। কিন্তু মহিম শেষ পর্যন্ত মহিম খ্যাতি প্রতিষ্ঠার সব সম্ভাবনাকে পেছনে ফেলে গ্রামে ফিরে এসেছিল নয়নপুরের মাটি ও নিঃসন্তান বৌদি অহল্যার কাছে। জমিদারের পুত্রবধূ উমা মহিমের কাজে মুগ্ধ হয়, সেও চায় মহিম কলকাতায় যাক, তাকে রাজি করাতে শরীরী মায়া বিস্তার করে। কিন্তু মহিম জমিদারের প্রস্তাব, উমার  প্রলোভন উপেক্ষা করলে, সে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হতে হয়। সন্তার স্নেহব্যাকূল বউদি অহল্যাকে একটি মাটির শিশু উপহার দিতে চেয়েছিল মহিম, সেই ইচ্ছাও পূরণ হয়না পাইকের অত্যাচারে। অহল্যা মহিমকে জিজ্ঞেস করে-‘চেরকাল মুই পাথরের অহল্যা হইয়ে থাকব?’ উত্তরে মহিম বলেছে-‘না, তাতে মুই পরাণ পিতিষ্ঠা করব।’ মৃৎশিল্পী মহিমের মাটির ভেতর প্রাণ প্রতিষ্ঠার আত্মপ্রত্যয় যেন সমরেশ বসুর শিল্প-প্রচেষ্টার মধ্যে দেখা যায়। দশ বছরের অমানসিক শ্রমের অসমাপ্ত ফসল শিল্পী রামকিংকর বেইজের জীবনী অবলম্বনে লেখা দেখি নাই ফিরে উপন্যাসে রয়েছে বাঁকুড়া ও শান্তিনিকেতনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, রামকিংকর আসানসোল  ও দিল্লিতে শিক্ষকতার সময় অর্থ এবং সম্মান পেলেও প্রকৃতির অমোঘ টানে চলে আসেন শান্তিনিকেতনে। শতাব্দীর বিস্ময়কর শিল্পী রামকিঙ্কর বেইজ, আরো চমকপ্রদ তাঁর জীবন। অনিঃশেষ সংগ্রাম, সাধনা, নিন্দা,বিতর্ক আস্বস্তির, তবু বিশ্বাসে অটল, জীবনবোধে অবিচল, নাটকীয়তায় উদ্বেল, বহুবর্ণিল সেই জীবনকে চিত্রিত করেছেন এই উপন্যাসে। এখানেই সমরেশ বসুর শিল্পনিষ্ঠতার পরিচয় স্পষ্ট।

 

সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি:

১. সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় (সম্পাদিত) ২০০১, সমরেশ বসু রচনাবলী ১-১০, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা।

২.অরুণকুমার মুখোপাধ্যায় (১৯৯৪) মধ্যাহ্ন থেকে সায়াহ্ন বিংশ শতাব্দীর উপন্যাস, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা।

৩. অলোক রায় (২০০০) বাংলা উপন্যাস: প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি, পুস্তক বিপণি, কলকাতা।

৪. অশ্রুকুমার সিকদার (১৯৮৮) আধুনিকতা ও বাংলা উপন্যাস, অরুণা প্রকাশনী, কলকাতা।

৫. গুণময় মান্না (১৯৯৫) বাংলা উপন্যাসের শিল্পাঙ্গিক, ভাষা ও সাহিত্য, কলকাতা।

৬.     দেবেশ রায় (২০০০) উপন্যাস নিয়ে, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা।

৭. নিতাই বসু (১৩৯৪) কালকূট সমরেশ, জহদ্ধাত্রী পাবলিশার্স, কলকাতা।

৮.     পার্থপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯৯১) উপন্যাস রাজনৈতিক, র‌্যাডিকলে ইম্প্রেশন, কলকাতা।

৯.     রমা বন্দ্যোপাধ্যায় (২০০৫) স্বাধীনতা উত্তর উপন্যাস নিম্নবর্গের অবস্থান, ভারতী বুক এজেন্সী, কলকাতা।

 

আহমেদ মাওলা, ডীন, বাংলা বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

কাজী নজরুল ইসলাম : বাংলা সাহিত্যে অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রাণপুরুষ

আ.ম.ম. মামুন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পর বাংলা সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলামই প্রথম মৌলিক কবি। রবীন্দ্র অনুবর্তী একগুচ্ছ কবির একজন তিনি নন। তিনি অন্যরকম স্বতন্ত্র। শিল্প সাধনায়,

আমেরিকায় রবীন্দ্রনাথ 

প্রবীর বিকাশ সরকার ১৯২৯ সালে বহির্বিশ্বে অবস্থানকালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনে ঘটেছে যুগপৎ দুঃখজনক এবং আনন্দদায়ক কিছু ঘটনা। যা নিয়ে বাংলায় সামান্যই আলোচনা হয়েছে, অথবা

হিংস্র ও বুনো অপশক্তির বিনাশ চাই

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় গ্রীষ্মকালটা বড়ই অসহনীয় ও দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশে এই ঋতুটির তেজ আগে কখনও এত তীব্র ছিলো না। ইতোমধ্যেই