প্রকৃতির নিঃশ্চুপ হার
ঘর আলো করে মনু চাষার ক্ষুদ্র কুটিরে প্রথম বংশধর এলে পাড়া প্রতিবেশীরা বলল, রূপবতী মায়ের গতরের রঙ পাইছে গো তোমার পোলা!
অতঃপর জীবন চাকার পরিবর্তন কিভাবে হয়, জানতে চাইলে নিজেই প্রশ্নটা করেই জেনে নিন না — ওই তো দাঁড়িয়ে আছে পাথর হয়ে সরষে ক্ষেতের মাঝে মনু মহাজন । যতদূর চোখ যায়, শুধু হলুদ আর হলুদ বিস্তীর্ণ মাঠ। সম্ভব হয়েছে ওই হিসেবি মা আর সৌভাগ্য বয়ে আনা ফুটফুটে ছেলেটার জন্যই তো! মা বাবা দু’জনায়ই শখ করে ছেলের নাম রেখেছে ”আলো”। পুত্রের কি যে এক দুরন্তপনায় ভর করে গড়ে উঠলো বিশাল ব্যবস্থা। সাত বছরেই মনু চাষা হয়ে গেলো যে মনু মাহাজন! এই তো সেদিন ছোট্ট আলো তার কচি তুলতুলে হাতে ছুঁয়ে দিয়েছিলো সরষের সবুজ গাছগুলো। আজ ডগায় ডগায় ফুলের কুঁড়িতে হলুদে হলুদে ঢেকে গেছে সব সবুজ পাতাগুলো। আজই হঠাৎ আলো কিনকিনে শব্দে বাপজানকে ডাকে, বাপজানগো আমার যে বড্ড সাধ জাগছে হলুদ মাঠে যাবার, প্রাণ ভইরা ফুল গুলানরে দুই হাতে একটু আদর করবো”।
মায়ের পরান ফেটে চৌচির, মাত্র দুদিনেই কি যে হলো! আলোর সারা শরীর কাঁচা হলুদে মেখে দিয়েছে কেউ। কোথা থেকে শরীরে বাসা বেঁধেছে হলদেটে মরণ ব্যাধি, যেতে হবে শহরের বড় হাসপাতালে দ্রুত, অতি দ্রুত।
আজ বাপজান কথা রেখেছে—আলো দু’হাতে জড়িয়ে ধরেছে ফুল। বাপজান পাথর, মনে অজানা শঙ্কা। উচ্ছসিত আলো’র বাঁধ ভাঙা হাসি সরষের হৃদয় জুড়েও ঝড় তোলে। হয়তো এই প্রথম, ছোট্ট আলো’র হলুদের কাছে সরষে ফুলগুলোও সবিনয়ে হার মানে!
কালো পিঁপড়া আর বিস্ফোরিত দুটি চোখ
এবড়ো থেবড়ো ভূমি থেকে কিছুটা উপরেই গুহা দুটো। বিশুদ্ধ আত্মার দেহ ত্যাগের গমনে সবার আগে জ্ঞাত ছোট্ট প্রজাতির পিঁপড়ারা দলবদ্ধ ভাবে একসারিতে তরতর করে উঠে যাচ্ছে। ঐ তো উঠে যাচ্ছে, কালো পিঁপড়ারা, হ্যাঁ ওই উন্মুক্ত নাসিক্য গহবরে—তারা প্রশিক্ষিত, অদম্য। আর নাসিকা গহবরের অধিকারী রয়েছে অনুভুতিহীণ অসার।
বাঁধাহীন সুরঙ্গ পথের সীমানায় তুলতুলে সুতোর মতো ঝুলন দোলা। কাটুস কুটুস— একটু একটু করে বিশাল ফোঁকরে পরিণত হচ্ছে, ফোঁকর পেরিয়েই বিশাল খাদ্য ভাণ্ডার এর আবিষ্কার—ফুসফুস, পাকস্থলী আরো কত কি! কালো পিঁপড়াদেরই পদচিহ্ন সে পথে প্রথম তা তো নয়। কোটি কোটি আণুবীক্ষণিক জীবও তো কাজ শুরু করেছে আগেই। তাদের কার্যকারিতায় শুরু হওয়া পঁচনে পিঁপড়াদের সে কি আনন্দ—খাদ্য আহরণে। ফিরতি পথ প্রথম গুহা দুটির নিচেই একটি — তবে অনেক বড়—সেটাই অনড় মানুষটির মুখ গহবর! মুখে সংগৃহীত খাবার নিয়ে পিঁপড়ার দলকে আবার সেই সুসংবদ্ধ বেড়োনো, খুবই নজরকাড়া বীভৎস দৃশ্যটি অনেকেই দেখছে, দেখছি আমিও। নাসিকা গুহা দুটোর উপরে বিস্ফোরিত সার্চ লাইটের মতো চক্ষু বলয়, কাকে যেনো খুঁজছে— হ্যাঁ, কাকে যেনো খুঁজছে, বিপুল বিগ্রহে। আমার জীবন্ত বিস্ফোরিত চোখ দুটোও মৃত চোখ দুটিতে আটকে গেছে। শহরের ব্যস্ততম মোড়ে সদ্য নির্মায়মান উড়াল সেতুর নিচে — জীবন সংগ্রামে যুঝতে থাকা নিঃসঙ্গ বৃদ্ধটির চির বিদায় নেবার পরেও, কালো পিঁপড়াদের একটু করুণা হলো বৈ কি! হয়তো তাই তারা সযত্নে ছেড়ে দিয়েছে বৃদ্ধের বিস্ফোরিত চোখ দুটি — ধাবমান উৎসুক মানুষের অবজ্ঞার চোখগুলোকে আরেক বার দেখবার জন্য!
