এখন সময়:দুপুর ১:৫৪- আজ: শুক্রবার-৭ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-২২শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-হেমন্তকাল

এখন সময়:দুপুর ১:৫৪- আজ: শুক্রবার
৭ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-২২শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-হেমন্তকাল

পুঁজিবাদে বিচ্ছিন্নতা : একটি মার্কসীয় বিশ্লেষণ

রাজেশকান্তি দাশ

উনবিংশ শতাব্দীতে পুঁজিবাদের অন্যতম সৃষ্টি বিচ্ছিন্নতা। বিচ্ছিন্নতার ইংরেজি প্রতিশব্দ Alienation শব্দটি দ্বারা Estrange বা ‘বিচ্ছিন্ন করা’ ক্রিয়াবাচক পদটিকে বুঝায়। ইংরেজি Estrange এর বিশেষ্য পদ হচ্ছে Estrangement যার বাংলা আভিধানিক তর্জমা দাঁড়ায় বিচ্ছেদ বা বিচ্ছিন্নতা। এই Estrangement পদবাচ্যের জার্মান প্রতিশব্দ Entfremdung। বিচ্ছিন্নতা তখনই ঘটে যখন কোনো ব্যক্তি তার সামাজিক সঙ্গ বা অন্যান্য মানুষ থেকে নিজেকে বিজাতীয় মনে করে। অন্য কথায় বললে, বিচ্ছিন্নতা এমন একটি সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা যার ফলে ব্যক্তি তার সামাজিক অস্তিত্বের কিছু ক্ষেত্র থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন মনে করে। সমাজতাত্ত্বিক মিচেল (Mitchel) এই কথাই বলেছেন, Alienation is a socio-psychological condition of the individual which involves his estrangement from certain aspect of his social existence-1  মার্কসের বিচ্ছিন্নতার সাথে বিস্নেহ, বিমায়া ইত্যাদি পদবাচ্য সমার্থকরূপে জড়িয়ে আছে। বিচ্ছিন্নতা মানুষের মধ্যে এক ধরনের ক্ষমতাহীন অনুভূতির সৃষ্টি করে। যার ফলে আক্ষরিক অর্থে তার মধ্যে ‘পৃথক’ বা ‘নিঃসঙ্গ’ অবস্থা দাঁড়িয়ে যায়।

মার্কস হেগেলের পরম সত্তা সংক্রান্ত ধারণা ও ফুয়েরবাকের ধর্ম বিষয়ক তত্ত্ব থেকে বিচ্ছিন্নতার ধারণাটি সৃষ্টি করেন। হেগেলের মতে, মানুষ তার জৈবিক চাহিদা মেটাতে গিয়ে পরম সত্তা থেকে ছিটকে পড়ে। মানুষ তার যাবতীয় কর্মকাণ্ড থেকে পরম সত্তাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে তার সৃষ্ট বিশ্বজগতকে এক পরম সত্তা বিরোধী অবস্থায় সমর্পিত করে। এভাবে সে নিঃস্ব হয়ে পড়ে এবং আত্মবিচ্ছিন্নতার পথে অগ্রসর হয়। হেগেলের দর্শনে বিচ্ছিন্নতা হল পরম ভাবসত্তা থেকে বিচ্ছিন্নতা। ফুয়েরবাকের ধর্মমূলক আত্ম অন্যীভবনে দেখা যায় এক বিশেষ ধরনের জগৎ। এখানে একমাত্র পরমই (ঈশ্বর) মানব প্রকৃতির নিখুঁত অভিক্ষেপ করতে পারে। মানুষের চাওয়া-পাওয়ার সমাধান তার হাতেই নিহিত। তার মধ্যেই যুক্তি, আকাঙ্ক্ষা, প্রেম পরিপূর্ণভাবে বিদ্যমান। যুক্তিতর্কের মাধ্যমে তার অস্তিত্ব প্রমাণ করা যায় না। পরম একমাত্র কল্পনায় বসবাস করেন। আমরা যুক্তির মাধ্যমে তাকে খুঁজতে গিয়েই প্রকৃত সত্য থেকে বিচ্ছিন্ন হই। আমাদের চাহিদাময় জীবন পরম সত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ব্যবহারিক জীবন লীন হতে থাকে। মার্কস, হেগেল ও ফুয়েরবাকের বিচ্ছিন্নতার সমালোচনা করে তার বিচ্ছিন্নতার তত্ত্বকে বৈজ্ঞানিক রূপ দেন। যুক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেন।

