শিশুগান ও অর্জুনের ছায়া
হামিদ রায়হান
নক্ষত্র ডুবে গেলে
আমি তাকাই না আকাশে,
আমি শুনি
মাটির ভেতরে পচে যাওয়া কালের ফিসফাস।
সেখানে স্রোত নেই,
তবু নদী বয়ে চলে,
মৃত্যুর মতো চেনা,
বাঁচার মতো নীরব।
আমি হাঁটি
নির্জনতার দিকে,
একটা ভাঙা বাঁশি বাজে
পথঘাট বোবা হয়ে পড়ে,
আমার ছায়াও ঘন হয়ে ওঠে,
আমি টের পাই,
এই নীরবতা
কে যেন অনেক আগেই লিখে রেখেছে।
তখন হঠাৎ,
দেখি
একটা গাছ দাঁড়িয়ে,
না, এটা গাছ না,
এটা কোনো এক যোদ্ধার দীর্ঘশ্বাস,
বয়স তার অনেক
পাতা নেই, ছায়া নেই,
তবু সে ছায়া দেয় মাঠজোড়া শস্যে।
এই মাঠ
যেখানে প্রতিটি ধানগাছ
নিজেকে শিশু ভেবে গান গায়,
গান ভাঙে
নুয়ে পড়ে,
আবার উঠে দাঁড়ায়,
যেন গানই তাদের জাতির রক্ত।
তার পাশেই
পুরনো ইটের একটা স্কুল
খোলা জানালা, গলা ছাড়ো!
একটা ছেলেমেয়ে দল গাইছে,
কেউ সুর জানে না,
তবু শব্দগুলো বাঁচে,
দেয়ালের ফাটলে গেঁথে যায়
তাদের ধ্বনি
ভবিষ্যতের মুখ।
তাদের গান
আলো নয়,
পৃথিবী নয়,
শুধু এক টুকরো আর্তনাদ
যা বাতাসে ঝুলে থাকে,
যেন প্রমাণ
আমরা এখনো মানুষ।
আমি শুনতে পাই
তাদের শ্বাস ফুসফুস নয়,
একটা ইশতেহার;
তাদের হাঁটুতে বাঁধা ক্ষুধা,
তাদের চোখে লুকানো পরাধীনতা,
তাদের খেলার ছলে
দেশের মানচিত্র ছিঁড়ে পড়ে মাটিতে।
আমি দাঁড়িয়ে থাকি
না, পথিক না,
আমি কেবল শ্রোতা
ভবিষ্যতের কণ্ঠ শুনি,
আর ভাবি
এই পতাকা, এই গান,
এই শিশুরা কি জানে
একদিন তাদের হাড়
ধ্বনি হয়ে যাবে?
অর্জুন গাছ জানে না কিছু,
তবু সে দাঁড়িয়ে থাকে,
যেন সাক্ষ্য দিতে এসেছে
এই পঁচে যাওয়া আলোতে
কীভাবে জন্ম নেয়
একটা অমর আহ্বান।
আমার হাত কাঁপে,
আমি লিখতে চাই
না, কবিতা নয়,
একটা রক্তাক্ত উচ্চারণ
যেখানে লেখা থাকবে
“যেখানে শিশুরা গান গায়,
সেখানে মৃত্যু মিথ্যে।
=====================================
রেপ্লিকার পর
রূপক বরন বড়ুয়া
রেপ্লিকা খুনের পর আর কোন জরায়ু থাকবে না
অন্ধকারে ঠেলে দেয়া হবে কঠিন যৌবন!
