মোহিত কামাল
পূর্বে প্রকাশের পর
তিন
এগোনোর পর পেছানো কঠিন!
এগোবে, না পেছাবেসংকটে পড়ে গেল স্নেহা। কুসুমকে কথা দিয়েছে। যেতেও ইচ্ছা করছে। তবে যাওয়াটা ঠিক হবে না ভেবে অ্যাপ্রোচ-অ্যাভয়ডেন্স বা আকর্ষণ-বিকর্ষণ দ্বন্দ্বে আটকে গেল স্নেহা।
অবশেষে জয় হলো কুসুমের। জয় হলো নিজের ইচ্ছার। বাস্তবতার দেয়াল টপকে সাধারণ সাজে বাসা থেকে বের হলো স্নেহা। ভাবল, যাওয়ার আগে টেলিফোন করলে কেমন হয়! টেলিফোন নম্বর দিয়েছিল রাহুল। এখনকার একটা কল ওষুধের মতো কাজ করবে। ওষুধ খাইয়ে শক্ত করে তোলা যেতে পারে ভেবে কল দিল।
নাহ! মোবাইলে ঢোকা যাচ্ছে না। সেট বন্ধ। ফুঁসে ওঠা উত্তেজনার পারদ হঠাৎ দপ করে নেমে এল নিচে।
খারাপ লাগা তৈরি হয়ে গেল। বড় করে শ্বাস ছেড়ে এগিয়ে গেল সামনে। কাছেই বাসা। রিকশার পথ। রিকশায় উঠে বসল স্নেহা।
এগিয়ে যাচ্ছে রিকশা। মুঠোসমান হ্যান্ডবাগে রয়েছে মোবাইল। অল্প কিছু টাকাও। ডান হাতে মুঠিতে ধরে রেখেছে ব্যাগটা। রিং হচ্ছে। চেইন খুলে সেটটা বের করে কানে ধরল।
স্নেহা, তুমি কোথায়? কল করেছেন ওর মামা।
বাসা থেকে বের হয়েছি? এক ফ্রেন্ডের বাসায় যাচ্ছি।
আমি এসেছিলাম তোমার কাছে। সিংগাপুর থেকে তোমার রিপোর্টগুলোর কমেন্ট আনিয়েছি। সবার সঙ্গে আলাপ করার আগে কথা বলতে চাই তোমার সঙ্গে।
তুমি বাসায় যাও, মামা। আমি এক ঘণ্টার মধ্যে আসছি।
আমি এখন তোমার পেছনে। রিকশা ছেড়ে দাও। আমার গাড়িতে ওঠো। তোমার গন্তব্যে নামিয়ে দিয়ে আসি।
ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাল স্নেহা। দেখল, কালো রঙের টয়োটা জি অনুসরণ করছে তার রিকশা। ড্রাইভিং সিটে বসে হাসছেন মামা।
তোমাকে গোয়েন্দার মতো লাগছে মামা।
হ্যাঁ। গোয়েন্দাগিরিই করছিলাম!
তুমি ব্যাক করো। আমার পেছনে লেগো না। বাসায় যাও। আমি আসছি।
বাসায় যাব কেন? নেমে এসো রিকশা থেকে।
তোমার অত্যাচারে বাঁচা যাবে না।
উপকার করতে চাচ্ছি, আর তুমি সেটাকে ভাবছ অত্যাচার? নেমে এসো, বলছি। মরতে দেবে কে তোমাকে?
মরতে দেবে না মানে? মরা কি ঠেকাতে পারবে তুমি?
যে কারণে সবাই ভয় পেয়েছে সে কারণে মরবে না। কনফার্ম রিপোর্ট। কী কারণে মারা যাব আমরা কেউ জানি না। তবে জেনে এসেছি, বিনাইন টিউমারের কারণে মারা যায় না কেউ। নেমে এসো।
বিরক্ত হলো না স্নেহা। মামার এ আদর ভালো লাগে ওর। ভাগ্নির জন্য এত করেন! কেন এত টান মামার, জানে না।
রিকশা থামিয়ে নেমে এসে গাড়িতে সামনের সিটে বসে বলল, কোথায় যেতে হবে?
ঝিগাতলা চলো।
র্ঝিগাতলা অনেক বড় এলাকা। স্পেসিফিক বলো।
জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হসপিটালের দুটো বাড়ির পর। রোড-৩-এ, ধানমন্ডি।
কার বাসা?