মানব প্রকৃতিতে মানুষের মধ্যে দুটো বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। প্রথমত— সে স্বেচ্ছায় শ্রম দিয়ে সৃজনশীল কিছু সৃষ্টি করতে চায়। যেখানে বাধ্যবাধকতার কোনো স্থান নেই। প্রয়োজনের বাইরে আনন্দে-স্বতস্ফূর্তভাবে সে এই কাজগুলি করে। যেমন- গান গাওয়া, কবিতা লেখা, ছবি আঁকা, পটচিত্র তৈরি ইত্যাদি। এগুলো সৃষ্টির মাধ্যমে সে এক প্রকার তৃপ্তি লাভ করে। এটাই তার সৃজনশীলতা। এখানে সে যে শুধু নিজে তৃপ্তি লাভ করে তা নয় অন্যকে তার সৃষ্টি প্রদর্শনের মাধ্যমেও সে আনন্দিত হয়। এ আনন্দ তাকে আবার নতুন সৃষ্টির দিকে ধাবিত করে। দ্বিতীয়ত— মানুষ উৎপাদনের জন্য সামাজিক শ্রম (ঝড়পরধষ ষধনড়ঁৎ ভড়ৎ ঢ়ৎড়ফঁপঃরড়হ) দিতে প্রস্তুত থাকে। সামাজিক শ্রমের মাধ্যমে উৎপাদনমুখি কাজে লিপ্ত হয়। সে জীবন ধারণের জন্য বস্তুগত উৎপাদন- খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান বা সামাজিক কর্ম- সাঁকো, বাঁধ, গণপাঠগার নির্মাণ কিংবা নান্দনিক তৃপ্তির জন্য কোনো শিল্পকর্ম সৃষ্টিতে উদ্যোগী হয়। যা-ই হোক না কেন মানুষ এরকম যৌথশ্রম বা সমষ্টিগত শ্রম দিতে ভালোবাসে। এর মধ্যে সে তার জীবনের অর্থ খুঁজে পায়। সার্থকতা খুঁজে পায়। সে বুঝতে পারে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন বা আত্মকেন্দ্রিক ব্যক্তিসত্তা মানুষের নয়। তার মধ্যে একটা সামাজিক সত্তা আছে। এই সামাজিক সত্তা তার মধ্যে মানবিক বোধ জাগিয়ে তুলে। মানব প্রকৃতির আরও নানান দিক আছে। তবে এ দুটো বিশেষ করে শ্রমের ব্যক্তিক ও সামাজিক আকাঙ্ক্ষা খুব গুরুত্বপূর্ণ। পুঁজিবাদ মানব প্রকৃতির এসব আকাঙ্ক্ষা নিবৃত্তিকরণের প্রক্রিয়ায় ভোতা করে দেয়।

স্বেচ্ছা বা সামাজিক শ্রমে উৎপাদন কর্তা যে আনন্দ পায় তারই প্রতিধ্বনি ‘জেমস মিল প্রসঙ্গে মন্তব্য’ (১৮৪৪) লেখায় মার্কস বিচ্ছিন্নতার ব্যাখ্যায় তুলে এনেছেন: “ধরে নেওয়া যাক যে আমরা মানুষ হিসেবে উৎপাদন করছি। সে ক্ষেত্রে আমরা উভয়েই দুই রকমে নিজেকে এবং অন্যকে তার উৎপাদনে স্বীকৃতি দিতে পারতাম। (১) আমার উৎপাদনে আমার স্বতন্ত্রতার বিশেষ স্বভাবকে গুরুত্বারোপ (Objectification) করতে পারতাম আর সে কারণে আমার কাজের কালে আমার নিজ স্বতন্ত্র জীবনের প্রকাশকে উপভোগের সাথে সাথে বস্তুটির দিকে তাকিয়ে একরকম স্বতন্ত্র আনন্দ উপভোগ করতে পারতাম, আমি আমার ব্যক্তিত্বকে সন্দেহের সকল ছায়ার উর্ধ্বে বিষয়গত, সংবেদনে দৃশ্যমান শক্তি হিসেবে জানতে পারতাম। (২) আমার উৎপন্ন তোমার ব্যবহার বা উপভোগের মাধ্যমে আমি প্রত্যক্ষ সন্তুষ্টি পেতাম, জানতে পারতাম যে আমার শ্রম দিয়ে আমি কোনো মানব প্রয়োজন মেটাতে পেরেছি, মানে আমি মানব স্বভাব বস্তুত্বারোপ করে অপর মানুষের প্রামাণিক স্বভাবের প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট জিনিস সৃষ্টি করেছি। (৩) আমি তাহলে তোমার জন্য তোমার এবং প্রজাতির মধ্যে মধ্যস্থ্যতাকারী হিসেবে কাজ করতে পারতাম, এভাবে আমি তোমার কাছ হতে তোমার নিজ সত্ত্বার পরিপূরক হিসেবে, তোমার প্রামাণিক অংশ হিসেবে স্বীকৃতি পেতে পারতাম। এভাবে আমি তোমার চিন্তা ও প্রেমে নিজেকে স্বীকৃত বলে জানতে পারতাম। (৪) আমার নিজ জীবনের স্বতন্ত্র প্রকাশে আমি তোমার জীবনে তোমার প্রকাশকে সৃষ্টি করতে পারতাম, আর তাই আমার ব্যক্তিগত কাজে আমি সরাসরি আমার সত্য স্বভাব, আমার মনের স্বভাব, আমার সম্প্রদায়গত স্বভাব নিশ্চিত করে বাস্তবায়িত করতে পারতাম।

