এখন সময়:রাত ১:১৫- আজ: বুধবার-১২ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-২৯শে মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-শীতকাল

এখন সময়:রাত ১:১৫- আজ: বুধবার
১২ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-২৯শে মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-শীতকাল

সুচক্রদন্ডী থেকে কলকাতা : সাহিত্যবিশারদ

হামীম রায়হান

অবিভক্ত বাংলার রাজধানী হিসেবে কলকাতা তখন শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সভ্যতায় বাংলার অন্যান্য অঞ্চল থেকে বেশ এগিয়ে। বড় বড় সাহিত্যিকদের পদচারণায় মুখরিত তৎকালীন বাংলার রাজধানী। ১৮৯৪ সালের ২৯ এপ্রিল কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ’। যার প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন মহারাজ কুমার বিনয়কৃষ্ণ বাহাদুর, অন্যতম সম্পাদক ছিলেন এল লিওটার্ড এবং সভাপতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এর থেকে বুঝা যায় এটি কত বড় প্রতিষ্ঠান ছিল। প্রতিষ্ঠানটির কাজের যৌক্তিকতা হিসেবে বলা হয়েছিলো ‘পিতৃপুরুষের ইতিহাস সামনে না রেখে বাংলা ভাষার অগ্রগতি অসম্ভব। তাই পরিষৎ বাংলা ভাষা, সাহিত্য, জীবনী, ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব, ধর্ম-দর্শন, অভিধান, ব্যাকরণ ইত্যাদির পাশাপাশি প্রাচীন পুথি ও পা-ুলিপি বিষয়ে বিশেষভাবে উদ্যোগী ছিল। ১৩০১ বঙ্গাব্দের কার্তিক সংখ্যায় প্রকাশিত একটি বিজ্ঞপ্তি বিশেষভাবে উল্লেখ্য, বিজ্ঞপ্তি থেকে জানা যায় যে কার্যালয়ে আলোচনা ও বক্তব্য প্রদান কালে কোন প্রকার ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করা যাবে না। কেবল যেসব শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ নায় সেসব শব্দই ইংরেজি ব্যবহার হবে। এ নিয়মের ব্যত্যয়ে উচ্চারিত প্রতিটি শব্দের জন্য এক পয়সা করে জরিমানা হবে আর জরিমানা লব্ধ অর্থ সমাজসেবায় ব্যবহৃত হবে। অবিভক্ত বাংলার রাজধানী কলকাতা থেকে প্রায় ৬০২ কি.মি. দূরে পূর্ব বাংলার দক্ষিণে চট্টগ্রামে পটিয়ার এক ছোট্ট গ্রাম সুচক্রদ-ীতে ১৮৭১ সালের ১১ অক্টোবর জন্ম গ্রহণ করেন মুন্সী আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ। পিতা মুন্সি নুরউদ্দীন ও মাতা মিসরীজান। তাঁর দাদার নাম মুহাম্মদ নবী ও দাদি জোলেখা খাতুন। আবদুল করিমের জন্মের পূর্বেই পিতা মারা যান। ‘মুন্সী’ তাঁর পারিবারিক উপাধি, আর ‘সাহিত্যবিশারদ’ তাঁর সাহিত্য সাধনার স্বীকৃতি। তাঁর এই বিশেষণ যেন ছাড়িয়ে গেছে তাঁর নামপদের সীমানাকেও। অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থায় কলকাতা যেন সুচক্রদ-ী থেকে সত্যিসত্যিই অনেক দূরের শহর। কিন্তু কেমন করে, কোন মন্ত্র-মায়ায় বশ করে কলকাতায় নিজের আসন পেয়েছিলেন সাহিত্যবিশারদ, তা সত্যি-ই আশ্চর্যের! তিনি যেন হ্যামিলনের সেই বাঁশিওয়ালার মতো, বাঁশি বাজালেন আর সবাই তাঁর বশ্যতা স্বীকার করলো!

