এখন সময়:বিকাল ৩:০৬- আজ: মঙ্গলবার-২৫শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-১১ই চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-বসন্তকাল

এখন সময়:বিকাল ৩:০৬- আজ: মঙ্গলবার
২৫শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-১১ই চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-বসন্তকাল

অতঃপর, সবুজ সংঘ ক্লাব

জাকিয়া শিমু

রওনক জাহান বাস ভিড়তে সাবধানী পায়ে বাসঘাটে এসে নামলেন। জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির মতো সূর্যটা,এই লোকালয়ে হাড়-সেঁকা রোদ ঢালতে চারপাশ পুড়ে কাহিল হয়ে আছে! মফস্বলের বাসঘাটে সকাল-বিকাল অযাচিত ভিড়বাট্টা সোরগোল লেগে থাকলেও এই ভরদুপুরে সকালের ব্যস্ততা কাটিয়ে এবং রোদের তেজে এখন অনেকটাই পরিশ্রান্ত। ঝড়ের পরের প্রকৃতির মতো থমথমে! বড় রাস্তার পেট চিড়ে উত্তর-দক্ষিণে দুটো নালা-রাস্তা একেবেঁকে মাঠঘাট ছাড়িয়ে চলে গেছে দূর গাঁয়ের দিকে। এসব জায়গাজমি একসময়ে রওনক জাহানের কাছে ঘরঘেঁষা উঠোনের মতো পরিচিত থাকলেও এখন অস্বাভাবিক পরিবর্তনে কিছুই চিনতে পারছেন না! তাঁর কপালে চিন্তার চিড়ল ভাঁজ পড়ল! কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ভাবলেন! এরপর দখিনদিকের রিকসাঘাটের দিকে এগিয়ে গেলেন। তপ্ত দুপুর! এসময়ে রিকসা চড়া ঠিক হবে কিনা! এমনতর ভাবনা ছাড়িয়ে রিক্সা নিয়ে যাওয়া সমীচীন মনে করলেন। রিক্সার মতো অমন খোলামেলা বাহন আর আছেই বা-কী! সামনে একটি খালিরিক্সা নিয়ে তাগড়া যুবক যাত্রীর অপেক্ষায় দাঁড়িয় আছে।তিনি রিক্সার কাছে গেলে যুবকটি বেশ আগ্রহ নিয়ে কাঁধের গামছায় রিক্সার সিট ঝাড়ামুছা করে তাঁকে বসার জায়গা করে দিল। রওনক জাহান নির্ভারে রিকশায় চেপে অভ্যাসমতো মাথায় গোঁজা ফটোসান চশমাটা টেনে চোখে নামালেন। সুরকিঢালাপথে মোটর-রিকসা দুর্বার গতিতে চলতে শুরু করলে, রওনক জাহান চমকে উঠলেন! তাঁর পৌঢ় দেহখানায় ইতিমধ্যে অযথা থলথলে মাংস জমেছে, রিক্সার অযাচিত ঝাকির তরাশে শরীর অস্বাভাবিক দুলতে থাকে! তিনি আতঙ্কে রিক্সার হুড খামচে ধরলেন! বহুদিন দেশের বাইরে আছেন। দিনদুনিয়ে বদলেছে বিস্তর তা ঠিক কিন্তু পায়ে-টানা রিকসার এমন আহামরি পরিবর্তনে তিনি যথার্থ মর্মাহত হন। তাঁর দৃষ্টি পড়ে পথের দু’ধারে। সেখানেও উটকো পরিবর্তনের ছাপ! মায়ের শাড়ির আঁচলের মতো আশ্রয় দেওয়া সেই ইছামতী নদীটি, এখন ভাগাড়ে রূপ নিয়েছে! বাঁয়ে ছিলো অসুমার খোলা সবুজ মাঠ। পুরোটাই ভরে গেছে সুরকি-কাঠের তৈরী খোঁয়াড়ের মতো মনুষ্যবসতিতে!