লেখা হচ্ছে পায়ুবিধি তাতে বিভিন্ন কৌশল
সর্বত্র উচ্চারিত হবে সমকামের অনুশীলন।
রেপ্লিকার বস্ত্রহরণ, নির্যাতন পৈশাচিক উল্লাস
রক্তপাত নেই,উড়ে যায় কম দামী স্তন
ছিটকে পড়ে মলিন পিন্ধন
গোপনে নয় প্রকাশ্য হতে চলছে বর্বর আক্রোশ।
কবিতারা একবার অর্জুনের মতো বৃহহ্নলা হও
ছিলা বদলাও, ঢুকে পড়ো ধর্মান্ধ সভায়
জেনে নাও কিভাবে কেটে নেবে ওরা
সৃষ্টির পাঁচ আঙ্গুল!ধ্বংসের কারিগরি সৃজনশালায়।
কবিতারা তোমরা সেজে ওঠো, শব্দময় হও! নাঙ্গা হবার আগে নাঙ্গা
করে দাও বিকৃত মনন, বিকৃতির যত উচ্চারণ।
=====================================
অরণ্যের অভিধান
আসিফ নূর
অরণ্যের অভিধানে লেখা বাউলা হাওয়ার শিসে দুলে ওঠা
পাতাদের সবুজ আনন্দ, সিংহের গর্জন, ক্ষুধার্ত বাঘের
থাবা, শিয়ালের ছলচাতুরি; হরিণশিশুর দ্যুতিময় নাচ।
আছে সাদাকালো জিরাফের উচ্চাকাঙ্ক্ষী গলা, হঠাৎ আওয়াজে
খাড়া খরগোশের জোড়াকান; ফুলে ওঠা সজারুর সাদা কাঁটা।
আরো আছে বানরের লম্ফঝম্প, বোকাসোকা হাতিদের গল্প,
‘কুক্কুরুকু’ বাক তুলে সকাল-ফোটানো তেজি শিকারি মোরগ,
সাপেদের ফোঁসফাঁস, নেকড়ের তাজা ত্রাস; এবং কত কী…
তারপর লিপিবদ্ধ কুঠারের সহিংস কামড়ে ডুকরে ওঠা
বৃক্ষরাজির টুকরো শরীর—মানুষের হাত-পা’র আঙুলের
মতো কাটা ডালপালা-মূল আর যত্রতত্র ছড়ানোছিটানো
রঙিন ফুল, অচিন ফল; পিষ্ট যতসব পাপড়ি ও বাকল।
পরিশিষ্টে সংযোজিত অরণ্যধ্বংসের বেদনারা—এই পর্বে
নিরাশ্রয় পাখিদের নীল পাখসাটে ঝরা পালকের শোক,
ভ্রমরের কান্না, প্রজাপতির মর্সিয়া, চাকভাঙা মৌমাছির
করুণ বিলাপ, পিঁপড়াদের উদ্বাস্তুযাত্রা; শত হাহাকার।
=====================================
বাদামি কবিতা
মনজু রহমান
আমার বাদামি কবিতা রোদচশমা হবে না জেনেও
খুঁটে তুলি বৈষম্যেও শব্দ! রোদেও ঝলক না বুঝে
পুরু চশমা এখনি না নিলে তোমার চোখে দুলবে
লাশের তৈলচিত্র; তুমি ও তোমার স্তাবক উড়াবে ঝড়ো বিভৎস গন্ধ!
তার চেয়ে ভালো নয় ডার্ক লেন্স, যেখানে দেখবে শুধু
উন্নয়ন, জোয়ারে ভাসা স্বদেশ—শান্তি শান্তি আর শান্তির আদিখ্যেতা?
বিষণ্নতা কোনো শাসককুলের থাকেনি কোনো কাল;
তুমি কেনো জড়াবে অযথায় দ্বন্দ্ব-কলহে
বরং বলছো এইসব স্যাবোটাজ— সেই ভালো।
শাসকরা অন্ধ না হলে মানায় না!
তারা চুম্বন করে তাদের—যারা খুন হত্যা ছিনতাইয়ে পারদর্শী
রাষ্ট্রযন্ত্র বিকল হলে আর গণতন্ত্র নামক যন্ত্রটি অকার্যকর হলে
তোমরা চুম্বন করো কাকের ঠোঁট, সারা দেশ যখন সর্বনাশায় মত্ত
তখন স্তাবকদের গলায় পরিয়ে দাও ঐশ্বর্যের মালা!
