মুশফিক হোসাইন : চট্টগ্রাম নগরের জীববৈচিত্রের অবস্থা কেমন আছে, তা নিয়ে নগরবাসী ও বিশেষজ্ঞরা কী ভাবছেন Ñ জানা প্রয়োজন। এ কারণেই জানতে হবে, জীববৈচিত্রের সাথে তার বাস্তুতন্ত্র ওৎপ্রতভাবে জড়িত। জীববৈচিত্র (ইরড়ফরাবৎংরঃু) বলতে এই মহাবিশ্বে জীবনের বৈচিত্র বর্ণনা করার অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। প্রাণী, উদ্ভিদ, তাদের বাস¯’ান ও জীনসমূহ এর আওতাভুক্ত। অক্সিজেন, খাদ্য, পানি, মাটি, আশ্রয়, ওষুধ, ঝড় বন্যা প্রতিরোধ, ঋতুবৈচিত্র এবং নির্মল আনন্দের সামষ্টিকতা হলো জীববৈচিত্রের অনুসঙ্গ। যা সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনের জন্য অপরিহার্য। বিশ্ব চরাচরে অগনিত উদ্ভিদ, প্রাণীকুল এবং অনুজীব রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় একীভূত হয়ে পরিবেশকে মানব সন্তানসহ সকল জীবের বাসযোগ্য করে তোলে।
পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি জীববৈচিত্রের দেখা মেলে গ্রীষ্মম-লীয় বৃষ্টিবনে (জধরহ ঋড়ৎবংঃ)। জীববৈচিত্রের অর্ধেকের বেশি বাস করে এই বৃষ্টিবনে। অথচ ভূ-পৃষ্টের ভূমির মাত্র ০৭ শতাংশ হলো বৃষ্টিবন। এ যাবত বিশ্বে সনাক্তকৃত জীবের সংখ্যা ১.৭ মিলিয়নেরও বেশি। তার ৩৫ ভাগই বাস করে গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে। বাস্তুতন্ত্র (ঊপড় ঝুংঃবস) মানবজাতিকে তার জীবনের মৌলিক চাহিদার যোগানদাতা। সে কারণেই সুস্থ ও সুন্দর জীবনের জন্য জীববৈচিত্র সংরক্ষণ অতি গুরুত্বপূর্ণ। এই জীববৈচিত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করে আমরা পক্ষান্তরে নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে আমাদের জানতে হবে চট্টগ্রামের প্রকৃতি কেমন আছে? চট্টগ্রাম নগরের জীববৈচিত্র কী যথাযথভাবে রক্ষা করছি! না করলে অনতিবিলম্বে জীববৈচিত্র সুরক্ষার উদ্যোগ নেয়া জরুরি।
‘প্রাচ্যের রাণি চট্টগ্রাম’। চট্টগ্রামের ভৌগলিক ও প্রাকৃতিক অবস্থানগত কারণে পাহাড়, নদী, হ্রদ ও সমুদ্রের এক বিচিত্র মেলবন্ধন। যা দেশের অন্য কোথাও দেখা যায় না। জরির ফিতার মতো জড়িয়ে আছে কর্ণফুলি নদী। এর মোহনায় গড়ে উঠেছে সামুদ্রিক বন্দর। যার ইতিহাস ও ঐতিহ্য হাজার বছরের। সামুদ্রিক বন্দরকে কেন্দ্র করে এখানে এসেছে নানান জাতির মানুষ। ব্যবসা, ধর্মপ্রচার, শাসন এবং লুণ্ঠনের জন্য এদের আগমন। ফলে এদতঞ্চলের সমাজ সংস্কৃতিও আলাদা বৈশিষ্টম-িত। স্বাধীনতার পর নগরায়ন ও শিল্পায়ন দ্রুত গতিতে বাড়তে থাকে। অর্থনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনায় চলতে থাকে ভাঙ্গা গড়ার কাজ। সে বিবেচনায় রাজনীতিবিদদের শ্লোগান “চট্টগ্রাম দ্বিতীয় রাজধানী”।
