ইউসুফ মুহম্মদ
পাহাড়ের সাথে সখ্যতা আমার আবাল্য। আমাদের বাড়ির কাছেই রয়েছে সারি সারি পাহাড় বা টিলা। এ টিলাসমূহের সংযোগ রয়েছে দক্ষিণে চট্টগ্রাম শহর এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় পাহাড়শ্রেণীর সাথে। ছোট বেলায় আমরা এখানে ঘুরতে বা খেলতে যেতাম। আবার কখনো যেতাম সুশোভিত আমলকি ও পেয়ারা বাগানের টানে।
এক সময় আমাদের কাছের এই প্রতিবেশি পাহাড়কে বড়ই আপন করে নিয়েছিলাম, ভালোবেসেছিলাম। পাহাড়ের সবুজ বৃক্ষ, ঘাস-লতা-পাতা, স্বচ্ছ পানির ফোয়ারা, সে ফোয়ারায় নাম না-জানা ছোট ছোট মাছের জলকেলী আমাকে স্নেহের ছায়ায় বাঁধে। এ বন্ধন এতটাই নিবিড় ছিল যে পাহাড়ে কখনো কোনো ছোট আগাছা তুলতেও আমার কষ্ট হতো। প্রাক যৌবনে পাহাড়ে ঘুরতে গেলে মনে হতো সবুজ গাছপালা আমাকে মাথা দুলিয়ে ভালোবাসায় নিবিড় করে পেতে চায়। ঠাণ্ডাছড়ির বাগানে গোলাপ ও বিভিন্ন প্রজাতির ফুল ফুটলে মনে হতো, এ বাগান যেন প্রেমের হাতছানি দিচ্ছে। আমাদের সেই পাহাড়ের সৌন্দর্য এখন ছন্দহীন জীবনের অনুরূপ। লাবণ্য হারানো মানুষের মত হয়ে আছে, দখল-দুষণ ও কর্তনের ফলে।
নেড়ামাথা পাহাড় আগের মত ডাকে না, ইশারা দেয় না ভালোবাসার। স্বচ্ছ পানির ফোয়ারাগুলো এখন প্রাণহীন। ঝর্ণাজল পা মুড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে নুড়ি পাথরের তলে।
আমরা বুঝি না যে এই পাহাড়-বন আমাদের কত আপন। পাহাড় না থাকলে ঝর্ণাধারা শুকিয়ে যাবে ঝরাপাতার মত। নদী মরে যাবে, শুরু হবে মরুপ্রক্রিয়া। কিন্তু সে-সব আমাদের বিবেচনায় নেই। আমরা বাংলাদেশের মানুষদের কেউ কেউ ব্যক্তি স্বার্থে সমানে পাহাড় নিধনে ব্যস্ত। পাহাড় নিধনের ফলে শুধু পানির উৎস নষ্ট হচ্ছে না, খাল নালা ভরাট হয়ে বন্যারও সৃষ্টি হচ্ছে। সেই প্রসঙ্গ আপতত থাক।
পাহাড়ের কাছে গেলে আমি ধ্যানি বৃক্ষ হয়ে যেতাম, এখনও তেমন হয়ে যাই। আমাকে খুঁজতে বেরিয়ে হাতের মুঠোয় উঠে আসে সবুজের স্নিগ্ধ ঘ্রাণ। যে সবুজ আমার প্রাণকে জাগিয়ে রাখত পাখি ও প্রজাপতির ডানায়। তখন কত পাখি উড়ত, গান ঝরে পড়ত হাওয়ায়। ঠাণ্ডাছড়ির জলাশয়ে পানকৌড়ির প্রেমময় গুঞ্জন ও খুনসুটি যে আবেশ সৃষ্টি করত, তা ভাবলে এখনো চোখ-মন উচ্ছল হয়ে ওঠে।
বিভিন্ন ঋতুতে এই পাহাড় নানা রূপ ধারণ করত। গ্রীষ্মের রুক্ষতা মাড়িয়ে বর্ষা এলে মনে হত নৃত্যপটিয়সী কোনো নারী তার সবুজ আঁচল দুলিয়ে নাচছে। শরতে সে নৃত্য মিশে যেত কাশফুলের শুভ্রতায়। কাশফুল মাথা দুলিয়ে যেন গল্প করতো আকাশে ভাসমান শুভ্র মেঘের সাথে। হেমন্তে উপত্যকা ও তার খুব কাছের ধান ক্ষেতের মৌ মৌ ঘ্রাণ বিমোহিত করত।
