এখন সময়:রাত ৮:৩৯- আজ: শুক্রবার-৭ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-২২শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-হেমন্তকাল

এখন সময়:রাত ৮:৩৯- আজ: শুক্রবার
৭ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-২২শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-হেমন্তকাল

আমেরিকায় রবীন্দ্রনাথ 

প্রবীর বিকাশ সরকার

১৯২৯ সালে বহির্বিশ্বে অবস্থানকালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনে ঘটেছে যুগপৎ দুঃখজনক এবং আনন্দদায়ক কিছু ঘটনা। যা নিয়ে বাংলায় সামান্যই আলোচনা হয়েছে, অথবা আদৌ হয়নি। কী সেই ঘটনা? এই বিষয়েই এই নিবন্ধ লেখার চেষ্টা।

১৯২৯ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কি আমেরিকায় দুবার দুর্ব্যবহার বা অবমাননার শিকার হয়েছিলেন? একবারের কথা জানা যায় জাপানশীর্ষ রবীন্দ্রগবেষক দেশিকোত্তম কাজুও আজুমার একটি প্রবন্ধে। “রবীন্দ্রনাথের পঞ্চমবার জাপান ভ্রমণ” শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন,

“তাঁর (রবীন্দ্রনাথের) প্রথম থেকে চতুর্থবার জাপান ভ্রমণ থেকে এই পঞ্চমবার ভ্রমণের পটভূমিকা ও বৈশিষ্ট্য একেবারে আলাদা। রবীন্দ্রনাখ কানাডা যাওয়ার পথে ১৯২৯ সালে চতুর্থবার মার্চ ২২ থেকে ২৮ তারিখ পর্যন্ত জাপানে ছিলেন। সেবার তিনি কানাডার জাতীয় শিক্ষা পরিষদের ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন শিক্ষা সম্পর্কে বক্তৃতা দেবার জন্য।

এপ্রিল মাসের ৬ তারিখে ভিক্টোরিয়া সমুদ্রবন্দরে পৌঁছুলেন। সেখানে তিনি অবসর তত্ত্ব (Philosophy of Leisure) বিষয়ক বক্তৃতা দিয়েছিলেন। পরের দিন ৭ তারিখে তিনি ভ্যান্কুভার পৌঁছুলেন। ৯ তারিখে সাহিত্যের দর্শন (Philosophy of Literature)  শীর্ষক ভাষণ দিয়েছিলেন। সেখানে কানাডার বুদ্ধিজীবী ছাড়াও বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি এবং বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষার্থীরাও উপস্থিত ছিলেন। ফলে ঐ দেশের নানা জায়গা থেকে কবির কাছে বহু নিমন্ত্রণ এসেছিল। ভ্যান্কুভার থেকে ফেরার পথে তিনি লস্এঞ্জেলেসে এপ্রিল মাসের ১৮ তারিখে পৌঁছুলেন। সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দেবার পর তিনি আরও পূর্বদিকে চলছিলেন। কিন্তু এই সময় অপ্রত্যাশিতভাবে এক দুঃখজনক ঘটনা ঘটে। কবি তাঁর পাসপোর্ট হারিয়ে ফেলেন। কোথাও খুঁজে না পেয়ে অবশেষে নতুন পাসপোর্ট পাওয়ার জন্য পাসপোর্ট অফিসে যান। সেখানে পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তাদের অহেতুক অসম্মানজনক কথাবার্তা ও আচরণে কবি অত্যন্ত মনঃক্ষুণ্ন হন।

এই ঘটনায় তিনি বিরক্ত হয়ে কোনো প্রকার প্রতিবাদ না করেই অকস্মাৎ লস্এঞ্জেলস ত্যাগ করে জাপান অভিমুখে রওয়ানা দেন। সে সময় এশিয়ানদের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন আইনে জাতিভেদ বিদ্যমান ছিল। এই ঘটনায় তাঁর অসীম ধৈর্যশীলতা ও আত্মসংযমবোধ এশিয়াবাসীদের মর্যাদা ও মানবতাবাদকেই ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছিল। কাজেই বলা যায় নোবেল পুরস্কারপ্রপ্ত কবি সত্যিই একজন মহামানব ছিলেন।”