আমাদের উৎপাদন হতো আমাদেরই স্বভাব ঝলমল করা অজস্র আয়না”।২

পুঁজিবাদী সমাজে শ্রমিকদেরকে জীবন ধারণের জন্য রক্ত পানি করা পরিশ্রম করতে হয়। পাগলকরা এ কাজে (গধফফবহরহম ড়িৎশ) তারা দিশেহারা হয়ে ওঠে। তাছাড়া নিজেদের সৃজনশীলতার প্রকাশ না ঘটায় (ঘ০ বীঢ়ৎবংংরড়হ ড়ভ পৎবধঃরারঃু) বিচ্ছিন্নতা তীব্র আকার ধারণ করে। কার্ল মার্কসের বিচ্ছিন্নতার তত্ত্ব … মানব প্রকৃতির বিশেষ দিক হিসেবে আলোচনা করে এবং বলে যে বিচ্ছিন্নতা সামাজিক শ্রেণিতে স্তরীভূত সমাজে বসবাস করার একটি পরিণতি। মার্কস পুঁজিবাদী সমাজের দুই প্রধান ত্রুটি শোষণ ও বিচ্ছিন্নতার ধারণা দিয়েছেন। পুঁজিবাদী শোষণের প্রধান কারণ ব্যক্তি মালিকানা। ব্যক্তি মালিকানার ওপর প্রতিষ্ঠিত পুঁজিবাদী সমাজের অর্থনৈতিক বৈষম্য থেকেই হয় শোষণের সৃষ্টি এবং শোষণের থেকেই উদ্ভব ঘটে বিচ্ছিন্নতার।৩  শিল্প সমাজে বিচ্ছিন্নতার প্রধান কারণ ব্যক্তি মালিকানা। ১৮৪৪-এর অর্থনৈতিক ও দার্শনিক খসড়াতে কার্ল মার্কস শিল্প উৎপাদনের পুঁজিবাদী প্রক্রিয়ার অধীনে শ্রমকারি শ্রমিকদের ক্ষেত্রে ঘটা চার রকমের বিচ্ছিন্নতাকে চিহ্নিত করেছেন।৪  এগুলো হলো: (১) উৎপাদিত দ্রব্য থেকে বিচ্ছিন্নতা, (২) উৎপাদন কার্য থেকে বিচ্ছিন্নতা, (৩) নিজ প্রজাতি তথা মানব প্রকৃতি হতে বিচ্ছিন্নতা এবং (৪) অন্যান্য মানুষ ও নিজ থেকে বিচ্ছিন্নতা। বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করা যেতে পারে:

১. উৎপাদিত দ্রব্য থেকে বিচ্ছিন্নতা (Alienation from the product): পুঁজিবাদে শ্রমিকের উৎপাদিত দ্রব্য তার কাছে একটি অপরিচিত বস্তু হিসেবে দেখা দেয় এবং স্বাধীন সত্ত্বা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পুঁজির খেলায় দ্রব্য পণ্যে রূপ নেয়। তার শ্রমের স্বাক্ষর (Objectification of labour) অর্থাৎ উৎপাদিত পণ্য তার কাছে সার্বভৌম শক্তি হিসেবে প্রকাশ পায়। সে যেন তাকে চিনতে পারে না। সে যে পণ্য উৎপাদন করে সে পণ্যই তাকে বাজার থেকে কিনে আনতে হয়। তার সৃষ্টি যেন তার সাথে বিমাতৃত্বসুলভ আচরণ করে। এভাবেই সে উৎপাদিত দ্রব্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অথচ পুঁজিবাদের আগের সমাজে উৎপাদন সম্পর্ক এরকম ছিল না। উৎপাদন কর্তার পাশাপাশি পরিবারের সবার অংশগ্রহণ ছিল। কোনো কামারের দা বা কুড়াল, কোনো কুমোরের মাটির ঘড়া, পাতিল বা ঘটি কিংবা কোনো সেকরা যখন রূপোর বা সোনার গয়না সৃষ্টি করত তখন সেখানে সমষ্টিগত শ্রমের অংশগ্রহণ ছিল। উৎপাদিত বস্তুটির সাথে উৎপাদন কর্তার সরাসরি সম্পর্ক থাকত এবং তার সাথে যত্ন, মমতা ও ভালোবাসা জড়ানো থাকত । তার শ্রমেই বস্তুটির সৃষ্টি— এ মমতায় বস্তুটির সাথে তিনি ওতপ্রোতভাবে ভালোবাসায় বাঁধা থাকতেন।

পুঁজিবাদী সমাজে যে পণ্য উৎপাদন করা হয় তার মূল লক্ষ্য সমাজের প্রয়োজন মেটানো নয়। বাজারে বিক্রি করে মুনাফা অর্জন। পণ্য, মুনাফা, পুঁজি এ ত্রয়ী চলকের মালিক পুঁজিপতি। শ্রমিক বারো ঘন্টা পরিশ্রম করে যে পণ্য উৎপাদন করে তার যথার্থ মজুরি (Wage) তাকে দেওয়া হয় না। তাকে চার ঘন্টার মজুরি মালিক হাতে ধরিয়ে দেয়। বাকি আট ঘন্টার যে উদ্বৃত্ত শ্রম এবং এ শ্রম যে মূল্য সৃষ্টি করে সেই উদ্বৃত্ত মূল্যের(Surplus value) পুরোটাই পুঁজিপতি নিয়ে নেয়। এই মুনাফা পুঁজিপতি, মুনাফা-পুঁজি-মুনাফা এই প্রবাহে পুনঃপুন বিনিয়োগ করে পাহাড়-সম পুঁজির মালিক হয়ে ওঠে। যে পণ্য বিক্রি করে মালিক পুঁজির পাহাড় হয়ে ওঠে পুঁজিবাদে সে পণ্য শ্রমিকের আত্মজ হয় না কখনো।