আমার বান্ধবী কুসুমের বাসা।
কুসুমের বাসা তো এলিফ্যান্ট রোডে।
কুসুমের শ্বশুরবাড়ি।
ওহ। তাই বলো।
তুমি যাবে না শ্বশুরবাড়ি?
না।
না কেন?
কেন আবার কী? যাব না, ব্যস যাব না। দিস ইজ মাই ডিসিশন।
কেন যাবে না?
বিনাইন টিউমার বলো আর যা-ই বলো, ব্রেন টিউমার নিয়ে শ্বশুরবাড়ি যাওয়া উচিত নয়। অন্যকে ঠকানো হবে।
ঠকানোর কী আছে? রোগ আছে, চিকিৎসাও আছে। এ চিকিৎসায় রয়েছে শতভাগ সাফল্য। ঠকানোর প্রসঙ্গ আসছে কেন?
বারবার ঠকানো শব্দটা বলার সময় রাহুলের কথা মনে পড়তে লাগল স্নেহার। রাহুলকে বলেছে ডাহা মিথ্যা কথা। বলেছে মায়ের টিউমারের চিকিৎসার জন্য গিয়েছিল বেঙ্গালুরু। কেন এ মিথ্যা বলেছিল? উত্তর জানা নেই। অথচ স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভেতর থেকে ধেয়ে এসেছিল মাকে জড়িয়ে বানানো গল্প। সে সময় কোনো অনুশোচনা হয়নি। এখন অনুতাপ হচ্ছে। কেন ভুলটা করল? তখন বলে দিলে হতো। সাবধান হয়ে যেত রাহুল। বিষের ছোবল খেতে হতো না তাকে। কুসুমও জানে না স্নেহার ব্রেন টিউমারের কথা। জানে কেবল মামা আর বাবা। মা ও ভাইয়াও জানে না ভালো করে। এখন যাওয়া উচিত হবে না রাহুলের কাছে। গেলে আরও আসক্তি বাড়বে। আরও ক্ষতি বাড়বে তার। যেই দেখে সেই পছন্দ করে স্নেহাকে। বিষয়টা নতুন নয়। নির্লিপ্ত থাকতে পারে। এখন নির্লিপ্ত থাকতে পারছে না। গুরুত্ব দিচ্ছে রাহুলকে। গুরুত্ব ইচ্ছা করে দিচ্ছে, তাও না। একদম গভীর থেকে চলে আসছে অদ্ভুত একটা টান। আগে কখনো কোনো ছেলের ব্যাপারে এমন হয়নি। কিসের টান এটি? কেন টানে মন? না যাওয়ার ইচ্ছা জাগল না কেন?
এসব ভাবনা চুপ করিয়ে রাখল স্নেহাকে।
গাড়ি টার্ন নিল ডানে। হাসপাতালের উত্তর পাশের গলি দিয়ে এগিয়ে গিয়ে মামা বলল, বলো, কোন বাড়িটা?
ওই তো বাঁয়ে।
বাড়ির সামনে দাঁড়াল গাড়ি।
মামা বললেন, দেরি হবে? দাঁড়াব আমি?
না। চলে যাও। কতক্ষণ থাকব বুঝতে পারছি না। নিজে ফিরব, অথবা কুসুম নামিয়ে দেবে।
চারদিকে মলমপার্টি তৎপর। প্রতিদিন একজন-দুজনের মৃত্যু সংবাদ আসছে পত্রিকায়। সাবধানে এসো।
বড়দের নিয়ে এ এক জ্বালা! কথায় কথায় একেবারে আকাশ ছুঁয়ে ফেল তোমরা! আর শব্দ পেলে না? একদম মৃত্যু পর্যন্ত টেনে নিলে?
যা বলেছি-তোমার ভালোর জন্য বলেছি। সরি। এমন বলা ঠিক হয়নি।
যাও। ঘ্যানর-ঘ্যানর করতে হবে না আর! বাসায় যাও। আমি আসছি।
সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এল স্নেহা। ডোরবেল টেপার সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেল দরজা।
ছোট একটা মেয়ে দরজা খুলে দিয়েছে। সে কি দাঁড়িয়েছিল দরজার পাশে? এত দ্রুত দরজা খুলল কীভাবে?
ঘরে ঢুকে স্নেহা বলল, কুসুম নেই?
মেয়েটি জবাব দিল, আছে।
কোথায়? ডাকো।
ভাবীজান বাথরুমে।
কৌতূহলী হয়ে স্নেহা প্রশ্ন করল, দরজার পাশেই দাঁড়িয়েছিলে তুমি?