কবিগুরুর আমেরিকায় অপদস্ত হওয়ার এই দুঃখজনক সংবাদ জাপানের তৎকালীন প্রায় সকল প্রভাবশালী সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল। ফলে ব্যাপক সাড়া পড়েছিল কবির ভক্তদের মধ্যে। কেননা ১৯১৩ সালে এশিয়া মহাদেশে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্যে প্রথম নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত হওয়ায় জাপানে জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করছিলেন। বলা যায় আইকনে পরিণত হয়েছিলেন। কিছুতেই তারা কবিগুরুর এই অপমান মেনে নিতে পারেননি। আমেরিকায় এশিয়ানদের প্রতি এই আচরণে জাপানিরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন। তাদের মধ্যে একদল উগ্র জাতীয়তাবাদী নাগরিক এই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদস্বরূপ এক অভূতপূর্ব ঘটনার জন্ম দেন। রাজধানী টোকিও থেকে ১০০ মাইল দূরে অবস্থিত ইবারাকি প্রদেশের নাগরিক এবং  দলনেতা হোমমা কেন্ইচিরোও কবির প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করেন এবং প্রশান্ত মহাসাগরে তাইয়োওমারু নামক জাপানি জাহাজে অবস্থানরত রবীন্দ্রনাথ সেই সংবাদ অবহিত হন। গভীর মনোবেদনায় অবসন্ন কবিগুরু জাহাজে বসে মে মাসের ৩ তারিখে একটি কবিতা লেখেন ইংরেজিতে। ুঅ ডবধৎু চরষমৎরস” নামক কবিতাটি পরে জাপানি ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন কবির আজীবন ভক্ত মাদাম ড.ওয়াদা তোমিকো তথা কোওরা তোমিকো। মাদাম কোওরাকে তারবার্তা পাঠিয়ে কবিগুরু পুনরায় জাপানে বিরতি নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। অথচ ক্লান্ত-শ্রান্ত দেহমনে তাঁর জন্মভূমি ভারতে ফিরে যাওয়াই ছিল উত্তম। বয়সও হয়েছে, তখন তিনি ৬৮ এবং শারীরিক অবস্থা স্বস্তিকর নয়। সেই সময় তাঁর যথার্থ চিকিৎসা ও সেবাগ্রহণ জরুরি ছিল।

এই প্রসঙ্গে প্রশ্ন জাগে যে, আমেরিকায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের এতবড় অপ্রীতিকর ঘটনার সংবাদ কি আমেরিকায় অবস্থিত বাঙালিদের কানে পৌঁছায়নি? কিংবা ভারতে? ভারতের কোনো সংবাদপত্রে কি এই ঘটনার সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল? প্রতিবাদ করেছিলেন কোনো বিশিষ্ট বাঙালি বা ভারতীয় নাগরিক? কবিগুরুর জাপান থেকে ফিরে যাওয়ার পর কোনো প্রতিবাদ সভার কি আয়োজন হয়েছিল বাংলা প্রদেশে? সেসব আমার জানা নেই। তবে তাঁর এই মানসিক বিপর্যয় থেকে পরিত্রাণ পেতে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে জাপানকেই স্মরণ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ কি বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর নির্বিঘ্ন বিশ্রাম এবং মানসিক শান্তির দেশটি জাপানই? এর আগের চারবার (১৯১৬, ১৯১৭, ১৯২৪ এবং ১৯২৯) জাপান ভ্রমণ তাঁকে নির্মল শান্তি ও অপার ভালোবাসায় হিমালয়সমান সম্মানিত করেছে। এবারও তিনি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পথে জাপানে কিছুদিন অবস্থান করতে চান এবং তাঁর এই আবেদন জাপানের জন্যও পরম শ্লাঘার বিষয়। কবিগুরু জাপানে পুনর্বার আসতে আগ্রহী এই সংবাদ ব্যাপক সাড়া ফেলে তাঁর ভক্তদের মধ্যে এবং ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন তাঁরা। জাপানের বিভিন্ন স্তরের অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তিরাই কবিগুরুর একনিষ্ঠ ভক্ত ও বন্ধু ছিলেন তাঁর জীবদ্দশায়।