২. উৎপাদন কার্য থেকে বিচ্ছিন্নতা (Alienation from the process of production): পুঁজিবাদে উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে শ্রমিকের সংশ্লিষ্টতা থাকে না। যন্ত্রপাতি, জ্বালানি, অবকাঠামো, শ্রমিক সংখ্যা, পরিবেশ এগুলো থাকে পুঁজিপতির পূর্ব পরিকল্পিত ও নিয়ন্ত্রিত। কোন যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হবে, জ্বালানি কোথা থেকে আসবে, অবকাঠামোর ইট, সুরকি, রড কিংবা শ্রমিকের উৎস— এগুলো সম্পর্কে শ্রমিকের কোনো ধারণা থাকে না। উৎপাদনের পরিমাণ (Quantity) কিংবা উৎপাদিত দ্রব্যের গুুণাগুণের (Quality) ওপর শ্রমিকের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। ফলে উৎপাদন কার্যে সে বিচ্ছিন্নতা বোধ করে।

৩. নিজ প্রজাতি তথা মানব প্রকৃতি হতে বিচ্ছিন্নতা (Alienation from the species-being and human nature): পুঁজিবাদে শ্রমিক তার কর্মক্ষেত্রে অপর শ্রমিকের সাথে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার সুযোগ পায় না। শ্রমকে পুঁজিতে রূপান্তরের ফলে এ বিচ্ছিন্নতার সৃষ্ঠি হয়। যখনই শ্রম পুঁজিতে রূপান্তরিত হয় তখনই ইচ্ছা/আকাঙ্ক্ষা, সৃজনশীলতা-সহ শ্রমিকের অন্যান্য গুণাবলি পুঁজির মধ্যে বিলীন হয়ে যায়। কারণ পুঁজি মুনাফার বাইরে অন্য কিছু চিন্তা করতে পারে না। মিথস্ক্রিয়া হয়ে ওঠে তার কাছে আদিখ্যেতা! ফলস্বরূপ, সে তার নিজ প্রজাতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। মার্কস এখানে নিজ প্রজাতি বলতে ‘প্রজাতি সত্তা’ Species-being শব্দটি ব্যবহার করেছেন। এভাবে মানব প্রকৃতির চিরন্তন স্বভাবের যে প্রামাণিক সৌন্দর্য মানুষকে ভালোবাসার আঁচলে জড়ানো ও মমতায় বেঁধে রাখা— এগুলো তার কাছে অপরিচিত হয়ে ওঠে।

৪. অন্যান্য মানুষ ও নিজ থেকে বিচ্ছিন্নতা (Alienation from the others and self): পুঁজিবাদে উৎপাদন সামাজিক। উৎপাদনের মালিকানা ব্যক্তিগত। তাই ভোগ ও মালিকানাকে কেন্দ্র করে পুঁজিপতির সাথে শ্রমিকের একটা বৈরী সম্পর্ক বিরাজ করে। মূলত সমাজের অন্যান্য মানুষের সাথে তার বিচ্ছিন্নতার সূত্রপাত ঘটে উৎপাদিত বস্তুর ভোগ ও মালিকানা হতে। কেননা সামাজিক উৎপাদনের ফসল ভোগ এবং মালিকানার মাধ্যমে পুঁজিপতি শ্রমিক ও শ্রমকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই ভোগের অধিকার এবং শোষণ থেকেই এ ধরনের বিচ্ছিন্নতা সৃষ্ঠি হয়।৫  মানুষ থেকে মানুষের বিচ্ছিন্নতা তখনই ঘটে যখন তার নিজের মধ্যেই এক ধরনের বিরোধাত্মক সম্পর্ক তৈরি হয়।৬

পুঁজিবাদ শ্রমিককে নিজ সত্তা থেকেও বিচ্ছিন্ন করে দেয়। পুঁজিপতি শ্রমিককে ঐটুকুই মজুরি দেয় যার মাধ্যমে সে কোনো রকমে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে। সে বাঁচার জন্য কর্মঘন্টা দ্বিগুণ করে। মার্কস-এঙ্গেলসের ভাষায়, “মজুরি-শ্রমের গড়পড়তা দাম হল ন্যূনতম মজুরি, অর্থাৎ জীবিকা-উপায়ের সেই পরিমাণ যা শ্রমিকরূপে শ্রমিকের মাত্র অস্তিত্বটুকু বজায় রাখার জন্য একান্ত আবশ্যক। সুতরাং মজুরি-শ্রমিক তার শ্রম দিয়ে যা অধিকার করে তাতে কেবল কোনোক্রমে এই অস্তিত্বটুকু চালিয়ে ও পুনরুৎপাদন করা চলে”।৭  সে তার পরিবারের সাথে বিনোদনের সুযোগ পায় না। পরিবারকে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারে না। বাঁচার জন্য তাকে দ্বিগুণ পরিশ্রম করে টিকে থাকতে হয়। শ্রমের ক্ষেত্রে নিজের স্বাধীনতা থাকলেও এ স্বাধীনতাকে তার কাছে প্রতারণাপূর্ণ মনে হয়। কারণ তাকে পরিশ্রম করতেই হয়। ‘অস্তিত্বের জন্য শ্রম’ তাকে সমগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এভাবে সে কর্মক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নতার শিকার হয়। উপরি কাঠামোর অংশ হিসেবে কর্মক্ষেত্রের বিচ্ছিন্নতা তার সামাজিক বিচ্ছিন্নতাকেও নির্দেশ করে।