শীতে ঠাণ্ডাছড়ি লেকে নানা প্রকার পাখি আসত। সমুদ্র-নদী-পাহাড়-পর্বত পেরিয়ে তারা সাময়িক এই অভিবাসনে আসে। ক্লান্তিহীন কলকাকলী, আনন্দ-সৌরভ ও পাখির প্রেম ছিল বাঁধভাঙা। শীতের আগমনী গানে বৃক্ষের পাতা হলুদ বর্ণে সাজত, ঝরে পড়ত ধীরলয়ে, সে-ছিল যেন রঙের এক উৎসব। বসন্তে বৃক্ষ-লতার পরতে পরতে নতুন পাতার জয়গান ও স্বর্গীয় দ্যুতিপূর্ণ ফুলের শোভা এখনো হৃদয়ে দোলা দেয় । আমাদের কাছের পাহাড়-জলাশয়ে সে-সব আজ অতীতের গল্প।
ও-সব কথা থাক পাহাড়ের দিকে অন্যভাবে দেখি। পাহাড়-পর্বত হচ্ছে সমতল ভূমি থেকে উপরের দিকে সম্প্রসারিত একটি ভূমিরূপ। ভূতাত্ত্বিকদের মতে “পৃথিবীর ভূত্বকের উপর টেকটোনিক প্লেটগুলোর নড়চড়া এবং সংঘর্ষের কারণে এগুলোর মধ্যবর্তী জমি সংকুচিত ও ভাঁজ হয়ে যায়। এই ভাঁজগুলো ক্রমাম্বয়ে একটি বিশাল উ”চতা অর্জন করে এবং পর্বত সৃষ্টি হয়।” এসব ভূ-বিজ্ঞান ও ভূতাত্ত্বিকদের গবেষণার বিষয়। আমরা সে দিকে যাবো না। তবে এটুকু বলতে পারি, পাহাড় না হলে নদী সৃষ্টি হতো না। আর নদী না হলে আজকে মানব সভ্যতার যে বিকাশ তা অনেকাংশেই বাধাগ্রস্থ হতো। এ কথার সমর্থনে আমরা যদি হিমালয়ের সন্নিহিত অঞ্চলের দিকে তাকাই তাহলে দেখি, গঙ্গোত্রী একটি হিমবাহ। এ প্রবাহ থেকে উৎপত্তি হয়ে গঙ্গা ভারতের দীর্ঘপথ অতিক্রম শেষে নবাবগঞ্জ জেলার মধ্যদিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশে এটি গোয়ালন্দের কাছে মেঘনার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। নবাবগঞ্জ থেকে মেঘনার সঙ্গমস্থল পর্যন্ত ধারার নাম পদ্মা। এ গঙ্গা-পদ্মার দুপাড়ে গড়ে উঠেছে বহু জনপদ, সভ্যতা ও শহর বন্দর। এভাবে পৃথিবীর সব নদ-নদীর উৎপত্তিস্থলই হচ্ছে পর্বত বা পাহাড়। আর এসব পর্বত থেকে উৎপন্ন হয়ে বহু নদী প্রবাহিত হয়েছে সমুদ্রের পথে। নদীর দুপাড়ে গড়ে উঠেছে কত শত মানুষের বাসতি।
শুরু করেছি আমার পাহাড় দেখা নিয়ে। সেসবে যাওয়ার আগে দেখি রবীন্দ্রনাথ এবং অন্যান্য কবিরা পাহাড় নিয়ে কি ভেবেছেন। রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে পাহাড়ের রূপ-লাবণ্য এ রকম…“কুজ্বঝটিকা যেই/সরে গেল মংপু-র/নীল শৈলের গায়ে/দেখা দিল রঙপুর।/বহুকালে জাদুকর, খেলা বহুদিন তার,/আর কোনো দায় নেই, লেশ নেই চিন্তার।/দূর বৎসর-পানে ধ্যানে চাই যতদূর/দেখি লুকোচুরি খেলে মেঘ আর রদ্দুর।/কত রাজা এল গেল, ম’ল এরই মধ্যে,/লড়েছিল বীর, কবি লিখেছিল পদ্যে।/কত মাথা কাটাকাটি সভ্যে অসভ্যে,/কত মাথা ফাটাফাটি সনাতনে নব্যে।/ঐ গাছ চিরদিন যেন শিশু মস্ত,/সূর্য-উদয় দেখে, দেখে তার অস্ত।/ঐ ঢালু গিরিমালা, রুক্ষ ও বন্ধ্যা,/দিন গেলে ওরই ’পরে জপ করে সন্ধ্যা।”… (মংপু পাহাড়ে)। রবীন্দ্রনাথ এখানে একদিকে প্রকৃতির রূপ অঙ্কন করেছেন, অপরদিকে সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক পঙ্কিলতা তুলে ধরেছেন। সেই সাথে কবির মনে হয়েছে রুক্ষ ও বন্ধ্যা দিনের পরে সন্ধ্যা যেন ঐ পাহাড়ে জপ করছে রাত্রি নামার অপেক্ষায়।