হ।
কেন?
ছোট ভাইজান কইল, একজন মেহমান আইছে। দরজা খুইলা রাখ।
ছোট ভাইজানটা কে?
রাহুল ভাইজান।
ওহ! চমকে উঠল স্নেহা। রাহুল জানল কীভাবে আমার আসার সংবাদ? মনে প্রশ্ন জেগে ওঠায় ভাবল নিশ্চয়ই কুসুম আগেই বলে রেখেছে।
বসার ঘরে একটা সোফায় বসল স্নেহা।
মেয়েটি বলল, ভাইজানের কাছে আহেন।
কোথায়?
ব্যালকনিতে বইসা আছেন।
অসুস্থ মানুষ থাকবে বিছানায়, ব্যালকনিতে কেন? নিজেকেই প্রশ্ন করে উঠে দাঁড়াল। মেয়েটি ওকে নিয়ে গেল ব্যালকনিতে।
একটা ইজি চেয়ারে বসে আছে রাহুল। পাশে রয়েছে আর একটা চেয়ার।
খুব সহজ ভাষায় রাহুল বলল, বসুন।
কোনো প্রশ্ন না করে খালি চেয়ারটায় বসল স্নেহা। ব্যালকনির কোণায় রয়েছে একটা টব। টব থেকে উঠে গেছে মানিপ্ল্যান্টের লতা-জড়িয়ে রেখেছে ব্যালকনির গ্রিল। পুরো গ্রিলে শৈল্পিক ঢঙে সেজেছে বাহারি পাতার পেঁচানো খেলা। বাইরে থেকে দেখা যায় পাতার সাজ। ভেতরে কেউ দাঁড়িয়ে থাকলে বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। ভেতর থেকে রাস্তার অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। তবে কি ব্যালকনিতে বসে গাড়ি থেকে ওকে নামতে দেখেছে রাহুল? হতে পারে। এ কারণে দরজা খোলার জন্য পাঠিয়েছে মেয়েটিকে নিজ থেকে। ভাবতে ভাবতে সহজ উত্তর পেয়ে স্বাভাবিক হয়ে গেল।
এখন কেমন আছেন?
এ মুহূর্ত থেকে ভালো লাগছে।
ও? আর কী বলবে বুঝতে পারল না স্নেহা।
ভাবি বলেছিল, আসবেন আপনি। এজন্য অপেক্ষা করছিলাম ব্যালকনিতে বসে। বলল রাহুল।
শুনলাম হসপিটালে যেতে হয়েছিল আপনাকে?
হ্যাঁ। বমি হয়েছিল অনেকবার। কাহিল হয়ে পড়েছিলাম। পাশেই হসপিটাল। ওখানে নিয়ে গিয়েছিল। ইমার্জেন্সির ডাক্তাররা ওষুধ দিল, সেলাইন দিল। কিছুটা ভালো বোধ করাতে সকালের দিকে বাসায় চলে এসেছি।
স্নেহা ভাবল, একটু আগে বলেছে ‘এই মুহূর্ত থেকে ভালো লাগছে’, এখন বলছে সকালের দিকে ভালো বোধ করেছে। মানুষ অযথা বাড়িয়ে বলতে চায়, ভেতর থেকে মিথ্যা বলে ফেলে, চেতন মনে ধরা দেয় না তা। রাহুলেরও এখন সেই দশা। ইমপ্রেস করার জন্য এমন মিথ্যা বলার প্রয়োজন কী? এমনিতেই ইমপ্রেসড হয়ে বসে আছে।
মুগ্ধ চোখে স্নেহা তাকাল সামনে। মানিপ্ল্যান্ট পাতার ফাঁকফোকর দিয়ে দেখা যাচ্ছে ওপাশের একটা চমৎকার বাড়ি। বাড়ির লন সবুজ ঘাসে ভরা, দূর্বাদল নরম পাপোশের মতো দখল করে আছে পুরো প্রাঙ্গণ। মাধবীলতা জড়িয়ে রেখেছে বাড়ির উঁচু দেয়াল।
স্নেহার চোখ অনুসরণ করে রাহুলও তাকাল সামনে। ওর বিমুগ্ধ চোখের ভাষা পড়ে নিল। ঠান্ডা গলায় বলল, এটা নিহত নেতা গোলাম কিবরিয়া সাহেবের বাড়ি। কিছুদিনের মধ্যে আমিন মোহাম্মদ গ্রুপ এখানে অ্যাপার্টমেন্ট গড়ে তুলবে।
এমন সুন্দর বাড়িতে অ্যাপার্টমেন্ট! ধানমন্ডির একক বাড়িগুলো শেষ হয়ে গেল। এ সুন্দর বাড়িটাতে অ্যাপার্টমেন্টের প্রয়োজন কী? এখানে একটা মিউজিয়াম গড়ে তুললেই তো হয়। বাড়িটা এমনই থাকুক। বলল স্নেহা।
যখন শুনেছি এখানে অ্যাপার্টমেন্ট হবে, আমার মনেও এমন কষ্ট লেগেছে। ডেভেলপারদের কাছে আমাদের কষ্টের দাম নেই, বুঝলেন।
রাহুলের কথা শুনছে না স্নেহা। উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, মাধবীলতা মায়ায় জড়িয়ে রেখেছে বাড়ির উঁচু দেয়াল, দেখেছেন?