এ কেমন হঠকারিতা
শহরের এক ব্যস্ত চৌরাস্তায় সিগনাল বাতিগুলো অলসভাবে দাঁড়িয়ে আছে নির্লজ্জ, অথর্ব, অন্ধ হয়ে। কোনো এক ট্রাফিক পুলিশের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসলে আমাদের গাড়িটি চৌরাস্তায় আটকে আছে ষোলো কি সতেরো মিনিট। একটি কিশোরী প্রতিটি গাড়ির জানালায় টোকা দিয়ে যাচ্ছে। মলিন পোশাকই বলে দিচ্ছে ভিক্ষাবৃত্তিই তার পেশা। সে কিন্তু একা নয় — কোলে যে এক ফুটফুটে ছোট্ট বাবুটিও আছে। বয়স হয়তো সাত কি আট মাস হবে — পরিপূর্ণ বস্ত্রহীন, কিশোরীর কোমরে চুপটি করে কোনো মতো ঝুলে আছে। এ গাড়ির ও গাড়ির জানালায় টোকা দিতে দিতে এখন আমাদের সামনে, টোকা দেয়ার আগেই জানালার কাচ নামিয়ে ফেলি। শিশুটির নিষ্পাপ মনকাড়া হাসি দেখেই মনে লাগে স্নিগ্ধ হাওয়া। বিমুগ্ধ নয়নে সে হাসি প্রাণে গেঁথে নিতেই হঠাৎ দেখি এক কুৎসিত দৃশ্যায়ন—শিশুটির তুলতুলে শরীরে কিশোরীর লুকিয়ে চিমটি কাটা! যে কারণে চিমটি কাটা তার কুৎসিত ফলাফল মূহুর্তেই পাওয়া গেল। নিষ্পাপ হাস্যোজ্জ্বল শিশুটির মুখটি বিষণ্ণ কান্নায় পরিণত হলো। দৃশ্যটির জন্য আমার অন্তর প্রস্তুত ছিলো না — হয়তো থাকবেও না কখনো।
ততক্ষণাৎ কিশোরীর করুণ বিষাদময় কন্ঠ বেজে উঠে — ভাইজানগো, বাইচ্চাডা দুই দিন ধইরা কিছু খায় নাই গো..
মন হঠাৎ বিষাদে ছেয়ে গেলো কিশোরী মায়ের হঠকারিতায়! নিষ্পাপ শিশুর যে মন আকুল করা হাসি আমি দেখেছি, বিপরীতে মায়ের হঠকারিতায় তার এখন যে কষ্টের ক্রন্দন — সে তো উজ্জ্বল সূর্য বলয়ে এক বিন্দু গ্রহাণুর কালো ছায়াই মাত্র!
ব্যর্থ শিশু মাতা
কি নাম দেয়া যায় তার — শিশু মাতা নাকি অন্য কিছু? অভিজ্ঞতাও লাগে না, দেখেই বয়স বলতে পারবে যে কেউ। হত দরিদ্র বাবার টলটলে হৃদয় জানে — এ বছর জুনে গুনে গুনে ঠিক বারো হতো তার ছোট্ট পুতুলের মত মেয়েটির।
সামান্য কাপড়ের একটা পুতুল তার মেয়েটির সেই ছোট্ট বেলার সাথী। আজো বাবার টিনের ট্রাংকে সযত্নে তোলা রয়েছে। গত বছর, মেয়েটা বিবাহত্তোর বিদায়ের কালে বুক ফাটা কান্না আর ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বলেছিল কত অনুনয়ে—বাবজান, এই জানের টুকরা পুতুলডা তুইলা রাইখো। আমি বাড়ি আইয়া ওরে জড়াইয়া ধইরা খেলুম।
আজ পুতুল খেলার গন্ধ গায়ে মেখে শুয়ে আছে ওই তো মেঝেতে ধবধবে সাদা কাপড়ে জড়িয়ে — নিথর।
অথচ সেই ছিল জীবন্ত পুতুল, জীবন্ত উচ্ছ্বাস ওই পাশে নির্জীব, কাঠ পুতুলের ন্যায় দাঁড়ানো বাবার।
গরিব বাবা, মেয়েটি অন্তত চারটা ভালো মন্দ খেয়ে বেঁচে থাকবে সেই আশাতেই বিয়ে দিয়েছিলো ওই লম্পটটার সাথে। দিনের পর দিন প্রলোভনের কাছে মেনেছিল হার, পাঁজর ভেঙে উপড়ে দিয়েছিল তার হৃদয়ের প্রাণ পাখি। লম্পটের সীমাহীন লোভ আর হৃদয়হীনতার ফলে ছোট্ট মেয়েটির দেহে জন্মাতে থাকে আরেক জীবন্ত পুতুল। অতঃপর হতভম্ব মেয়েটি কত সহজেই হলো ব্যর্থ। নিঃস্প্রাণ কাপড়ের পুতুল ছেড়ে তারই রক্তে মাংসে গড়া নিজস্ব জীবন্ত পুতুলের মা হতে পারল না আর।
সৈয়দ মনজুর কবির, গল্পকার