এই সংবাদ জাপানপ্রবাসী ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে সংক্রিয় মহাবিপ্লবী রাসবিহারী বসুর কাছেও পৌঁছায়। গুরুদেবের বিশ্রামের উপযুক্ত একটি বাসস্থান খুঁজে বের করার দায়িত্ব পড়ে তাঁর ওপর। জাপানে কবিগুরুর সঙ্গে একাধিকবার সাক্ষাৎকারী রাসবিহারী বসু তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু শিল্পপতি কাগজ ব্যবসায়ী, শিক্ষাবিদ এবং আধ্যাত্মিক সংস্কৃতি গবেষক ড.ওওকুরা কুনিহিকোকে অনুরোধ জানান কবিগুরুকে তাঁর বাসভবনে আতিথ্য দেবার জন্য। তাঁর অনুরোধে ড. কুনিহিকো সানন্দে রাজি হন। তিনি এশিয়া মহাদেশে সাহিত্যে প্রথম নোবেল শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম জানতেন, এও মনে হতে পারে তিনি জানতেন রাসবিহারীর মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ তাঁর গ্রন্থ ুঞযড়ঁমযঃং” বা চিন্তা পাঠ করে থাকবেন। কালবিলম্ব না করে ড.কুনিহিকো কবিগুরুকে টোকিওস্থ মেগুরো শহরে অবস্থিত তাঁর সুপরিসর নান্দনিক বাসভবনে আমন্ত্রণ জানান।

কবিগুরু ১০ মে জাপানের য়োকোহামা বন্দরে পৌঁছলেন। সেইদিনই রাজধানী টোকিওর সবচেয়ে অভিজাত ইম্পেরিয়াল হোটেলে অতিথি হন। তিনি টোকিওতে পদার্পণ করা মাত্রই বিভিন্ন কাগজের সাংবাদিক যেমন পিছু নেন, তেমনি অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি, সংগঠনের প্রধান তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করা ও বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন করার জন্য ভীড় জমান। কিন্তু কবিগুরু শারীরিক অসুস্থতার কারণে প্রাথমিকভাবে অপারগতা প্রকাশ করেন।

সেদিন অনেককেই হোটেলের কক্ষে প্রবেশ করতে দেয়নি কর্তৃপক্ষ। এদের মধ্যে ইবারাকি প্রদেশ থেকে ছুটে যাওয়া উক্ত জাতীয়তাবাদী নেতা হোমমার দলটিও ছিল। দলের প্রতিনিধি শ্রীযুক্ত নাগাই নামক এক ব্যক্তি জোর করে প্রবেশ করতে চাইলে দোভাষী মাদাম ড.কোওরা তোমি মধ্যস্থতা করে নাগাই মহাশয়কে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেন। নাগাই মহাশয় রবীন্দ্রনাথের চেহারা ও দৈহিক সৌন্দর্য দেখে অত্যন্ত মুগ্ধ হন। নাগাই মহাশয় জানান যে, তারা ইবারাকি প্রদেশের মিতো নামক একটি ঐতিহাসিক স্থানে কবিকে সংবর্ধনা জানানোর জন্য একটি সভার আয়োজন করে ফেলেছেন। কবিকে যেতেই হবে, কারণ তিনি উপস্থিত থাকবেন বলে জাহাজে থাকতেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কবিকে সসম্মানে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। সেখানে কবিগুরুকে আমেরিকা কর্তৃক অসম্মানের জোরালো প্রতিবাদ করা হবে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সেই আমন্ত্রণকে সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করে দলপ্রধান হোমমা কেন্ইচিরোও এবং স্থানীয় অধিবাসীদের উদ্দেশে নমস্কার জানিয়ে একটি বাণী লিখে দেন। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয় না। বাণী দেখে অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হয়ে হোমমা কেন্ইচিরোও তাঁর এক শিষ্য নুমাজিরি হিরোশিকে সঙ্গে নিয়ে টোকিওতে আগমন করেন।