হুঁ। প্রকৃতির অনেক মায়া! সবুজ গাছগাছালি জড়িয়ে রেখেছে কংক্রিটের দেয়াল-কংক্রিটের ভেতরও মনে হচ্ছে জাগিয়ে তুলেছে প্রাণ।
হ্যাঁ। মায়ার বাঁধন এমনই শক্ত। একবার এ বাঁধনে জড়ালে ছাড়ানো কঠিন।
ছাড়ানোর প্রয়োজন কী?
বাস্তবতা। বাস্তবতা ছাড়তে বাধ্য করে সব বাঁধন। আপনিই তো বললেন, ডেভেলপাররা ওই বাড়ি অ্যাপার্টমেন্ট বানিয়ে ফেলবে। এটাই বাস্তবতা। নিষ্ঠুর বাস্তবতা গুঁড়িয়ে দেবে সুন্দর বাড়িটা।
গুঁড়িয়ে দেওয়ার কথাটা এমন জোরালোভাবে বলল কেন স্নেহা? প্রশ্ন এল রাহুলের মনে। উত্তর খোঁজার জন্য শূন্য চোখে তাকাল তার মুখের দিকে। মায়ায় পূর্ণ হয়ে উঠল না, শূন্য হতে লাগল চোখ, এমন কঠিন অভিব্যক্তি দেখে হোঁচট খেল রাহুল।
হঠাৎ ব্যালকনিতে এল কুসুম।
কী রে, কখন এলি চুপিচুপি, ব্যালকনিতে? এমন স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছিস কেন? স্নেহাকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করল কুসুম।
এ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থেকে কুসুমের উচ্ছ্বাসের সঙ্গে তাল না মিলিয়ে বলল, আজ ভোর থেকে ভালো বোধ করছেন তিনি।
কথাটা লুফে নিয়ে রাহুল বলল, সকাল থেকে ভালো বোধ করছিলাম। মেহমান আসার পর আরও বেশি ভালো লাগছে। এখন জ্বর-জ্বর লাগছে।
বলো কি! বলেই কপালে হাত দিল কুসুম। হ্যাঁ। তাই তো! জ্বর-জ্বর লাগছে! ডাক্তারকে জানাতে হবে। জ্বর আসলে জানাতে বলেছেন।
ভেতরের অনিয়ন্ত্রিত তাড়না সামাল দিতে না পেরে স্নেহাও চট করে হাত রাখল রাহুলের কপালে।
চোখ বুজে ফেলল রাহুল। অসাধারণ অনুরণন জেগে উঠল দেহে। ওর পুরো সত্তায় কাঁপন উঠল। নড়ে উঠল বুকের ঘরে জমে ওঠা মায়ার পাহাড়।
স্নেহা বলল, কই জ্বর তো নেই!