নজরুল শির উঁচু করে রাখার শিক্ষা পেয়েছিলেন পাহাড়ের কাছ থেকেই। তিনি লিখেছেন, “আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই।/ওই পাহাড়ের ঝর্না আমি,/উধাও হ’য়ে বই গো, উধাও হ’য়ে বই।।/পাহাড় ঘুমায় ওই।/আকশে হিলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই।/চিতা বাঘ মিতা আমার গোখ্রো খেলার সাথি/সাপের ঝাঁপি বুকে ধ’রে সুখে কাটাই রাতি।/ঘূর্ণি হাওয়ার উড়্নি ধ’রে/আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই।/নাচি তাথৈ থৈ ও আমি/নাচি তাথৈ থৈ।।/পাহাড় ঘুমায় ওই!!/আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই।/ওই পাহাড়ের ঝর্ণা আমি,/উধাও হ’য়ে বই।।/পাহাড় ঘুমায় ওই! ”
এই ঘুমন্ত পাহাড়ে বিষাক্ত সাপ নিছক কোনো সাপ নয়, বিষাক্ত মানুষ তথা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও শোষক শ্রেণী। এদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার ও ‘তাথৈ থৈ’ প্রলয় নাচনের সাথে সত্য প্রকাশের সাধনা তাঁর চিরদিনের।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নিজস্ব নদীর বিনিময়ে পাহাড় কিনতে চেয়েছিলেন। তাই তো ‘পাহাড় চূড়ায়’ কবিতায় তিনি বলেছেন, “অনেকদিন থেকেই/আমার একটা পাহাড় কেনার শখ।/কিন্তু‘ পাহাড় কে বিক্রি করে তা জানি না।/যদি তার দেখা পেতাম, দামের জন্য আটকাতো না।/আমার নিজস্ব একটা নদী আছে,/সেটা দিয়ে দিতাম পাহাড়টার বদলে।/কে না জানে পাহাড়ের চেয়ে নদীর দামই বেশি।/পাহাড় স্থানু, নদী বহমান।/তবু আমি নদীর/বদলে পাহাড়ই কিনতাম।/কারণ আমি ঠকতে চাই।/নদীটাও অবশ্য আমি কিনেছিলাম একটা দ্বীপের বদলে।/ছেলে বেলায় আমার বেশ ছোট্টোখাট্টো ছিমছাম একটা দ্বীপ ছিল।/সেখানে অসংখ্য প্রজাপতি।/শৈশবে দ্বীপটি ছিল বড় প্রিয়।/আমার যৌবনে দ্বীপটি আমার কাছে মাপে ছোট লাগলো।/প্রবহমান ছিপছিপে তন্বী নদীটি বেশ পছন্দ হল আমার।/বন্ধুরা বললো, ঐটুকু একটা দ্বীপের বিনিময়ে এতবড় একটা নদী পেয়েছিস?/ খুব তো জিতেছিস মাইরি।/তখন জয়ের আনন্দে আমি বিহ্বল হতাম।/তখন সত্যিই আমি ভালবাসতাম নদীটিকে।/নদী আমার অনেক প্রশ্নের উত্তর দিত।/যেমন, বলো তো, আজ সন্ধেবেলা বৃষ্টি হবে কিনা?/সে বলতো, আজ এখানে দক্ষিণ গরম হাওয়া।/শুধু একটা ছোট্ট দ্বীপে বৃষ্টি, সে কী প্রবল বৃষ্টি, যেন একটা উৎসব।/আমি সেই দ্বীপে আর যেতে পারি না।/সে জানতো। সবাই জানে।/শৈশবে আর ফেরা যায় না।/এখন আমি একটা পাহাড় কিনতে চাই।”
কবি পাহাড় কিনতে চাওয়ার আড়ালে আমাদেরকে ক্রমশঃ তাঁর দিগন্ত বিস্তৃত ভালোবাসা ও বিনয়ের প্রতি আকর্ষিত করতে চান। কবি পাহাড়ের নির্জনতায় নিজেকে স্থাপন করে জলাঞ্জলী দিতে চান মনের সমস্ত কলুষতা। তিনি আমাদের ঔদ্ধত্যপূর্ণ সমাজ ও সামাজিক পরিবেশ থেকে একা হতে চান। একা হলেই মানুষ বুঝতে পারে ক্ষুদ্রতার কথা; প্রতিযোগী হয়ে বিজয়ী হওয়ার পরিবর্তে ক্ষমা চাওয়াই শ্রেয়।