 

আধ-ঘণ্টা পথ পেরিয়ে রিকশা ঢুকে পড়ে বাঁ-পাশের নির্জন একচিলতে সরুপথে। সামান্য এগোতে পথ আরও সরু হয়ে আসে। এক পর্যায়ে রিক্সা চলার জো থাকে না! কণ্টকাকীর্ণ হাঁটাপথ! মেটে স্যাঁতস্যাঁতে শ্যাতলা-পড়া সে পথে বহুকাল কারো পদচিহ্ন পড়েনি তা বোঝা যায়! অগ্যতা রওনক জাহান অনভ্যস্ত পায়ে শাড়ির কুচি টেনে ধরে হেঁটে এগিয়ে চললেন। এই ভরদুপুরে পথজুড়ে নিশিরাতের নিস্তব্ধতা ভর করেছে! বর্ষাকাল চলছে। কাঁটানটে, শিয়ালকাঁটারা বাউয়া দূর্বার সাথে জড়াজড়ি করে পথটাকে আঁটকে দিয়েছে! এসব মাড়িয়ে কিছুদূর যেতে সম্মুখে চোখে পড়ে সোহাগীবাগান! রওনক জাহান থামলেন। বাগানে নানাপদের প্রাচীনসব গাছ একসময় থাকলেও এখন প্রায় ফাঁকে হয়ে গেছে! যদিও কোনমতে গুটিকয় কদম,কড়ই শতবর্ষীর নড়বড়ে দাঁতের মতো করে আজও টিকে আছে! কদমফুলের রেণু হাওয়ায় ভেসে কেমন বুনোসুগন্ধ ছড়াচ্ছে! সোহাগীবাগান ছাড়িয়ে কয়েক পা ফেলতে, চোখ আঁটকে গেল মাথাসমান উঁচু পুকুরপাড়ে। তিনি কোনমতে পাড়ভেঙ্গে পাড়ের উপরে ওঠে দাঁড়ালেন। ক্রমেই হাওয়ায় গোমটভাব ভর করল। আকাশে অস্পষ্ট মেঘেরা জমে জমে ভারি এবং গর্ভবতী হয়ে উড়বার শক্তি হারিয়ে ফেলল! রওনক জাহান আকাশের দিকে তাকালেন। মন বলে উঠল, “এমনতর মেঘে বৃষ্টি না হয়ে যায় কোথায়!” ভাববার ফুঁসরতে বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি শুরু হলো। ঝুম বৃষ্টি! রওনক জাহান দু’হাত মেলে ছোট্ট খুকির মতো বৃষ্টিস্নানে মগ্ন হলেন।

 

বৃষ্টির ঝাপসায় চশমাটা আবছা হয়ে এলে অভ্যাসমতো টেনে তা মাথার মাঝখানে গুঁজে রাখলেন। বয়সের জেরে দৃষ্টি অনেকটাই ক্ষীণ হয়েছে কিন্তু এমুহূর্তে চশমাটা খুলতে দিব্যআলোর মতো পরিষ্কার হয়ে উঠল সবকিছু! রওনক জাহানকে প্রায় ছুঁয়ে একপাল হাঁসের ছানার মতো ছেলেমেয়ে সানন্দে ঝাঁপিয়ে পড়ল পুকুরজলে! নুরুকে ওরা পানকৌড়ি ডাকে। ঝুপ করে জলেরতলে ডুব দিয়ে সে হাওয়া হয়ে যায়! সানু-টা ভিতুর ডিম। নুরু যেই ডুবে ওকে পা ছুঁয়ে দিবে, সে এক ঝটকায় পুকুরপাড়ে উঠে, খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে যাবে। দলবেঁধে টেনেও তাকে আর জলে নামানো যাবে না। জলেরবুড়ি তাকে টেনে নিয়ে যাবে পাতালপুরিতে- নুরু তাকে সে ভয় দেখায়!

 

রুনু যেমন দেখতে নাদুসনুদুস, ভয়ডরও তাকে ছুঁতে পারে না। ডুবসাঁতারে কতোবার ছুঁয়ে আসবে পুকুরের ও-পাশটা। নাজমা-ছালমা দুই বোন। জলে কিংবা স্থলে এদের গল্পের শেষ নেই! দুনিয়ার যতসব আজগুবি গল্প এদের কোঁচরে জমা আছে। জলে নেমেও গালগল্পের শেষ হয় না। নিয়ম করে রওনকের গায়ে কাদা ছুঁড়ে দিয়ে হাসির তোরে ভাসে দুবোন। ততক্ষণে ঘাস কাটা ফেলে কাস্তে হাতে করিম চাচা, পুকুরঘাটে এসে দাঁড়িয়ে গেছেন। ওমা! এর মধ্যে এক ঘন্টা নাকি জলসাতারে কেটে গেছে! এমন কথা কেউ বিশ্বাস না করলেও করিম চাচার কথার উপর কারো কথা খাটবে না! বাড়ির রাখাল হলেও চাচার মর্যাদা বাড়ির ছেলেদের চেয়ে কম নয়! এ বাড়ির কাচারিঘরে চাচা সংসার পেতেছেন। চাচার দু’ছেলে- জামাল, কামাল। রওনকদের সাথে সমানতালে এরাও বড় হচ্ছে। ওরা সারা বছর সর্দিকাশিতে ভোগে!  শীত কিংবা বর্ষা অনিয়ম করা যাবে না।