কুসুম বলল, তোর হাতের ছোঁয়া লাগলে কি জ্বর থাকবে? পালাবে না? পালিয়েছে বোধ হয়। বলতে বলতে আবার কপালে হাত দিয়ে চমকে উঠল। তাই তো! শরীর এমন ঠান্ডা হয়ে গেল কেন? জ্বর উধাও হয়ে গেল কেন? কুসুমের বিস্ময় কাটে না।
রাহুল কথা বলছে না। চোখ খুলছে না। অভূতপূর্ব অনুভূতি নিয়ে বসে আছে চুপচাপ। মায়ার জালে জড়াতে লাগল দেহের অণু-পরমাণু, ডিএনএর ঘরে মায়ার ঝড় শুরু হয়ে গেছে। এই ঝড়ের খবর টের পেয়ে গেল স্নেহা।
নিজেকে সামলে বলল, চোখ খুলুন।
চোখ খুলল রাহুল। দেখল কুসুম চলে গেছে ভেতরের ঘরে।
শুনুন, আমাকে মুগ্ধ করার প্রয়োজন নেই। সহজে মুগ্ধ হই না আমি।
ধারালো কথা শুনে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল রাহুল। বুঝে গেল মুগ্ধ হই না বললেও মোহিত হয়ে বসে আছে স্নেহা। ভেতরের অনুভূতির সঙ্গে বাইরের প্রকাশভঙ্গির পার্থক্যটা ধরতে পারল। কথার জবাব না দিয়ে অপলক তাকিয়ে রইল স্নেহার দিকে।
অমন করে তাকাবেন না তো!
কেন? তাকালে কী হয়?
মনে হচ্ছে আপনার চোখ লেগে যাচ্ছে শরীরে।
লাগুক না। ক্ষতি কী?
ক্ষতি আছে।
কী ক্ষতি?
এখন ক্ষতি টের পাবেন না। পরে পাবেন।
কখন টের পাব?
বেঙ্গালুরু যাব আমি। সেখানে দেখা হলে টের পাবেন।
বেঙ্গালুরু যাবেন আপনি?
হুঁ। যাওয়া লাগবে। নিমহ্যান্সে যাব চেক করাতে।
অবশ্যই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। আমার ইন্ডিয়ার সিমের ফোন নম্বরটা লিখে নিন, প্লিজ।
এটাই চাচ্ছিল স্নেহা। রাহুল বলতে লাগল। নিজের মোবাইলে নম্বরটা স্টোর করে নিল স্নেহা।
মাকে নিয়ে বেঙ্গালুরু যাবে স্নেহা, সত্য। চেক করানোর কথাও সত্য। রাহুল বুঝতে পারল না স্নেহা নিজেকে চেক করানোর কথা বলে দিয়েছে। সত্যটা বলেছে। ঘোরের মধ্যে থাকার কারণে সূত্রটা টের পায় নি। তার অন্তর আকাশে উড়তে শুরু করল লাল-নীল ঘুড়ি। রাহুলের মনে হলো অসীম আকাশটা এখন হাতের মুঠোয় বন্দি।
চার
বাংলাদেশ বিমানে ঢাকা থেকে কলকাতা নেতাজি সুভাষচন্দ্র ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে নামল স্নেহা, ওর মা ও ছোট মামা। বাবা আসবেন দুদিন পর। এটাই স্বস্তি। বাবার আতঙ্কিত চোখ সইতে পারে না স্নেহা। শক্ত আছেন মা। ছোট মামার কথার জোরে শক্তি ফিরে পেয়েছেন তিনি।
এক ট্রলিতে তিনটা লাগেজ নিয়ে বেরিয়ে আসছে সবাই। ছোট মামা ট্রলি ঠেলছে। স্নেহা ও ওর মা হাঁটছেন সঙ্গে।
একটি ছেলে ছুটে এসে শুদ্ধ বাংলায় বলল, আমি বাংলাদেশের। এখানে এসে কষ্টে আছি। বাংলাদেশি দশ টাকার একটা নোট পেলে খুশি হব। ট্রলি ঠেলে নিচ্ছি আমি। ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে ডোমেস্টিক এয়ারপোর্ট। পূর্ব দিকে আসতে হয় বেশ খানিকটা পথ। মনে হচ্ছে ওই তো ওখানে… পথ ফুরোয় না।
ছেলেটিকে উদ্দেশ্য করে স্নেহা বলল, বাংলাদেশি ছেলে এখানে ভিক্ষা করছ? দেশের সম্মান ডুবে যায়, বোঝো না?
ভিক্ষা করছি না আপু। কাজ করে পয়সা চাচ্ছি।
ওই হলো। এটাই ভিক্ষা। ট্রলি ঠেলাটা এয়ারপোর্টের যাত্রীদের কাজ। শ্রমিক লাগে না এখানে। দেশের কথা বলে ভিক্ষা করছ তুমি। ভিক্ষা করবে কলো। ভবিষ্যতে দেশের নাম উচ্চারণ কোরো না। নাও। দশ টাকা নাও। পথ ছাড় এখন।
টাকা পাওয়ার পর উধাও হয়ে গেল ছেলেটি। আরেকজন যাত্রী ধরার জন্য ছুট দিল। মন খারাপ হয়ে গেল স্নেহার। ছেলেটিকে বকা দিতে হয়েছে, এজন্য বেশি খারাপ লেগেছে। বকা না দিয়েও উপায় নেই। পরদেশে এভাবে দেশের নাম বিকোয় কেউ?