আমার বাদামি কবিতা তোমার জন্য নয়;
এইসব নির্মল পঙক্তি তাঁদের—যাঁরা রক্ত ঝরিয়েছে ঊনসত্তরে
গণঅভ্যুত্থানে, একাত্তরে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে
স্বৈরচার বিরোধী রাজপথে এবং এখনাবধি যাঁদের রক্তের
উপর দাঁড়িয়ে আছে তোমার রাজসিংহাসন—
তোমার পুরু লেন্সের দুর্বিদ্ধ কালো চশমায় এইসব বিবর্ণ হলুদ কবিতা
ঢুকবে না জানি; তবু যে কেন— কবিরা মাকড়সার জাল বুনে শব্দের…
=====================================
আমি কানা বাউলের ব্যাটা
হোসাইন আনোয়ার
স্ট্যাচু অব লিবার্টির দেশ ছেড়ে
সুখী দেবতার আজ আমার আঙিনায় এসে দাঁড়িয়েছেন।
কিছু মানবিক এবং সহজ শর্তে
ওরা আমার মঙ্গল চায়।
কোরো কোনো ঋণের দায়ে
আমার ভিটে-মাটি উচ্ছেদ হবে না,
দরিদ্রতার দায়েও আমাকে কোনো দিন
অনশন করতে হবে না আর।
বাহ! কী চমৎকার তরজমাহীন ব্যাকরণ
কিন্তু, আমার স্পষ্ট উচ্চারণ
প্লিজ, লিভ মি অ্যালোন
আমাকে একা থাকতে দাও।
আমি কানা বাউলের ব্যাটা
আকাশ থেকে রংধনু কেড়ে নিয়ে
আলপনা আঁকি আমারই উঠানে
মনের সুখে।
=====================================
পিসারোর রাস্তা
শিশির আজম
পিসারো এই রাস্তা এঁকেছিলেন ১৮৮৮ সালে
প্যারির এমন রাস্তা কেউ আর আঁকেনি কখনও
হয় তো এরকম রাস্তা যা একই সঙ্গে কৌমনিরপেক্ষ
আবার ইম্পেরিয়াল কখনও ছিলই না
রাস্তা প্রশস্ত আর সংবেদনশীল
দু’পাশের ঘরবাড়ি
টলটলে আকাশ
তিন তলার খোলা জানালায় এক বিষাদমাখা মুখ
কিন্তু কোন রাস্তাকেই আগের মতো পাওয়া যাবে না আর
প্রতি মুহূর্তে
নিজেকে
বদলে ফেলে সে
প্যারিসের একজন আর্ট কালেক্টর তো পিসারোকে
রীতিমতো ‘অবিশ্বস্ত’ বলে অভিমত দিলেন
বললেন ষোড়শ লুই ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন রাস্তা না পেলে
বিরক্ত হতেন
হ্যাঁ পিসারোর রাস্তাগুলো আজও
হারিয়ে যায়নি
=====================================
বৃত্তাবর্ত
শিল্পী নাজনীন
গনগনে সূর্যতাপে দীর্ঘশ্বাস ছড়িয়ে
ঝরা পাতা ওড়ে
করুণ বিলাপে কাঁদে ব্যাকুল ডাহুক
দূরে, রূপালি নূপুর পায়ে মরীচিকা নাচে
উড়ে উড়ে
ঘুরে ঘুরে
কী যে কথা কয়
চোখে ধাঁধা
মনে বাজে কোনো এক তানপুরা-সুর
কী যেন শোকেরা ওড়ে
কী যেন গোপন কথা
ধূলোর শরীর জুড়ে বয়
মরা নদী উড়ে যায় রোদের ডানার মোহে
পুরনো পাতার শোকে বৃক্ষও বাজায় বাঁশি ঢের…
বহুদূরে বাজে কোন ক্ষীণ ভায়োলিন
জলের জীবন ছুঁয়ে তীব্রতর প্রেমানলে