করিম চাচার পাচনির ভয়ে ওরা পুকুর ছেড়ে ওঠে আসে।

এবাড়িতে চার চারটি বড়ো ঘর। রওনকের দাদা নেই। দাদী সবচেয়ে বড় ঘরটিতে এগারজন নাতিনাতনী নিয়ে থাকেন। এইঘরের কোলাহল কখনো থামে না! সারাক্ষণ বাজার ঘাটের মতো ব্যস্ত সরগরম! রাতদুপুরের নিস্তব্ধতা এ ঘরকে ছুঁতে পারে না! রওনকের বাবা, বড় ছেলে- রাশভারি স্বভাবের, লোকে বলে তাঁর মায়ের মতো হয়েছেন। স্থানীয় স্কুলের গণিত শিক্ষক। দাদা প্রচুর বিষয়সম্পত্তি রেখে গেছেন বলে এবাড়ির ছেলেদের বাড়তি পয়সা আয় করার তাড়া থাকে না! স্কুলের কাজ বাদে সংসারের বাদবাকি কাজে তাঁকে প্রায় দেখা যায় না। তিনি আমুদে লোক, বিকেলে বন্ধুদের ডাকে বাড়ি ছাড়েন- আড্ডা,তাসপেটানো, চায়ের আসর সেরে রাত করে বাড়ি ফিরেন। তবে তিনি কোন এক অচিন কারণে দাদিকে বেশ ভয় পান!

 

রওনকদের কাছে দাদী পানির মতো সহজ। জগতের সমস্ত আবদার অজুহাত তিনি হাসিমুখে মেনে নেন। সকল দুঃখকষ্ট উপড়ে ফেলার পাঁচনও তাদের কাছে, দাদী। কিন্তু বাবাকে পারতপক্ষে দাদীর কাছাকাছি দেখা যায় না, তিনি দাদীকে এড়িয়ে চলেন! তবে মাঝে মধ্যে সাংসারিক কাজকর্ম দাদীরঘরে তার ডাক পরে তখন তাকে বেশ অপদস্ত লাগে! মেজ চাচা, সেজো চাচা শহরে চাকরি করেন। তাঁদের বউ-বাচ্চারা দাদির আওতায় থাকে। ছেলেরা ছুটিছাটায় বাড়ি ফিরে। তখন এবাড়ি বর্ষাকালে জলেভরা পোয়াতি নদীর মতো আনন্দ আড্ডায় টইটুম্বুর হয়ে ওঠে! বাড়ি ভর্তি এমন মানুষজন দেখতে বিয়েবাড়ি বলে ভ্রুম হয়!

 