পুঁজিবাদে শ্রমিকের শ্রমশক্তি ছাড়া হারাবার কিছু থাকে না। উদ্বৃত্ত মূল্য শোষণের মেরুকরণ প্রক্রিয়ায় তারা স্কেলের তলানিতে চলে যায়। শ্রমিক ক্রমশ নিঃস্ব হতে থাকে। যন্ত্রচালিত মেশিনের ব্যবহার ও শ্রমের বিভাজন পরিস্থিতিকে আরও উসকে দেয়। জঠিল করে তুলে। যন্ত্রশিল্পের ব্যবহার সম্পর্কে মার্কস বলেছেন, আধুনিক শ্রমিক কিন্তু যন্ত্রশিল্পের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে উপরে ওঠে না, নিজেদের শ্রেণির যে অবস্থা, তারও নিচে ক্রমশই বেশি করে তাদের নেমে যেতে হয়। সে হয়ে পড়ে নিঃস্ব।৮  অন্যদিকে, শ্রম বিভাজনের ফলে  শ্রমিক পুরো বস্তুটির একটি নির্দিষ্ট অংশ উৎপাদন করে মাত্র। পুরো বস্তুটি সম্পর্কে তার কোনো ধারণা থাকে না। বিভাজনের ফলে যে কাজটি সে করে তা তার নিয়ন্ত্রণে থাকার বদলে তার সামনে ‘স্বাধীন সত্ত্বা’ হিসেবে আবির্ভূত হয়। মানুষ এমন শ্রমের বিভাগ তৈরি করে, এমন সমস্ত কাজ করে, এমন সমস্ত কিছু সৃষ্টি করে যে নিজে তারই দ্বারা শর্তাধীন হয়ে পড়ে। যা নিজে উৎপাদন করছে, সে সমস্তই তার কাছে পর; যা সে চায় না তাই তাকে করতে হয়; যার সাথে মেলামেশার আগ্রহ, যেভাবে বসবাসের আকাঙ্ক্ষা, তার কোনো কিছুই করতে না পেরে সে হয়ে পড়ে একা, সম্পূর্ণ একা। গোটা পরিবেশকে অসহনীয় মনে হচ্ছে অথচ এই পরিবেশই প্রতিনিয়ত সে গড়ে তুলছে।৯  পুঁজিবাদে শ্রম হয়ে ওঠে শ্রমিকের কাছে বাইরের শক্তি (খধনড়ঁৎ রং বীঃবৎহধষ ঃড় ড়িৎশবৎ রহ পধঢ়রঃধষরংস)। শ্রমের বিভাগ সম্পর্কে মার্কস-এঙ্গেলস লিখেছেন, শ্রম বিভাগ হবার কারণে মানুষের কাজ আর স্বেচ্ছামূলক নয়, প্রকৃতিগতভাবেই হয়ে পড়ে বিভক্ত। মানুষের নিজের কাজ তার নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে তার বিরুদ্ধেই হয়ে পড়ে এক বিচ্ছিন্ন শক্তি। যেইমাত্র শ্রমের বন্টন একটা অস্তিত্ব লাভ করে, প্রতিটি মানুষের একটি বিশিষ্ট এলাকা হয়ে যায় যেটি জোরপূর্বক চাপানো এবং যেটি থেকে সে পালাতে পারে না।১০

মানুষ প্রকৃতির কোলে বসে যে পণ্য উৎপাদন করে সেই প্রকৃতি থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আর ‘ব্যক্তি’ কার্ল মার্কস যাকে বলেছেন ‘বুর্জোয়া’ বা ‘মধ্য শ্রেণিভুক্ত সম্পত্তির মালিক’১১— সে আমার আমার ভাবতে ভাবতে অতি মাত্রায় আত্মকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে। রক্ত-মাংসে মিশে যাওয়া ‘আমি এবং ‘আমার সম্পত্তি’ নামক অভ্যাসের শক্তি তাকে ধ্বংস করে দেয়। তার মানবিক সত্তা লোপ পায়। পুঁজি তাকে নৈর্ব্যক্তিক করে তুলে। মানবিকতার লোপ ও নৈর্ব্যক্তিকতার ফলে শ্রমিক নিজ ইচ্ছা/আকাঙ্ক্ষার (ডরষষ) প্রতিফলন ঘটাতে পারে না। সে নিজ ইচ্ছা/আকাঙ্ক্ষা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। তার ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে না এবং তার সৃজনশীলতা ব্যাহত হয়। সে একটি বিচ্ছিন্ন জীবিকা শক্তির প্রতীকে রূপান্তরিত হয়। পুঁজিবাদে এই বিচ্ছিন্নতা একবারে চূড়ায় পৌঁছে যায়। সে জীব থেকে যায়। মানুষ হতে পারে না। পুঁজিবাদে পুঁজি মনে করে সেই একমাত্র যৌক্তিক আর বাকি সব কিছু অযৌক্তিক। পুঁজির সর্বব্যাপী বিচলন, নিয়ন্ত্রণ ও সর্বগ্রাসী আচরণ ব্যক্তির স্বাধীনতা চরম মাত্রায় খর্ব করে। অ্যাডাম স্মিথ (১৭২৩-১৭৯০) মনে করতেন যে, যদি দরকার পড়ে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ উৎপাদনশীল শ্রমকে কাজে লাগানোর জন্য মজুদিকৃত ও পুঞ্জিভূত করা যায়। কার্ল মার্কস এ থেকেই পুঁজিকে বলেন পুঞ্জিভূত শ্রম (stored-up labour) বা মৃত শ্রম। পুঁজিবাদী সমাজে এই মৃত শ্রম বা পুঁজি, যা হলো অতীত, আধিপত্য করে বর্তমানের ওপর।১২  মার্কস-এঙ্গেলসের মতে, “বুর্জোয়া সমাজে জীবিত-শ্রম সঞ্চিত-শ্রম [পুঁজি] বৃদ্ধি করার এক উপায় মাত্র। কমিউনিস্ট সমাজে, সঞ্চিত শ্রম শ্রমিকের অস্তিত্বকে বিস্তৃত করা, সমৃদ্ধ করা, উন্নত করার এক উপায় মাত্র।