এই প্রসঙ্গে গবেষক কাজুও আজুমা জানান, “(হোমমা) পৌঁছেই হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, “আজকের খবরের কাগজে রবীন্দ্রনাথ আসাহি শিম্বুন সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পরিষদের সভাতে উপস্থিত থাকবেন বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। টোকিওতে বক্তৃতা সম্ভব হলে মিতো শহরে সম্ভব নয়–এটা হতেই পারে না। সত্যিই যদি তাঁর শরীর খারাপ হয়ে থাকে তাহলে টোকিওতেও বক্তৃতাসভা বন্ধ করাটাই হবে রবীন্দ্রনাথের প্রতি যথার্থ ভদ্রতা প্রদর্শন। টোকিওতে সভা করতে পারলে অবশ্যই মিতোতেও আমরা করতে পারব। মিতোতে যদি বক্তৃতা না হয় তাহলে আমরা টোকিওর বক্তৃতাসভাও ভেঙ্গে দেব। রবীন্দ্রনাথ প্রাচ্যের কবি, প্রাচ্যের রত্ন। আমিও একজন জাপানি নাগরিক। ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্বের মধ্যে পারস্পরিক উঁচু-নিচুর ভেদাভেদ থাকা অনুচিত। পুরুষ হলে সে পুরুষের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করাই কর্তব্য। কবির মিতো যাওয়া বন্ধ করা সম্ভবত কবির সত্যিকারের ইচ্ছে নয়। তাঁকে সেখানে যেতে বাধা দেওয়ার চক্রান্ত, সব বন্ধ করব।”

“অবশেষে হোমমার দলকে, দলের সদস্যদেরকে বুঝিয়েসুজিয়ে মিতোতে কবির বক্তৃতা প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আর সেটা সম্ভব হয়েছিল একমাত্র তাঁর অপরিসীম ঐকান্তিক উৎসাহের কারণে। নুমাজিরি জানাচ্ছেন, হোমমা আগের রাত থেকে খাদ্যগ্রহণ না করে উপোস থেকে বলেছিলেন, “যদি বাধা আসে, দুতিনজনকে তরবারি দিয়ে মারব এবং মেরে শেষে আত্মহত্যা করব”–এই সংকল্প নিয়েই টোকিও গিয়েছিলেন।”

“জাপানে থাকতেই সত্যি সত্যি রবীন্দ্রনাথের শরীর খারাপ হয়ে পড়েছিল। কিন্তু শরীর অত্যন্ত ভেঙে যাওয়া সত্ত্বেও তিনি মিতোতে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করলেন। হোমমা দরিদ্র হলেও ট্রেনের একটি কেবিন পুরোটা রবীন্দ্রনাথের জন্য ভাড়া করেছিলেন ঋণ করে। মিতো শহরে অবস্থিত মিতো প্রাইমারি বালিকা বিদ্যালয়ে রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতাসভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল।”

“সভায় রবীন্দ্রনাথ বললেন, “মিতো এমন একটি ঐতিহাসিক শহর জানতাম না। তা হলে প্রথমেই এখানে আসতাম। আমার প্রিয় বন্ধুরা, আমি যখন তরুণ ছিলাম, যখন গলার স্বর ছিল জোরালো, শরীরে তেজ ছিল প্রবল, সেই সময় আপনাদের কাছে আসতে পারলে ভালো হত বলে অনুভব করছি। এবং এই জায়গাতে উদ্বেলিত আপনাদের আত্মাকে নমস্কার জানাতে পারলে, আমার সত্যাদর্শকে উপস্থিত করতে পারলে আরও ভালো হত এখন ভাবছি।”