কিছুক্ষণের মধ্যে অভ্যন্তরীণ এয়ারপোর্টে চলে এল ওরা। জেট এয়ারওয়েজের টিকিট কাটা আছে। দুই ঘণ্টারও বেশি দেরি আছে এখনো, ইন্টারকানেকটিং টিকিট কাটা। এয়ারপোর্টের লবিতে বসে চারপাশ দেখতে লাগল স্নেহা। কলকাতার ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে অভ্যন্তরীণ এয়ারপোর্ট অনেক বড়, অনেক বেশি সুন্দরজমজমাট। বেশি ব্যস্ততা এই রুটে।
লবিতে বসে অপেক্ষা করছে স্নেহা, আর ভাবছে কত উন্নত হয়েছে অভ্যন্তরীণ এয়ারপোর্ট। কিছুক্ষণ ঘুরল এদিক-ওদিক। মামা বসে আছেন ট্রলি নিয়ে।
নির্দিষ্ট সময় চেক ইন সেরে ওরা উঠে গেল জেট এয়ারওয়েজের এয়ারবাসে। কী বিশাল বিমান! বাংলাদেশ বিমানের মুড়ির টিনের চেয়ে হাজার গুণ ভালো। এয়ার হোস্টেজ ঘোষণা দিচ্ছেন। এ কি! কলকাতা এয়ারপোর্ট থেকে ছাড়ছে অথচ বাংলায় কোনো ঘোষণা নেই। হিন্দি ও ইংরেজি ঘোষণা দিয়ে শেষ। বাংলায় বলবে না ওরা?
পাশে বসে আছে একটি বাঙালি ছেলে। সেও যাচ্ছে বেঙ্গালুরু। বলল, দিদি ওরা বাংলা বলবে না।
প্রতিবাদ করেন না?
প্রতিবাদ করে কী হবে দিদি? বাংলা নিয়ে পড়ে থাকলে চলবে কলকাতাবাসীদের? এ দেশে অসংখ্য ভাষাভাষীর মানুষ রয়েছে। বাংলার ভূত চেপে থাকলে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকব না আমরা।
তাই বলে বাংলাকে বিসর্জন দেবেন?
বিসর্জন দিচ্ছি না, দিদি। ঘরে বাংলা বলি আমরা। কলকাতা থেকে বেরোলে আর বাংলা বলা হয় না।
শুনে মন খারাপ হয়ে গেল। ভিক্ষুক ছেলেটির কারণে মন খারাপ হয়েছিল দেশের জন্য, বিমানে উঠে মন খারাপ হয়েছে ভাষার জন্য। হায় আমার বাংলা ভাষা! এটাই কি আন্তর্জাতিক ভাষার সম্মান?
দেশের জন্য মায়া লাগছে, ভাষার জন্য মায়া লাগছে, বাবার জন্য মায়া লাগছে! মা সঙ্গে আছেন। মার জন্য আলাদা মায়া টের পাচ্ছে না। চুপ হয়ে গেল মন। নিঝুম মনের অচেনা খোপ থেকে আরেক ধরনের মায়া জাগছে। মাধবীলতার মতো সে মায়া জড়িয়ে আছে পুরো দেহ। মন ভরে আছে গোপন এক ঐশ্বর্যে। কী? জানে না স্নেহা। এটুকু বোঝেওই ঐশ্বর্য টানছে তাকে, টানছে রাহুলের দিকে। রাহুলের মায়াবী মুখটা ভেসে উঠছে চোখের পর্দায়। ওকে দেখতে ইচ্ছা করছে। কেন এমন ইচ্ছা জাগে, তাও জানে না স্নেহা।
পাঁচ
ছোট মামার মুখ গম্ভীর। নিমহ্যান্সে নিউরোসার্জারি বিভাগে চেকআপ করানোর পর মুখের ওপর চেপে বসেছে কালো পর্দা। টের পায় নি স্নেহার মা। তিনি স্বাভাবিক আছেন। স্বাভাবিকভাবে চলছেন। কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসেছেন বারান্দায়। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখছেন নিমহ্যান্সের রূপ।
বুদ্ধিমতী স্নেহা চুপচাপ তাকিয়ে থাকে মামার মুখের দিকে। তিনি তাকাতে পারছেন না ভাগ্নির চোখের দিকে।
স্নেহা ডাকল, ছোট মামা!