 

সুতরাং বুর্জোয়া সমাজে, অতীত বর্তমানের উপর প্রভাব বিস্তার করে। কমিউনিস্ট সমাজে, বর্তমান অতীতের উপর প্রভাব বিস্তার করে। বুর্জোয়া সমাজে পুঁজি হলো স্বাধীন এবং তার ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য আছে, যেখানে জীবিত মানুষ হচ্ছে পরাধীন এবং তার কোনো ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য নেই”।১৩

পুঁজিবাদী সমাজে এই যে বিচ্ছিন্নতা দেখা দেয় তার ফলে পুঁজিবাদে চিন্তার কর্তা-বিষয় সম্পর্ক (Subject-Object relations) বিপরীত রূপ ধারণ করে। চিন্তার বিষয় (Object) হয়ে ওঠে কর্তার (Subject)প্রদর্শক। বিষয়টিকে ইংরেজিতে এইভাবে তুলে ধরা যায়— Subject-object relations get inverted. Object became subject master|  চিন্তাবিদ ই. ফ্রম  বিচ্ছিন্নতার যে বর্ণনা দিয়েছেন তা বহুলাংশে কার্ল মার্কস-এর বক্তব্যেরই অনুরূপ। ফ্রম এর মতে, “বিচ্ছিন্নতা হল সেই বিশেষ অবস্থা যখন মানুষ নিজেকে তার স্বীয় শক্তি ও সম্ভাবনার প্রত্যক্ষ বাহক না ভেবে, বহিস্থ কোনো শক্তির উপরে নির্ভরশীল— দুর্বল বস্তু বলে গণ্য করে”।১৪

এজন্যই  মার্কস মনে করেন, একমাত্র সাম্যবাদেই মানুষ পরিপূর্ণ মানুষ (ঞড়ঃধষ সধহ/নবরহম) হতে পারে। অধিক পণ্য উৎপাদন ও অধিক ভোগের (বস্তুগত প্রাপ্তির) চেয়ে মানুষ হবে সম্পূর্ণ মুক্ত ও স্বাধীন, মানবিক মানুষ। রুশোর ‘সামাজিক চুক্তির’ মাধ্যমে সমাজ পরিচালনার ধারণার প্রসঙ্গ টেনে মার্কস বলেছেন: “স্বাধীন মানুষের শ্রমশক্তির সামাজিকীকরণের মাধ্যমে উৎপাদনের উপায়সমূহের যখন মৌলিক কাঠামোগত রূপান্তর ঘটবে তখন শ্রম আর কারখানার মালিক বা রাষ্ট্রীয় মালিকানায় বাধ্যতামূলক যান্ত্রিক শ্রম থাকবে না। শ্রম তখন স্বাধীন, সৃষ্টিশীল ও দায়িত্বশীল উৎপাদন-কর্ম হয়ে ওঠবে। তখন মানুষের শ্রম পূর্বেকার দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে সামাজিক ও মানবিক চরিত্র লাভ করবে। ফলে ব্যক্তি-মানুষের শ্রম বিপুল সামাজিক ও মানবিক শক্তিতে রূপান্তরিত হবে। এর ফলে শ্রমের এই নতুন সামাজিক শক্তি, তা কখনোই মানুষ থেকে (মানুষের সত্তা থেকে) বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে না। আর এই ধরনের সমাজ পরিচালনার জন্য আলাদা কোনো রাজনৈতিক দল বা রাষ্ট্রের প্রয়োজন পড়বে না। আর তখনই মানুষের শ্রমের ও মানুষের পরিপূর্ণ মুক্তির শর্ত পূরণ হবে”।১৫

মার্কসের মতে, শ্রমিক যদি কারখানার মালিক বা রাষ্ট্র দ্বারা ‘নিয়োগপ্রাপ্ত’ মজুর হয় তাহলে তার স্বাধীন মানবিক শ্রমের রূপ পাল্টে যায়। মানুষের শ্রম তখন তার ইচ্ছাবিরুদ্ধ, ক্লান্তিকর মজুর খাটায় পরিণত হয়।১৬  শ্রম মানুষের সত্তার প্রকাশ, শ্রম সৃজনশীল ও মানবিক। শ্রম মুক্ত হলে মানুষ তার সৃষ্টিশীল, মানবিক শ্রমের মাধ্যমে সুন্দর পৃথিবী গড়ে তুলতে পারে।১৭  মার্কসের কাছে মুক্ত, মানবিক শ্রম এতই মহিমাময় যে, এমনকি সকলে যখন ঢালাওভাবে শিশুশ্রমের বিরোধিতা করেন, মার্কস তখন নির্দিষ্ট মাত্রায় শিশুশ্রমকেও উৎসাহিত করেন। মার্কস সবাইকে অবাক করে দিয়ে জার্মান সোশ্যালিস্ট পার্টির গোথা প্রোগ্রামের কর্মসূচিতে উত্থাপিত শিশুশ্রমের সম্পূর্ণ বিলোপের সম্ভাবনার সমালোচনা করেন। তিনি সমাজতান্ত্রিক সমাজে শিশুদের বিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষা প্রদানের পাশাপাশি কায়িক শ্রমে যুক্ত করার দাবি করেন। রবার্ট ওয়েনের চিন্তার বরাত দিয়ে মার্কস বলেন: “রবার্ট ওয়েন তার কারখানা-ব্যবস্থাপনাধীন বিদ্যালয়ের বাস্তব কার্যক্রমের মাধ্যমে আমাদের দেখিয়েছেন, বিদ্যালয়ে শিশুদের যে শিক্ষা প্রদান করা হবে, সেখানে সাধারণ শিক্ষার পাপাপাশি বয়স অনুপাতে তাদের কায়িকভাবে উৎপাদন-কর্মের সাথেও যুক্ত করতে হবে। এটা তাদের উৎপাদন ক্ষমতা ও দক্ষতা বাড়ানোর জন্য নয়, বরং শ্রম যে নৈতিকতা ও মানবিকতারও একটা ব্যাপার, এই শিক্ষার বীজ যাতে শৈশবেই শিশু-কিশোরদের মধ্যে রোপিত হয়, সেই উদ্দেশ্যে”।১৮  ওয়েন ভোগবাদীতার পরিবর্তে প্রকৃত স্বাধীন মুক্ত মানুষ হওয়ার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। ওয়েন মনে করতেন, ‘অতীতের কোনো এক সময় থেকে সমাজ এমনভাবে চলতে শুরু করে— তখন মানুষ একে অপরকে ধ্বংস করে বেঁচে থাকত, অপরের শ্রম শোষণ-নিপীড়ন করে নিজের সম্পদ বৃদ্ধি করত, মানুষ অন্য মানুষের রক্ত শোষণ করে নিজে মোটা-তাজা হতো। সেই অবস্থা আজও বিদ্যমান। এখন এমন সমাজ গড়ে তোলা দরকার যেখানে সকল মানুষ স্বাধীনভাবে সমঅধিকারের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সকলের কল্যাণের জন্য মিলিতভাবে কাজ করবে’।১৯  চার্লস ফুরিয়েরেও আমরা এধরনের বক্তব্যের প্রতিফলন দেখতে পাই। চার্লস ফুরিয়ের বস্তুগত প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে ভোগবাদীতার পরিবর্তে মানবিক সমাজের কথা বলেছেন। তার মতে, বস্তুগত প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা সমাজে অসুস্থ প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি করে। ফুরিয়ের বলেন: “মানুষ হবে প্রজাপতির মতো। কাজ বা শ্রম হবে মানুষের জন্য আনন্দের। দিনে দুই ঘন্টা কাজই যথেষ্ট। মানুষ কাজ করবে স্বপ্রণোদিত হয়ে, স্বাধীনভাবে, সম্মিলিতভাবে। এভাবেই মানুষের মধ্যে তৈরি হবে একতা, ভ্রাতৃত্ববোধ ও প্রেম। এভাবেই মানুষ সত্যিকার মানুষের সমাজে প্রবেশ করবে”।২০  ফুরিয়েরের বক্তব্যে এই যে, ‘স্বপ্রণোদিত হয়ে, স্বাধীনভাবে, সম্মিলিতভাবে’ কথাগুলো ফুটে ওঠেছে এগুলো ব্যক্তির স্বেচ্ছা ও সামাজিক শ্রমকে প্রতিনিধিত্ব করছে। চার্লস ফুরিয়েরের মতো মার্কসও মনে করেন, সমাজতন্ত্রে শ্রম হবে মানুষের জন্য আনন্দের, যা একই সাথে হবে মানুষের স্বাভাবিক চাহিদা ও মানবিক আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। এক্ষেত্রে মার্কসের আরও মতামত হলো, ‘সাধারণ উৎপাদনের ক্ষেত্রে একজন মানুষের শুধু একটি কাজে বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। একজন মানুষ তার পছন্দমতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করবে। সে তাঁত বুনবে অথবা ঘড়ি তৈরি করবে, সে মৎস্য শিকারও করবে। কাজের বৈত্র্যিময়তার মধ্যে মানুষের স্বাধীন মানবিক সত্তার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটবে’।২১

মার্কস মনে করেন, শ্রেণি সংগ্রামের সাথে বিচ্ছিন্নতা যুক্ত হলে তা শ্রম মুক্তির একটা পরিপূর্ণ কাঠামো দাঁড় করাবে। যা পুঁজিবাদের মৃত্যু ডেকে আনবে। তার মতে, মানুষের সাথে মানুষের পুনরেকত্রীকরণের ফলেই (Reintegration oneself with oneself)  বিচ্ছিন্নতা দূর হতে পারে। আর এটা সমাজতান্ত্রিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে একমাত্র সাম্যবাদেই সম্ভব।

 

তথ্যনির্দেশ:

১. উদ্ধৃত, আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের চিন্তা ও তত্ত্ব, সম্পাদনা-কাজী তোবারক হোসেন ও মুহাম্মদ হাসান ইমাম, সৈয়দ জহির

সাদেকের প্রবন্ধ ‘কার্ল মার্কস’ থেকে, সামাজিক বিজ্ঞান উন্নয়ন কেন্দ্র, ঢাকা, তৃতীয় প্রকাশ জুন ১৯৯৬, পৃষ্ঠা ২৫

২. উদ্ধৃত, অনুপ সাদি, মার্কসবাদ, ভাষা প্রকাশ, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০১৭, পৃষ্ঠা ৯৭-৯৮, আরও পড়ুন, কার্ল মার্কস, ইকোনমিক এন্ড ফিলোজফিক ম্যানুস্ক্রিপ্টস: ১৮৪৪, ভাষান্তর-জাভেদ হুসেন, বাঙলায়ন, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০১২, পৃষ্ঠা ১৬০-১৬১

৩. অনুপ সাদি, মার্কসবাদ, ভাষা প্রকাশ, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০১৭, পৃষ্ঠা ৯৬

৪  উদ্ধৃত, ঐ, পৃষ্ঠা ১০০

৫. আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের চিন্তা ও তত্ত্ব, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৫

৬. অনুপ সাদি, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৯৯

৭. কার্ল মার্কস-ফ্রেডারিক এঙ্গেলস, কমিউনিস্ট পার্টির ইশতিহার, প্রকাশক-সলিল কুমার গাঙ্গুলি, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, নভেম্বর ২০০৮, পৃষ্ঠা ৪১

৮. কার্ল মার্কস-ফ্রেডারিক এঙ্গেলস, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩৭-৩৮

৯. অনুপ সাদি, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৯৮

১০. উদ্ধৃত, অনুপ সাদি, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৯৮

১১. কার্ল মার্কস-ফ্রেডারিক এঙ্গেলস, প্রাগুক্ত , পৃষ্ঠা ৪২

১২. উদ্ধৃত, অনুপ সাদি, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৯৬

১৩. কার্ল মার্কস-ফ্রেডারিক এঙ্গেলস, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৪১

১৪. সমাজবিজ্ঞান শব্দকোষ, সম্পাদনা-ড. আনোয়ার উল্লাহ চৌধুরী, মুহম্মদ হাবিবুর রহমান ও অন্যান্য, অনন্যা, ঢাকা, জানুয়ারি ২০২৪, পৃষ্ঠা ২১

১৫. উদ্ধৃত, রইসউদ্দিন আরিফ, অক্টোবর বিপ্লব ও রুশ সমাজতন্ত্রের পুনর্পাঠ, পাঠক সমাবেশ, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, পৃষ্ঠা ৯১

১৬. রইসউদ্দিন আরিফ, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৯১

১৭. ঐ, পৃষ্ঠা ৯১

১৮. উদ্ধৃত, রইসউদ্দিন আরিফ, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৯১-৯২

১৯. রইসউদ্দিন আরিফ, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৮৪-৮৫

২০. উদ্ধৃত, রইসউদ্দিন আরিফ, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৮৪

২১. রইসউদ্দিন আরিফ, অক্টোবর বিপ্লব ও রুশ সমাজতন্ত্রের পুনর্পাঠ, পাঠক সমাবেশ, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি  ২০২৪, পৃষ্ঠা ৯২

 

 

রাজেশকান্তি দাশ,  প্রাবন্ধিক, সুনামগঞ্জ

আহমদ রফিক: ভাষাসৈনিক থেকে সাহিত্য-গবেষণার আলোকবর্তিকা

শাহেদ কায়েস   আহমদ রফিক (জন্ম: ১২ সেপ্টেম্বর ১৯২৯-মৃত্যু: ২ অক্টোবর ২০২৫) বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের ভুবনে আহমদ রফিক একটি উজ্জ্বল নাম। তিনি একাধারে

অধ্যাপক ডা. রবিউল হোসেনের ‘প্লেজার অ্যান্ড পেইন’ গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসব

আন্দরকিল্লা ডেক্স \ চট্টগ্রাম চক্ষু হাসপাতাল ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম এর ম্যানেজিং ট্রাস্টি অধ্যাপক ডা. রবিউল হোসেনের আত্মজীবনী ‘প্লেজার অ্যান্ড পেইন’ গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসব

ফেরা

সৈয়দা মাসুদা বনি   নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের কথা শোনা থাকলেও আদতেই সেটা কেমন জানা ছিল না রিশানের। এটাই তাহলে মৃত্যুর পরের জগৎ, সে ভাবে। সে ভাবতে

ফিরে যাওয়া

বিচিত্রা সেন   রুবা.. রুবা খবরদার, না খেয়ে এক পাও বাইরে দিবি না। মুশকিল হয়ে যাবে কিন্তু! মায়ের হুমকিতে অগত্যা রুবাকে দাঁড়াতেই হয়। মা যে

চিরহরিৎ বৃক্ষের গল্প

সুজন বড়ুয়া   ছাদে উঠে দেখি শানবাঁধানো উঁচু আসনে একা বসে আছেন হরিৎবরণ ঘোষাল। একটু অবাক হলাম। এ সময় তার ছাদে বসে থাকার কথা নয়।