কত মায়া
অফিসে রাজ্যের কাজ থাকুক আর না থাকুক কাজ শেষে বাড়ির সদর দরজায় এসে দাঁড়ালেই শান্তি। তেমনি একদিন সদর দরজায় এসে কল ইন বেল চাপতেই ভেতরের ডিং ডং শব্দ কানে এলো, আরো কানে এলো ঘরের ভিতরে হঠাৎ হুড়োহুড়ি। জানালার পর্দা বাতাসে উড়তেই ভেতরের সামান্য অংশ চোখে পড়ে। ছয় বছরের মেয়েটিকে দেখা গেল — উদ্বিগ্ন। খুবই সতর্কতার সাথে এ রুম হতে ও রুমে যাচ্ছে, পিছনে লুকানো ভঙ্গিমায় ধরা বড় সড় হাত পাখাটি। আঁতকে উঠে মন— নিঃশ্চয় অঘটন ঘটেছে আজ! কথাছিল, দুষ্টু মিতে যে ব্যথা পাবে— শাস্তি হবে তারই। আর পিঠে পরবে ওই হাত পাখার ডাটের মৃদু বাড়ি। তাই ছোট মেয়েটি আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে পাখাটি লুকিয়ে ফেলার। মন আমার বিক্ষিপ্ত, না জানি কি হলো— বড় কিছু কি? ভেতরে হুড়ো হুড়ি শান্ত হলে সদর দরজা খুললো। আমার উদ্বিগ্ন চোখ ঘরে ঢুকেই কন্যার হাত পায়ের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে ব্যস্ত। আর দেখলাম মেয়ের ডান হাঁটুতে ছিলে যাওয়ার দাগ। মেয়ে আমার আজ ভীষণ শান্ত শিষ্ট — কিছু লুকাচ্ছে। অপেক্ষায় থাকি, কখন সে নিজেই বলবে তার দুষ্টুমির কথা। যখন বলবে বলবে ভাব ঠিক সেই মুহূর্তে হঠাৎ বিদ্যুৎ গেল চলে। দুঃসহ গরম বাতাসহীন পরিবেশ। ঘর্মাক্ত শরীর আরো ঘেমে নেয়ে উঠছি প্রায়। চুপটি করে থাকি, তবুও হাত পাখা টি চাচ্ছিলাম না।
গরমে বাবার কষ্ট মেয়েকে বোঝাতে হলো না। সে নিজেই বুঝে নেয়। মায়ার সাগরে শাস্তির ভয় অজান্তেই ডুবে যায় অতলে। দৌড়ে লুকিয়ে রাখা হাত পাখা নিয়ে আসে— হাসি হাসি মুখে। ছোট্টহাত, শক্তিতে যে কুলায় না — তবুও বাতাস দিয়ে যাচ্ছে যত শক্তিতে পারে বাবার শান্তির জন্য। মুখে মায়ার ঘাম জমছে বিন্দু বিন্দু করে।
আমার মনের গহিনে উপচে উঠে কান্নার ফেনা! কত মায়া রেখেছে মেয়ে আমার ঐ ছোট্ট টলটলে দুচোখ ভরে। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠি মায়ার সাগরে ভাসতে ভাসতে। আর মেয়ে আমার বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থাকে অবাক বিস্ময়ে।
নিকৃষ্ট সফল ব্যবসায়ী
টার্গেট স্থির হয়ে গেছে — এখন শুধু কৌশলে এগিয়ে যাওয়া। ঝাক্কাস টাইপের মোটরসাইকেল মিলে গেলো ভাড়ার দোকান থেকে, হৃদপিণ্ড কাঁপানো রেসিং সাউন্ড অ্যাফেক্ট যুক্ত সাইল্যান্সার। দোহারা গড়ন, লম্বা জুলফি করা এক মাস্তান এখন মোটর সাইকেলটির আরোহী। রাজকীয় ভঙ্গীমায় ব্যস্ত রাস্তায় জনমানব উপেক্ষা করে দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে। লক্ষ্য একটাই— ঐ যে ঐ নবম শ্রেণির হাবাগোবা মেয়েটি। জীবনে অন্য কেউ সাফল্যের শীর্ষে আরোহন করে কি না করে, প্রকৃতির অমোঘ বিধানে এই সব মাস্তান কেনো জানি সব সময় সফল! ফাঁদে পা দেয়া হাবাগোবা মেয়েটিও বাবা মায়ের অপার ভালোবাসার বন্ধন ছিঁড়ে মোটর সাইকেলের গতির ঝড়ে উড়ে বেড়াতে চোখে আঁটে রঙিন স্বপ্ন। বাবা মায়ের শত বারণ মনে হয় দোযখের অগ্নিসম। মেয়ের মনে শংকা— তার পরম ভালোবাসার বিরুদ্ধে কি সবাই? ভেঙে ফেলে শংকা। স্নিগ্ধ বন্ধন ছিঁড়ে উড়ে যায় ওই মাস্তানের কাছে।