মামা অন্য জগৎ থেকে যেন ফিরলেন এইমাত্র।
কথা বলছ না কেন তুমি? মুখ এমন কালো কেন? সব কি শেষ?
উচ্ছল মামা বিকৃত একটা হাসি দিয়ে বললেন, এই তো কথা বলছি।
হাসতেও ভুলে গেছ। ভালো করে হাসো। ধমক দিল স্নেহা।
মামা স্বীকার করলেন, হাসতে পারছি না।
আমি জানি, কেন হাসতে পারছ না।
কী জানো?
আমি তো বাঁচব না, অবস্থা খারাপ, তাই না?
না। খারাপ না। কে বলেছে তোমাকে। আজই অপারেশন করতে যাচ্ছে ওরা। মেডিকেল বোর্ড এ ডিসিশন দিয়েছে। তোমার বাবা কাল আসবে।
অপারেশন করে লাভ হবে না, তাই না, মামা?
চিৎকার করে বলল, বাজে বকো না। লাভ হবে না মানে? অবশ্যই হবে। ভালো হয়ে উঠবে তুমি। বলতে বলতে প্রায় কেঁদে ফেললেন ছোট মামা।
শোনো, তুমি কেঁদো না। তুমি কাঁদলে মাও কাঁদবে। আমিও কাঁদব। মায়ের কান্না দেখতে চাই না আমি। বাবার কান্নাও দেখতে চাই না। অপারেশন করার জন্য রাজি হয়ে যাও আজই।
বলো কি! তোমার বাবার জন্য অপেক্ষা করব না?
না। বাবার কষ্ট সইতে পারব না।
কী করব এখন?
রাজি হয়ে যাও। মাকে দিয়ে কনসেন্ট ফর্ম সই করিয়ে নাও।
ছোট মামা ফ্যালফ্যাল করে তাকালেন ওর মুখের দিকে।
এভাবে তাকিয়ো না। নাও। নম্বরটা নাও। নিমহ্যান্সে আমার এক বন্ধু থাকে। রাহুল ওর নাম। ওকে একটু কল করব আমি। ব্যবস্থা করো।
বেঙ্গালুরু এসে মামা একটা সিম কিনেছিলেন। সেই সিম থেকে রাহুলকে কল করল স্নেহা। মোবাইল ফোন বন্ধ। সংযোগ দেওয়া যচ্ছে না।
পাহাড়সমান কষ্ট এসে চেপে বসল স্নেহার বুকে। আবার চেষ্টা করে দেখল মোবাইল বন্ধ।
একটা মেসেজ লিখল : আমি নিমহ্যান্সে। রুম নম্বর-৩০৮। নিউরোসার্জারি বিভাগ। আজ বিকেল দুটায় অপারেশন। আপনি আসবেন? কাছে থাকলে সাহস পেতাম-স্নেহা।
ছয়
ক্লাসে ছিল রাহুল। ক্লাসে থাকলে অফ রাখতে হয় মোবাইল। ক্লাশ শেষে বাইরে এসে মোবাইল অন করার সঙ্গে সঙ্গে মেসেজটি ভেসে উঠল স্ক্রিনে।
দ্রিম করে কেঁপে উঠল বুক। এত কাছে স্নেহা! অপারেশন দুপুর দুটোয়। এখন বাজে দেড়টা। কিছুই ভাবার সুযোগ পেল না আর। নিউরোমেডিসিন থেকে নিউরোসার্জারি বিভাগ। দূরত্ব খুব কম। একছুটে চলে এল তিনতলায় ৩০৮ নম্বর কেবিনের সামনে। কেবিন বন্ধ। মাথায় বাজ পড়ল। সিস্টারদের কক্ষে ছুটে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, সিস্টার, হোয়ার ইজ পেশেন্ট অব রুম নম্বর থ্রি জিরো এইট?
অপারেশন থিয়েটার। ছোট্ট করে জবাব দিল নার্স।
ছুটে গেল সে ওটিতে। বাইরের লবিতে অপেক্ষা করছেন অনেক অভিভাবক।
রাহুল একজনকে প্রশ্ন করল, ইজ দেয়ার এনি বডি ফ্রম বাংলাদেশ?