সুনির্মল বসু তাঁর ‘রাত পাহাড়ের কবিতায়’ পাহাড়-প্রকৃতির নিটোল একটি চিত্র এঁকেছেন। কবি সেখানে প্রত্যক্ষ করেছেন রাত গভীরে জেগে থাকা “অরণ্য পাখির ডানা ঝাপটানো”। কবির অন্তর জুড়ে খেলে আর জীবনের বিমূর্ত ছবি দেখে “আকাশ, চাঁদ, তারামণ্ডলী… পাহাড়িয়া নদীর মতো, শান্ত নদীর মতো জীবন এখানে ধীরে প্রবাহিত, লাল মাটির গন্ধ, সবুজের গান, ময়ূরের কর্কশ স্বর।”
কবিরা পাহাড়ের রূপ বর্ণনা করে এবং পাহাড়ের বিশালতার কাছে উদার হওয়ার মন্ত্রণা দিয়ে আমাদের সামনে খুলে ধরেছেন অনন্য এক ক্যানভাস। যেগুলোর পাশে রাখা যায় আরো একটি কবিতা; এটি লিখেছেন অরুণ চক্রবর্তী। কবিতাটি এরকম, “লালপাহাড়ীর দেশে যা,/রাঙ্গামাটির দেশে যা।/লালপাহাড়ীর দেশে যা,/রাঙ্গামাটির দেশে যা।/এখানে তোকে মানাইছেনায় গো…/এক্কেবারে মানাইছে নায় গো…/ হায় গো./এখানে তোকে মানাইছেনায় গো…/এক্কেবারে মানাইছে নায় গো…/লালপাহাড়ীর দেশে যা,/রাঙ্গামাটির দেশে যা।/লালপাহাড়ীর দেশে যা,/রাঙ্গামাটির দেশে যা।/এখানে তোকে মানাইছেনায় গো…/এক্কেবারে মানাইছে নায় গো…/হায় গো./এখানে তোকে মানাইছেনায় গো…/এক্কেবারে মানাইছে নায় গো…/আরে ওখানে গেলে মাদল পাবি,/মেয়ে মরদের আদর পাবি।/ওখানে গেলে মাদল পাবি,/মেয়ে মরদের আদর পাবি।/মরবি তুই মরে যা, এক্কেবারে মরে যা।/মরবি তুই মরে যা, এক্কেবারে মরে যা।/এখানে তোকে মানাইছেনায় গো…/এক্কেবারে মানাইছে নায় গো…/হায় গো./এখানে তোকে মানাইছেনায় গো…/এক্কেবারে মানাইছে নায় গো…/আরে হো…/আরে নদীর ধারে শীমুলের ফুল,/না না পাখির বাসারে, না না পাখির বাসা।/কাল সকালে ফুটিবে ফুল,/মনে ছিল আশা রে, মনে ছিল আশা।/নদীর ধারে শীমুলের ফুল,/না না পাখির বাসারে, না না পাখির বাসা।/কাল সকালে ফুটিবে ফুল,/মনে ছিল আশা রে, মনে ছিল আশা।/তুই ভালোবেসে গেলি চলেএএএএএ…/তুই ভালোবেসে গেলি চলে,/কেমন বাপের ব্যাটা রে,/কেমন বাপের ব্যাটা।/মরবি তুই মরে যা, এক্কেবারে মরে যা।/মরবি তুই মরে যা, এক্কেবারে মরে যা।/এখানে তোকে মানাইছেনায় গো…/এক্কেবারে মানাইছে নায় গো…/হায় গো./এখানে তোকে মানাইছেনায় গো…/এক্কেবারে মানাইছে নায় গো…/লালপাহাড়ীর দেশে যা,/রাঙ্গামাটির দেশে যা।/লালপাহাড়ীর দেশে যা,/রাঙ্গামাটির দেশে যা।/এখানে তোকে মানাইছেনায় গো…/এক্কেবারে মানাইছে নায় গো…/হায় গো./এখানে তোকে মানাইছেনায় গো…/এক্কেবারে মানাইছে নায় গো…/আরে ওহো, ওহো…
আজ থেকে পঞ্চাশ বছরেরও অধিককাল আগে এটি লেখা হয়। তিনি কক্সবাজারের একটি কবিতা উৎসবে এ কবিতার প্রেক্ষাপট উল্লেখ করেছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন, ঠিক কোন ভাবনায় প্রকৃতি প্রেমের এই কবিতাটি লেখা হয়েছিল। তিনি একবার দেখেন, ‘স্টেশনের পাশে একটি মহুয়া ফুল গাছ লাগানো হয়েছে। সেটি দেখে তাঁর মনে হয়েছিল, এখানে না, এই রূপ-যৌবন সমৃদ্ধ গাছ লাল পাহাড়ের দেশেই মানায়। সেই ভাবনা থেকেই কবি কালজয়ী এই কবিতাটি লিখেছিলেন। তাঁর মতে যাকে যেখানে মানায় সেখানেই থাকা উচিত।’