আরো আছেন রওনকের ছোট চাচা, পুরোদস্তুর রহস্যে ঢাকা এই মানুষটিকে ও খুব ভালোবাসে। কিন্তু কোন এক অচিন কারণে এবাড়ির সকলে তাঁকে এড়িয়ে চলে। তিনি নিজেও কারো সাথে স্বেচ্ছায় বাৎচিত করেন না। ছাত্রাবস্থায় রাজনীতি করতেন, তাও নাকি নিষিদ্ধ রাজনীতি! বাড়ির বড়োরা অবশ্য ফিসফিসিয়ে বলেন- এখনো নাকি তিনি ভুলপথে আছেন! সে অনেক কথা, রওনক এসব বুঝে উঠতে পারে না। মূল বাড়ি থেকে বিচ্ছিন্ন, কাচারিঘর-ঘেঁষা আধঃপাকা পুরনো ঘরটিতে ছোট চাচা একা থাকেন। দেশের সেরা কলেজ থেকে ডিগ্রি নিয়েও কাজকাম কিছু করেন না। বয়স চল্লিশ হলেও অকৃতদার! ভালোবেসে ব্যর্থ হয়েছেন-এমন কানাঘুষা অবশ্য শোনা যায়। তবে বিয়ে-সংসার, চাকুরি এসব আটপৌড়ে বিষয়ে তাঁকে সম্পূর্ণ উদাসীন মনে হয়। লেখালেখি, গানবাজনা এবং গুটিকয় বন্ধুবান্ধুব নিয়ে নির্ভারে তাঁর দিন কেটে যায়। লোকে বলে, ব্যর্থপ্রেম-ই’ তাঁর সংসারধর্মে অনীহার কারন। রওনক একদিন ভয়ে ভয়ে ছোটকাকাকে এই কথা পারতে- সে মৃদু হাসে! ছোট চাচার বেশিরভাগ কথার অর্থ সে ধরতে না পারলেও, সেদিনের কথাগুলো তার কিশোরীমনকে নাড়িয়ে দিয়ে যায়। ছোট চাচার নাকি ব্যর্থ প্রেম বিষয়ে একবিন্দু আক্ষেপ নেই! চাচা বলেন, ভালোবাসার মানুষকে সারাজীবন কাছে পেতে হবে এমনতর ভাবনা বোকারা ভাবে। না-পাওয়াতে আছে অপার্থিব-সুখ! আজীবন তাঁকে তোলাকাপড়ের মতো যত্ন করে ভালোবাসা যায়। তিনি মাঝেমধ্যে বাড়ির কাউকে কিছু না জানিয়ে হাওয়া হয়ে যান! অবশ্য রওনক ছাড়া তাঁকে নিয়ে এবাড়িতে কেউ মোটেও আগ্রহ দেখায় না!

 

তবে ছোট চাচা একমাত্র মানুষ, যাকে দেখলে দাদী ভীষণ ভড়কে যান! মাঝেমধ্যে গম্ভীর হয়ে তিনি দাদীর ঘরে ঢুকেন। রওনক বদ্ধ জানালার ওপাশে দাঁড়িয়ে তাদের আলাপে কান পাতে। জানালার ফুটা দিয়ে ঝাঁপসা দৃষ্টিতে দেখে-চাচা আঙ্গুল উঁচিয়ে কী যেন বলছেন আর দাদি নিরাশ চোখে তাকিয়ে আছেন! কিন্তু কিছুই শোনা যায় না! রওনক অবশ্য বুঝতে পারে কিছু একটা ঘটবে, ঘটেও তাই! তারপর থেকে চাচার ঘরের দরজা জানালা বন্ধ থাকে এবং একদিন গভীর রাতে কেউ একজন দাদীকে এসে জানায়-ছোটচাচা ঘরে নেই! তারপর দু’তিন মাস তিনি উধাও থাকেন! এবং কোন একদিন ঘুম ভাঙ্গলে দেখা যায়-তিনি ফিরে এসেছেন। রওনক ভয়ে ভয়ে তাঁর দরজায় উঁকি দেয়। তিনি হাতের ইশারায় কাছে ডাকেন। তখন ছোট চাচার মেজাজ মর্জি ভালো থাকলে, ভারি ভারি বিষয় ধরে কথা বলেন- এই যেমন তাদের এই বিশাল বাড়িটি,জায়গাজমি নাকি তাদের নিজেদের নয়! ১৯৬৪’র এক রাতে দাদা নাকি হুট করে এই বাড়িতে এসে উঠেন! দাদার মৃত্যু নিয়েও ছোটচাচা রহস্যময় কথা বলেন! দাদার অপমৃত্যু রওনককে ভারাক্রান্ত করে যদিও এবিষয় নিয়ে কারো সাথে কথা বলার সুযোগ থাকে না।

 

দখিনের খোলামেলা ঘরটি দু’কামরার। স্কুলঘরের মতো লম্বা বারান্দাটি, ঘরটিকে আঁকশিলতার মতো প্যাঁচিয়ে রেখেছে। মাঝেমধ্যে রওনকের বাবাকে বারান্দায় পায়চারী করতে দেখা যায়। বেশি রাতে ওদিকে তাকালে জুনিপোকার রহস্যময় আলো জ্বলে ওঠে- যার অর্থ বাবার মন ভালো নেই। তিনি অনবরত সিগারেট ফুঁকছেন! দু’কামরার একটিতে বাবা-মা বাকিটা মেজচাচার। বাকি রইল উত্তরভিটের এবাড়ির প্রাচীন ঘরটি। কোনকালে ঘরটি ঘেঁষে একটি আমগাছ ছিল বলে সবাই বলে