জীবন কৌশলে জয়ী মাস্তান হাসে, হাসে ভয়ঙ্কর কুৎসিৎ কালো মনে। তার পরিকল্পিত ব্যবসায় অর্থ লগ্নি হয় স্বার্থক! এই তো আর কিছুদিন — তারপর না হয় মুখোশ উন্মোচন করবে। আগে তো নিজেকে খুশির ঢেউয়ে ভাসতে দিতে চায় যেমন, যে ভাবে। দৈহিক আনন্দ ভোগের দিন শেষে মাস্তান ভাসে খুশির জোয়ারে! পকেটে তার মোটা অংকের টাকা। শেষমেশ ঝক্কি ঝামেলাহীনই হাবাগোবা মেয়েটিকে তুলে দেয়া গেছে কোনো এক অন্ধকার নিষিদ্ধ পল্লীতে। অফুরন্ত আনন্দ নিয়ে নিকৃষ্ট সফল ব্যবসায়ী মাস্তান ছোটে পুনরায় — নতুন কোনো হাবাগোবা টার্গেটের খোঁজে, পুনরায় ব্যবসায় লগ্নিতে।
বিস্ময়কর সি—০৪০৮০১
এই পৃথিবীতে যা কিছু বিস্ময় তার সবই ঘটছে রাজু সাহেবের জীবদ্দশায়। ঢাকার বৈচিত্র্যময় খানা—খন্দের রাস্তায় রিক্শা গেলো উল্টে। বেকায়দায় পড়ে রইলেন উৎসুক জনতার ভিড় বাড়ার আগ পর্যন্ত। অতঃপর, অনেক আলোচনা পর্যালোচনার পর তার স্থান হলো হাসপাতালে। হলো বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা। বিস্ময়করই! হয়তো বা কোটিতে ঘটে এক — কোমরের সবচেয়ে মোটা স্যাকরাম হাড় ভাঙলো!
কোনো দিন দাঁড়াতেই পারবে না শুনে অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত হলো। আনা হলো মজবুত টাংস্টেন পাতলা পাত। ডাক্তার বিস্ময়ে চেয়ে দেখেন কিছুক্ষণ নিজ দেশে প্রথম আসা টুকরো পাতটির ওপর লেখা — সি—০৪০৮০১। এদিকে এই ক্রমিক নম্বরটি কাকতালীয় ভাবে মিলে যায় রাজু সাহেবের দুরন্ত ছেলের জন্মের তারিখের সাথে — ০৪/০৮/০১। অনেকদিন পর সুস্থ হয়ে রাজু সাহেব বাড়িতে আসেন নিজের পায়েই ভর দিয়ে। কত শত কথা জানার এক ফাঁকে শুনলেন বিস্ময়কর আরেক কথা— তার দুরন্ত ছেলেটি যে সরকারি মেডিকেল কলেজে পড়ার সুযোগ পেয়েছে। মনে শান্তি, অসম্ভব শান্তি নিয়ে ঘুমাতে গেলেন সে রাতে।
আবারো বিস্ময়! পরদিন নতুন প্রভাতে আর জাগলেন না। মধ্যবিত্তের একমাত্র অবলম্বনকে মাটিতে শুইয়ে দিয়েও স্বস্তি নেই। কোথা থেকে লাশ চোরেরা এসে মাটি খুঁড়ে তার লাশটা নিয়ে গেলো।
বিস্ময়, বড়ই বিস্ময় যেন রাজু সাহেবের সমস্ত জীবনজুড়ে! সময়ের ব্যবধানে দুরন্ত ছেলেটির ডাক্তারি শিক্ষার অ্যানাটমি ক্লাসের জন্য প্রয়োজন পরে এক মানুষের কঙ্কাল। সামান্য কষ্টেই মিলেও যায় টাটকা বিশুদ্ধ এক পুরুষ কঙ্কাল। পরম আগ্রহে বাড়ি নিয়ে এলে মা ভীত চোখ নিয়ে এগিয়ে আসেন। আনকোড়া শিক্ষানবিশ ছেলে বিভিন্ন অংশগুলো দেখাতে গিয়ে যায় থমকে। একি! কঙ্কালটার কোমরের মোটা হাড়ে কি যেন চিকচিক করছে! মা, ছেলের দু জোড়া বিস্ফোরিত চোখ পড়ছে — টুকরো পাতে লিখা, সি—০৪০৮০১। অসম্ভব বিস্ময়কর ভাবেই রাজু সাহেব তারই প্রিয়জনদের মাঝে ফিরে এসেছেন — জীবিত না হলেও কঙ্কাল হয়ে।