চট্টগ্রাম নগরের আয়তন প্রায় ১৬০ বর্গ কিলোমিটার। জনসংখ্যা ৭০ লাখ ছাড়িয়ে কোটির কাছাকাছি। ভাসমান আছে আরও ১০ থেকে ১৫ লক্ষ মানুষ। পাহাড়, সমতল, জলাভূমি, নদী ও সমুদ্রে বাস করে নানা জাতের প্রাণি ও উদ্ভিদকুল। চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক অবস্থানের কারণে অসংখ্য জীববৈচিত্র ভরপুর ছিল এতদাঞ্চল। নদী, খাল ও জলাশয়ে পাওয়া যেত নানা প্রজাতির প্রচুর মাছ। ৬০ এর দশকে কর্ণফুলী নদীতে হাতিয়ে গলদা চিংড়ি ধরার অভিজ্ঞতা আমার নিজের। তখন নদীতে প্রচুর গলদা চিংড়ি পাওয়া যেত। নদীতীরে বসলেই চোখে পড়ত অসংখ্য ‘হুতুম মাছ’ বা শুশুক। কাদায় ক্রীড়া দেখাত ডউক মাছ বা মাডস্কিপার। চট্টগ্রাম নগরের আশে পাশের ঝোপ ঝাড় বনে দেখা যেত বাঘ, শুয়র, হরিণ, খরগোশসহ নানা বন্যপ্রাণী। চকবাজার ও ফিরিঙ্গীবাজারে বাঘে মানুষ মারার কথা উনিশ শতকের। সর্বশেষ নগরের পতেঙ্গায় বাঘ দেখা যায় ১৯৬০ সালে। বাঘ বিচরণের কারণে টাইগারপাস, বাঘঘোনা, বাঘভেলু, বাঘগুজরা ইত্যাদি নাম স্থায়ীভাবে আসন গেড়ে আছে চট্টগ্রামের সমাজে।
গত পঞ্চাশ বছরে স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে চট্টগ্রামে নগরায়ন ও শিল্পকারখানা স্থাপনের অজুহাতে পাহাড় কাটা, জলাশয় ভরাট, বনভূমি নিধন করে স্থাপনা ও আবাসিক গড়ে তোলার হিড়িক পড়ে যায়। অপরিকল্পিতভাবে বাড়তে থাকে নগর। এতে করে প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট এবং জীববৈচিত্র ব্যাপক হারে হ্রাস পেতে থাকে। এই প্রেক্ষাপটে চট্টগ্রামের জীববৈচিত্রের প্রকৃত অবস্থা যাচাইকরণে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ১৯১৮ সালে একটি পাইলট প্রকল্প গ্রহণ করে। “জীববৈচিত্র জরিপ ও সংরক্ষণ প্রকল্প-২০১৮” নামে একটি প্রতিবেদনও প্রকাশ করে। জরিপকারীগণ শুলক বহর ওয়ার্ডকে নমুনা হিসাবে বাচাই করে জরিপ কাজ পরিচালনা করে। তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে (অনুজীব, প্রাণী ও উদ্ভিদ) জরিপ কাজ পরিচালনা করে। উক্ত ওয়ার্ডে ৭৯০টি প্রজাতি চিহ্নিত করে। তার মধ্যে ২২ প্রজাতির অনুজীবের মধ্যে ১৬টি ছত্রাক, ৬টি ব্যাকটেরিয়া রেকর্ড করে। যার মধ্যে উপকারী ও ক্ষতিকারক উভয় প্রজাতির অনুজীব রয়েছে। এছাড়া বিরল গ্যানো ডার্মা (এধহড় ফবৎসধ) নামের একটি স্থলজ ঔষধি ছত্রাকও পাওয়া যায়।
মুশফিক হোসাইন, কবি ও নিঃসর্গ কর্মী