আমতলা ঘর। ও-টা সেজচাচার ঘর। বাড়িতে বাড়তি লোক এলে সে ঘরেরতালা খোলা হয়।

বাড়ির শেষ সীমানার সড়কঘেঁষা বাংলাঘরের কপাটটি খট শব্দে খোলে যায়! করিম চাচার বউ আম্বিয়া চাচি খুপা-খসা চুল ঘোমটাতলে ঠেসেঠুসে গুঁজতে গুঁজতে দাদীরঘরে দৌড়ে ছুটেন! চাচীর ওই একটাই স্বভাব! দাদীর হাঁক কানে পড়তে এতটুকু তর সইবে না, হুরমুড়িয়ে দাদীর নিকটে হাজির না হলে যেন মহাভারত জলে ডুবে অশুদ্ধ হবে! তার নাকের ডানপাশটায় রূপোর নাকছাবি চিকচিক করছে, বাঁদিকে ভোমরার মতো কালো একটি তিল! ও-দুটো চিহ্নের কারণেই বোধহয় তার মুখে আউস ধানের পাকাছড়ার মতো সর্বদা হাসি ঝুলে থাকে। মা-চাচিদের ছাপিয়ে দাদীর পরে আম্বিয়া চাচি রওনকদের প্রশ্রয়-আবদারের মোক্ষম স্থান। এবাড়ির ঘর গৃহস্থালীর সমস্তটা দাদীর নির্দেশে আম্বিয়া চাচি-ই চালান।

 

মূল বাড়িঘেঁষা পোড়ো-ভিটেখানা, সেটাও রওনকদের দখলে রয়ে গেছে! শোনা যায়-চৌষট্টির দাঙ্গায় ভুলক্রমে এবাড়ির কর্তা লোকটি নাকি কলিকাতায় কাটা পড়েছিল! পরিবারের বাকি লোক, রাতের আঁধারে সেই যে গৃহ ছেড়েছে আর ফেরেনি! করিম চাচার বেশিরভাগ সময় কাটে সেই পড়ো ভিটেয় গরু-ছাগলের সাথে! গোয়ালঘর, খড়েরপালা,সারি পচা গোবর,গরুর চনার ঝাঝাল দুর্গন্ধ ভরা ভিটেয় ঠেলায় না পড়লে কেউ পা রাখে না কিন্তু রওনকরা সুযোগ পেলে দলবেঁধে আম্বিয়া চাচির পিছু পিছু সে ভিটেয় ছুটে। চাচি প্রায়ই চাচাকে কাজে সাহায্যে করতে এভিটেয় আসেন। ভিটেয় একটা প্রাচীন কুলবরই গাছ আছে। বড্ড উঁচুতে তার ডালপালা ছড়ানো। গাছে ওঠা মুশকিল! একমাত্র করিম চাচা লুঙ্গি কাছারে কাঠবিড়ালির আদলে বেঁয়ে, মগডালে উঠে যেতে পারেন! কিন্তু চাচার মেজাজ সবসময় থাকে জ্বলন্ত মাটিরচুলার মতো উত্তপ্ত। রওনকরা পারতপক্ষে চাচার ধারেকাছে ঘেঁষে না। তবে চাচীর কথা চাচা ওহী বাক্যের মতো শোনেন। চাচী বলতে চাচা একলাফে গাছে চড়ে বসেন। এবং ডাল ধরে ঝাঁকাতে, শিলের মতো কূল বরই দূর্বাঘাসের উঠোন ভরে ওঠে!

 