পাহাড়ের রয়েছে এক মৌন-মুগ্ধ সুর। নির্জনাতার মাঝে পাতায় পাতায় হাওয়ার দোলা দেখলে, মন চনমন করে ওঠে। পাহাড়ি অরণ্যে একা গেলে মনে হয় পাহাড় স্পর্শ দিতে কাছে ডাকছে। নানা প্রজাতির পাখি ও পোকা গান শোনাতে ব্যস্ত। ঝিঁঝি পোকা ফিস ফিস করে কথা বলে আর পাশেপাশে ঘোরে। তারা জানাতে চায় যে, আমি একা নই, তারাও আছে সাথে।
একবার হয়েছে কি, তখন আমি অষ্টম শ্রেণীতে উঠেছি। কিছুদিন হলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়েছে। হেমন্তের এক সকালে আমাদের স্কুল থেকে কাপ্তাই পিকনিকে গমন করি। কাপ্তাইতে তখনো এত ঘর-বাড়ি ও মানুষজনের আনাগোনা ছিল না। হেমন্তকাল, পাহাড়ের বন-প্রান্তর তখনো সবুজে কিছুটা আচ্ছন্ন। আমরা কয়েকজন নৌকা ভ্রমণে বেরিয়েছি, লেকের পাড়ে এক স্থানে সবাই নামলাম। পরে লেকের ধার ঘেষে জঙ্গলের ভেতর আমরা হাঁটতে থাকি। আমি ছিলাম সবার সামনে। একটি বহুবর্ণ মাছরাঙা পাখির ছানা, পাখায় তখনো সম্পূর্ণ রূপ-লাবণ্য ধরেনি; আমাকে দেখে সামনের দিকে ধীরে ধীরে উড়তে শুরু করে। আমি সেটি ধরার জন্য পিছু পিছু ছুটতে থাকি। বন্ধুদের ছেড়ে আমি বেশ এগিয়ে যাই। দেখলাম বেশকিছু মানুষের কঙ্কাল। তাতে মন আড়ষ্ট হয়ে গেল। মাছরাঙার ছানা থেকে আমার মনোযোগ সরে গেল। মানুষের এসব হাঁড় খুববেশি দিনের বলে মনে হলো না। সেখানে তখনো মাংস ও রক্তের পঁচা উৎকট গন্ধ বিদ্যমান। আমি ভয়ে চিৎকার করতেও ভুলে গেলাম। অনেকক্ষণ পর সম্বিৎ ফিরে এলে এক দৌঁড়ে বন্ধুদের কাছে ফিরে গেলাম। কাঁপতে কাঁপতে তাদের জানালাম, বিস্তারিত। সকলে দ্রুত সে স্থান ত্যাগ করে গাড়ির কাছে ফিরে আসি। স্থানীয় একজন বয়স্ক মানুষ জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী সেনাবাহিনী রাজাকারদের সহায়তায় বহু লোকজনকে এখানে হত্যা করে। এইসব লাশ লেকের পাড়ে, পাহাড়ের ঢালে ফেলে রাখে, ওগুলো শিয়াল-কুকুেরর খাবারে পরিণত হয়। এখন শুধু কঙ্কালগুলো অবশিষ্ট আছে। সেই যে ভয় পেয়েছিলাম, তা বহুদিন আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। এরপর বহুবার বাংলাদেশের বিভিন্ন পাহাড়ে বেড়াতে গিয়েছি। কিন্তু ভয়ে তার গভীরে যাওয়া হয়নি।
যৌবনে পাহাড়ে ঘুরতে যেতাম। সাথে কেউ না কেউ থাকত। একবার একা একা গিয়ে দেখলাম পাহাড়ের পাখিরা আমাকে দেখে আর পাখা দুলিয়ে অভিবাদন জানা”েছ না, গান করছে না… দূরে সরে যাচ্ছে। কেননা আমার সঙ্গে সে নেই; যে পাখি এঁকে ডালে ডালে ঝুলিয়ে রাখত। পাতার গানে কণ্ঠ মেলাত, ভিজত অঝোর বৃষ্টি ধারায়। সে অন্য প্রসঙ্গ।