“আমি এখানে আসার পথে এই অঞ্চলের ইতিহাস শুনে এসেছি। এখানকার সাহসী মহামানুষের আবির্ভাব সম্বন্ধে নানা কাহিনী জানতে পারলাম। তাঁদের আত্মার প্রেরণার কারণেই এইখানে উপস্থিত হতে পেরেছি বলে মনে করছি। যা আমাকে পরম আনন্দ দিয়েছে।”

“বর্তমান বিশ্বে যেসব তীর্থস্থান রয়েছে, যেখানে মহাপুরুষদের আত্মরা নিভৃতে বিরাজিত, মানুষ সেসব ভ্রমণ করে সেখানকার লোকেদের কাছে আমাদের বার্তাকে বহন করে পৌঁছে দিচ্ছে। জাপানের মহাত্মাদের সত্যিকারের মহাপ্রাসাদ এই মিতোতে রয়েছে। তা জানতে পেরে আমার মন আনন্দে ভরে উঠল।”

মিতোতে রবীন্দ্রনাথ প্রদত্ত নাতিদীর্ঘ বক্তৃতাটি ইবারাকি প্রদেশের জোয়োশি শিম্বুন পত্রিকায় ১৯২৯ সালের ১৩ জুন তারিখে প্রকাশিত হয়েছিল। যার বাংলা অনুবাদ করেছেন রবীন্দ্রগবেষক কাজুও আজুমা। ইবারাকি প্রদেশের মিতো যেমন রবীন্দ্রস্মৃতিবিজড়িত তীর্থস্থান, তেমনি এই প্রদেশেরই আরেকটি স্থান দুজন মহৎ মানুষের তীর্থস্থান সেটি হল ইজুরা। যেখানে বহুশ্রুত রবীন্দ্রসুহৃদ মনীষী ওকাকুরা তেনশিনের বাসগৃহ ছিল। ১৯০২ সালে ব্রিটিশ-ভারতের রাজধানী কলিকাতায় ওকাকুরার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ গভীর বন্ধুত্বের বন্ধনে বাঁধা পড়েন। ১৯১৩ সালে ওকাকুরা প্রয়াত হন মাত্র ৫০ বছর বয়সে। রবীন্দ্রনাথ ১৯১৬ সালে প্রথম জাপান ভ্রমণের সময় আগস্ট মাসে প্রয়াত বন্ধুর পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ইজুরাতে এবং চারদিন অবস্থান করে ওকাকুরাকে স্মরণ করেন। এই ঘটনা যে প্রবল জাতীয়তাবাদী এবং প্রাচ্যভ্রাতৃত্ত্ববাদ তথা প্যান-এশিয়ানিজমের উদ্গাতা ওকাকুরার ভাবশিষ্য হোমমা কেন্ইচিরোও, শ্রী নাগাই এবং নুমাজিরি হিরোশিকে প্রভাবিত করেছিল তা বলাই বাহুল্য। হোমমা ছিলেন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতা এবং মিতো শহরস্থ দেশর্চচা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিযান জুকুর প্রধান শিক্ষক। শ্রী নাগাই ও নুমাজিরি ছিলেন হোমমার প্রধান দুই শিষ্য ও খ্যাতিমান জুদোও ক্রীড়াবিদ। যে জুদোও ক্রীড়াকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বন্ধু ওকাকুরার সহযোগিতায় শান্তিনিকেতনে প্রচলন করতে চেয়েছিলেন। ১৯০৫ সালে ওকাকুরার শিষ্য প্রসিদ্ধ জুদোও ক্রীড়াবিদ সানো জিননোসুকে প্রশিক্ষক হিসেবে শান্তিনিকেতনে গমন করেন এবং ক্রমশ হয়ে ওঠেন রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ১৯২৪ সালে যিনি মূল বাংলা থেকে কবিগুরুর সুদীর্ঘ গোরা উপন্যাসটি জাপানি ভাষায় অনুবাদ করে ইতিহাসে খ্যাত হয়ে আছেন।