সাহিত্যবিশারদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এবং চাকুরি সবটাই পটিয়া ও চট্টগ্রামেই। শৈশব থেকে বাড়ির উঠানে পুঁথির পাঠের আসর দেখেছেন। সে হিসেবে সুর করা এসব পুঁথির প্রতি ভালোবাসা জন্ম নেয় সাহিত্যবিশারদের। এই ভালোবাসায় তাঁকে করেছে সকলের চাইতে আলাদা।
বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে থেকেই সাহিত্যবিশারদের পুঁথিসংগ্রহের শ্রম শুরু হয়েছে। ‘পূর্ণিমা’ পত্রিকায় ‘অপ্রকাশিত প্রাচীন পদাবলী ‘ শিরোনামে তাঁর পুঁথি সম্পর্কিত প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় ১৮৯৫ সালে। যার সাধনার ইতিহাস নিশ্চয় আরো আগের। তাঁর এই লেখা প্রকাশের পর কবি নবীনচন্দ্র সেনের সাথে পত্র যোগে পরিচয় হয়। অল্পদিনেই তিনি নবীনচন্দ্রের প্রিয় হয়ে উঠেন। তাই কবি নবীনচন্দ্র আবদুল করিমকে চট্টগ্রাম কমিশনার অফিসের কেরানি করে শহরে নিয়ে আসেন। উল্লেখ্য কবি নবীনচন্দ্র সেন ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট।
প-িত ক্ষিতিমোহন সেন সাহিত্যবিশারদকে নিয়ে বলেছিলেন ” তিনি ব্যক্তি নহেন, তিনি একটি প্রতিষ্ঠান।” কথাটা আবেগের শুনালেও সাহিত্যবিশারদের কাজ কথাটিকে সত্য প্রমাণ করেছে। সাহিত্যবিশারদ একাই, একক চেষ্টায় সংগ্রহ করেছিলেন আড়াই হাজারের উপর পুঁথি। এদের মধ্যে প্রায় একহাজার পুঁথি বাঙালি মুসলমান কর্তৃক রচিত। যা এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগৃহীত। অন্যগুলো বাঙালি হিন্দু কবিদের রচিত। যা বরেন্দ্র মিউজিয়ামে দেয়া হয়েছিল। যা কোন প্রতিষ্ঠান থেকে কম নয়। এক সময় বাঙালি মুসলমান তাঁদের সাহিত্যকর্মের ইতিহাস নিয়ে যে হীনমন্যতায় ভুগতো তা সাহিত্যবিশারদ একাই দূর করে দেন। এবং পুঁথির মাধ্যমে মধ্যযুগের বাঙালি মুসলমানদের এমন ইতিহাস তুলে আনেন যা তাদের জন্য গর্বেরও। মধ্যযুগের মহাকবি আলাওলকে বাংলা সাহিত্যে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করেন আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ। তিনি আলাওলকে চট্টগ্রামের বলে প্রমাণ করেন এবং মধ্যযুগের ‘রবীন্দ্রনাথ’ বলেও আখ্যা দেন। আলাওলের ‘পদ্মাবতী’ পুঁথিটি তিনি সংগ্রহ করেন আনোয়ারার এক কৃষক বাড়ি থেকে। যার সম্পাদনাও তিনি করেছিলেন। আলাওলকে নিয়ে তিনি চল্লিশটিরও অধিক প্রবন্ধ রচনা করেন, যাও এক অসাধারণ কাজ! যদিও আলাওল’র পুঁথিটি সাহিত্যবিশারদ সম্পাদনা করলেও তা ছাপা হরফে দেখে যেতে পারেননি। সে এক করুণ ইতিহাস! সাহিত্যবিশারদের সংগৃহীত পুঁথিগুলো বিদেশে বিক্রির প্রস্তাব পান, কিন্তু তিনি তাতে রাজি হননি। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এসব পুঁথি একবার দেশের বাইরে চলে গেলে আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। তাই তিনি চাইতেন এসব যেন দেশেই থাকে। দেশের গবেষকদের কাজে লাগে। দেশের উন্নতি হোক।