বাড়ির কাছে দেখতে দেখতে পাহাড়-প্রকৃতির প্রতি এক ধরনের ভালোবাসা তৈরি হয়, সে কথা আগেই বলেছি। ছোট বেলায় শহরের বেশকিছু বিখ্যাত পাহাড়ের কথা শুনেছি। এরমধ্যে চেরাগি পাহাড়, পরীর পাহাড় ও বাটালী পাহাড় উল্লেখযোগ্য। মাধ্যমিক পরীক্ষার পর প্রথম শহরে এসেই দুটো পাহাড় দেখার বাসনা পূরণ করি। শুরু করি চেরাগি পাহাড় দিয়ে—ওখানে গিয়ে হতাশ হলাম। আসার আগে ভেবেছিলাম এটি একটি বিশাল পাহাড় এবং এর উপর উঠে দেখব ওটার রূপবৈচিত্র্য। কিন্তু এ পহাড়ের বিশালতা বলতে কিছুই নেই। হয়তো কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। এর পাশে রয়েছে অন্য একটি পাহাড়, সেটিকে ডিসি পাহাড় নামে সবাই চেনে। সে সময় চেরাগি পাহাড়ের মোড় আজকের মত এত সুন্দর ও সুসজ্জিত ছিল না। রাস্তগুলো ছিল বেশ সরু। যেখানে এখন একটি স্মারক রয়েছে, সেটি ছিল ছোট একটি টিলা। পাশে কয়েকটি পাকা কবর। সে কবরগালো এখনো বর্তমান। কথিত আছে বদর পীর, অর্থাৎ হযরত সৈয়দ বদর আওলিয়া একখণ্ড পাথরে চেপে সমুদ্র পথে চট্টগ্রাম আগমন করেন। এখানে তখন গভীর বনাঞ্চল ছিল। কথিত আছে এই অঞ্চলে তখন জ্বীন-পরীদের বেশ উৎপাত ছিল। তাঁর আগমনে জ্বীন-পরীদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হয় এবং ওরা তাঁর সাথে বিরোধ করতে চায়। তিনি একটি মাটির চেরাগ বা চাটি রাখার সমপরিমাণ জমি তাদের কাছ থেকে চেয়ে নেন। রাত নেমে এলে তিনি তাঁর ওই চেরাগ জ্বেলে দেন। এর তেজ ও দ্যুতিতে জ্বীনরা ধীরে ধীরে চট্টগ্রাম ছেড়ে যায়। তাতে বৃদ্ধি পায় মানুষের আনাগোনা ও আবাস।
আবদুল হক চৌধুরী তাঁর ‘বন্দর শহর চট্টগ্রাম’ গ্রন্থে লিখেছেন, “বদরশাহ্ চট্টগ্রামের প্রাচীনতম সুফি সাধক। এখানকার হিন্দু বৌদ্ধ ও মুসলমান নির্বিশেষে বদর শাহকে নৌকা, সমুদ্রের মাঝিমাল্লা ও যাত্রী এবং চট্টগ্রামের অধিবাসীদের বিপদে-আপদে ত্রাণকর্তা বলে বিশ্বাস করেন। গ্রাম চট্টলার অধিবাসীরা বিপদে-আপদে উচ্চঃস্বরে বদরের নাম করে এক জায়গায় জমায়েত হওয়ার জন্য ডাক দেয় এবং জমায়েত হয়। ছেলেরা বদরের নাম উচ্চঃস্বরে উচ্চারিত করে খেলাধুলা করার জন্য মাঠে একত্রিত হয়। কবি মোহাম্মদ খান বিরচিত মক্তুলণ হোসেন কাব্যে ও (রচনা কাল ১৬৪৬ খ্রি.) আত্মকথা সূত্রে জানা যায় যে, চট্টগ্রাম মুসলমান শাসনভুক্ত হওয়ার কিছু পূর্বে বদর শাহ ধর্ম প্রচার করার উদ্দেশ্যে এখানে আগমন করেছিলেন।”
পরে একদিন দেখতে গেলাম পরীর পাহাড়। এ পাহাড়ের চূড়ায় রয়েছে সুদৃশ্য লাল রঙের একটি দ্বিতল ভবন। এটি এই এলাকার প্রধান সরকারী ভবন বলে জানতে পারি। টিলা থেকে পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হলাম। কি নয়নাভিরাম দৃশ্য! পূর্বে অনেক দূরে বিস্তৃত ধান ক্ষেত ও সবুজ বৃক্ষের হাতছানি। দক্ষিণে কর্ণফুলি বয়ে যাচ্ছে আপন সুর-ছন্দে। নদীতে ছোট-বড় নৌকা ও জাহাজ চলাচল করছে। আরো দূরে, ঝাপসা দৃষ্টিতে ভেসে উঠছে বন্দর। এখানে বন্ধুসহ বেশকিছু সময় মনের আনন্দে কাটালাম।
