সৈয়দ ইবনুজ্জামান
হস্তির প্রশস্ত শরীরের ন্যায় ঘনায়মান জমাট নিশুতি অধিকার নিতে চাইছে চারপাশটা। ঝোপ ঘিরে সন্নাস নেয়া জোনাকেরা দ্যুতি করা ফুলের পসরা সাজিয়েছে। তবে তা হাসনাহেনার যৌবন সুধাকে ছাপিয়ে যেতে পারছে না। নদীর শান্ত জল বাসরে বধূয়ার অঙুলি স্পর্শের ন্যায় ছুঁয়ে যাচ্ছে নৌকার নিম্নাংশ। নদীর এপারের ছয় গজ দূরের কবরস্থানকে স্থির কুহেলিকা অদৃশ্য করে রেখেছে। গন্তব্যের এত কাছে থেকেও বড্ড দূরত্ব! ফুলের সুবাস নেয়া জীবেরা ভয়ার্ত চড়ূইয়ের মতো নিজেকে লুকোতে চাচ্ছে আপন নিশ্বাসের শব্দ থেকেও।
— বান্দির পুত ! কত বুঝাইলাম তোরে আইজ এইসব না খাইতো!
আধো মেলা চোখ আর রঙিন মেঘে ভাসা শরীরকে সামলাতে চাইলেও শরীর যেন কিছুতেই জামালের বাধ্য হচ্ছে না।
— নেশা খাইলেও হুশ যায় নি আমার। আমি ভবের পাগল গো রইশ্যা কাকা! — এই কুড়িতেই যদি এত নেশা খাস তোয় বাকী জিন্দেগি পার কেমনে করবি ?
হঠাৎ যেন কার পদধ্বনি শুনে তাদের নিশ্বাসের শব্দ ফের আশ্রয় চাইছে নিশ্চল নীরবতায়। এদিকে আবুল মাঝি মাথায় টুপি দিয়ে দু’হাত উর্ধŸাকাশের দিকে উঠিয়ে সে যে টাকার লোভে এ পাপ কাজের সাথে জড়িয়ে পড়েছে তার জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে ক্ষমা ভিজ্ঞা চাইছে।
— কাকা, আওয়াজ নিচু করেন
— চোখের পানি ছাড়া কি মাবুদ আমার ডাক শুনব ?
লোনা ¯্রােতে সাতার কেটে পুরোটা জীবন পার করে দিল আবুল মাঝি। সংসার পেতেছিল শিরিষের তলে। মায়া বেড়েছিল বড্ড! বেশি মায়া ভাল নয়! নিয়তির বুঝি সহ্য হলো না, যুবতি বৌয়ের জন্য বানাতে হলো মাটির কুটির। নিজেই শুইয়ে দিয়েছিল বউকে- মাটির কুঠিরে। কার যেন হাত ধরে নিরুদ্দেশ হয় ডাঙ্গর মেয়ে। অনেক খুঁজেও পাওয়া যায়নি। মেয়ের জন্য কেঁদে কেঁদে নাওয়া খাওয়া সব ভুলেছিল। বাড়ি ঘর বিক্রি করে বিবাগী হয়েছিল। পেটের দায়ে বাড়ি বেচার টাকা দিয়ে নৌকা কিনে। সেটাই এখন তার ঘর। নিদ্রা, খাওয়া দাওয়া সব এই নৌকায়।
মাঘের ঘাড়ে কামড় বসানো মৃদু বাতাস যেন অজানা পাপের প্রতিশোধ নিচ্ছে তাদের ওপর। গলায় প্যাচানো মাফলার খুলে আরো শক্ত করে প্যাচিয়েছে আবুল মাঝি। ঘন কালোয় অতিকায় ক্ষুদ্র স্ফুলিঙ্গ জ্বলছে রইশ্যা দালালের ঠোঁটের ডগায়। ধোঁয়া তার নাক মুখ দিয়ে ইটের ভাটার চিমনির মতো বেরুচ্ছে। ভালোবাসার মানুষ কত্ত কাছে!