১৩০১ বঙ্গাব্দের মাঘ সংখ্যায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ-পত্রিকায় প্রথমবারের মতো ছাপা হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছেলেভুলানো ছড়া’। প্রবন্ধটিতে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নানা লোকজ ছড়া সংগ্রহের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা করেন। রবীন্দ্রনাথের এই আহবানে সাড়া দিয়ে সারা বাংলায় লোকজ ছড়া সংগ্রহের উদ্যোগ দেখা যায়। পরিষদের অর্থানুকূল্যেও অনেকেই এসব ছড়া সংগ্রহ করতে থাকেন। কিন্তু সম্পূর্ণ বাক্তিগত উদ্যোগে ও নিজের খরচে নিজের এলাকা চট্টগ্রাম থেকে ঘুরে ঘুরে পুঁথি সংগ্রহের পাশাপাশি লোকজ ছড়াও সংগ্রহ করতে থাকেন আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ। প্রায় দশ বছরের প্রচেষ্টা ও শ্রমের ফলে চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা থেকে সাহিত্যবিশারদ সংগ্রহ করেন নানা ছড়া ও ধাঁধা। যা ১৩০৯ বঙ্গাব্দে পরিষৎ পত্রিকায় ‘চট্টগ্রামী ছেলে ভুলানো ছড়া’ শীর্ষক প্রবন্ধ এবং ১৩১২ র মাঘ সংখ্যায় ছাপা হয় ‘চট্টগ্রামী ছেলে ঠকন ধাঁধা’ শীর্ষক প্রবন্ধের মাধ্যমে।
বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ এ সাহিত্যবিশারদের অবস্থান ছিলো বেশ সম্মানের। পরিষৎদের উদ্যোগেও যেহেতু নানা অঞ্চলে অর্থের বিনিময়ে পুঁথি সংগ্রহ ও ফোকলোর সংগ্রহের কাজ চলতো সেখানে সাহিত্যবিশারদ সম্পূর্ণ আলাদা ছিলেন। তিনি পরিষৎ থেকে কোন অর্থ সুবিধা কখনো নেননি। কিন্তু নিরবে, নিভৃতে একই কাজ করে গেছেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, “আমি ছিলাম পাল থেকে পলাতক।’ চট্টগ্রামের সংস্কৃতি সম্মেলনের সভাপতির ভাষণে ১৬ই মার্চ ১৯৫১ সালে তিনি বলেন, “পুরাতন পুঁথি কঙ্কালেরই মত। কিন্তু আমি তাহার ভিতর যুগযুগান্তের রক্তধমন ও নিঃশ্বাসের প্রবাহধ্বনি শুনিয়াছি। ‘
সাহিত্যবিশারদ ১৫টি বই সম্পাদনা করেছিলেন, যার মধ্যে কিছু ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ – থেকে প্রকাশিত হয়। সেগুলো হলো- নরোত্তম ঠাকুর রচিত- রাধিকার মানভঙ্গ, বাঙালা প্রাচীন পুঁথির বিবরণ ১ম খ-, বাঙালা প্রাচীন পুথির বিবরণ ২য় খ-, দ্বিজ রতিদেব রচিত ‘মৃগলুদ্ধ’, কবি বল্লব রচিত ‘সত্য নারায়ণের পুথি’, রামরাজা রচিত ‘মৃগলুদ্ধ’, আলী রাজা রচিত ‘জ্ঞানসাগর’, বাসুদেব ঘোষ রচিত ‘শ্রী গৌরাঙ্গ সন্ন্যাস’ মুক্তরাম সেন রচিত ‘সারদা মঙ্গল’, শেখ ফয়জুল্লা রচিত ‘গোরক্ষ বিজয়’। ‘রাধিকার মানভঙ্গ’ এর সম্পাদকীয় গুণ বিচারে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লিখেন, ‘তিনি এই দুর্লভ গ্রন্থের সম্পাদনকার্যে যেরূপ পরিশ্রম, যেরূপ কৌশল, যেরূপ সহৃদয়তা ও যেরূপ সুক্ষ্মমদর্শিতা প্রদর্শন করিয়াছেন, তাহা সমস্থ বাংলা কেন সমস্থ ভারতেও বোধ হয় সচারাচর মিলে না। এক একবার মনে হয় যেন কোন জর্মান এডিটার এই গ্রন্থ সম্পাদনা করিয়াছেন।’
হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় সাহিত্যবিশারদ সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘ সে অনেক দিনের কথা। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ মন্দিরে যাতায়াত করি। প্রিয় সুহৃৎ রামকমল সিংহ পরিচয় করাইয়া দিলেন। আমা অপেক্ষা বয়সে কিছু বড় হইলেও করিম সাহেবের সঙ্গে বন্ধুত্ব হইয়াছিল। উদার মানুষ, কোনরূপ সাম্প্রদায়িকতা কি সঙ্কীর্ণতা নাই। পুরনো পুথি সংগ্রহ করেন এবং পুরনো পুঁথি পড়িতে জানেন। পরিষৎ কর্ত্তৃপক্ষ সকলে তাহাকে ভালবাসেন।দেখিলাম সাহিত্যিক মহলেও বেশ সুপরিচিত ব্যক্তি।’ এ থেকে বুঝা যায় কলকাতা সাহিত্য মহলে বেশ সম্মান ও সুনাম লাভ করেছিলেন সাহিত্যবিশারদ।
এই সম্মান ও সুনাম তিনি লাভ করেছিলেন তাঁর পা-িত্য ও সাহিত্যের প্রতি একাগ্রতার জন্য। আর অতি সাধারণ জীবনাচার তাঁকে অন্যন্য করেছিল। এ সম্পর্কে সাহিত্যিক ওহীদুল আলম লিখেছিলেন, ‘ শহরে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হঠাৎ চোখে পড়তো বেঁটে খাটো হালকা শরীর, পরণে ধূতি, গায়ে সাদা পাঞ্জাবি, আমাদের সঙ্গীদের মধ্যে যার একটু বয়স হয়েছে সে তৎক্ষণাৎ আঙুল দিয়ে চিহ্নিত করে বলতো: এই, এই সাহিত্যবিশারদ আবদুল করিম, দেখ দেখ, এমন প-িত লোকটির অতি সাধারণ পোষাকে এমন নিরীহ মুখচ্ছবি দেখে আমরা অবাক হতাম। মুখে চোখে কোন পা-িত্যের ঝাঁজ নেই। শিশুর সারল্য সারা মুখে।’ ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ লিখেছিলেন, “ছাত্র অবস্থা হইতে ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’ এর সংশ্রবে আসিয়া তাঁহার নাম শুনিতেছিলাম।’ এ থেকে সহজেই বুঝা যায় পরিষৎ এ ভালোই অবস্থান ছিল সাহিত্যবিশারদের।
সাহিত্যবিশারদ পঁথি সংগ্রহের পাশাপাশি নানা বিষয়ে বা পুঁথি বিষয়ে প্রায় ছয়শতাধিক প্রবন্ধ লিখেছেন। এ সব প্রবন্ধ তৎকালীন কলকাতা ও বাঙালার বিখ্যাত সব পত্রিকায় গুরুত্বসহকারে ছাপানো হতো। পত্রিকাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-পূর্ণিমা, সাহিত্য-সংহিতা, ভারতবর্ষ, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, কোহিনূর, বঙ্গদর্শন, ইসলাম প্রচারক, দিলরুবা, সত্যবার্তা, মাসিক মোহাম্মদী, সোনার বাংলা, রেনেসাঁ, মাহেনও, আলো, পার্বণী, ইনসাফ, নবযুগ, সওগাত, ভারত সুহৃদ, দিলরুবা, বুলবুল, পূর্ব পাকিস্তান, কাফেলা, সাধনা, অঙ্কুর, স্বদেশী, পাঞ্চজন্য, অবসর, অর্চনা, প্রতিভা, মিহির ও সুধাকর, বাঙালি, কল্পতরু, সঙ্কল্প, সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা, জ্যোতিঃ, মানসী, মদিনা, বিজয়া, আল ইসলাহ, শিক্ষা সমাচার, বৌদ্ধ পত্রিকা, কায়স্থ, যমুনা, অবসর, দেশপ্রিয়, মিল্লাত, তপোবন, শাকপুরা, জনমত, আশা, নোয়াখালী, সৌরভ, হিতবাদী, নবনূর, আওয়াজ, প্রদীপ, বীরভূমি, পুরবী, সীমান্ত, বীণাপাণি, যুগের জ্যোতি, সুপ্রভাত, প্রকৃতি ইত্যাদি সহ অসংখ্য পত্রিকা। কোন কোন পত্রিকা আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদকে সম্পাদক হিসেবেও নিয়োগ করেছিল কারণ সর্বমহলে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা।