বস্তুত, ১৯২৯ সালে রবীন্দ্রনাথের পঞ্চম তথা শেষ জাপানভ্রমণ সুদূরপ্রসারী এক ঐতিহাসিক ঘটনার জন্ম দিয়েছিল। আর সেটাই হচ্ছে ড.ওওকুরা কুনিহিকোর সঙ্গে সাক্ষাৎ। ১৯৬১ সালে জাপানে চার বছর ধরে নজিরবিহীন বিপুল পরিকল্পনাধীনে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষ উদযাপিত হয়েছিল, এই উপলক্ষে গঠিত হয়েছিল তাগো-রু কিনেনকাই অর্থাৎ টেগোর মেমোরিয়াল অ্যাসোসিয়েশন ১৯৫৮ সালে, যার প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন উক্ত ড.ওওকুরা কুনিহিকো। তিনি যেভাবে গভীর আগ্রহ নিয়ে বিচক্ষণ নেতৃত্বের সঙ্গে রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ উদযাপনের আয়োজন করেছিলেন তা এককথায় বিস্ময়কর! উল্লেখ্য যে, টোকিওর ইম্পেরিয়াল হোটেল থেকে দ্রুতই রবীন্দ্রনাথ ড.কুনিহিকোর বাসভবনে আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন। ড.কুনিহিকো দ্রুত কবির চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলেন। কবিকে সদা আনন্দময়, প্রাণবন্ত রাখার জন্য নানা আয়োজন করেছিলেন, ভ্রমণের ব্যবস্থা করেছিলেন, বক্তৃতার ব্যবস্থা করেছিলেন। পান-ভোজন-আপ্যায়নেও কোনো ত্রুটি রাখেননি।

তিন সপ্তাহের মতো কবিগুরু ড.কুনিহিকের বাসভবনে অবস্থান করেছিলেন। কুনিহিকোর উদার আতিথেয়তা ও পাণ্ডিত্যে অত্যন্ত মুগ্ধ হয়েছিলেন। কুনিহিকোও নোবেলবিজয়ী কবির সান্নিধ্য পেয়ে অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলেন যা তাঁর স্মৃতিলেখায় জানা যায়। তাঁর মননে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিলেন কবিগুরু। এই গভীর সম্পর্ককে চিরস্থায়ী করার জন্য ড.কুনিহিকো স্বরচিত গ্রন্থসহ জাপানের ইতিহাস, সংস্কৃতি, দর্শন, সাহিত্য, শিল্পকলাবিষয়ক মহাগ্রন্থাদি কবিকে উপহার প্রদান করেন। অনুরূপ, কবিও ভারতে ফিরে গিয়ে তাঁর রচিত বাংলা ও ইংরেজি গ্রন্থ ১৭০টি এবং একটি ভারতীয় নৌকোর মডেল প্রতি-উপহারস্বরূপ বন্ধু কুনিহিকোকে পাঠান ১৯৩১ সালে। যেগুলো আজও ড.কুনিহিকো প্রতিষ্ঠিত বন্দরনগরী য়োকোহামাস্থ নান্দনিক ওওকুরায়ামা কিনেনকান নামক স্মারক ভবনে সংরক্ষিত আছে।

আমেরিকায় রবীন্দ্রনাথের পাসপোর্ট হারিয়ে ফেলেছিলেন তাঁর ভ্রমণসঙ্গী ব্যক্তিগত সচিব অধ্যাপক অপূর্বকুমার চন্দ বলে কথিত আছে। পাসপোর্ট সংক্রান্ত অবমাননার সূত্র ধরে রবীন্দ্রনাথ জাপানে যে বিরল এক সম্মানলাভ করেছিলেন জাতীয়তাবাদীদের দ্বারা এই ঘটনা সংবাদপত্রের বড় শিরোনাম না হলেও তাঁর মননে যে গভীর রেখাপাত করেছিল তাঁর বক্তৃতায় সেটা ধরা পড়েছে।

০২.