নিটোল রোদ্দুর পুড়ে যায়…
তখন
মনের শরীর থেকে তুমিও ঝরে যাও
বাহুল্য মেদ
মুছে যাও গাঢ়তর বেদনার ছায়া…
নতুন দিনের মোহে সূর্য ওঠে ফের
আর
জীবন-পেয়ালায় জমে মুগ্ধকর প্রেম…
=====================================
আপন ভেবে
মিজানুর রহমান মিজান
আসা যাবার ভবের হাটে
উদাসী হয়ে ঘুরি ঘাটে ঘাটে।
যেথা যাই দেখতে পাই মিশ্রিত ভেজাল
সোনা ভেবে খরিদ যবে রুপার মাল
আসল ফেলে নকল তোলে লা-জবাব জুটে।
আপন ভেবে কাছে গেলাম আশার আশে
ধোকা খেলাম মিছা হলাম ভাগ্য দোষে
হলাম প্রতারিত অবিরাম অবিরত কর্মে ঘটে।
দেখায় সোনা করে প্রতারণা বেচে পিতল
দেয় ধোকা বানায় বোকা ঝরে চক্ষুর জল
জীবন একাকার সদা হাহাকার ফাঁকা মাঠে।
শুধু বঞ্চণা সঙ্গি লাঞ্চনা কষ্ট যাতনা
ভালবাসার মুল ফুটেনি ফুল পাতা ঝরার বেদনা
তবু আসেনি দেখা মিলেনি সবই অযথা রটে।
=====================================
অসময়ে হাঁটে জোড়া চোখ
রুদ্র সাহাদাৎ
দু:খ পেলে কাঁদতে যাই শ্রাবণ বৃষ্টি জলে
আমার কিছু কথা ছিলো
কেউ শুনে না -কেউ বুঝে না
বলি বলি হয়নি বলা -গোপন কথা গোপনেই থাক
বিশ্বাসহীন রঙিন নাট্যমঞ্চে করছি অভিনয়
এই তো বেশ আছি -ভালোই আছি
একেক দিন একেক চিন্তা মগজে ঘুরে
অসময়ে হাঁটে জোড়া চোখ
সময় বুঝি না কোনোকালে
ফিলিস্তিনের মতো বিধ্বস্ত যৌবন
ভুলেও আর -জীবনের সংজ্ঞা খুঁজি না …
=====================================
মায়া
খুকু আহমেদ
একদিন মৃত্যু এসে বসে
সামনের চাতালে
কপাট খুলতেই বলে ওঠে,
যাবি? বললাম, কোথায়?
হেসে বলে, অন্য এক লোকে।
আমি সংশয় ভেতরে চেপে
করুণ মলিন স্বরে বলি,
এই চিরচেনা পৃথিবীর মতো সেই
অন্যলোক আমাকে আপন করে নেবে?
মৃত্যু উঠে হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে যেতে
বলে যায়, ‘মায়া থেকে বের হতে হবে’।
মায়া থেকে কখনো কী বের হওয়া যায়!
মনকে জিজ্ঞেস করি, পেছনের বেঞ্চে
বসা ছাত্রের মতন মন মুখ নিচু করে থাকে।
=====================================
পদ্মমুকুট
সৈয়দ ইবনুজ্জামান
কাবিন নামায় দিতাম ফালি ফালি করে কাটা চাঁদ
যদি বলা হত পাতালপুরীর রাহ্মসের সাথে যুদ্ধ করতে অথবা পদ্মমুকুট আনতে
টাকার সাথে মানুষ কী পারে?
কেউ- কেউ;
কতবার শ্রাবণ ধ্বনি পৌঁছে দিয়েছি তোমার কর্ণ কুহকে!
কতগুলো বার জ্যোৎস্না ছোঁয়ার ব্যর্থতায় দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছো বুক পশমে!