ওদিকে ওদের দুপুরের খাওয়া শেষ না হতে- ন্যাংড়া স্যার উঠোনে এসে হাঁক ছাড়েন! দুর্ঘটনায় পা গেছে, খুড়িয়ে হাঁটেন। মেজাজ সবসময় বলক-উঠা হাঁড়ির পাতিলের মতো উষ্ণ থাকে! ছোটরা বড়দের কাছ থেকে ন্যাংড়া-স্যার নামে ডাকতে শিখেছে! তিনি পড়ার শুরুতে ধপাস ধপাস বেতের বারিতে পিঠে একপড়স্ত লালদাগ ফেলে তারপর বই খুলতে নির্দেশ দিবেন- এ ধরাবাঁধা নিয়মের ব্যত্যয় ঘটে না কখনো! উঠোনের মধ্যিখানে স্যার বেতের মোড়া পেতে বসেন। রওনকরা আদর্শলিপি, চক স্লেট নিয়ে চারপাশে গোল হয়ে বসে। সমস্বরে গলা ফাটিয়ে ঝুঁকে হেলেদুলে পড়া চলে মুন্সিপাড়ার মসজিদে আছরের আযান পর্যন্ত! এরপর পড়া ধরার পালা! ততদিনে রওনকরা বুঝে গেছে ন্যাংড়া স্যারের মতিগতি- পড়া সঠিক জানা-অজানায় কিছু যায় আসে না, সবার জন্য সমানদরের বেতেরবারি বরাদ্দ! এরপর স্যার দাদীর ঘরে পানের নেশায় ঢুকে পড়েন। এইফাঁকে ওরা পালিয়ে ছুটে বাড়ির পাশের হিজলতলা মাঠে।

 

সন্ধ্যা নামতে দাদীর তালপাতার পাখায় হাওয়ার ঢেউ ওঠে। রওনকরা তক্তপোশের মাঝখানে হারিকেন রেখে গোল হয়ে পড়তে বসে পড়ে। দাদীর কাছাকাছি বসলে বাতাসে ভেসে যাওয়া যায়। অক্ষরহীন দাদী গলা ফাটিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন। সানু’র ঝুমুনি রোগ। বই না খুলতে সারাদিনের ক্লান্তি তাকে দস্তুরমতো নাজেহাল করে তুলে! অবশ্য ওর এই রোগের উছিলায় সবাই পড়া থেকে নিস্তার পায়। ততক্ষণে আম্বিয়া চাচি মাটির বাসনে রাতেরখাবার নিয়ে হাজির হন। খাওয়া শেষে ঘুমের আয়োজন। দাদীর ডানে-বাঁয়ে রওনকরা পালা করে ঘুমায়। নির্ঘুমরোগে-ভোগা দাদীর হাত বিজলিপাখার মতো ঘুরতে থাকে সারারাত!

 

দাদীর ঘরের কপাট ভোরের নীলআলো ফোটার আগেই খোলে যায়! দাদীর নির্ঘুম ব্যামো! রাতে বেশ ক’বার বারান্দার পূবকোণায় দাঁড়িয়ে পরখ করেন, সূর্য উঠতে এত দেরি কেনো! এই ফাঁকে রওনকদের মধ্যে কেউ একজন জেগে উঠে ,বাকীদের ডেকে তুলে! এবং দাদীর চোখ ফাঁকি দিয়ে ছুটে পালায়!  রাতের গায়ে আঁধারের প্রলেপ তখনো রয়ে যায়! বাড়ির সীমানা পেরুতে চোখ আঁটকে পড়ে শতবর্ষী অশথ গাছটিতে। গাছের আগা নড়েচড়ে উঠতে ভয়ে ওদের শরীর কাঁটা দিয়ে যায়! হয়তো দলবেঁধে ভূতেরা দাদীর গল্পের মতো ঝিম মেরে বসে আছে মগডালে! তারপরও আঁধারপথে ভয়আতঙ্কে এ-ওর হাত ধরাধরি করে ছুটে যায় পালপাড়ায়। ওপাড়ার ওদের বয়সী ছেলেমেয়েদের বুকে বেজায় সাহস! শিয়াল-ডাকা রাতে ঘরের বার হতে মোটেও ভয় পায় না! অন্যপাড়ার কেউ তাদের আগে যেন আসতে না পারে। আসলেও, ভূত সেজে ভয় দেখায়! ওরা বলে ভূতেরা গাব গাছে বাসা বেঁধে বাস করে। শুধু ওরা নয়, দাদি কিংবা আম্বিয়া চাচিও একই কথা বলেন! রওনকের বাবার বন্ধু, ধিরেন চাচার বাড়ি ও-পথে। তিনি বহুবার সচক্ষে ভূতের বউকে ফুল কুড়াতে দেখেছেন! জগতে কতো নাম-জাত, রং-বেরঙের ফুল রয়েছে কিন্তু রওনকের প্রিয় ফুল গাবফুল। বাকীদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে হলেও রওনকের কারনে কিংবা অন্ধকারে ধূসর শাদা রঙের ফুলগুলো সহজে খুঁজে পেতে ওরা সবার আগে গাবতলায় যায়। এবং দুষ্ট ছেলেগুলো শাদা কাপড়ে ভূত সেজে গাছের গুঁড়ায় বসে থাকে! ভয়ে ওরা মরণ চিৎকারে পালপাড়া মাথায় তুলে!