মহুয়ার সুরায় মাতাল হত মধুকরেরা। উল ফুটাতো যৌবনা ডালিমে। কুকড়িয়েও রেহাই পেত না অর্থ উসুলের আগ অব্দি। ভদ্র সমাজে স্থান না হলেও ভদ্র জনেরাই আসত তার মাংসের টানে। মনের আকুতি নিয়ে চেয়েছিল রশিয়ার সাথে এক ঘরে চাল ডালের মাসিক বাজারের হিসাব কষতে, চেয়ে থাকতে দুরের সোনা ধানের মাঠে, রশিয়ার পথ চেয়ে ! রইশ্যাকে সে ভালোবেসে রশিয়া ডাকত।
মহুয়ার সাথে মাটির বৈরিতা নেই। বৈরিতা ভদ্রজনদের। ভদ্র মানুষেরাই তার কাছে যেত নরকের ভয় উপেক্ষা করে। ভদ্রজনেরা পাহারা বসিয়েছে কবরস্থানে কোন বেশ্যার জায়গা হবে না। যার হাত ছেড়ে ঘর ছেড়েছিল সেই তাকে বেচেছিলো এই নরকে । কখনো ভাবত পালিয়ে বাড়িতে চলে যাবে। যে কালো ভদ্রজনেরা তার কপালে এঁকেছে গভীর রাতে। আলো ফুটলেই তারা থুতু দেবে। বাপ যদি শেষে গলায় দড়ি দেয়। জীবনের প্রতি অভিযোগ ভুলে চাদরে মুখ ঢাকা মহুয়া যেন বহুদিন পড়ে মুক্তি পেল ! এভাবেই বিদায় নেয় মহুয়ারা। অনেককে রশিয়া নিথর দেহের সাথে বড় পাথর বেঁধে ফেলে এসেছে নদীর মাঝে। ভদ্রজনেরা নষ্ট হলেও সমাজকে তো তারা আর নষ্ট হতে দেবে না। নদী মরলে ভদ্র জনেরা শোক সভা করে, মহুয়ারা মরলে তার নতুন মহুয়া খুঁজে। রশিয়াকে মহুয়া প্রায় বলত- কথা দাও! আমি মরলে জানাযা পড়াইয়া কবরে শোয়াইবা। রশিয়াকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিত সে। রশিয়ার চোখ এখন ছলছল। ঝোপের জোনাকেরা ঘিরে ধরেছে মহুয়াকে। তারা কি জানে না মহুয়া এখন অন্ধকারে ? কেন তবে এত আলো! আহা ! পাতার মর্মর শব্দে মগজের ভেতর ফের ভয় জাগে। মানুষ হয়ে মানুষকে! জোনাকদের কি ভয় নেই পাপের ? মানুষের ? পূর্ণিমার আলোয় নদীর আলতো জলে ভেসে ওঠে তাদের প্রতিচ্ছবি। তারা আরো সতর্ক! আবুল মাঝি কৌতূহলে লাশের মুখের চাদর সরায়। মৃদু কম্পিত ঠোঁটের ভাষা দিতে চোখের পাপড়িতে ভিড় জমিয়েছে নোনা শিশির। সমস্ত আবেগ জমা পড়েছে এই হিম মুখে। মমতার বিন্দু বিন্দু জল মহুয়ার মুখে পড়ে। মহুয়া জাগে না! এই মুখে পাপ কিসের ? সন্তানের চেয়ে বড় ? মানুষের চেয়েও বড় ?
– মুর্দারে তোল ! ডর কিসের ? আমি পরামু জানাজা, মাটির শায়রে আমি শোয়ামু। – কে ? কে কথা কয় ?
আট ব্যাটারির টর্চের আলো এসে পড়ে লাশবাহী নৌকার ওপর।
দূর হতে থেমে থেমে আসছে শেয়ালের ডাক ওউও-ওউও-ওউও। সুবাস ছড়ানো হাসনাহেনা কি জানে কোন পৃথিবীতে তার বাস ?
সৈয়দ ইবনুজ্জামান, কলামিস্ট ও সম্পাদক, ইদানীং লিটলম্যাগ