সম্প্রতি এক নতুন তথ্য আবিষ্কারের পর প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, সেই একই বছর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমেরিকায় কি আরেকবার অবমানিত হয়েছিলেন? নাগাসাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও রবীন্দ্রভক্ত মিনে তাৎসুজি তাগো-রু তো য়ুতা.হোতেরু অর্থাৎ টেগোর এবং য়ুতা.হোটেল বিষয়ক নাতিদীর্ঘ স্মৃতিকথায় সেই তথ্য জাপানি ভাষায় লিপিবদ্ধ করেছেন। ১৯৬০ সালে নাগাসাকি টেগোর রিসার্চ সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত তাগো-রু মুখপত্রে প্রকাশিত সেই স্মৃতিকথার মূল অংশটুকু বাংলায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায়:

“১৯২৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আমি য়ুতা প্রদেশের রাজধানী সল্ট লেইক সিটিতে অবস্থিত য়ুতা প্রাদেশিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময়ের কথা বলছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে শহরের কেন্দ্রস্থলের দিকে তাকাতে চোখে পড়ল একটি ভবন। আমেরিকান এক ছাত্রকে ওটা কী জিজ্ঞেস করলে, “ওটা মার্বেল পাথরের তৈরি বিখ্যাত য়ুতা হোটেল। পাহাড়ের মাঝখান তো বটেই, মহানগরের কোথাও নেই এমন মুগ্ধকর ভবন, তাই বাড়ি ফেরার সময় দেখতে পারলে ভালো হবে” বলে অনুরোধ করল। আমি সঙ্গে সঙ্গে ভবনটির সামনে যাই এবং ভেতরটা দেখতে পাই। এমন সময় ভবনের ভেতর থেকে একজন জাপানি বেরিয়ে এলেন এবং আমাকে বললেন, “আমি এই হোটেলের কর্মচারী——রান্নাবান্না করি একজন কুক। তুমি তো ছাত্র, তাই না?” আরও বললেন, “ভবনের অভ্যন্তর দেখাব চলো। হোটেলের অভ্যন্তর ভাগের প্রতিটি কর্নার দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমার তাঁর কল্যাণে। তারপর সেই প্রাচুর্যের প্রশংসা করে বিদায় নেবার সময় জাপানি কুক “সত্যিই এ হোটেলটি প্রশংসাতুল্য। দোষের কিছুই নেই। কিন্তু সত্যিকথা বলতে, একটি বড় কলঙ্ক আছে। সেটা একবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমেরিকা কর্তৃক আমন্ত্রিত হয়ে বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতাসফরের মাঝখানে এই সল্ট লেইক শহরে আগমন এবং একরাত্রি এই হোটেলে অবস্থানের ইচ্ছে পোষণ করেন। সেই সময় কর্তৃপক্ষ “তুমি সংকর জাতির লোক তাই সদর দিয়ে প্রবেশ করা নিষেধ। পেছনের দরজা দিয়ে প্রবেশ করো” বলে নির্দেশ দিলে কবিগুরু তাৎক্ষণাৎ ক্ষুদ্ধ হয়ে দ্রুত জাপান হয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন” বলে জানান। এই ঘটনা শোনার পর নতুন ছাত্র হিসেবে আমি অন্যান্য ছাত্রদের সঙ্গে দুর্বল ইংরেজিতেই এই ঘটনাকে মানবতা ও সভ্যতাবিরোধী বলে আলোচনা করি। অনেকেই আমাকে সমর্থন করেন, এবং এদের মধ্যে বড় একটি অংশ ছিল সাংবাদপত্রশিক্ষা বিভাগের ছাত্র।”