জোনাকির আলোয় বিভোর করেছিলাম যাবতীয় অন্ধকার
ইচ্ছে করত দুবাহু দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে সাপের মত প্যাচিয়ে ধরি
বলছিনা ভালোবাসা মাত্রই কাম
এসব ভাবতে ভাবতে সুতো ছিঁড়ে ঘুড়ি
শ্যাওলা জমে পদ্মমুকুটে
ও.টির সামনে
সুজাউদ্দৌলা
ও.টির সামনে আঙুলে নাচছে তসবিদানা
ঠোঁট নড়ছে তার সাথে পাল্লা দিয়ে
মৃত্যুর দরজা থেকে হাত নাড়ছে কেউ
জীবনকে বলছে কেউ স্বাগত
কেউ ঠোঁট কামড়ে কান্নাকে আটকে দিচ্ছে
হাউমাউ বিলাপ জুড়েছে কেউ
গ্লাভস খুলতে খুলতে ডক্টর বলছে সরি
গ্লাভস খুলতে খুলতে ডক্টর বলছে কংগ্রাচুলেশন।
প্রাচীরের ওপরের বেড়াল
তোমার অনেক ক্ষমতা, তুমি তিলকে
তাল করতে পার তালকে তিল
তোমার রয়েছে গুণমুগ্ধ চারণের দল
যারা নৈবেদ্য দিয়ে ধন্য হয় তোমার চরণে
তবু তুমি কি হয়েছ সুখী? আমার কেন যে
তোমাকে অসুখী মনে হয় —
মনে হয় একটা স্বাধীন বেড়াল যেমন
প্রাচীরের ওপর ঘুমায় নিশ্চিন্তের ঘুম
তেমন ঘুম তুমি কোনদিন ঘুমাতে পারনি।
=====================================
ভিন্ন অভিমত
মেরিনা সুলতানা
আকাশ আছে আমার সাথে
চলতে পথে চাঁদ হাঁটে
জীবন রথে চলতে দেখি
পথের ভেতর পথ থাকে।
ক্লান্তিবিহীন অন্ধ পথে
জোনাক জ্বালায় আলো
মনের ভিতর ঘরবসতি
ভাবতে লাগে ভালো।
প্রথম আলো দিচ্ছে উঁকি
ভোরের হাওয়া ভেদ করে
ক্লান্ত পথের পদভারে
টঙ দোকানে ভিড় করে।
নিদ্রাবিহীন অশ্রুসিক্ত
অভিমানের ভোর
কষ্ট গুলো জমিয়ে রাখি
সুখগুলো হোক ওর।
একলা ভীষণ চলার পথ
পথের ভিতর পথ খুঁজি
বাক্যে-তর্কে শ্রদ্ধা করি
ভিন্ন হোক তার অভিমত।
স্মৃতির মায়া জালে
মারজিয়া খানম সিদ্দিকা
হেঁটেছি দিনভোর, জেগেছি রাতভোর মায়ার বাঁধনে
আজ কতো দূর দূর থেকেও স্মরণে আছো ওগো আমার আঁতুড় ঘর,
নিবিড় ছায়ায় সুবিন্যস্ত বাড়িঘর
সেই মোরগ ডাকা সুবেহ।
শিউলি-চাঁপার আকুলিত মেলবন্ধন,
গন্ধরাজের সৌরভে শিহরণে পুলক জাগায়,
মায়ের হাতের গরম ভাপাপিঠার আয়েশি স্বাদের অনুভব হয়,
সেই মোরগ ডাকা শিশির ঝরা ভোরে।
হেঁটেছি আলপথ ধরে দুপাশে সবুজ ধানক্ষেতের ঝিরিঝিরি হাওয়ায়,
হেঁটেছি টিলার উপর পূর্বপুরুষের লিচু-আম বাগানে,
হেঁটেছি বড়োপুকুরের চারপাশের পাড়ে পাড়ে,
কোন রঙিন গোধূলি লগ্নে।
এতোটা বছর পর আজ সাথীদের হয়তো কথা শুনা যায়,
দূর আলাপনি কিংবা আধুনিকতায়
তারা যেমনই থাকুক বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস,
কখনো তো আর তেমনটি দেখা হবেনা।
যা ছিল নয়ন সম্মুখে এখন হৃদয় গ্রন্থিতে,
শুধু আশাহীনতার দোলাচলে এক জুজু যেন—
ভর করে আছে জীবনটিতে-
আহা,সেই মোরগ ডাকা ভোরের আলো!!