তাছাড়া তৎকালীন সময় বাংলা ও কলকাতায় অনুষ্ঠিত হওয়া বিভিন্ন সাহিত্য সম্মিলনে সাহিত্যবিশারদ সভাপতিত্ব করেছেন। এসব সম্মিলনে বাঙালার প্রথিতযশা বিভিন্ন সাহিত্যিকগণ অংশ গ্রহণ করতেন। ১৯১৪ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত সপ্তম বর্ষ বাংলা সাহিত্য সম্মেলনে গুরুত্বপূর্ণ অভিভাষণ পেশ করেন সাহিত্যবিশারদ ‘বাঙ্গলার মুসলমানগণের মাতৃভাষা’ শিরোনামে। ১৯১৪/১৫ সালে চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনেও অভিভাষণ, ১৯১৮ সালে চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত তৃতীয় বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সম্মেলনে অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি হিসেবে অভিভাষণ, ১৯৩৩ সালে চট্টগ্রাম জেলা সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতির অভিভাষণ, চন্দন নগরে বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মিলনের একবিংশ অধিবেশনে অভিভাষণ, বঙ্গসাহিত্য সম্মিলনে উদ্বোধনী ভাষণ, কলকাতায় অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতির অভিভাষণ (১৯৩৯), ১৯৪৩ সালে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মরণ সভায় সভাপতির অভিভাষণ, ১৯৪৫ সালে প্রগতি সাহিত্য সম্মেলনে সম্মানিত অতিথির উদ্বোধনী অভিভাষণ, ১৯৪৭ সালে কবি নবীনচন্দ্র সেনের শতবার্ষিকী স্মৃতি উৎসবে সভাপতির অভিভাষণ ইত্যাদি সহ অসংখ্য অভিভাষণ তিনি প্রদান করেছেন। এসব অভিভাষণে তিনি দেশ, সমাজ, মুসলমান সমাজ, ভাষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি ইত্যাদি নানা বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। সাহিত্যিক মূল্য বিচারে এসব অভিভাষণও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
তাঁর অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গী তাঁকে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছিল। তিনিই প্রথম অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে হিন্দু মুসলিম সবার পুঁথি সংগ্রহ করেছিলেন। যখন কথা উঠলো যে হিন্দু লেখকগণ তাঁদের সংস্কৃতি মুসলমানদের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে তখন সাহিত্যবিশারদ বললেন, ‘পৃথিবীর কোন সাহিত্যিক আজ পর্যন্ত তাহা করিতে পারেন নাই। আমার বিশ্বাস, হিন্দুরা জোর করিয়া তাঁহাদের আদর্শ ও ভাবকে আমাদের স্কন্ধে যতটা চাপাইতেছেন না, আমরা তাঁহাদের প্রতিভাবান সাহিত্যিকদের সৃষ্টির দ্বারা অজ্ঞাতসারে ততোধিক আকৃষ্ট হইয়া তাঁহাদের আদর্শ ও ভাবকে বরণ করিয়া লইতেছি।’ তিনি জাতীয় ঐক্যের কথা বলেছেন। বলেছেন নিজের সংস্কৃতি চর্চার কথা। তিনি মনে করতেন পৃথিবীর কোন জাতিই জাতি হিসেবে আপন বৈশিষ্ট্য ছেড়ে বাঁচতে পারে না। জাতির উন্নতি কেবল সম্ভব তার নিজের বৈশিষ্ট্য ও মাতৃভাষাতেই। দেশীয় মুসলমানদের যখন বাংলা রেখে উর্দু ভাষার ব্যবহার করতে বলা হচ্ছিল তখন সাহিত্যবিশারদ লিখলেন, ‘স্বাভাবিক সহজপ্রাপ্য দেশীয় নদীকে উপেক্ষা করিয়া বিদেশীয় খাল হইতে পানীয় জল সংগ্রহ করিবার চেষ্টার ন্যায়; বঙ্গীয় মুসলমান-সমাজে উর্দ্দু প্রভৃতির প্রচলন চেষ্টাও একান্ত উপহাস্য।’

আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ তাঁর চুরাশি বছরের জীবনে আপাদমস্তক একজন সাহিত্যসেবী হিসেবেই ছিলেন। তিনি চাইতেন যেন জীবনের শেষ মুহুূর্তেও এই সাহিত্যসেবা করেই মৃত্যুবরণ করেন। হলও তাই, ১৯৫৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর সাহিত্যবিশারদ তাঁর লেখার টেবিলে বসা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর কত ত্যাগ তিতিক্ষার ফলস্বরূপ আজ আমাদের এই বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের ইতিহাস। সাহিত্যবিশারদ যতটা আলো ছড়িয়েছেন আমরা তার সিকিভাগও গ্রহণ করতে পারিনি। তাই আজও আমাদেরকে লড়তে হয় সাম্প্রদায়িকতার সাথে। আজও হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবাই মিলে এক বাঙালি গড়ে উঠেনি। সাহিত্যবিশারদ আজও আমাদের কাছে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। আরো বেশি প্রয়োজনীয়।

 

হামীম রায়হান, প্রাবন্ধিক

প্রাচীন বাংলার স্বচ্ছ ইতিহাস রচনায় তাম্র-শিলালিপি মুদ্রা ও প্রত্ন-ভাস্কর্য কতটা দরকারি

ড. আবু নোমান উৎস বা সূত্র যতটা স্বচ্ছ যৌক্তিক ও প্রায়োগিক হয় ইতিহাস তত বেশি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। এ কারণেই ইতিহাস রচনায় উৎসের ভূমিকা অত্যন্ত

আন্দরকিল্লার উদ্যোগে আনন্দ আড্ডা ও দুই কবির জন্মদিন পালন

রুহু রুহেল বিগত ১ জানুয়ারি ২০২৫ সন্ধ্যা ছয়টায় শিল্প, সাহিত্য ও সমাজভাবনামূলক কাগজ ‘আন্দরকিল্লা’র ২৭ বছরে পদার্পণ, দুই কবির জন্মদিন পালন, ‘আন্দরকিল্লা’র ডিসেম্বর সংখ্যার পাঠ

রাজা মহারাজাদের ‘হারেম’

বাবুল সিদ্দিক   ‘হারেম’ শব্দটি তুর্কি শব্দ। কেউ কেউ বলেন হারেম শব্দটি আরবি শব্দ হারাম থেকে এসেছে। যার অর্থ নিষিদ্ধ। সহজ ভাষায় হারেম অর্থ মহিলাদের

অরক্ষিত সময়ের গল্প

মনি হায়দার সে পাহারাদার, সুতরাং নারী ও রাত তার কাছে অতৃপ্তির আধার। গল্পটা একজন পাহারাদারকে নিয়ে অথবা  একজন পাহারাদারের গল্পও হতে পারে। গাছ গাছই, যে

রুয়েলিয়া, রুয়েলিয়া

শোয়ায়েব মুহামদ শাহানা বলে, বেলায়াত স্টুডিও থেকে কি ছবিটা তুমি নিতে পারছো? বেলায়াত এসেছে খানিক আগে, ট্রেনে। এসে জোহরের নামাজ শেষে গুটানো জায়নামাজ টেবিলে রেখে