ছোট মামা এগিয়ে এসে বললেন, আমি স্নেহার ছোট মামা। আপনার নাম কি রাহুল?
জি। আমি রাহুল। খালাম্মা কোথায়? স্নেহা কোথায়?
এই যে আপনার খালাম্মা। পাশে বসা স্নেহার মাকে দেখিয়ে দিলেন ছোট মামা।
ওটিতে থাকার কথা না আপনার? স্নেহা কোথায়? রাহুল প্রশ্ন করল।
অপারেশন স্নেহার। আমার তো কোনো অসুখ নেই, বাবা।
ভূকম্পনের মতো কেঁপে উঠল রাহুল। আবারও বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করল, স্নেহার অপারেশন?
হ্যাঁ বাবা, স্নেহার অপারেশন।
দু হাতের মুঠি শক্ত করে ধরে নিজেকে সামলাল রাহুল। তারপর ছুটে গেল ওটি ইনচার্জের কক্ষে।
আই অ্যাম এ স্টুডেন্ট অব নিউরোমেডিসিন, এমডি-ফাইনাল ইয়ার। মাই কাজিন ইজ ইনসাইড ওটি। আই ওয়ান্ট টু স্টে ইউথ পেশেন্ট।
প্লিজ ইউ টেক পারমিশন ফ্রম কনসালট্যান্ট। পেশেন্ট ইজ নাউ অন প্রি-অপারেটিভ প্রসিডিউর।
হাউ ক্যান আই গেট পারমিশন?
ওয়েট। বলে সিস্টার ইনচার্জ কল করলেন ইন্টারকমে। কিছুক্ষণ কথা বলার পর রাহুলকে উদ্দেশ্য করে বললেন, প্লিজ গো টু ড্রেসিং রুম। টেক ড্রেসিং অ্যান্ড গো ইনসাইড।
যাওয়ার আগে ৩০৮ কেবিনের রোগীর ফাইলটা হাতে তুলে নিল রাহুল। ব্রেন ইমেজিং-এমআরআই রিপোর্ট পড়ার পর বুকের ভেতরে গগনবিদারী এক চিৎকার ভেসে এল। বাইরে শোনা গেল না সেই চিৎকার। কেবল তা ভেঙেচুরে গুঁড়িয়ে দিল রাহুলকে। জীবনবিধ্বংসী ম্যালিগনেন্ট টিউমার! রেপিডলি গ্রোয়িং!
শক্ত হয়ে ড্রেসিং রুমে গিয়ে ওটিতে ঢোকার পোশাক পরে নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল রাহুল। মাস্কটি রাখল হাতে।
টেবিলে শুয়ে আছে স্নেহা। প্রি-অ্যানেসথেটিক প্রসিডিউর প্রস্তুত। এখনো ইনজেকশন পুশ করা হয়নি। চোখ খোলা স্নেহার। নিজেকে শক্ত করে রাহুল দাঁড়াল সামনে। কেঁপে উঠল স্নেহার চোখ। রাহুলকে দেখে শান্তিতে চোখ বুজে কিছুক্ষণ পর আবার চোখ খুলে তাকাল। চোখ হেসে উঠল। হাত বাঁধা। ডান হাতের আঙুলগুলো নাড়িয়ে ইশারা করল রাহুলকে। একটু এগিয়ে এসে রাহুল ধরল স্নেহার হাতের আঙুল। শান্তিতে আবার চোখ বুঝল স্নেহা। রাহুল মনে মনে বলল, ফিরে তোমাকে আসতেই হবে, স্নেহা। তোমাকে কোথাও যেতে দেব না।
চোখ বেয়ে নেমে এল জলধারা। হাতের উল্টো পিঠে রাহুল মুছে নিল লোনাজল। ওই চোখ থেকে এখন বেরোচ্ছে আলো। আলো ছুঁয়ে যাচ্ছে স্নেহার মন। সেই আলোয় স্নেহা দেখছে… কেবল রাহুলকেই দেখছে। মনে হচ্ছে যেভাবে মাধবীলতা জড়িয়ে রাখে কংক্রিটের দেয়াল, রাহুলও একই রকম মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে রেখেছে তাকে… অনন্তকাল জড়িয়ে রাখবে এভাবে। (সমাপ্ত)
মোহিত কামাল, সম্পাদক, শব্দঘর