টিলা ও পাহাড়বেষ্টিত চট্টগ্রাম নিয়ে এক সময় নানা গল্প-কাহিনী শোনা যেত। এই পাহাড়টিও এর ব্যতিক্রম নয়। যদিও এখন পরীরা এখানে থাকে না, এক সময় ছিল বলে মিথ প্রচলিত আছে। এলাকাবাসীর ধারণা ছিল, আদিকালে জ্বীন-পরীরা চট্টগ্রামে রাজত্ব করত। এই প্রচার থেকে পরীর পাহাড় নামটি এসেছে হয়তো।
পর্তুগিজ নাগরিক জন হ্যারি থেকে বৃটিশ ক্যাপ্টেন টেক্স পাহাড়টি কিনে নেন। পরে এটির মালিক হন পেরেডা নামের এক ভদ্রলোক। তিনিও এটি কিনেন। পরবর্তীতে এই পাহাড়ের মালিকানা যায় জমিদার অখিল চন্দ্র সেনের কাছে। বৃটিশ শাসনামলে চট্টগাম শহর আরো সম্প্রসারিত করার প্রয়োজনে পড়ে। ফলে তৎকালীন সরকার ১৮৮৯ সালে জমিদার অখিল চন্দ্র সেনের কাছ থেকে পাহাড়টি অধিগ্রহণ করে। এর চার বছর পর ওই পাহাড় চূড়ায় নির্মাণ করা হয় বর্ণিত লাল ভবনটি। বৃটিশ সরকার চট্টগ্রামের প্রশাসনিক কেন্দ্র মহসিন কলেজের পাহাড় থেকে ওখানে স্থানান্তর করেন।
বর্তমানে ওই পাহাড়ের বৃক্ষরাজি কেটে সুউচ্চ দালান নির্মাণ করা হয়েছে। এতে হারিয়ে গেছে সেই জৌলুস। দূরের ধান ক্ষেত ও খালি জায়গায় উঠেছে বহু বাড়ি ঘর। উপর থেকে দূরবর্তী দৃশ্য ও কর্ণফুলী নদী দেখে চোখ জুড়ানোর সুযোগও আর নেই।
পরে একদিন বাটালী পাহাড়ে যাই। আমরা কয়েকজন হেঁটে হেঁটে এর উপর উঠলাম। দেখি এটি এক সবুজে ছাওয়া মনোরম পাহাড়। এখানে বেশ কয়েকটি পাহাড় রয়েছে, সবগুলো মিলেই বাটালী হিলস। আমরা যেটিতে উঠলাম সেটি নগর ও পাশের পাহাড়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে উঁচু, উচ্চতা প্রায় ২৮০ ফুট। উপরে যাওয়ার পথটি ঘোরানো-পেঁচানো, অনেকটা জিলিপির পেঁচের মত। তাই এটিকে জিলিপি পাহাড়ও বলা হয়। পাহাড়গুলোর অবস্থান চট্টগ্রাম শহরের টাইগার পাস এলাকা থেকে মতিঝরনা পর্যন্ত বিস্তৃত। চট্টগ্রাম শহরের বেশ বড় অংশ এখান থেকে দৃশ্যমান হলো। চারিদিকে সবুজের চোখ ধাধাঁনো সমারোহ। এর ফাঁকে বঙ্গপোসাগর ও সূর্যাস্তের স্বাসরুদ্ধকর দৃশ্য উপভোগ করলাম। পাহাড়ে দু-একটি ছাড়া বড় কোনো গাছ নেই। সবগুলো ছোট ছোট পাহাড়ী গাছ ও লতাগুল্ম। জানতে পারলাম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে বৃটিশরা এ পাহাড়ের চূড়ায় বিমান বিধ্বসী কামান স্থাপন করেছিল। তাছাড়া বহুকাল আগে সামুদ্রিক জাহাজকে নির্দেশা দেয়ার জন্য এখানে বাতিঘরও নির্মাণ করা হয়েছিল। বর্তমানে এসবের কিছুই নেই। ডান ও বাম দিকে দুটো সরকারী বাংলো রয়েছে। এ পাহাড়ের জৌলুস বর্তমানে আরো বেড়েছে। জিলিপির মতো পেঁচানো রাস্তাটি পাকা করা হয়েছে। পাহাড়ে লাগানো হয়েছে নানা প্রজাতির ফলজ ও বনজ বৃক্ষ। সকাল-সন্ধ্যা শোনা যায় গাছে গাছে বিভিন্ন পাখির কল-কাকলী, মধুর গান-গুঞ্জন । পাতায় পাতায় বাতাসের নয়নাভিরাম নৃত্য, তন্বী তরুণী যেন।