 

এতকাল পরেও সে-আতঙ্কে হিম হয়ে আছে রওনকের মনোজগত! সে নিজের অজান্তে ভয়ে চিৎকার করে ওঠে! এবং পরক্ষণে হুঁশ ফেরে, মনে পড়ে মাঝে চলে গেছে প্রায় পঞ্চাশটি বছর! এতক্ষণ পরিষ্কার দেখা দৃশ্যের সাথে সন্মূখে দাঁড়িয়ে থাকা, পোড়ো বাড়িটির একফোঁটা সাদৃশ্য নেই! শানবাঁধানো ঘাট নেই, পুকুরটি ক্ষুদ্র হতে হতে মজা-জলাশয়ে রূপ নিয়েছে! পুকুরের শেষপ্রান্ত ছুঁয়ে বিস্তর খোলা যে মাঠটি ছিল, তারও কোন অস্তিত্ব নেই! বাড়ির মানুষগুলো তো নেই-ই!  নিজেকে কোন মতে সামলে নিয়ে পুকুরপাড় পেরিয়ে উঠোনে এসে দাঁড়ায়। বুনো গাছগাছড়ায় উঠোন দখল হয়ে আছে! উঠোনের চারপাশে থরেথরে সাঁজানো বসতঘরগুলোর কোন চিহ্ন খোঁজে পাওয়া গেল না! একমাত্র দাদীর ঘরটি ন্যুজবুজা, চিতকাত হয়ে রাস্তারধারে বিকলাঙ্গ মানুষটির মতো পড়ে আছে! এবং সেঘরের চৌকাঠ ছুঁয়ে “সবুজ সংঘ ক্লাব” নামে একটি সাইনবোর্ড ঝুলছে!

 

জাকিয়া শিমু, কথাসাহিত্যিক, লণ্ডন প্রবাসী লেখক

লাহোর প্রস্তাব বিকৃতির কারণে একাত্তর অনিবার্য হয়ে ওঠে

হোসাইন আনোয়ার ২৩ মার্চ ১৯৪০। পাকিস্তানিরা ভুলে গেছে ২৩ মার্চের ইতিহাস। একটি ভুল ইতিহাসের উপর ভিত্তি করেই ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবস পালিত হয় সমগ্র পাকিস্তানে।

ইফতার পার্টি নয়, সেদিন যেন তারার হাট বসেছিল পিটস্টপে

রুহু রুহেল সমাজ ও সংস্কৃতির বড় পরিচয় সম্প্রীতির অটুট বন্ধনে সামনের পথে অবিরাম এগিয়ে চলা। সাম্য সুন্দর স্বদেশ গঠনের জন্য প্রয়োজন বিবিধ মত ও পথকে

নভোচারী সুনিতা মহাকাশে ফুল ফোটায় পৃথিবীতে নারীর পায়ে শেকল পরায় কে?

প্রদীপ খাস্তগীর চমৎকার একটি সফল মহাকাশ সফর শেষ হয়েছে গত ১৮ মার্চ মঙ্গলবার দিবাগত রাত ৩টা ৫৭ মিনিটে। গত বছরের ৬ জুন মাত্র ৮ দিনের

দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ: দর্শনের বিজ্ঞান

রাজেশ কান্তি দাশ দর্শনের ক্ষেত্রে বস্তু ও ভাবের দ্বন্দ্ব অতি প্রাচীন। খ্রিষ্টপূর্ব সময়ের। বস্তুবাদী দার্শনিকেরা মনে করেন বস্তু থেকে জাগতিক সব কিছুর উৎপত্তি। গ্রীক দার্শনিক

মানুষ ও মঙ্গল মানব

সরকার হুমায়ুন দুজন মহাকাশচারী- একজন পুরুষ এবং একজন মহিলা মঙ্গল গ্রহ অভিযানে গেলেন। তারা নিরাপদে মঙ্গল গ্রহে অবতরণ করেন। সেখানে তাদেরকে অতিথি হিসেবে মঙ্গলবাসীরা সাদরে