হাসান নাসির
মোয়াজ্জেম হোসেন মাস্টার, আমার পিতা। ছিলেন অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের গোপন আশ্রয়দাতা, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, শিক্ষাবিদ এবং অত্যন্ত জনপ্রিয় একজন শিক্ষক। সাংবাদিকতার সুবাদে অনেক বড় বড় মানুষের কাছাকাছি হবার সুযোগ আমার হয়েছে। নিজের বাবা বলেই বলছি না, এমন জ্ঞানী মানুষ আমি খুুব কমই পেয়েছি। দার্শনিকের মত একজন মানুষ। তখন তথ্যপ্রযুক্তি ছিল না। এখন মনে হচ্ছে, আব্বা যেন ছিলেন অনেকটা গুগলের মত। মনে হত, তাঁর জ্ঞানের বাইরে কিছু নেই। গুণমুগ্ধ ছাত্রছাত্রীরা তেমনই ভেবে থাকেন।
বিপ্লবী কালিপদ চক্রবর্তী, সুখেন্দু দস্তিদার, পূর্ণেন্দু দস্তিদার, শরদিন্দু দস্তিদার, সুধাংশু বিমল দত্ত, অমর সেন, অনঙ্গ সেন(নাছির সাহেব), কমরেড আবদুস সাত্তার(বীরেণ বাবু), দেবেন সিকদার, পূর্ণেন্দু কানুনগো, বামপন্থী রাজনীতিক চৌধুরী হারুনুর রশিদ, অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন আহমদ, মওলানা আহমেদুর রহমান আজমী, সাংবাদিক এটিএম সামসুদ্দীন, অধ্যাপক মেজবাউল আলম এবং আরও অনেকেই ফেরার জীবনে আশ্রয় পেয়েছিলেন আমাদের বাড়িতে। সিপিবি নেতা বালাগাত উল্লাহ আব্বার স্নেহের চাচাত ভাই। পঞ্চাশ দশকের তুখোড় ছাত্রনেতা সাংবাদিক কাজী জাফরুল ইসলাম আমার বড় মামা। চট্টগ্রাম জেলায় এমন বামপন্থী নেতা কমই আছেন, যিনি অন্তত একদিনের হলেও আমার আব্বার আতিথেয়তা গ্রহণ করেন নি।
মুক্তিযুদ্ধকালীন ন্যাপ, সিপিবি, ছাত্র ইউনিয়নের সমন্বয়ে গঠিত গেরিলা বাহিনির পরিচালক, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী কমান্ডার আবদুর রউফ ছিলেন আমাদের পরিবারের মানুষের মতই। তিনি অনেকবার এসেছেন, থেকেছেন আমাদের বাড়িতে। বন্ধু সাহিত্যিক অধ্যক্ষ মিন্নাত আলীর ভাগ্নে, তাই আব্বাকে তিনি মামা ডাকতেন। তাঁর পাশে বসলে মনে হত, আমি এক হিমালয়ের পাদদেশে বসে আছি। রউফ সাহেবের মৃত্যুর পর স্মৃতিচারণ করে লিখেছিলাম, “আমার হিমালয় দেখা।”
শামসুল আলম চৌধুরী, আরেক তুখোড় বামপন্থী নেতা। বাড়ি চট্টগ্রামের রাউজান। তিনি ছিলেন নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টি সমর্থিত যুবলীগের(বর্তমান আওয়ামী যুবলীগ নয়) কেন্দ্রীয় সহসভাপতি। জাতীয় রাজনীতিতে কামরুন্নাহার লাইলীর সমসাময়িক। তাঁরও যাওয়া আসা ছিল আমাদের বাড়িতে। বিয়ের জন্য রাজনৈতিক পরিবারের শিক্ষিত পাত্রী খুঁজছিলেন শামসুল আলম চৌধুরী। রাজনৈতিক পরিবার খুঁজবার কারণ, বউ নিজে রাজনীতি না করলেও জীবনসঙ্গীর রাজনীতিটা যেন সহ্য করে। বাবা তাঁর কাছে ভাগ্নি বিয়ে দিয়েছিলেন। অবশ্য পরে তিনি নিজের মেয়েকেও বিয়ে দিয়েছেন সিপিবি’র নুরুচ্ছফা ভূঁইয়ার কাছে।