=====================================
জীবনের গান
মোহাম্মদ জাফর সাদেক
এই ধুলোঘেরা প্রান্তরে—ভাঙা দুপুরের গন্ধে,
আমি হাঁটি, যেন যুগের পর যুগ ধরে হাঁটছি
ভাঙা কুয়াশার দেশ, রৌদ্রহীন পথে,
পা-ফেলা মাটির নিচে গোপনে গুনগুন করে মৃত ঘাসের গান
পেছনে ফেলে এসেছি একখণ্ড জ্যোৎস্না;
তারও আগে হারিয়ে গেছে এক মেয়ের মুখ
ভাঙা নৌকার মতো ভেসে গেছে দূরের শূন্যতায়।
সন্ধ্যার ধূসর হাওয়ায় ভেসে আসে মৃত পাখির ডাক;
আমি কুড়িয়ে নিই একাকী ফেলে-আসা শব্দের ছায়া
চোখের ভিতর গড়িয়ে যায় এক অবিশ্রান্ত নদী,
তার গভীরে মিশে থাক;
ভাঙা ঘাসের ঘ্রাণ, পোড়া রৌদ্রের ফালি,
আর কোন সুদূরে শিশির-ভেজা ভোরের অপেক্ষা।
=====================================
গুপ্ত বর্ষাপাঠ
সারমিন চৌধুরী
ডুবে যাচ্ছে হৃদয়ের গিরিখাত
দুচোখের প্যাপিরাসে হচ্ছে সুগুপ্ত বর্ষাপাঠ
নিয়তির হাঁকে ভাসছে অস্তিত্বের চিরকুট
নিভে গেছে জোনাকির আলো চতুষ্পার্শের
অবিনাশী বিষাদ টানছে ক্রমশই অধোলোকে
প্রত্ন আহাজারিতে রক্তাক্ত হচ্ছে অন্তঃকর্ণ
নৈঃশব্দ্যের বিবিধ সম্ভোগে হারাচ্ছে বন্দনা,
যেন আজ দাঁত কেলিয়ে হাসছে অভিসম্পাত,
সার্বভৌম দুঃখের অন্তহীন মাঠে সানন্দেই!
অপার্থিব গর্জনে কাঁপছে বুক পাঁজরের হাড়
কেন বর্ষার অনিমেষ আক্রোশ থামছে না?
শোনাচ্ছে যেন প্রজ্ঞাময় বিচ্ছেদের সংলাপ।
বাঁচার অভিপ্রায়ে ছুটছি শরণাগত দ্বীপে
পদেপদে অসীম ভ্রমে হারাচ্ছি পথের হদিস
অভিশ্রান্ত চোখ এগোচ্ছে সন্ন্যাস দৃষ্টিতে,
ছোবল মারতে মরিয়া বহুবর্ণের সাপ,তবুও
হন্যে হয়ে খুঁজছি জ্যার্তিময় বেলাভূমি।
=====================================
জীবনের মায়া হাসি
হোসনে আরা
জ্যৈষ্ঠের শেষ
এল বরষার সৃষ্টি
আজ সকালে সে বারতা
মৃদুমন্দ হাওয়া
আর রিমঝিম বৃষ্টি
এ যেনো প্রকৃতির খেলা বিজনে
আকাশ গর্জনে,
বলে দেয় নির্জনে
এসো হাওয়ায় ভাসি
বৃষ্টির জলে ভাসি।
যত যাতনা মুছে যায়
যত অনাচার ধুয়ে যায়
আবার ঘুরে ঘুরে আসি,
ফিরে ফিরে দেখি
জীবনের যত রূপ ছন্দ
আর জীবনের মায়া হাসি।