সূর্যোদয় দেখার জন্যএকবার টাইগার হিলে গেলাম, আমি ইয়াসমিন ও প্রিয়। এটি দার্জিলিংয়ের একটি পাহাড়। এখান থেকে সবাই সূর্যোদয়ের দৃশ্য অবলোকন করে। কাঞ্চনজঙ্ঘার মাথায় রোদের নৃত্য দেখা যায়। চারিদিক শীতে জবুথবু। খুব ভোরে, ভোরে মানে রাত তিনটায় গাড়ীতে চেপে পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে। পৌঁছার ক্ষণিক পরেই দেখি কমলার রঙ গায়ে জড়িয়ে অপূর্ব এক আলোর গোলক মেঘের জরায়ূ ভেঙে বেরিয়ে পড়েছে চোখের ওপর। এটিকে আবার ডিমের বিশাল কুসুমের মতও মনে হল। সবাই উলুধ্বনি দিয়ে উঠল, তার মানে সূর্যোদয় হয়েছে। বাম দিকের রমণীয় কাঞ্চনজঙ্ঘা তখন নানা রঙের শাড়ি পরিবর্তনে ব্যস্ত। এ দৃশ্য প্রকৃতই স্বর্গীয় বিভায় উজ্জ্বল। তা এখনো চোখে খেলা করে যেন বেনেবউ রং।
উটি-নীলগিরি পাহাড়ের দৃশ্য অন্যরকম। এ পাহাড়ে কিছু বৃক্ষকে বিভিন্ন প্রাণীর আদলে সাজানো হয়েছে। রমণীয় ও দৃষ্টি শোভন নানা প্রজাতির ফুল যেন প্রীতিতে জড়িয়ে রাখতে চায়। পাহাড়ের চূড়ায় রয়েছে চতুর্দিকের দৃশ্য অবলোকনের একটি টাওয়ার। উটিতে বেশ বড় একটি হ্রদ রয়েছে। পাহাড়ের চারিদিকে রয়েছে দৃষ্টি-নন্দন চা বাগান। সকালে বেরুলে মনে হবে সবুজ পাতা যেন নরম রোদ পান করে মাতাল হয়েছে। জড়িয়ে ধরতে চায় মায়া-মমতায়। ঘাসের পিনোদ্ধত মঞ্চে বিন্দু বিন্দু শিশিরের দোলা তৈরি করে অপূর্ব এক আবেশ। ভোরের কুহেলিকায় পাখির কুজন, প্রজপতির নৃত্য ও ঝিঝিঁর শব্দে মুখরিত প্রকৃতিতে হারিয়ে যেতে মন চায়। তবে মন চাইলেই হারিয়ে যাওয়া যায় না। নীলগিরি পাহাড়ের ধারে কাছে আরো অনেকগুলো পাহাড়ে দর্শনীয় স্থান রয়েছে। উটি পাহাড়ের সৌন্দর্যমুগ্ধ চোখ দুটোকে আর কিছু দেখাতে চাইনি বলে সেখানে যাই নি।
পরে একবার গিয়েছিলাম নৈনিতাল পাহাড়ের সৌন্দর্য মন্থনে। নৈনিতাল ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যের একটি জনপ্রিয় শৈল শহর। নৈনি লেক, মল্ রোড, নয়না দেবী মন্দির, নৈনিতাল চিড়িয়াখানা, স্নো ভিউ পয়েন্ট, নয়না শৃঙ্গ, ভিমতাল লেক, টিফিন টপ, সাততাল লেক, লাভার্স পয়েন্ট, জিম করবেট গার্নি হাউজ এসব প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক স্থান নয়ন-মন দুটোই সার্থক করে। নৈনিতাল ‘ভারতের হ্রদ জেলা’ হিসাবেও খ্যাত। এর সরল-শান্ত ও মনোরম হ্রদের সৌন্দর্য চোখ ধাধাঁনো। প্রকৃতি প্রেমীদের জন্য এটি এক স্বপ্নের গন্তব্য।
এভাবে পাহাড়ের মমতায় জড়িয়ে দূরের ও কাছের আরো বহু পাহাড়ে গিয়েছি। পাহাড়ের এই ভালোবাসা অনন্য ও অবিচ্ছেদ্য। তাই তো বলি, পাহাড়ে মজিলে মন কিছু আর থাকে না গোপন।
ইউসুফ মুহম্মদ, কবি, প্রাবন্ধিক ও দোঁহাকার, চট্টগ্রাম