অধ্যাপক মিনে তাৎসুজির কথা যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে বিশ্বনন্দিত নোবেলজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমেরিকায় দুবার অপদস্থ হয়েছিলেন বলে প্রতীয়মান হয়। রবীন্দ্রগবেষক কাজুও আজুমার ঘটনায় আমরা জানতে পারি যে, কবিগুরু ১৯২৯ সালে আমেরিকার অঙ্গরাজ্য ক্যালিফোর্নিয়ার লস্এঞ্জেলস শহরস্থ পাসপোর্ট অধিদপ্তরে অপদস্থ হয়েছিলেন। এর পর কবিগুরু কি সেখান থেকে য়ুতা প্রদেশে গিয়েছিলেন? সেখানেও কি তিনি দুর্ভাগ্যবশত য়ুতার অভিজাত সল্ট লেইক সিটি হোটেলে আরেক প্রস্ত অপমানিত হয়েছিলেন য়ুতা হোটেল কর্তৃপক্ষ দ্বারা? এর বেশি তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। দেশ-বিদেশে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবমানিত, অপদস্থ, প্রতারিত এমনকি ষড়যন্ত্রের শিকার হওয়ার ঘটনা কম নয় তাঁর জীবদ্দশায়! এই আমেরিকাতেই ১৯১৮ সালে বহুশ্রুত হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্র মামলার শিকার হয়েছিলেন স্বাধীনতাকামী গদর পার্টির সদস্যরা। তাঁদের তালিকায় ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে স্যার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও ফাঁসাতে চেয়েছিল প্রভাবশালী সানফ্রান্সিসকো আদালত। এই নিয়ে কবিগুরুকে কম দখল পোহাতে হয়নি! তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনকে পর্যন্ত চিঠি লিখতে হয়েছিল কবিকে!

 

তথ্যসূত্র:

রবীন্দ্রনাথের পঞ্চমবার জাপান ভ্রমণ/কাজুও আজুমা, আড্ডা টোকিও মুখপত্র, সংখ্যা ১, ২০০৫

তাগো-রু তো য়ুতা.হোতেরু/ মিনে তাৎসুজি, নাগাসাকি তাগো-রু কেনকিউকাই, ১৯৬০

টেগোর মেমোরিয়াল অ্যাসোসিয়েশন বুলেটিন-১, টোকিও, ১৯৫৯

https:/ww/w.academia.edu/9554036/Tagore_s_Crisis_in_America_An_Overviwe

 

আলোকচিত্র

১. আমেরিকায় রবীন্দ্রনাথ

২. আমেরিকায় রবীন্দ্রনাথ এবং উইলিয়াম উইনস্টাসলি পিয়ারসন

৩. রবীন্দ্রনাথ এবং ড.ওওকুরা কুনিহিকো

 

প্রবীর বিকাশ সরকার, জাপান প্রবাাসী কথাসাহিত্যিক

আহমদ রফিক: ভাষাসৈনিক থেকে সাহিত্য-গবেষণার আলোকবর্তিকা

শাহেদ কায়েস   আহমদ রফিক (জন্ম: ১২ সেপ্টেম্বর ১৯২৯-মৃত্যু: ২ অক্টোবর ২০২৫) বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের ভুবনে আহমদ রফিক একটি উজ্জ্বল নাম। তিনি একাধারে

অধ্যাপক ডা. রবিউল হোসেনের ‘প্লেজার অ্যান্ড পেইন’ গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসব

আন্দরকিল্লা ডেক্স \ চট্টগ্রাম চক্ষু হাসপাতাল ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম এর ম্যানেজিং ট্রাস্টি অধ্যাপক ডা. রবিউল হোসেনের আত্মজীবনী ‘প্লেজার অ্যান্ড পেইন’ গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসব

ফেরা

সৈয়দা মাসুদা বনি   নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের কথা শোনা থাকলেও আদতেই সেটা কেমন জানা ছিল না রিশানের। এটাই তাহলে মৃত্যুর পরের জগৎ, সে ভাবে। সে ভাবতে

ফিরে যাওয়া

বিচিত্রা সেন   রুবা.. রুবা খবরদার, না খেয়ে এক পাও বাইরে দিবি না। মুশকিল হয়ে যাবে কিন্তু! মায়ের হুমকিতে অগত্যা রুবাকে দাঁড়াতেই হয়। মা যে

চিরহরিৎ বৃক্ষের গল্প

সুজন বড়ুয়া   ছাদে উঠে দেখি শানবাঁধানো উঁচু আসনে একা বসে আছেন হরিৎবরণ ঘোষাল। একটু অবাক হলাম। এ সময় তার ছাদে বসে থাকার কথা নয়।