এলাকার তৎকালীন কমিউনিস্ট নেতা আবুল কালাম মাস্টার বয়সে আব্বার ছোট হলেও সম্পর্কে চাচা। তিনি ডাকতেন, কালাম কাকা। কালাম সাহেব প্রায়ই বলতেন, মোয়াজ্জেমের কাছে আমি ঋণী আমার রাজনীতির জন্য। কারণ, সাংগঠনিক কাজে আসা পার্টির নেতাদের থাকা খাওয়ার চিন্তা আমাকে কখনোই করতে হয় নি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসজুড়ে প্রতিদিনই অন্তত ১৫/২০ জন মুক্তিযোদ্ধার খাবারের ব্যবস্থা করতে হত। আমাদের কাচারি ঘরটা ছিল যুদ্ধদিনের একটা আশ্রয়।
আব্বার পড়ালেখা ভৈরবে। ঐতিহ্যবাহী ভৈরব কেবি হাইস্কুল এবং হাজী আসমত আলী কলেজের ছাত্র। প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমান ও সাহিত্যিক অধ্যক্ষ মিন্নাত আলী তাঁর বাল্যবন্ধু। একসঙ্গে বেড়ে ওঠা। সাহিত্যিক ড. আলাউদ্দিন আল আজাদ এক ক্লাস জুনিয়র। তবে তিনিও চলতেন একই সার্কেলে। কারণ, তাঁরা সংস্কৃতি ও নাট্যমঞ্চের মানুষ। আব্বা বলতেন, জিল্লুর রহমানের সঙ্গে সম্পর্ক এতটাই ঘনিষ্ঠ ছিল যে, দিনের বেশিরভাগ সময় হয় জিল্লুর আমার ঘরে নয়তো আমি মোল্লাবাড়িতে।
কমিউনিস্ট ভাবধারার প্রখ্যাত লেখক রেবতী বর্মনের কাছে প্রাইভেট পড়েছিলেন আব্বা। ছাত্রজীবনেই এই রাজনীতিবিদের সান্নিধ্য তাঁর মনে রেখাপাত করে। তিনি শোনাতেন রাজনীতি ও সমাজ বিজ্ঞানে রেবতী বর্মনের অগাধ পাণ্ডিত্যের কথা।
পার্টির পদবি ধারণ করা বড় নেতা ছিলেন না বাবা। তিনি বরং বড় নেতাদের তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব পালন করেই বেশি আনন্দ পেয়েছেন। শিক্ষকতা তখন অনেকটা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াবার মতই। সরকারি বেতন, টাকা পয়সা ছিল না। একই স্কুলে একটানা ৩৭ বছর শিক্ষকতা করে খালিহাতে বিদায় নিলেন।
বিদায় সংবর্ধনায় যেতে চাইছিলেন না আব্বা। ক’জন ছাত্র এসেছিল তাদের স্যারকে নিয়ে যেতে। আব্বা ঝরঝর অশ্রুজলে কেঁদে ফেললেন। বললেন, আমি বিদায় নিতে পারব না। আমিসহ অনেক বুঝিয়ে আব্বাকে নিয়ে গেলাম। মঞ্চে দাঁড়িয়ে তখনকার এবং প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের সামনে তিনি কথা বলতে পারছিলেন না।
সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় বললেন, আমাকে যদি কেউ প্রশ্ন করে আপনি জীবনে কোন কাজটি ভালো করেছেন? জবাবে আমি বলব, সারাজীবন আমি শিক্ষকতা করেছি। যদি প্রশ্ন করে, সারাজীবনে আপনি কোন কাজটি খারাপ করেছেন? তার জবাবেও বলব, সারাজীবন আমি শিক্ষকতা করেছি। শিক্ষকতা করে আমি অনেক সম্মান পেয়েছি। আবার শিক্ষকতার বাইরে অন্যকিছু চিন্তা না করায় আমার জীবনে কোনো বৈষয়িক অর্জন ঘটে নি। তাই জীবনের ভালো খারাপ দুটোই এই শিক্ষকতা।
আব্বার জ্ঞানের অর্ধেকও পেলাম না। ০৯ জুন আব্বার ২৩তম মৃত্যুবার্ষিকী। মৃত্যুদিনে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করি।
হাসান নাসির, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক




